রাঙাবউ পর্ব -০৫

0
975

#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০৫

শেষমেশ সজলই সাহায্যটা করেছিল। বাদল বাসায় যাওয়ার কিছু সময় পর সে পুনরায় এসে মিঠিকে খালপাড় থেকে নিয়ে আসে। এরপর তুলে দেয় বাসে। বাকীটা পথ মিঠি একাই এসেছিল। মামা-মামীর বাড়িতে কোনোভাবেই যেতে পারবে না। ওখানে যেতেও চায় না। মামা-মামীকে বাড়তি আর কোনো ঝামেলায় ফেলার ইচ্ছে নেই তার,সেই জন্যে খুব ছোট বেলার বান্ধবী প্রভার কাছেই এসেছে মিঠি। মিঠির বিশ্বাস, প্রভার মা তাকে ফেলবে না। আর সে-ও তার ঘাড়ে চেপে বসবে না। খুব দ্রুতই একটা কাজের ব্যবস্থা করে ফেলবে।

সব শুনে পলি সত্যি সত্যি মিঠিকে ফেলতে পারেনি। তাকে আশ্রয় দিয়েছে সত্যি, তবে তা অনেকটাই প্রভার চাপাচাপিতে পড়ে। পরবর্তীতে কী হবে তা নিয়ে যদিও পলির মনে অনেক সংশয়, কিন্তু তাই বলে একটা মেয়েকে রাতের আঁধারে ফেলে দেওয়ার মতো এত ছোট মন-ও তার নয়। কিছু না খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মিঠি। শুতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। সারাদিন কম ধকল যায়নি তার উপর দিয়ে! শত বিপদের পড়েও একটা স্বস্তি, নিজেকে অন্তত রক্ষা করতে পেরেছে! সজলের প্রতি তার যে রাগ, অভিমান ছিল- তা অনেকাংশেই কমে গিয়েছে। সজল যদি সাহায্য না করত, তবে মিঠির বেঁচে ফিরাটা খুব কঠিন হয়ে যেত। অজ্ঞান না হয়েও শ্বাস আঁটকে ধরে মৃতের অভিনয় করাটা সজল প্রথমেই বুঝে গিয়েছিল, কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি। ভাগ্য এরকম ভাবেও বদলে যেতে পারে,তা বোধকরি মিঠিকে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না!

দিন গড়াতে লাগল পূর্বের নিয়মেই। প্রভাদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার বেশ কিছুদিন পরের কথা-
একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে মিঠি শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত হয়েছে। এই চাকরির পেছনে পলির হাত রয়েছে। সেই বুঝিয়ে বলে, মিনতি করে মিঠিকে চাকরিটি করবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাশাপাশি প্রভার জন্য আসা টিউশনিটিও মিঠি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এছাড়াও সে আরও টিউশনি খুঁজছে। মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট টাকা পলির হাতে তুলে দিতে পারলে শান্তি পাবে সে। প্রভারাই খুব কষ্টে দিন কাটায়, সেখানে নিজেকে বোঝা বানানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার।

রবিবার, ভ্যাপসা গরমে মুখরিত চারিপাশ, গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। কেমন থম ধরে রয়েছে পরিবেশ। ঝড় অথবা বৃষ্টি আসতে পারে। স্কুল থেকে ফিরে ফ্যান চালিয়ে বিছানার উপর আরাম করে বসল মিঠি। মাথা থেকে ওড়না খুলে নিয়ে পিঠময় চুল ছেড়ে দিলো। ঘামে চুলের ভেতরের অনেক জায়গায়ও ভিজে গিয়েছে। হাত দিয়ে চুল ঝেড়ে ভেতরে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাতাস প্রবেশের পথ করে দিতে লাগল সে। ঘরে পলি নেই, প্রভা আছে। পলি সকালে রান্না করে যায়, রাতে আসে। প্রভা যখন ভার্সিটিতে যায়, দরজায় তালা দিয়ে যায়। এখন একটা চাবি মিঠির কাছেও রয়েছে। একটা স্টিলের মগে লেবুর শরবত নিয়ে এলো প্রভা। মিঠিকে বলল,

-এটা খা..

মিঠি এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাস শেষ করল।

-ধন্যবাদ রে।

-মা বাইরে থেকে এলে আমি মায়ের জন্যেও বানাই।

মিঠিকে হঠাৎই অন্যমনস্ক দেখালো। স্কুল কেমন চলছে তা জিজ্ঞেস করলে মিঠি ছোট উত্তরেই কথা সাড়লো। প্রভা উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করে,

-কী হইছে মিঠি? কী ভাবছিস? সব ঠিক আছে তো?

মিঠি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাকাল, করুণ কণ্ঠে বলল,

-মামা-মামীর কথা খুব মনে পড়ে রে। উনারা আমার জন্য যথেষ্ট করেছে। কতদিন উনাদের দেখি না! জানিস,উনারা কখনো বুঝতে দেয় নাই যে আমি তাদের সন্তান না। সবসময় আমাকে ভালোবাসা দিছে। সজল যে খারাপ ছেলে সেটা তারা বুঝতে পেরেই আমাকে ভালো মানুষের সাথে বিয়ে দিছিলো। অথচ আমি করলাম? নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম। ওই মানুষটাও আমাকে ঘৃণা করে বোধহয় এখন৷ উনার সম্মানের কথা আমি চিন্তা না করেই চলে এলাম! নিজের প্রতি খুবই রাগ লাগে যখন এসব ভাবি..!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিঠি। প্রভা বলল,

-তুই একবার উনার সাথে দেখা কর। দেখা করে মাফ চা অন্তত! উনার সাথে যা করেছিস,আসলেই খারাপ করেছিস। আর এইজন্যেই বোধহয় এরকম একটা ঘটনা ঘটলো তোর সাথে। যাইহোক, এখন একবার দেখা কর। ক্ষমা চা। ক্ষমা করলেও করতে পারেন।

-করবে না,উনি কোনোদিনই আমাকে ক্ষমা করবে না।

-কেন করবে না? তুই না বলিস,উনি খুব ভালো মানুষ? তাহলে কেন ক্ষমা করবে না? তুই আগে কথা বলেই দেখ না। মানুষের ভাগ্য কখন কোনদিকে মোড় নেয়,তা কেউ কী বলতে পারে আগে থেকেই?

মিঠি চুপ করে কিছু সময় ভাবল। ভেবে বলল,

-কিন্তু উনার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করব আমি? উনার ফোন নাম্বার নাই আমার কাছে। চেনার মধ্যে উনার বাসাটা চিনে চিনে যেতে পারব। কিন্তু ওখানে এই মুহূর্তে আমি যেতে চাই না। উনার পরিবারের সামনে আমি কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব? আর কীইবা জবাব দেব? উনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার মতো কোনো উপায় নেই।

পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিঠি। প্রভা হুট করে বলে উঠল,

-তুই না আমাকে কিছুদিন আগে বলছিলি,উনার ব্যবসা আছে। উনার দোকানের কথা তুই জানিস। সেই দোকান কোথায়? সেখানে চলে যা সরাসরি, তাহলে আলাদাভাবে দেখা হয়ে যাবে।

প্রভার কথা মিঠির মনে ধরল। বিয়ের পরই মুনীফ নিজে থেকে নিজের ব্যবসা,নিজের দোকানের কথা বলেছিল মিঠিকে। প্রতিদিন দুপুরের সময়টায় সে দোকানে থাকে, তখন ভীড় কম থাকে বলে সে বিভিন্ন হিসেব টিসেব করে গিয়ে,এসব কিছুই বলেছিল সে। তাহলে তা-ই করা যাক। আর দোকানটাও খুব দূরে নয়। দুই এলাকা পড়েই…চাইলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু মিঠির ভয় হচ্ছে খুব। এতবড় একটা কান্ড ঘটানোর পর মুনীফের সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে সে! তা কিছুতেই মাথায় আসছে না। মুনীফ যদি তার সাথে কোনোপ্রকার বাজে ব্যবহার করে বসে, তবে যে তার ‘ভালো মানুষ’ ট্যাগ উঠে যাবে মিঠির চোখ থেকে। তারচেয়ে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু! ক্ষমা না চাওয়াটাও কী ঠিক হবে? রুহের হায় বলে একটি কথা আছে। মুনীফের দীর্ঘশ্বাস যদি মিঠির কপালে পড়ে, তবে কী আর কোনোদিন সুখী হতে পারবে মিঠি? সাতপাঁচ ভাবনায় মিঠির নিঃশ্বাস বেড়ে গেল। একবার ভাবছে সে যাবে,আরেকবার ভাবছে যাবে না। যাওয়ার প্রশ্নই আসে না.. তার অত সাহস নেই। তার চেয়ে বরং প্রভাকে পাঠানো যাক…?
আচমকা এই কথাটি মাথায় আসতেই মিঠির সব দুশ্চিন্তা নেমে গেল। সে ইনিয়েবিনিয়ে কথাটি প্রভাকে বলতেই প্রভা তিন লাফে দূরে সরে বলল,

-আমি পারব না বাবা, পরে তোর রাগ আমার উপরে ঝাড়বে।

-প্লিজ দোস্ত, আমার জন্য এইটুকু কর। এটাই শেষ উপকার নিচ্ছি তোর থেকে। আর কখনো কিছু চাবো না। তুই শুধু তাকে গিয়ে বলবি, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। সে যদি ইচ্ছুক হয় তবে কখন কোথায় দেখা করব, তা জেনে চলে আসবি। ব্যস এইটুকুই… প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ!

প্রভা রাজী হলো না। শেষ পর্যন্ত প্রভাকে রাজী করানোর জন্য তার পায়ের উপর পড়ে গেল মিঠি। উপায়ন্তর না পেয়ে প্রভা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আচ্ছা যাব!

____

‘মা ভ্যারাইটিজ স্টোর’ দোকানের নাম। সবুজ নেইম প্লেটে বড় অক্ষরে লেখা। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক ফাঁকা ঢোক গিলছে প্রভা। তার পা জমে গেছে। দোকানের ভেতর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তবে কী আসেনি মুনীফ ভাইয়া? অবশ্য তাকে দেখেওনি প্রভা। মুনীফ ভাই দেখতে কেমন হবে, কে জানে! কিন্তু তার চেহারায় একটা সরলতা, পবিত্রতা থাকবে নিশ্চয়ই। ভালো মানুষদের চেহারায় তো তাই থাকে! নিজের দোনোমোনো চিন্তাটাকে সামলে প্রভা একটু আগালো। দোকানের মুখোমুখি যেতেই দেখল, সাদা পাঞ্জাবি পরে কেউ একজন বসে রয়েছেন। প্রভাকে দেখামাত্রই সে উঠে দাঁড়াল। পুরুষালি ভরাট স্বরে বলল,

-কী চাও আপু?

প্রভা বলল,

-আপনাকে।

মুনীফের দুই ভ্রু কুঁচকে এলো। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আগন্তুক মেয়েটির দিকে তাকাতেই প্রভা নিজেকে সামলে পুনরায় বলল,

-ইয়ে মানে,আমি মুনীফ ভাইয়াকে খুঁজছিলাম। উনার সাথে আমার একটু কথা আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

-আমিই মুনীফ।

ফের নিজের পুরুষালি কণ্ঠটি নাড়ায় মুনীফ। প্রভাকে ইতস্তত করতে দেখে সে বলল,

-যা বলার নির্ভয়ে বলো আপু। ভয়ের কিছু নেই এখানে।

স্বস্তি মিলে প্রভার। মিঠিটা ঠিকই বলেছে,লোকটি ভালো। এরকম একজনকে ছেড়ে ওই বখাটের কাছে কোন দুঃখে যে গিয়েছিল মিঠি, কে জানে!

প্রভা বলল,

-ভাইয়া, আপনি মিঠিকে চিনেন?

-কোন মিঠি?

তাৎক্ষণিক ভাবে ধরতে না পেরে কথার উত্তরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মুনীফ। প্রভা এবার বিস্তারিত বলতেই,মুনীফের শান্ত স্বভাবটা বদলে গেল চোখের পলকে। চোয়াল শক্ত করে সে বলল,

-তুমি তার কে হও?

প্রভা একটু কেঁপে ওঠে। কথাটায় কেমন যেন,ধমকের আভাস!

-আমি ওর বান্ধবী ভাইয়া।

-তো আমার কাছে কেন এসেছো? আমি জানি না সে কই। বিয়ের পরদিনই সে পালিয়ে গেছে। পরদিন বললে ভুল হবে, ভোর রাত্রেই সে পালিয়েছে।

-আমি জানি সে কই আছে ভাইয়া। সে আমাদের বাসায় আছে।

-তোমাদের বাসায় মানে? সে পালিয়ে তোমাদের বাড়িতে গেছে?

মুনীফকে অবাক মনে হলো এই পর্যায়ে। প্রভা বলল,

-না, তা না…

-তাহলে কী? দেখো,ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে, যা বলতে এসেছো সরাসরি বলো। আমার আরও কাস্টমার আসবে।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিঠির ব্যাপারে সবকিছু বিস্তারিত ভাবে খুলে বলল প্রভা। সব শুনে মুনীফের চোখেমুখে একটা হতবিহ্বল ভাব ফুঁটে উঠল। মেয়েটার সাথে এরকম কিছু ঘটতে পারে- তা সে কল্পনাও করেনি!শেষে প্রভা বলল,

-ও আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে ভাইয়া। ওর সাহস হচ্ছিল না, তাই আমাকে আগে পাঠাইছে। আপনি যদি বলেন,তাহলে আমি গিয়ে ওকে বলব আসতে?

-কোনো দরকার নেই। তাকে বলে দিও, আমি তার সাথে দেখা করতে চাই না। সে বিয়ের আগে আমাকে সব খুলে বলত যদি,তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু যা করেছে.. দুঃখীত আমি এসব মেনে নিতে আগ্রহী নই। তাই তার সাথে কোনোপ্রকার সম্পর্কও আমার রাখার ইচ্ছা নাই। উপরন্তু সে এসে ভালো করছে। এবার তালাকটা করতে সুবিধা হবে।

প্রভা বিস্ময় নিয়ে বলল,

-এসব আপনি কী বলছেন ভাইয়া! ও ভুল করছে মানলাম, তাই বলে…

-দেখো,তুমি এখনো অনেক ছোট। যেদিন বড় হবে সেদিন বুঝতে পারবে আমার এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটি। অবশ্য না বুঝলেও আমার আসে যায় না। তুমি তাকে এই কথাটা বলে দিও কেমন? এবার আসতে পারো।

ব্যথিত মন নিয়ে প্রভা চলে এলো। আসার পথের পুরোটা রাস্তা সে ভাবল, মিঠিকে এই খবর দিলে আবারও কোনো পাগলামি করে বসবে না তো?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে