#রাঙাবউ
অলিন্দ্রিয়া রুহি
পর্ব-০১
বিয়ের পরদিনই নতুন বউ পালিয়েছে। ব্যাপারটা মুনীফ বুঝতে পারল সকাল নয়টার দিকে। চোখ মেলে নিজেকে একাই আবিষ্কার করল বিছানায়। তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আশেপাশে নেই। মুনীফ ভাবল,হয়তো বাথরুমে। ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে সে ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসল। গতকাল রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় তিনটা বেজে গিয়েছিল। মাথাটা এখনো ভার হয়ে আছে। কোনোভাবেই চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। মুনীফ পুনরায় শুয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে লাগলো। প্রায় অনেকক্ষণ পর দরজায় করাঘাত পড়ে। সেই শব্দে মুনীফ জেগে উঠে খানিকটা চমকে যায়। মিঠি কই? তবে কী এখনো বাথরুমে মেয়েটি? এতক্ষণ ধরে কী করছে বাথরুমে? ঘোলা চোখে মুনীফ সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে উঠে গিয়ে দরজাটা খোলে। তার ছোটবোন সিথি এসেছে। সিথি দুষ্টু গলায় বলল,
-দশটা বাজতে চলল ভাইয়া। তোমার বা ভাবীর কারো দেখা নেই। বাহিরে লোকজন ফিসফিস করছে আর হাসছে। দেখি সরো, আমি ভাবীকে উঠাই।
বলে সিথি ঘরের ভেতর ঢোকে। বিছানা খালি দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে মুনীফের দিকে তাকাতেই মুনীফ বলে উঠল,
-বাথরুমে দেখ..
সিথি দেখল, কোথাও কেউ নেই। মুনীফের টনক নড়ল এইবার। হন্তদন্ত পায়ে সে সারা বাড়ি খুঁজতে লাগল। ভাইয়ের দিকবিদিকশুন্য অবস্থা দেখে সিথির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। একঝাক দুশ্চিন্তা ও অশুভ ভাবনা মস্তিষ্কে ভীড় জমায়। প্রায় দশ মিনিট পর মুনীফ বুঝতে পারে, তার বউ বাড়িতে নেই। এমনকি আশেপাশে কোথাও নেই। হতাশা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চিত্ত নিয়ে বিছানায় এসে বসতেই বালিশের উপর এক টুকরো কাগজ ভাঁজকৃত অবস্থায় দেখতে পেল। চিলের ন্যায় ছোঁ মেরে কাগজটি তুলে নিলো সে এবং পড়তে শুরু করল সাথে সাথেই। কাগজে লেখা,
আমার অন্য জায়গায় সম্পর্ক আছে। আমার পক্ষে এই বিয়ে বা আপনাকে- কোনোকিছুই মেনে নিয়ে জীবন যাপন করা সম্ভব না। তাই রাতের আঁধারেই চলে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন,প্লিজ! আর শুনুন, আপনি ভীষণ ভালো মানুষ। আপনার জীবনে খুব ভালো কেউ আসুক,এই দোয়ায়…
মুনীফ স্তব্ধ হয়ে গেল। সে হাসবে নাকী কাঁদবে, নাকী রাগ দেখাবে- কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। কাগজখানা সিথির উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে ধরল। সিথি গিয়ে পুরো বাড়িতে জানিয়ে এলো বউ পালানোর ঘটনা। কথাখানা শোনার পর মুনীফের মতোই বাকী সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলো, শুধুমাত্র শেফালী বেগম হৈচৈ লাগিয়ে দিলেন। তাদের বাধ্য থাকবে এই ভেবে গরীব ঘর থেকে বাবা-মা হীন মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন এ-বাড়িতে। কিন্তু এরকম একটি কান্ড ঘটাবে তা কে জানত! মিঠির মৃত বাবা-মা’কে তুলে বেশ কয়েকটি গালি দিয়ে তবে থামলেন তিনি। বিপদ দ্রুতই কাঁধ থেকে নেমেছে- এই বলে আল্লাহর শোকর আদায়ও করলেন। পুরো ঘটনাটায় মুনীফ শান্ত রইলো। উজাড় শেষে ভাটা নামলে নদী যেমন শান্ত হয়ে যায়, ঠিক তেমন। তবে একটি কারণ তার কাছে স্পষ্ট হলো। বিয়ের পর থেকেই মিঠির এত কান্না,আহাজারি কেন ছিল,সেটা এবার বেশ স্পষ্ট ভাবেই সে বুঝতে পারল। দিন শেষে রাত নামলো, তবে মেয়েটি আর ফিরে এলো না। মুনীফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের জীবন নিয়েই এগিয়ে যেতে শুরু করল…
____
কাচা রাস্তার মোড়ে মিঠিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সজল চমকে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সে ছুটে এলো মিঠির দিকে। এতগুলো দিন পর সজলকে চোখের সামনে পেয়ে নিজেকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারল না মিঠি। সে ডুকরে কেঁদে উঠল। সজলের বুকের মাঝে নিজের স্থান করে নিতে চাইলে সজল বাঁধা প্রদান করে। মিঠির এক বাহু টেনে ধরে চাপা গলায় ধমকের সুরে বলল,
-তুমি এখানে!
মিঠি ভেজা স্বরে উত্তর দেয়,
-আমি পালিয়ে এসেছি সজল। তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের স্বামী বলে পরিচয় দিতে পারব না।
-মানে কী! এসব তুমি কী বলছ!
-তুমি এখানে আসার পরদিন হঠাৎই শুনতে পাই,আমার বিয়ে শুক্রবারে। আমি তো কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। তোমার সাথে ফোনে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করি। কিন্তু প্রতিবার ফোন বন্ধ বলছিল। ফেসবুকেও তুমি ছিলে না। বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম,পারিনি। মামী সবসময় চোখে চোখে রাখত। হয়ত তোমার আমার সম্পর্কটা মেনে নিবে না বলেই মামা মামী এভাবে বিয়েটা দিয়ে দিলো আমার। তবে শুনেছি,অনেকদিন আগে থেকেই এই বিয়ের আলাপ চলছিল। অথচ আমার কানে কিছুই পৌঁছোয়নি।
সজল ঢোক গিললো। মিঠি’র সঙ্গে তার তিন বছরের সম্পর্ক। তবে সবটাই এখন মিথ্যে মনে হয়। প্রথম প্রথম মিঠির সুন্দর মুখখানা, শান্ত স্বভাব এবং বাবা-মা নেই বলে একটা মমতাবোধ থেকেই সম্পর্কটা তৈরি হয়েছিল। এখন আর আগের টান অনুভব হয় না। বরং তার বাবা-মা যেই মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে সজলের জন্য,তাকে দেখতেই গ্রামে আসা। তাকে দেখার পর থেকেই সজলের মাথা আউট হয়ে গেছে। এত সুন্দর পরীর মতো মেয়েকেই তার চাই স্ত্রী হিসেবে। ওই মেয়ের সৌন্দর্যের সামনে মিঠিকে পান্তাভাত মনে হয়। অনুভূতি গুলো ফিঁকে হয়ে গেছে। সময় যেমন পাল্টে যায়, মানুষের মনও পাল্টে যায়। আর সম্পর্ক করেছে বলেই বিয়ে করতে হবে- এ কথা কোথাও লেখা আছে কী? নেই!
ভাবনার রেলগাড়ি একবার ছুটতে শুরু করলে ছুটতেই থাকে। একটি ছেলে এসে সজলকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে বলেছে, একজন অচেনা মেয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। মেয়েটির নাম মিঠি। তাই শুনে ছুটে এসেছে সজল,অজানা ভয়ে,আতংকে…ভালোবাসার টানে নয়!
ভাবনার গতিপথ থামিয়ে সজল মিঠির দিকে চাইলো। একরাশ স্বপ্ন ও আশা নিয়ে মিঠি তাকিয়ে রয়েছে। সজল ইতস্তত করে। কী বলবে,ভেবে পাচ্ছে না। তাকে নির্বাক থাকতে দেখে মিঠি ফের বলে উঠল,
-ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসতেই হয়। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে তাকে মানতে পারছিলাম না তোমার জায়গায়। আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছি, তাই না? তাহলে তাকে কী করে মানবো! তাই সুযোগ পেয়ে ভোর বেলায় ওই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসি।
সজল বিস্ময় নিয়ে বলল,
-তোমার বিয়ে হয়ে গেছে? মানে তুমি বিয়ের আসর থেকে পালাওনি?
-চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। কিন্তু বিয়ের পর পালাতে সক্ষম হলাম।
এইতো মোক্ষম সুযোগ, মিঠিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এরচেয়ে বড় যুক্তি আর কী হতে পারে! চোয়াল শক্ত করে সজল বলে উঠল,
-তুমি ভাবলে কী করে, একটা বিবাহিত মেয়েকে আমি বিয়ে করব! তাকে নিয়ে সংসার সাজাবো? তোমাকে যে ছুঁয়েছে,তার কাছেই যাও। বৃথা এলে এখানে!
চোখের পানিরাও থমকে গেল সজলের কথা শুনে। ফ্যালফ্যাল নয়নে মিঠি তাকিয়ে রইলো। কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। ঠোঁটের কোণ দিয়ে মলিন হেসে বলার চেষ্টা করল,
-তুমি মজা করছো আমার সাথে?
-মজা করার মতো মুড আমার নাই। শোনো মিঠি, আমাদের ভেতর যা ছিল, সব ভুলে যাও। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর আমার বাবা-মা কিছুতেই একজন বিবাহিতা নারীকে আমার স্ত্রী হিসেবে মানবে না।
-তাহলে সম্পর্ক কেন গড়েছিলে?
মিঠির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সজল ভ্রু কুঁচকে বলল,
-আজব কথাবার্তা তোমার! সম্পর্ক ছিল বলেই বিয়ে করতে হবে এমন কী বলেছিলাম আমি? আর এখন তো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে কেন মানতে চাইছো না? বাস্তবতা দেখো মিঠি, আর চলে যাও। শুধু শুধু আমার জীবনে অশান্তি করো না।
সজল পা বাড়ায়। পেছন থেকে মিঠি টেনে ধরল তাকে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সজল তাকাল। মিঠির দুই চোখ বেয়ে নোনাজল ঝরে পড়ছে। সজলকে অনেক অনুনয় বিনয় করল সে,সজল শুনলো না। মিঠিকে টেনে বড় রাস্তায় তুলে দিলো। বলল,
-এখানেই বাস আসবে। সেই বাসে করে চলে যাও। টাকাপয়সা আছে নাকী দিয়ে দিব?
মিঠির কান্না হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। নিজেকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ ছোট মনে হলো। এ কার জন্য একটা ভদ্রলোকের মনে কষ্ট দিয়ে এলো সে! ছিঃ! নিজের ভালোবাসা এভাবে অপাত্রে ঢালার জন্যে নিজের উপর খুব রাগ হলো মিঠির। কাটকাট করে সে বলল,
-আমার মন যেভাবে ভাঙলে,তার চাইতেও বড় আঘাতে তোমার মন ভাঙুক।
সজল বিরক্ত গলায় বলল,
-তোমরা পারো তো এই এক মাথা বলতে! কিছু হলেই অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কীইবা যোগ্যতা আছে! যত্তসব…
সজল পা বাড়ালো সামনে। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। তাকালে দেখতে পেত,মিঠি দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কাঁদছে।
চলবে?