রাঙাবউ পর্ব -০৬

0
912

#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০৬

উষ্ণ বাতাবরণ। মুনীফের গলার কাছটা ভিজে উঠেছে ঘামে। এই ছোট্ট ঘরে এতগুলো লোকের সম্মিলন, বায়ুর তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে যেন। মাথার উপর ঘটরঘটর শব্দে ঘুরতে থাকা ফ্যানও পেরে উঠছে না সেই তাপমাত্রার সঙ্গে। মুনীফ একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। আজকে তার জন্য বিয়ের পাত্রী দেখতে আসা হয়েছে। সঙ্গে আসতে চায়নি, তবুও জোর করে তাকে এনেছেন শেফালি বেগম। তার আনন্দে সর্বোচ্চে। মেয়েকে ইতিমধ্যেই দেখা হয়েছে। রূপে গুণে একটু বেশিই সুন্দর! মুনীফ একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। সবার মাঝে বসে বারবার তাকানোটা ঠিক কতটুকু সমীচীন! আর একটি মেয়ের দিকে বারবার তাকানোর স্বভাবটাও তার নেই। একটি কথা শোনামাত্র মুনীফ নড়েচড়ে বসল। মেয়ের বাবা বলেছেন,

-ওদের দু’জনকে আলাদাভাবে কথা বলতে দেওয়া উচিত না?

উপস্থিত সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ করল। শেফালি বেগমের দিকে কিছুটা রাগ নিয়েই তাকাল মুনীফ। শেফালি বেগম সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চোখের ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। অগত্যা মুনীফকে উঠতে হলো। যেতে যেতে ঠিক করল, মেয়েটির সাথে পূর্বের বিয়ের ব্যাপারটাও শেয়ার করে নেবে। একবার বিয়ে করে যে শিক্ষা হয়েছে,আর এরকম কিছুর সম্মুখীন হতে চায় না সে।

-এই যে,এদিকে,এদিকে আসুন।

নারী কণ্ঠটি মুনীফকে চমকে তুললো। কী রিনরিনে কণ্ঠস্বর! বাহ..মুনীফ চমৎকৃত হলো। কে বলেছে দেখার জন্য বামে তাকাতেই বর্ষাকে দেখতে পেল। এই এর সঙ্গেই তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। বর্ষা তাকে দেখে একটু হাসল, তারপর ফুড়ুৎ করে একটা রুমের ভেতর ঢুকে গেল। মুনীফ বুঝলো,তাকেও সেই রুমের ভেতর আহ্বান করা হয়েছে।

কক্ষটি সুন্দর করে সাজানো। বড় জানালার পাশ ঘেঁষে বিছানা সাজিয়েছে বর্ষা। বেডের উপরে একের পর এক মানিপ্লান্টের টব। একটা প্রাকৃতিক ভাব আছে। সুন্দর লাগে। মুনীফ সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই বর্ষাকে চোখে পড়ল। বিছানার এক পাশে চুপ করে বসেছে। মুনীফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। মুনীফ নির্ভয়ে এগিয়ে গেল। এতক্ষণ গায়ে কাঁটা দেওয়া একটা ভাব লাগছিল,সেটা এইমুহূর্তে মিলিয়ে গেছে। মেয়েটা মিশুক বোধহয়।

মুনীফই প্রথম প্রশ্ন করল,

-কেমন আছেন?

-আলহামদুলিল্লাহ,ভালো। আপনি ভালো?

মুনীফ দু’দিকে ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। তারপর বলল,

-আমার ব্যাপারে কতটুকু জানেন?

-উমম.. আপনি একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসা নিয়ে থাকতেই পছন্দ করেন বেশি। বাসায় খুব একটা সময় দিতে পারেন না। আপনার স্বভাব ভালো। নম্র ভদ্র টাইপের লোক এবং আপনি আপনার পরিবারকে খুব ভালোবাসেন।

মুনীফ মৃদু হেসে বলল,

-ব্যস,এইটুকুই?

বর্ষা বিদ্রুপের সুরে জবাব দেয়,

-এরচেয়ে বেশি কিছু জানার কথা কী আমার? আমি তো আপনার প্রেমিকা নই।

মুনীফ নড়েচড়ে বসল। বর্ষা ঠোঁট টিপে হাসছে। মুনীফ বুঝল, এই মেয়ে মিশুকের পাশাপাশি বেশ চঞ্চল ও বটে! তবে খারাপ লাগলো না মুনীফের। জীবনকে উপভোগ করতে হলে একটু চঞ্চল হতেই হয়। যেখানে সে এত গম্ভীর! তখন তো বর্ষাকে একটু প্রাণোচ্ছল হতেই হয়!

মুনীফ বলল,

-তা ঠিক,তবে একটা বিষয় আছে,যেটা আপনাকে না জানালে ঠকানো হয়ে যাবে।

-ঠিক আছে,তাহলে বলুন। কেউ আমাকে ঠকাক,এটা তো চাইবো না।

-হুম, আসলে আমি বিবাহিত। মানে বিবাহিত ছিলাম। যদিও এখনো ডিভোর্স হয়নি তবে সব বন্দোবস্ত করে ফেলা হয়েছে।

বর্ষাকে খুব একটা বিচলিত দেখা গেল না খবরটা শুনে। সে পূর্বের ন্যায় চঞ্চল কণ্ঠে শুধালো,

-তাই নাকি? ইশশিরে, আপনার মত লোকের কপালে ডিভোর্সি ট্যাগ টা লেগে আছে! জাস্ট ভাবতেই পারছি না। এত ভালো মানুষ আপনি..! আচ্ছা,কীভাবে কী হলো? বলা যাবে?

-কেন নয়!আমার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, মেয়েটার নাম মিঠি। একদম পারিবারিক বিয়ে। বিয়ের আগে এভাবে আলাদা করেও কথা বলা হয়নি মেয়েটার সাথে। এটাই ভুল ছিল। মেয়েটার অন্যত্র সম্পর্ক ছিল। যেটা সে কাউকে বোঝাতে পারেনি। ফলে আমাদের বিয়ের দিন ভোর রাতের বেলায়-ই মেয়েটা পালিয়ে গেছে।

-বলেন কী!

এইবার বর্ষাকে খানিকটা চিন্তিত দেখালো। সে ব্যথিত কণ্ঠে বলল,

-তারপর? ওই মেয়ে কী আর ফিরে আসেনি? ওর প্রেমিকের সাথে বিয়ে করে নিয়েছে?

মুনীফ চুপ করে রইলো। মিঠির ব্যাপারে আর কোনোকিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু বলল,

-ও ফিরে এসেছিল, আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। আমি করিনি। করার প্রয়োজনবোধও করিনি। তবে ওর পরিবারকে সবটা জানিয়ে সেখানে তালাকের ব্যবস্থা করে এসেছি। এরকম একটা সম্পর্ক কাঁধে বয়ে বেড়ানোর মানে হয় কোনো?

বর্ষা দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বলল,
-না,মানে হয় না। কিন্তু একবার দেখা করা উচিত ছিল। হতে পারে সে আপনার কাছে ক্ষমা চাইতো।

-ক্ষমা চাওয়ার জন্যেই দেখা করতে বলেছিল আমি জানি,কিন্তু আমার মন দ্বিতীয়বার ওকে ফেস করার জন্য টানেনি। মনের উপর তো কোনো জোর নেই বলো..

মুনীফ অজান্তেই ‘তুমি’ সম্বোধন করে বসল বর্ষাকে। বর্ষার ভালো লাগলো। এই লোকটার প্রথম বিয়ের স্মৃতি ভয়াবহ বলাই যায়! তাই তার দ্বিতীয় বিয়ের স্মৃতিটাকে এমন সুন্দর করবে, যেন পূর্বের সব দুঃখ,কষ্ট ভুলে যায়। সাংসারিক জীবন অথবা ব্যক্তিগত -সব দিক দিয়েই মুনীফকে খুশি করার চেষ্টা করবে বর্ষা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে। মুনীফ জবাবের আশায় চেয়ে আছে দেখে নিজের ভাবনার গতিপথ খুব একটা দীর্ঘ করল না বর্ষা। বিজ্ঞের ন্যায় মাথা দুলিয়ে বলল,

-হুম! আচ্ছা,এসব কথা বাদ দিন। আপনার ব্যাপারে সবকিছু জানলাম, এবার আমার ব্যাপারে জানবেন না আপনি?

-তোমারও যদি কোনো প্রেমিক ট্রেমিক থাকে,আগেই বলে দাও। পরবর্তীতে ওই ধরনের কর্মকান্ড আর ফেস করতে চাই না বাবা…

মুনীফ হেসে ওঠে। সেই হাসিতেই মুগ্ধ হয়ে যায় বর্ষা। ফাঁকা ঢোক গিলে মিনমিন করে বলল,

-প্রেমিক ছিল না তবে এইমুহূর্তে হয়ে গেল।

মুনীফ শুনে ফেলল। ভ্রুবিলাস করে বলল,

-মানে! এইমুহূর্তে হয়ে গেল মানে কী?

বর্ষা চপল পায়ে উঠে দাঁড়াল, বলল,

-মানে আপনাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আপনি আজ থেকে আমার প্রেমিক… এইতো..

বলেই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রেখে গেল অট্টহাসিতে মাতোয়ারা মুনীফের মুখখানা। বর্ষার পাগলামি মুনীফকে মুগ্ধ করেছে। এই মেয়েটিকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়াই যায়!

____

-এই যে, এই মেয়ে..দাঁড়ান বলছি..!

পেছন থেকে ওড়নায় টান পড়ল। সিথির দম বন্ধ হবার জোগাড়। তার মন বলছে, একজন পুরুষ তার ওড়না টেনে ধরেছে। এটা কেমনতর অসভ্যতামি! সিথি মনে সাহস সঞ্চয় করে পেছন ফিরতেই চমকে গেল। কোনো পুরুষ নয়, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ওড়না পেঁচিয়েছে। তাই দেখে বাদল উঁচু কণ্ঠে থামতে বলেছে তাকে। নইলে গলায় টান পড়ে নির্ঘাত ব্যথা পেতো মেয়েটা। সিথি বাদলের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো। বাদল ততক্ষণে এগিয়ে এসে গ্রিল থেকে ওড়নার প্যাঁচ খুলে দিলো। সিথির দিকে তাকিয়ে বলল,

-সাবধানে দেখে শুনে চলেন। এখনই একটা অঘটন ঘটে যেতো।

সিথি কোনোরকমে বলল,

-থ্যাংকস!

সিথির গলা কাঁপছে। কপালে ভীড় করেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটা। হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে। এই আচমকা পরিবর্তনের কারণ সামনে দাঁড়ানো আগন্তুক। এত সুন্দর ছেলে সিথি এর আগে দেখেনি। অথবা দেখেছে কিন্তু এরকম প্রবল আকর্ষণবোধ করেনি। এই ছেলের মধ্যে অন্যরকম কিছু একটা আছে যা সিথিকে উত্তেজিত করে তুলেছে। সেই অন্যরকম কিছুটা বোঝা গেল বাদলের মৃদু হাসিতে। তার গেঁজ দাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে তখনই। সিথির মনে হচ্ছে,কেউ তাকে খুন করে ফেলেছে। তার কান দিয়ে দমদমিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে৷ এইমুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে সে। চারপাশের পৃথিবী কী খুব জোরে কাঁপছে?
সিথিকে টলতে দেখে বাদল ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তার অন্তঃকরণে কিছু দুশ্চিন্তার বীজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

-এই মেয়ে,আপনি ঠিক আছেন? হ্যালো মিস.. আরে আজব তো!

সিথি পড়ে গেল। জমিনে পড়বার আগেই দু’হাতের আঁজলায় নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ধরলো বাদল। সিথিকে ধরেই আশেপাশে তাকাল আগে। ভাগ্যিস কেউ নেই! নইলে কী মনে করত কে জানে! কিন্তু এই মেয়েটি কে? আজকে তার ছোট বোন কে দেখতে আসার কথা। তবে কী পাত্রপক্ষীয় কেউ? বাদলের কপালের রগ ফুলে উঠল ক্রোধে৷ বাড়ি ফিরতেই এরকম একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে, কে জানত তা!

আরও একবার আশেপাশে নজর ঘুরালো বাদল। কেউ নেই! কেন কেউ নেই? কেউ থাকলে ভালোই হতো। দু’জন মিলে ধরে নেওয়া যেতো ভেতরে। একা এই অজ্ঞান মেয়েকে নিয়ে কী করবে এখন! মেজাজ তুঙ্গে উঠছে বাদলের। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল সে। জ্ঞান হারা সিথির মুখপানে চাইলো। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। খুবই শান্তির ঘুম.. তার ঘন ঘন নেওয়া নিঃশ্বাস বাদলের চোখজোড়া আকৃষ্ট করে। নিজের অজান্তেই সিথির বক্ষ যুগলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাদল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। পুনরায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। খ্যাঁক করে গলা ঝেড়ে ডেকে উঠল,

-এই মেয়ে.. এই যে শুনছেন?

সিথির হেলদোল নেই। মিনিট দুয়েক সিথিকে বারবার জাগানোর চেষ্টা করেও সফল হলো না বাদল। শেষমেশ উপায় না পেয়ে সিথিকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়ালো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে