রঙিন খামে বিষাদের চিঠি পর্ব-২৫+২৬

0
733

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ২৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৫৭,
পরদিন বিকেলবেলায়, একটা ক্যাফেতে বসেছে জুবায়ের এবং আয়াত। অবশ্য দেখা-টা জুবায়ের-ই করতে চেয়েছে। সে নিজে-ই বাইক নিয়ে আয়াতকে আয়াতদের বাড়ি থেকে নিয়ে ক্যাফেতে নিয়ে এসেছে। কফির অর্ডার দিয়ে বসে আছে দুজন। আয়াতের ভেতরে ভেতরে উশখুশ অনুভূতি হলেও সে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বসে আছে। ওয়েটার কফি দিয়ে গেলে জুবায়ের কফির কাপ-টা হাতে নেয়। চুমুক বসিয়ে আয়াতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আয়াত কফির কাপ হাতে নেয়নি দেখে বলে উঠে,

“আন কমফোর্ট ফিল হচ্ছে আমার সাথে?”

আয়াত হকচকিয়ে যায় জুবায়েরের প্রশ্নে। হাসার চেষ্টা করে বলে,

“যার সাথে দুদিন পর এক ছাঁদের তলায় থাকতে হবে! তার সামনে আন কমফোর্ট ফিল করা নেহাৎ-ই বোকামি।”

“ওয়েল, আপনাকে কিছু কথা জানাতে আমি আজ এখানে ডেকেছি। ইট’স অল এবাউট মাইসেলফ এন্ড মাই পাস্ট। প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার যেহেতু আপনার সাথে পার করতে হবে। সো আই থিংক আপনার আমায় পুরো-টা জেনেই আমার জীবনে আগমন করা উচিত। কারণ আমাদের বিয়ে-টা হয়ে যায়নি এখনও। জাস্ট দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। আমি এসবের আগে-ই বলতে চেয়েছিলাম। বাট আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আগের বার যখন বাবা বিয়ের কথা তুলেছিলো, আমি জানতাম না পাত্রী আপনি। তাই মানা করেছিলাম। এরপর ঢাকায় গিয়ে যখন বুঝলাম পাত্রী-টা আপনি! আমি আফসোস করেছিলাম। যে বিয়ে-টা কেন ভাঙলাম? এরপর আবার যখন দাদুর জন্য ব্যাক করলাম গ্রামে। দাদু আর বাবা দুজন-ই জানালো, পাত্রীর বাবা আর চাচা সম্পর্ক-টা আগাতে চাচ্ছে। আগের বার ইচ্ছে করে কেউ বিয়ে ভাঙতে উনাদের ভুলভাল বুঝিয়েছিলো বিধায় তারা সম্পর্ক তৈরি করতে আগায়নি। এবার পাত্র মানে আমার সম্পর্কে সব খবরাখবর নিয়ে-ই তারা মানে আপনার বাবা আর সাজ্জাদ ভাইয়ের বাবা আগাতে চায়! তো আমি আর মানা করিনি।”

আয়াত জুবায়েরের কথার আগামাথা কিছু বুঝলো না। নিজেই বলছে বিয়ে ভাঙার কথা! আবার কেউ চেষ্টা করেছে ভাঙতে! মানে কি এসবের? সে বিস্ময় দমাতে না পেরে প্রশ্ন করলো,

“কি বললেন একটু ক্লিয়ার করুন। বিয়ে-টা আপনি-ই বললেন, আফসোস করছেন ভেঙেছেন বলে! আবার বলছেন কেউ ভাঙার চেষ্টা করেছে! আগের বার জানতেন না পাত্রী আমি! পরের বার জানলেন পাত্রী-টা আমি। কিছু বুঝতে পারছিনা আমি।”

“লেইট মি এক্সপ্লেইন। প্রথমবার যখন বিয়ের কথা বাবা আমায় জানায়! আমি বিয়ে-টা করতে রাজী ছিলাম না। ভাঙার জন্য আমি-ই নিজেকে আড়াল করে আপনার বাবা আর চাচার কাছে নিজের সম্পর্কে বাজে কথা বলেছিলাম। এমনভাবে কনভিন্স করেছিলাম যে, উনারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হোন আমি খারাপ। কিন্তু কোথাও একটা আরিফ চাচ্চুর মনে খুঁতখুঁতানি রয়ে-ই যায়। এজন্য আপনি আর আপনার বাবা ঢাকা ব্যাক করার পর আমার সম্পর্কে সব খবরাখবর নিয়ে আপনার বাবাকে জানায়। এবং বোঝায়, কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন-টা করেছিলো। সেই কেউ-টা যে আমি! এটা উনারা এখনও জানেন না। আর আপনার বাবা আর চাচার মাঝে একটা বাকবিতন্ডার-ও সৃষ্টি হয়েছিলো আমার জানামতে। সেটা আপনিও জানেন কেন! ভাই হয়ে ভাইয়ের মেয়ের জীবন নষ্ট করতে এমন বাজে ছেলে চয়েজ কি করে করেছিলো আপনার চাচা? এটা নিয়েই ঝগড়া হয়েছিলো তাইনা?”

আয়াত মাথা নাড়ায়। বিস্মিত চাহনীতে তাকিয়ে জবাব দেয়,

“হ্যাঁ, তা হয়েছিলো। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?”

৫৮,
“আরিফ চাচ্চু বাবাকে বলেন৷ তার থেকে আমি অব্দি কথাগুলো আসে। ২য় কথা, আপনাকে আমি ঢাকায় গিয়ে দেখে প্রথমে বুঝিনি দাদু আর বাবার ঠিক করা পাত্রী আপনি। পরে বুঝতে পারি আপনার বাবাকে দেখে। কারণ আমার সামনেই আপনার বাবা আরিফ চাচ্চুকে ভাই ডাকছিলেন। যেদিন আমায় দেখার জন্য জন্য দুজন গিয়েছিলো সেদিন। এরপরে ঘটনা কমন। আংকেলকে দেখে বুঝতে পারি মেয়ে-টা আপনি। কারণ উনি আপনার বাবা। গেইজ করি পাত্রী-টা আপনি ছিলেন। সেজন্য বাড়িতে এসে আর আপত্তি করিনি। কারণ আপনার ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লেগেছে। আর আমার পরিবারেরও আপনাকে পছন্দ। তাই ২য় বার আপনাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ-টা মিস করলাম না।”

জুবায়ের জবাব দেয় আয়াতের কথার। আয়াত সব শুনে মাথা দুলিয়ে কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে শুধায়,

“সব বুঝলাম। আর একটা বিষয় ক্লিয়ার করুন। বিয়ে-টা কেন প্রথম বার ভাঙতে চেয়েছিলেন? আর ২য় বার পাত্রী আমি জেনে-ই বা বিয়ে-টা করতে রাজী কেন হলেন? আর বড়-বাবা, বাবা আপনাকে চিনলো না কেন? আপনার ভাষ্যমতে তো আপনি-ই বিয়ে-টা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন!”

“প্রথম প্রশ্নের থেকে আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিই। তা হলো আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ। আমরা দুজন-ই ভেতরে ভেতরে সব যন্ত্রণা চেপে হাসতে পারি। একটা রঙিন খামে নিজেদের মুড়িয়ে রাখি। যেটা সবাই করে না। আপনার বোনের প্রতি ভালোবাসা, বাবার প্রতি শ্রদ্ধা! আমার সাথে কিছু-টা ম্যাচ করে। আমিও আমার বোনকে+বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি। আর প্রথম বার ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম, কারণ আমার লাইফের ছোট্টো কিছু বাজে ঘটনা আর আমার সৎ মা মিসেস ডালিয়া চৌধুরী। আর আপনার বাবা, চাচা আমায় চিনতে পারেনি। কারণ আমি নিজেকে সেভাবে প্রকাশ করে তাদের সামনে যাইনি। যদি চেনার চেষ্টা করে! তবে হাইট ছাড়া কিছু সন্দেহ করতে পারবেনা তারা।”

“ওকে, দ্যান আপনার কি এমন পাস্ট আছে? যেটার জন্য বিয়ে অব্দি করতে চাননি! আর সৎ মায়ের কাহিনী-টা কি?”

“পাস্ট তেমন আহামরি কিছু নয়। আমার মা মারা যান আমার ৯বছর বয়সে। আমার বোন তখন ৪বছরের। আজ আমার বয়স ২৭পেরিয়ে ২৮ছুঁইছুঁই। এই যে ১৯টা বছর! তার মাঝে ৯বছর আমার ছোটোমা আমায় কম যন্ত্রণা দেননি। আমার মায়ের মৃত্যু-টা নরমাল মৃত্যু এটা বলা চলে না। আমার মা সু’ইসাইড করেছিলেন। এটা আমার মায়ের পাপের সাজা-ই বলা চলে। আমার মা পরপুরুষে আসক্ত হয়ে পরেছিলেন। যেটা জানাজানি হওয়ার পর উনি সু’ইসাইড করেন। এই যে আমার মা একটা ভুল করেছিলেন! স্যরি ভুল নয় অন্যায়। এই অন্যায়ের সাজা উনি মারা গিয়েও কমেনি। আমার ছোটোমা আমার বাবার চাচাতো বোন। উনারও আগে এক জায়গায় বিয়ে হয়েছিলো। সেখানে তার স্বামী কর্মক্ষেত্রে এক্সিডেন্টলি মারা যান। আমার দুই সৎ ভাই উনার আগের পক্ষের সন্তান। দাদু আর ছোটো দাদু বাবা আর ছোটোমা-র বিয়ে দিয়ে দেন আমাদের ভাইবোনদের কথা ভেবে। যে আমরা মা পাবো, তারা বাবা পাবে। বিয়ে তো হয় তাদের। শুধু জীবন-টা দুনিয়াবী আযাবে ভরপুর হয় আমার। মেয়ে ছিলো না বলে ছোটোমা আমার বোনকে যথেষ্ট আদর করে অস্বীকার করবোনা। কিন্তু বাবার অলক্ষ্যে এত-টা অশান্তিময় করে দিয়েছিলেন যে, আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। ১৭বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছি। আজ ১০বছর পেরিয়েছে বাড়িতে একমাস! তাও থাকিনি।বড়জোড় একসপ্তাহ। আমার ছোটোমা সবটা সময় বাড়ির আনাচে কানাচে মিশে থাকা আমার মায়ের স্মৃতি নিয়ে খোঁচা দিতেন আমায়। আমার সামনে মা-য়ের সম্মান নিয়ে টানাহেঁচড়া করতেন। আমি থাকলে উনার ছেলেদের হক পাবেন না ভেবে বা ভাগীদার একটা বেশি! এই ভেবে উনার কত যে কথা শুনেছি! তার ইয়ত্তা নেই। যত যা হোক আমার মা তো! উনার সম্মান নিয়ে রোজ খোঁচা মূলক কথা আমার সহ্য হয়নি। বাবার তখন ভীষণ ব্যস্ততা। ব্যবসায় উন্নতি করা নিয়ে। আমি বাবাকে খুজে আমার পাশে পাইনি। দিন, মাস, বছর গড়ানোর সাথে উনার কথা শোনানো কমবে থাকতো বৃদ্ধি পায়। এই তো জীবন! বাবাকে বলে শহরের ফ্লাট-টায় শিফট হই। ওখানেই থেকে পড়াশোনা করতে থাকি। আমার ছোটো মামা আমার সাথে থাকতেন। আমি বড় হওয়ার পরপর উনি দেশর বাইরে চলে যান। এই তো এরপর একা-ই আছি। ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পর রায়াদের সাথে বন্ধুত্ব হয়। এরপর সুন্দর আর একটা পরিবার পেলাম। গ্রামে আসতাম, বোনকে দাদুকে দেখে চলে যেতাম। বাবার দেখা কখনও পেতাম। কখনও না। মাস গেলে একাউন্টে টাকা ঠিকই দিয়ে দিতেন। বাড়ি ছেড়েছি বাবার কথা না শুনে। জিদ করে চলে আসায় উনিও অভিমান করেছেন। কখনও নিজের ভুলগুলো জানার চেষ্টা করেননি। চেষ্টা করবেন এই আশাও করিনা। কারণ মানুষ নিজের থেকে বেশি অন্যের ভুল ধরতে এক্সপার্ট। এই তো ঘটনা আমার জীবনের। এত কথার শেষ কথা আমার ছোটোমা উপর থেকে যতটা ভালোবাসা দেখায়! ততটা ভালো কখনও বাসে না। বিয়ের পর হয়তো হাসির ছলেও কথা শুনিয়ে দিবে। আর মানুষের কথার আঘাত বড় আঘাত। ছুড়ির আঘাত শুকায়, কথার নয়। এজন্য বলি আমায় বিয়ে করার সিদ্ধান্তে আর একটা বার ভাবুন।”

৫৯
আয়াত সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কার জীবনে কি গল্প লুকিয়ে আছে! এটা উপর থেকে দেখে কখনও বোঝা যায় না। ইশশ! এই ছেলে-টা ভেতরে ভেতরে এত কষ্ট চেপে রেখেছে কে বুঝবে তাকে দেখে? বোঝার উপায় নেই। আয়াত টেবিলে দুহাত রেখে জুবায়েরের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

“আমার ভাবাভাবির কিছু নেই। বিয়ে-টা হচ্ছে।”

জুবায়ের মৃদু হাসলো। আয়াতের মতোই টেবিলে হাত রেখে আয়াতের চোখে চোখ রেখে বললো,

“আরও একটা ছোট্ট স্টোরি আছে আমার।”

“কি শুনি?”

“আমি একজনকে ভালোবাসি। ভালোবাসি বললাম কারণ এর পাস্ট টেনস কি আমার জানা নেই। হবে হয়তো ভালোবাসতাম শব্দ-টা। কিন্তু আমার এই ভালোবাসি শব্দ-টা ভালোবাসতামে রুপান্তর করার জন্য কেউ সুযোগ পায়নি। এবার আমি নিজেই নিজেকে সুযোগ-টা আপনাকে বিয়ে করার মাধ্যমে দিতে চাচ্ছি। আপনি কি এপ্রিশিয়েট করবেন আমায়?”

আয়াত মুচকি হাসলো। বললো,

“কেউ আমায় ঘিরে আগাতে চাইলে আমি বাঁধা দেবার কে? হয়তো বলবেন, আমি আমার মর্জির মালিক। আমি-ই বাঁধা দেওয়ার মানুষ। কিন্তু আমার মর্জির উপরও একজনের হুকুম চলে। সে আমাদের রব। উনি না চাইলে কিছু এতদূর গড়াতো না। সো আই হ্যাভ নো প্রবলেম। কিন্তু একটা ছোট্ট আগ্রহ হচ্ছে।”

“কি আগ্রহ?”

“ভালোবাসি বলার মানুষ-টাকে রেখে আমায় কেন বিয়ে করছেন? কারণ অবশ্যই একটা আছে। কি সেই কারণ-টা?”

“সে আমায় চায় না। আর যে আমায় চায় না তাকে জোড় করে বাঁধার মানে হয় না। আমি আমার মতো চেষ্টা করেছি। সে আমার জীবন-কে জেনে সুযোগ দেয়নি। তো আমিও পিছুটান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি। হয়তো পুরো-টা পারিনি। এবার সেটাও পারতে চাই। সে অন্য কারো বা আমি অন্য কারো হলে অবশ্যই পারবো। আমি জীবনে তার পর আপনার সামনেই নিজের জীবনে ভেঙেচুড়ে বললাম। রায়াদও এসব জানেনা। বলা হয়নি, ও জানতে চায়। আমি বলিনি। আমি চাইবো এাব কথা আমাদের মাঝে-ই থাকুক। রায়াদকে কিছু বলার হলে সময় মতো আমি বলবো।”

আয়াত হাসিমুখে সম্মতি দিলো। বললো,

“টবার বাড়ি ফেরা যাক? অনেকক্ষণ হলো বসেছি এখানে।”

জুবায়ের মৃদু হাসলো। উঠে দাড়িয়ে আয়াতকে ইশারা করলো আগাতে। সে কফির বিল মিটিয়ে দুজনে বের হলো ক্যাফে থেকে। দুজনে বাইকে করে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তার মাঝে হঠাৎ করে ভ্যানে ফুলের দোকান দেখে জুবায়ের রাস্তার একপাশে বাইক থামালো। আয়াত অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

“বাইক থামালেন যে?”

জুবায়ের নেমে কোনো উত্তর দিলো না। হেসে হাঁটা ধরে শুধু বললো,

“ওয়েট, এখানেই থাকুন।”

আয়াত তার কথা মতো বাইকে বসে রইলো। জুবায়ের ফুলের দোকান থেকে বেলি আর গোলাপের মিশ্রণে তৈরি গাজরা কিনে আনলো। আয়াত অবাক হলো গাজরা দেখে। জুবায়ের আয়াতের হাতের দিকে ইশারা করে বললো,

“ক্যান আই?”

আয়াত বিস্ময় সহিত হাত এগিয়ে দিলো। জুবায়ের তার হাতে গাজরা পেঁচিয়ে দিয়ে বললো,

“কেউ একজন আমার সব-টা জেনে আমায় একসেপ্ট করলো। আমার মায়ের চরিত্র কি ছিলো! জেনেও নিরবে মেনে নিলো। আমি তাকে সম্মান জানিয়ে আমার জীবনেও একসেপ্ট করে নিলাম। ফুলের শুভ্রতার মতোও আমাদের সম্পর্ক টায় শুভ্রতা বজায় থাকুক। এক নতুন শুভ সূচনা ঘটুক।”

আয়াত মনখুলে হাসলো। হাসিমুখে বললো,

“ঘটুক তবে।”

“আপনি তো বিদেশে থেকেছেন। তেমন ভাবে এই শহর ঘুরেননি! আজ একটু আমার বাইকে ঘোরা যাক? এরপর না হয় পৌঁছে দিলাম বাড়ি?”

আয়াত মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। জুবায়ের বাইকে বসে স্টার্ট দিলো। আজ একটু শান্তিতে তবে ঘোরা যাক!

৬০,
ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নামার প্রতিক্ষা। সময়-টাকে হয়তো গোধূলি বেলা বলে। রিয়ানা ছাঁদে দাড়িয়ে রেলিঙে ঝুঁকে হাত রেখে যতদূর দৃষ্টি মেলা যায়! তাকিয়ে আছে ততদূর অব্দি। পাখি-রা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের নীড়ে ফিরছে। কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতি মেতেছে। সকালবেলা থেকে দুপুর অব্দি বৃষ্টি হওয়ায় প্রকৃতি বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। রিয়ানার যেহেতু ঠান্ডার বাতিক। সে গায়ে শাল চাদর জড়িয়ে বসেছে। রিফাকে বললো তার ঠান্ডা লাগছে। সে ছাঁদে একটু একা থাকবে। তা শুনে রিফা শাল চাদর বের করে দিয়েছে। কফিও বানিয়ে দিয়েছিলো। তা ফুরিয়েছে রিয়ানা। কফির মগটা পাশেই সুন্দর করে রেখে দেওয়া। হাতের ফোন-টায় মৃদু শব্দে তার প্রিয় কিছু গান একের পর এক বেজে চলেছে। মোদ্দাকথা সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি নিজেকেও সময় দিচ্ছে। যা তার গত কয়েকদিন হলো নিজেকে একদমই দেয়নি। এখন দিচ্ছে, তার ভালো লাগে নিজেকে একটু সময় দিতে। এই সময় টুকুতে সে কারোর কথা ভাবে না। নিজের মতো থাকে। তার ভীষণ ভালো লাগে এই বিষয়-টা। নিজের নিরবতা আর প্রকৃতির চঞ্চলতার মাঝে কারোর পা ফেলার শব্দ হলো ছাঁদে। ঝড় বৃষ্টিতে অনেক পাতা উড়ে এসে পরেছে ছাঁদে। সেই পাতাতে পা পরার খসখসে শব্দ। রিয়ানা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইলো কে! কিন্তু ঘুরালো না। যার দরকার, সে নিজে এসেই দাড়াবে। তার ভাবনা সত্যি করে রায়াদ এসে দাড়ালো সেখানে। রিয়ানা না তাকিয়েও টের পেলো। পারফিউমের স্মেল বলে দিলো এটা রায়াদ। একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণের পারফিউম ইউজ করে ছেলে-টা। যার সুঘ্রাণ জানান দেয় তার উপস্থিতি। গতকাল পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হালকা ধাক্কা লেগেছিলো। রায়াদও সরে তাকে সাইড দিচ্ছিলো! আর সেও সেই সাইড দিয়েই পা বাড়িয়েছিলো। যার ফলে ধাক্কা-টা লাগে। তখন-ই পারফিউমের স্মেল ভালো ভাবে নাকে লেগেছিলো রিয়ানার। যার দরুণ এখন বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা রায়াদ। রায়াদ এসেছে বুঝেও রিয়ানা তাকালো না, কিছু বললোনা! বিষয়-টা অবাক করলো রায়াদকে। হ্যাঁ, আছে এই মেয়ের কিছু খারাপ ঘটনা মিশ্রিত অতীত। এজন্য এতটা চুপচাপ হবে? তাকে এত চুপচাপ হতে বলেছে কে? সেও তো চুপচাপ! কিন্তু রিয়ানার সাথে একটা গুড ফ্রেন্ডশিপ তো করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে সে! এই যে সে রিয়ানাকে হঠাৎ করে এত প্রায়োরিটি দিচ্ছে! রিয়ানার কি একটু অবাক হওয়া উচিৎ নয়? একবারও কি জিগাসা করা উচিৎ না যে, রায়াদ ভাই! আপনি তো আমাকে সহ্য-ই করতে পারেন না। হঠাৎ এত কথা বলার চেষ্টা করছেন? কারণ কি? কিন্তু না। সে তো ফিরে অব্দি তাকায় না। তার থেকে ৬-৭বছরের ছোট্ট মেয়ে-টার এত এটিটিউড কেন থাকবে? রায়াদ বিক্ষিপ্ত মনে এতগুলো প্রশ্ন সাজিয়ে ফেললো। কিন্তু উত্তর তো একটাও নেই। মিললোও না উত্তর গুলো। সে প্রশ্ন ভাবা বাদ দিয়ে সাথে আনা রিয়ানার ডায়েরী-টা রিয়ানার হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

“নিন, আপনার ডায়েরী। গতকাল জুবায়েরকে আনতে বলেছিলাম। এনেছে, দিয়ে দিলাম আপনাকে।”

রিয়ানা না তাকিয়েই ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,

“পড়া শেষ?”

“না, ভাষাগুলো কি দেখেছেন? পড়বো কি করে?”

“হঠাৎ আমায় জানার এত আগ্রহ কেন রায়াদ ভাই?”

“জানতে ইচ্ছে হলো এতটুকু ধানীলঙ্কার এত ঝাঁজ কেন?”

“ঐ যে বললেন ধানীলঙ্কা? এজন্য এত ঝাঁজ।”

“ধানিলঙ্কাও এক বয়সে এসে ঝাঁজ হয়। সেই বয়সে আপনি পৌঁছাননি মিস রিয়ানা। দ্যাট’স হুয়াই আমার আগ্রহ।”

“ওকে ফাইন। আমি বাংলা ট্রান্সলেটও লিখে দিবো লাইনগুলোর নিচে। জেনে নিবেন। এরপর দয়া করে আগ্রহ দমন করে ফেলবেন ওকে? আমার প্রতি কারোর আগ্রহ আছে? এটা বুঝতে পারলে আমার প্রচুর অদ্ভুত লাগে বিষয়-টা।”

“আপনি মানুষ-টাই আপাদমস্তক অদ্ভুদ টাইপ।”

রিয়ানা এবার হাসলো রায়াদের কথায়। তার দিকে তাকিয়ে দু কদম আগালো। রায়াদ অসস্তি নিয়ে পেছালো। রিয়ানা হাসির রেখা বড় করলো। হাসি বজায় রেখে বললো,

“আমায় জেনে কি করবেন? প্রেমে পরবেন আমার? ভালোবাসার চেষ্টায় নামবেন? আসুন এখনই না হয় প্রেম করি।”

কথাটুকু বলেই রিয়ানা রায়াদের দিকে দুহাত বাড়ালো জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিমায়। রায়াদ লাফ দিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে শক্ত গলায় বললো,

“মেয়ে মানুষ আপনি। কিছু তো লজ্জা রাখুন। এভাবে পরপুরুষের গায়ে ঢলে পড়ছেন? অসহ্য লাগে আমার।”

“আমারও অসহ্য লাগে মিঃ রায়াদ শাহনেওয়াজ। আমার বিষয়ে এত আগ্রহ আমারও অসহ্য লাগে। এজন্য আমি এই কাজ-টা করেছি। আপনিও জানুন আমি কেমন। আমার ডায়েরীর একপাতা পরে আমি সিওর আপনি এত নরম আমার প্রতি। নয়তো আমার চালচলন আপনার পক্ষে মেনে নিয়ে এত নরম ব্যবহার অপ্রত্যাশিত৷ আপনি কিছু সময়ের জন্য বোধ হয় ভুলে গেছেন আমি ঘাড়ত্যাড়া, জেদি, নির্লজ্জ এক মেয়ে। সেটা আবারও মনে করিয়ে দিলাম। এই বিষয়-টা মাথায় রাখবেন। অসহ্য লোক একটা।”

রিয়ানা কথাগুলো বলেই ডায়েরী আর কফির মগ-টা নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো নিচে যাবে বলে। রায়াদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে। এই মেয়ে-টা এমন কেন? আজব তো! আয়াতের বিয়ে সামনে বলে হানিফ হোসাইন তাকে যেতে দেননি। রায়াদের পরিবার-ই এবার গ্রামে আসবে। ভাবলো থাকছে যখন! একটু রিয়ানার সাথে সম্পর্ক-টা রাগারাগি থেকে নরমাল করবে। হ্যাঁ এটা সত্যি রিয়ানার খানিক যন্ত্রণা জেনে সে নরম হয়েছে। তাই বলে মুখের উপর সরাসরি বলবে? এত সাহস কেন এই মেয়ের! সে ঠিক-ই ভাবে। আস্তো বেয়াদব একটা মেয়ে। এই মেয়ে জীবনেও ভালো হবে না। রায়াদও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচ দিকে পা বাড়ায়।

চলবে?

#রঙিন_খামে_বিষাদের_চিঠি
#পর্বঃ২৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৬১,
দিন-টা সোমবার। রিয়ানা দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে কোলের উপর বালিশ নিয়ে তাতে ডায়েরী রেখে একেক-টা পাতায় চোখ বুলিয়ে চলেছে। বলা যায় এটা স্মৃতিচারণ। ৫বছরের কিছু বিশেষ দিনের স্মৃতি ব্যতিত কিছু-ই নেই এই ডায়েরীতে। তবুও রায়াদের এত জানার উৎকণ্ঠা কেন! রিয়ানা জানেনা৷ আছে আর কি এতে! বাবার করা অবহেলার কারণ। উড়নচণ্ডী জীবন কাটানোর জন্য শাসনের কিছু ঘটনা। যেগুলো হয় রাত করে বাসায় ফেরার জন্য! অথবা সিগারেট, বিয়ার, ওয়াইন খাওয়ার জন্য পাওয়া থাপ্পড়ের ঘটনা। এরপর! এরপর তো আছে আরও একটি কালো অধ্যায়। যার নাম কি বলা চলে? সাজ্জাদ! নাকি তার বদলাতে না পারার এক পরাজয়ের গল্প? এরপর আছে ধীরে ধীরে কি করে সে বুঝতে পারলো! সে সাজ্জাদকে ভালোবাসে। সেই ঘটনাগুলো। এর বেশি কিচ্ছু নেই। ডায়েরী-তে এতগুলো পাতা। অথচ কলমের কালী-তে ভরাট রয়েছে কিছু পাতা। রিয়ানা সেগুলোয় হাত বুলিয়ে ডায়েরী বন্ধ করলো। মাথা-টা খাটের বোর্ডের সাথে মাথা এলিয়ে দিয়ে হাতের দু আঙুলে কপাল চেপে ধরলো। মনের ভিতর-টায় বড্ড ধরফর করে চলেছে। নিজের অতীতের মুখোমুখি হতে চাওয়া যতটা সহজ! হওয়া-টা তত-টাই কঠিন। একেক-টা ডায়েরীর পাতা উল্টানোর পাশাপাশি চোখের সামনে দিনগুলো ভেসে উঠেছে যেন। রিয়ানা লম্বা করে কয়েক-টা শ্বাস নিলো। বিছানা থেকে নেমে ডায়েরী-টা বালিশের তলায় চাপা দিয়ে গায়ের উপর ওরনা ফেলে বের হলো রুম থেকে। এরআগে সাজ্জাদের বিয়ে-তে এসে বাবা আর বোনকে যে অপমান সহ্য করতে হয়েছিলো! সেই ঘটনা আবারও পুনরাবৃত্তি হোক! রিয়ানা একদম চায় না। এজন্য যত অসস্তি-ই লাগুক না কেনো? সে থ্রিপিস, নরমাল ভাবে লং ফ্রক, স্কার্ট, টপসের সাথে স্কার্ফ পরার চেষ্টা করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। টকটকে লাল রঙের এক সুতির থ্রিপিস চাপিয়েছে শরীরে। কিন্তু রুম থেকে বের হওয়ার সাথে-ই রিয়ানার দেখা হয়ে যায় রোজার সাথে। রোজা চিল্লিয়ে রিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,

“রিয়ুপি, তোমায় যে কত্ত মিস করেছি গো। বলে বোঝাতে পারবোনা।”

রিয়ানা রোজা-কে দেখে অবাক হলেও পরে মনে পরে শুক্রবারে আয়াতের বিয়ে। সেজন্য রোজার আগমন অযাচিত নয়। সে রোজাকে জড়িয়ে তার পিঠে হাত রেখে বলে,

“এত মিস করো না। চলে গেলে মায়া লাগবে। আর আমার মাঝে মায়ার টান বড্ড কম। তোমার মন ভালো করতে চলে আসতেও পারবো না। আবার ফোনে কনটাক্ট! সেটাও করতে পারবো না। আমি যেখান থেকে পদচারণ উঠাই! সেখানে ২য় বার ফিরি না সহজে। অতি দরকার না হলে তো একদমই পা ফেলতে রাজী না আমি।”

রিয়ানাকে ছেড়ে সরে দাড়ালো রোজা। গাল ফুলিয়ে বললো,

“আমি তোমার ছোট্ট বোন। এটা তুমি ভুললেও আমি ভুলতে দিবো না ”

“আমার এই বিষয়-টা একদম পছন্দ নয় রোজা। যে যাওয়ার, সে এমনিই যায়। তাকে যেতে দেওয়া উচিত। তার থাকার হলে! মনে রাখার হলে এমনিই রেখে দিবে। জোড় করে মনে করানোর দরকার নেই।”

“কিন্তু যাকে ভুলতে গিয়ে বারবার মনে পরে যায়? তার ক্ষেত্রে কি বলবেন আপনি?”

রোজা আর রিয়ানার কথার মাঝে আচমকা সাজ্জাদের উপস্থিতি আর তার কথা শুনে রিয়ানা ঘাবড়ালেও তা আড়াল করলো। মুচকি হেসে বললো,

“কিছু মানুষ থাকে-ই এমন। তাদের মনে রাখতে হয়না। থেকে যায়। তাদের ভুলতে হয় না। সময় এমনি-ই ভুলিয়ে দেয়। ভোলার চেষ্টা করলে বারবার মনে করিয়ে সাপের দংশনের মতো ব্যথা দেয়। তাই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা ছেড়ে দেওয়া উচিত। সময় ভুলিয়ে দিবে। সময় সবকিছুর উত্তর সুন্দর ভাবে দেয়।”

৬২,
রিয়ানা কথাগুলো বলে স্থান ত্যাগ করতে পা বাড়ায়। সাজ্জাদ অফিস থেকে ফিরেছে সবে। আয়াতের বিয়ের শপিং করতে যাবে সব। এজন্য আসিফা বেগম তাকে কল করে বাড়িতে এনেছে। সাজ্জাদ গলার টাই ঢিল করতে করতে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রোজা দুজনের কথার আগামাথা কিছু না বুঝে-ই রিয়ানার পিছু দৌড় লাগালো। রিয়ানা ততক্ষণে রিফার রুমে এসেছে। রোজা অনুমতি ব্যতিত কারোর রুমে ঢুকতে চাইলো না। সে আয়াতের কথামতো উপরে এসেছিলো রিয়ানাকে দেখতে। যে পথে এসেছিলো, সে পথেই নিচে নেমে গেলো সে। এদিকে রিফা ফোনে কারোর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলো। রিয়ানা ঢুকেছে লক্ষ্য করে সে কথার সমাপ্তি টেনে রিয়ানার পাশে বসে। রিয়ানা আলতো হেসে বলে,

“আমার জন্য কথা স্টপ করলেন? সমস্যা ছিলো করে দিলাম এসে?”

“না রিয়ু, ইট’স ওকে। ভার্সিটি ফ্রেন্ড। ক্লাসে যাই না। এজন্য কল করেছিলো। তোমার কিছু দরকার আছে?”

“হ্যাঁ, একটু দরকার ছিলো।”

“কি দরকার বলো?”

“আমার আসলে একটা কথা জানার ছিলো। আর একটা জিনিস নেওয়ার ছিলো।”

“কি কথা? আর কি জিনিস?”

“একচুয়ালি আই ওয়ান্ট টু নো দ্যাট, আপনি ঐদিন সাজ্জাদ ভাইয়ের সম্পর্কে এতকিছু আমায় জানালেন। আমায় নিয়ে তার ফিলিংস জানালেন! সাজ্জাদ ভাই শেয়ার না করলে তো আর আপনি সব-টা জানতেন না। ভাই শেয়ার করেছিলো? আর আমার একটা কলম লাগতো।”

“ভাইয়া আর আমার বন্ডিং এজ লাইক বেস্টফ্রেন্ড। আমার ভাইয়া আমার কাছে এসে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে যেমন কেঁদেছে। আমার কোলেও মাথা রেখে কেঁদেছে। এভরি সিঙ্গেল সেকেন্ড! আমার ভাইয়ার প্রতিটা কষ্টের সাক্ষী হয়েছি। সেই দিক থেকে বলতে গেলে তোমার উপর আমার রাগ করা উচিত। আমার ভাইয়াকে কি একটু ভালোবাসা যেত না রিয়ু?”

রিয়ানা দমে গেলো রিফার প্রশ্নে। পরপর কয়েক-টা ফাঁকা ঢোক গিললো। ভালোবাসা যেত না কি? ভালোবাসা যেত কি যেত না! তা তো পরের বিষয়। সে তো ভালোবেসে ফেলেছে। সেটা দেরীতে উপলব্ধি করেছে। যার পরিণাম এত যন্ত্রণা। কে পারে ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সঙ্গে সংসার করতে দেখে। একপাক্ষিক ভালোবাসা! তা বাসতেও তো দম লাগে। ভালোবাসার মানুষকে অন্যের পাশে সহ্য করা! তার ছোয়ায় অন্য কাউকে সুখ পেতে দেখা! এসব দেখেও সবার সামনে নরমাল থাকা! এত সহ্য শক্তি আদৌও কারোর হয়? তার ভালোবাসার মানুষ-টাও একসময় তাকে ভালোবাসতো। জেনেশুনে ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া! এরপর ভালো থাকার চেষ্টা করা? এত সহজ কি? রিয়ানা এসব ভাবতে চাইলো না। তার ভেতরটায় হাঁসফাঁস করে উঠলো। রিয়ানা নিজেকে শক্ত করে বললো,

“আপু কলম-টা? একটু দিবেন? আমি রুমে যাবো।”

রিফা বুঝলো রিয়ানা বিষয়-টা এড়িয়ে যেতে চাইছে। সে তার পড়ার টেবিল থেকে একটা কলম এনে রিয়ানার দিকে এগিয়ে দিলো। রিয়ানা কলম নিয়ে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। রিফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আলনা থেকে নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। যা গরম! পানির নিচে সারাদিন ডুব দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তার। রিয়ানা রুম থেকে বেরুতে-ই ধাক্কা লাগলো রায়াদের বাহুর সাথে। রিয়ানা কপালে হাত দিয়ে রায়াদকে দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রায়াদ হকচকিয়ে যায় হঠাৎ এমন হওয়ায়। সে ঘুরে রিয়ানার দিকে তাকালে রিয়ানা বলে উঠে,

“একটা জলজ্যান্ত মেয়ে একটা রুম থেকে বের হচ্ছে। এটা দেখেও কি একটু থামা যায়নি?”

“স্যরি, ভুল-টা আপনারও। আমি আসছি দেখেও কি একটু ধীরে রুম থেকে বের হওয়া যায়নি?”

“সিনেমা পেয়েছেন এটা? ঝগড়া কেন শুরু করেছেন?”

“এটা সিনেম্যাটিক কোনো সীন নয় যে এখন ঝগড়া করতে করতে প্রেমে পরে যাবো। সে স্যরি! ফল্ট আপনার। আমার নয়।”

“এখানে প্রেমের কথা আসলো কোথা থেকে? আর স্যরি বলবো আমি? পাগল নাকি?”

” আমি নই, আপনি পাগল। বদ্ধ উন্মাদ। যে সুস্থ মানুষের ভাণ ধরে অসুস্থ একজন মেয়ে হয়ে সবাইকে পাগল বানাতে নেমেছেন নিজের মেজাজ দেখিয়ে।”

৬২,
রিয়ানার সহ্য হলো না রায়াদের কথা। এই লোককে সে শুরু থেকে পছন্দ করেনা; তার অযাচিত শাসন আর ভাষণের জন্য। সে দেওয়ালের সাথে কলমের মাথা লাগিয়ে লীক করলো। এরপর কালী ছুড়লো রায়াদের পরনে থাকা সাদা শার্টের উপর। একে তো এতো গরম! তাতে পাগল হবার যোগার। এজন্য রায়াদ নিজের পছন্দের সাদা শার্ট পরেছিলো। সেই শার্টে রিয়ানা কালী দিয়ে মেখে দিয়ে পরার অযোগ্য করে তোলায় সে রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেললো। রিয়ানার হাত ধরে মুহুর্তে দেওয়ালের সাথে চেপে দাড়ালো। দাঁতে দাঁত পিষে শুধালো,

“এটা কি করলেন আপনি? আমার এত পছন্দের শার্ট আপনি নষ্ট করে দিলেন?”

“দেখতেই তো পাচ্ছেন। তাতে এভাবে দেওয়ালে চেপে বলার মানে কি? ছাড়ুন আমার হাত। সরুন সামনে থেকে।”

রিয়ানার জবাবে রায়াদের রাগ কমলোনা। উল্টে তরতর করে বাড়লো। একে তো এ মেয়ে ভুল করেছে। আবার গলা উঁচিয়ে কথা বলছে! রায়াদ চোয়াল শক্ত করে বললো,

“মেয়ে মানুষ, নরম স্বভাব নিজের মাঝে বজায় রাখতে হয়। এত ঝাঁজ কেন? নরম দুই গালের মাঝে থাকা মুখটার নরম ঠোঁটে কি নরম কথা ফুঁটে না? সব-টা সময় তেজ? এত তেজ কেন হ্যাঁ?”

রায়াদের কথা ফুরোতেই রিয়ানা অদ্ভুদ এক কাজ করে বসলো। এক হাত রায়াদের হাতে বন্দী থাকলেও অন্য হাতে সে রায়াদের কলার টেনে ধরলো। রায়াদের পায়ের উপর পা দিয়ে দাড়ালো। রায়াদের ঠোঁটে দিকে ঠোঁট বাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল গলায় ব্যঙ্গাত্মক সুর ফুঁটিয়ে বললো,

“কেন? মেয়েদের তেজ থাকতে নেই বুঝি? নরম গালের মাঝে থাকা মুখের দুই ঠোঁটে কি শুধু লীপ করতে হয়? তাছাড়া কিছু বলা যাবেনা ঝাঁজের সহিত?”

রায়াদ রিয়ানার আকস্মিক এহেন কান্ডে পুরোই বরফ বনে গেছে। মুখের কথা, রাগের তেজ সব গলে পানি। সে রিয়ানাকে ছেড়ে ছিটকে সরে গেলো। আর একটা কথা-ও খরচ করলো না। হনহনিয়ে হেঁটে সোজা হানিফ হোসাইনের রুমে ঢুকলো। তার বাবা এসেছে বলে হানিফ হোসাইনকে ধরে নিচে নিয়ে যেতে উপর তলায় এসেছে সে। আসতেই এরুপ কান্ড ঘটলো। রায়াদের নিজের-ই এবার লজ্জা লাগছে। একটা মেয়ে এতটা নির্লজ্জ কি করে হতে পারে! আন্দাজও করতে পারছেনা রায়াদ। উপরতলায় উঠতেই প্রথমে রিফার রুম, এরপর আয়াত-রিয়ানার, তারপর সাজ্জাদ-অন্তির। এরপরের-টা হানিফ হোসাইনের। সেদিকে যেতে ধরেই এইরুপ এক কান্ড ঘটে বসলো। এদিকে রায়াদ যেতেই রিয়ানা হেসে উঠলো। বিরবির করে বললো,

“জানি তো মিঃ রায়াদ শাহনেওয়াজ। আপনার দৌড় এতদূর অব্দি। আমার যেটুকু না লজ্জা আছে। তার চারগুণ বেশি আপনার লজ্জা। জোড়াজুড়ি করে শক্তি খরচ করার কোনো মানে হয়? যেখানে আপনাকে ঘায়েল করার পদক্ষেপ-ই জানি। ছেলে-দের সাথে মেয়ে-রা তো শক্তিতে পেরে কখনও উঠে না। তাদের প্রতিঘাত করার একটা-ই উপায় দু্র্বল জায়গায় আঘাত করা। তা হোক কথার আঘাত বা ব্যথার আঘাত।”

রিয়ানা হাসিমুখে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে ঢুকতেই দেখলো অন্তি তার বিছানায় বসে আপেল কামড়াচ্ছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অন্তি বলে উঠলো,

“হাতে হাত বন্দী, পায়ে পা, চোখে চোখ আর ঠোঁটের পরশ খানিক-টা দূরে। চরিত্রে দোষ একার আমার নয়। তোমারও তবে আছে রিয়ানা।”

৬৪
বুদ্ধিমতী রিয়ানা বুঝে গেলো অন্তি রায়াদের সাথে তাকে দেখেছে। সে ঘাবড়ালো না। অন্তির পাশে বসে ঠোঁটের কোণে বিস্তর হাসি ফুঁটিয়ে বললো,

“আপনার মতো লো ক্লাস টাইপ চরিত্র আমার নয় ভাবী। আমি পালাইনা। যা করি সরাসরি। আর একটা মজার কথা জানেন? আমি এঔ ছোট্ট জীবনে সহস্র ছেলের সাথে ফ্লার্ট করেছি। এটা তার-ই ছোট্ট নমুনা। আই হোপ, বিষয়-টা ক্লিয়ার। নাউ লীভ ফ্রম মাই রুম।”

শেষের কথা-টা রিয়ানা শক্ত কন্ঠেই বললো। রিয়ানার জবাবে তার মুখ-টা চুপসে গেলো। আরও ২-৪কথা বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগে অন্তিকে ডাকার শব্দ ভেসে আসলো। দরজার বাইরে দাড়িয়ে সাজ্জাদ তাকে ডাকছে। রিয়ানা আবার একদফা হাসি প্রসস্থ করলো। বললো,

“আমার কাছে অপমানিত হওয়ার ঢের সুযোগ আছে ভাবী। এখন যান, স্বামীর সেবা করুন। মনে আছে তো! পার্ফেক্ট কাপল হতে হবে। দম থাকলে হয়ে দেখিয়ে আমায় কথা শোনাতে আসবেন? ওকে? নাউ বাই।”

রিয়ানা নিজেই হাত ধরে অন্তিকে দরজার বাইরে বার করে দিয়ে দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দিলো। অন্তি সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বললো,

“দেখলেন! আপনার সাধের ভালোবাসার চোখে আমার সম্মান কতটুকু? দেখলেন আপনি?”

“যেচে অপমানিত হতে আসো কেন অন্তি? ভাবী হও সম্পর্কে! তেমন বিহেভ করতে পারো না? তবে তো রিয়ানা তোমায় সম্মান দিবে? টিপিক্যাল ভাবী যারা ননদদের দেখতে পারে না! এমন বিহেভ কেন করতে যাও?”

“সম্পর্ক-টা ননদ অব্দি থাকলে ঠিক ছিলো। তার সীমা পেরিয়ে সে তো আমার হতে হতে না হওয়া সতীন।”

অন্তির কথায় সাজ্জাদ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। অন্তির হাত ধরে টেনে রুমে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো। অন্তি ঘাবড়ে যায়। সাজ্জাদ অন্তিকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। বুকের সাথে অন্তির মাথা-টা চেপে ধরে বলে উঠে,

“ট্রাস্ট মি বউ, ঐ মেয়ে-টার জন্য আমার অনুভূতি ঐ যে ঢিপঢিপ শব্দ শোনা যায়!সেখানের কোথাও একটা দাফন হয়ে গেছে। সব-টা জুড়ে তোর বসবাস আনার চেষ্টায় নেমেছি। এত বার আঘাত কেন দিস বারবার মনে করিয়ে দিয়ে? থাক ও ওর মতো। আমি আমার মতো তোকে নিয়ে একটু ভালো থাকি? ৪টা বছর পেরিয়ে গেছে। ৪বছর আগে তাকে ভালোবাসি বলেছিলাম। ফিরিয়ে দিয়েছে। মেনে নিয়েছি। বিরক্ত করিনি। ২টা বছর তাকে নিয়ে ভাবতাম। তুই জীবনে জড়িয়ে যাওয়ার পর ভুলতে যাওয়ার পথে হাঁটছি। এবার একটু আমায় বোঝ। আমায় সাহায্য কর তাকে ভুলে যেতে। কথায় কথায় আর খোঁচা দিস না অন্তি। আমার সহ্য হয়না। আমিও তো মানুষ। রোবট না। একটু বোঝার চেষ্টা কর আমায়।”

অন্তির চোখে জল এসে পরে সাজ্জাদের হাহাকারে। এই মানুষ-টা বিয়ের আগে যেমন তাকে তুই বলতো! সেই সুর খুঁজে পেলো তার কথায়। মনে হলো তার পুরোনো সাজ্জাদ ভাই। তবে কাজিন নয় স্বামী। এটাই পার্থক্য।সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। কান্নামিশ্রিত গলায় বলে,

“কি করবো আমি! বারবার ঐ মেয়েকে দেখলে মনে হয় আবার আপনাকে আমার থেকে কেড়ে নিবে। ওর ব্যক্তিত্ব, চলাফেরা! নরমালই বেশিরভাগ ছেলেই আর্কষিত হবে। সেখানে তো আপনি ওকে একসময় ভালোবাসতেন। আমার অতীতে করা হীনকাজ! বারবার মনে হয় আমায় ছেড়ে আবার ওকে ভালোবাসতে শুরু করবেন আপনি।”

“পাগলিরে! তোরে ছেড়ে দেওয়ার হলে অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম। একটা পশুর সাথে থাকতে থাকতে তার প্রতিও মায়া পরে। তুই তো সেখানে মানুষ। ২বছর হয়ে গেছে এক পবিত্র বাঁধনে বেঁধে পরেছি দুজন। তোকে ছুঁয়েছি। তোর শরীরের ভাঁজে আমার ছোঁয়া যেখানে লেগে আছে, সেখানে মায়া কি লাগেনি? জীবনে ১ম কাউকে ভালোবাসলে এক যুগ পরেও তার মুখোমুখি হলে একটু মনে পরেই। মনে জ্বলেও। তার মানে তো এটা না যে নিজের বর্তমান ভবিষ্যত ছেড়ে সেই অতীতকে কেউ আকড়ে ধরে! কবে বড় হবি আর? ২১তো হয়ে আসলো। এবার একটু মাথায় বুদ্ধি আন। আমায় একটু বোঝ। এই সম্পর্কের বোঝা একা বয়ে বেড়াচ্ছি। এবার আমায় একটু সামলা! আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। রিয়ানা আমার চাচাতো বোন। সেই হিসেবে টুকটাক যা কথা আর দেখা হওয়া! সেটা তো আঁটকানো সম্ভব না। তার মতো সে আছে থাকুক। বললি না তার ব্যক্তিত্ব! ঐ ব্যক্তিত্ব-ই কখনও তোর থেকে তোর স্বামীকে কেড়ে নিতে দিবে না। একটু তো বোঝার চেষ্টা কর।”

অন্তি সাজ্জাদের কথায় ভরসা পেলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সাজ্জাদ অন্তিকে বোঝাতে পেরে নিজেও হাফ ছাড়লো। অন্তির কপালে চুমু খেয়ে বললো,

“রেডি হয়ে নেও বউজান। আয়াতের বিয়ের জন্য শপিং এ যেতে হবে।”

অন্তি মুচকি হাসলো। ঝট করে সাজ্জাদের পায়ে পা রেখে দাড়িয়ে তার কলার টেনে ধরে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বসলো। সাজ্জাদ হাসলো অন্তির পাগলামিতে। অন্তি হেসে বললো,

“এটা আমার স্বামী। তার চিহ্ন বসিয়ে দিলাম। তার উপর শুধু আমার অধিকার থাকুক।”

এরপর সাজ্জাদকে ছেড়ে সে রেডি হতে চলে গেলো। সাজ্জাদ নিজেও হেসে বাইরে আসলো। ড্রইং রুমে নেমে সবাইকে বললো তৈরি হতে। শপিং করতে যাওয়া হবে।

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে