যে প্রেম এসেছিল পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
614

#যে_প্রেম_এসেছিল
#পর্ব১৩ অন্তিম
#Raiha_Zubair_Ripte

-“ এরপর কি হলো ম্যাম? ইন্দু কি তার তুহিন কে পেয়েছিল?
পুরো ক্লাস জুড়ে চলছে নিস্তব্ধতা। সামনের এক কাঠের চেয়ারে বসে আছে চল্লিশ বছরের এক নারী। চোখে তার চিকন ফ্রেমের চশমা। মাথার চুল গুলো আধপাকা। চোখের নিচে কালো দাগ। চল্লিশ বছরের নারীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্লাসের সকল স্টুডেন্ট। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খাওয়া শেষে সে তার স্টুডেন্টের দিকে তাকিয়ে ফের বলা শুরু করে-

-“ মুহূর্তে ফকফকা রাস্তা টা লাল র’ক্তে ভিজে উঠলো। লোকজন দৌড়ে দৌড়ে আসলো দেখতে। ইন্দু পাগলের ন্যায় ছুটে গেলো দেহটার কাছে। সাদা গোলাপ এখনও তুহিনের হাতের মুঠোয়। রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। তুহিনের মাথাটা কোলের উপর নিলো, গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে বলল-
-“ এই তুহিন উঠুন না। কি হলো উঠছেন না কেনো, তুহিন এই তুহিন উঠেন,আমার কষ্ট হচ্ছে তো,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার ইন্দু কষ্ট পাচ্ছে খুব উঠুন না। আজ না আমাদের বিয়ে। দেরি হচ্ছে তো উঠুন।

কাজি অফিসের ভেতর থেকে ইন্দুর মা ও সবাই বেড়িয়ে আসলো হইহট্টগোল শুনে। কিন্তু বেরিয়ে এসে সামনে এমন কিছু দেখবে কল্পনা ও করতে পারে নি। মনোয়ারা বেগম ছুটে মেয়ের কাছে গেলো। সাথে তুহিনের ফ্রেন্ড গুলো ও। মনোয়ারা বেগম কে দেখে ইন্দু ডুকরে কেঁদে উঠল। কান্নারত গলায় বলল-

-“ ও মা মা তুমি তো বলছিলা তুহিন কে কষ্ট দিতে না আমি তো সেটাই করছি। তুহিন কে আর কষ্ট দেই নি তাহলে তুহিন কেনো এমন করতেছে। আমাকে কষ্ট কোনো দিচ্ছে।
তুহিনের ফ্রেন্ড সাগর তুহিনের কাছে গিয়ে পার্লস চেক করে দেখে তুহিন এখনও বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি করে লোকদের সাহায্য নিয়ে হসপিটালে এডমিট করে।

ইন্দু এখনও ভয়ে তার মায়ের হাত জাপ্টে ধরে আছে। তখন রোড পাড়ি দিতে গিয়ে ওপর পাশ থেকে একটা গাড়ি এসে তুহিন কে ধাক্কা মা’রে। তুহিন দিক বেদিক ভুলে গিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি ইন্দুর কাছে আসতে চাইছিল,আশে পাশে ভালো করে না দেখেই রোড পার হতে যাচ্ছিল।

তুহিনের মা পাগলের মত দৌড়ে এসেছে হসপিটালে। ছেলের এই অবস্থা মানতে পারছে না। বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে। সে যদি ইন্দু আর তুহিনের সম্পর্ক মেনে নিত তাহলে এমন দিন আসতো না। হসপিটালে পাগলের মতো কান্না করছে তনয়া বেগম।

ইন্দু তনয়া বেগমের সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে বলে-
-“ ও আন্টি কাঁদছেন কেনো। তুহিন ঠিক হয়ে যাবে, হসপিটালে আনা হইছে তো। ও একদম ঠিক হয়ে যাবে।
তনয়া বেগম ইন্দুর পানে চাইলো। চুলগুলো এলোমেলো, মুখের সাজ লেপ্টে গেছে। পাগলের চেয়ে কম কিছু লাগছে না।

এরমধ্যে ডক্টর ওটি থেকে বের হয়ে জানায় চব্বিশ ঘন্টায় পেসেন্টের জ্ঞান না ফিরলে পেসেন্ট কমায় চলে যাবে। কারন মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।

কথাটা শুনে তনয়া বেগম সেন্সলেস হয়ে যায়। সাগর নার্স ডেকে এনে তনয়া বেগম কে কেবিনে নিয়ে যায়। ইন্দু পাথরের ন্যায় বসে রইলো। বারবার আল্লাহ কে ডাকলো তুহিনের যেনো জ্ঞান ফিরে আসে।

-“ তুহিনের কি জ্ঞান ফিরেছিল ম্যাম?

নারী টি ব্যাঘাত পেলো কথার মাঝে কথা বলায়। চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল-

-“ না আল্লাহ সেদিন ইন্দুর সহায় হয় নি, ফিরে নি জ্ঞান তুহিনের,কমায় চলে গিয়েছিল। তার পনেরো দিন পর ইহকালের মায়া ত্যাগ করে তার ইন্দু কে একা ফেলে চলে যায়। ঐ পেনেরো টা দিন ইন্দু তুহিনের কাছ থেকে এক মিনিটের জন্য ও সরে নি। নামাজ কালাম যা যা করা যায় সব করেছে শুধু তুহিনের সুস্থতার জন্য কিন্তু আল্লাহ দিলো না তার তুহিন কে।

তুহিনের লা’শ ধরে সেদিন পাগলের মতো কেঁদেছিল ইন্দু। লোকটাকে একবার বলতে পারলো না তার ইন্দু তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসি বলার আগেই কেঁড়ে নিলো তাকে। কেড়েই যখন নিবে তাহলে পাঠালো কেনো জীবনে। একটা সপ্তাহ ইন্দু পাগলের মতো বিহেভ করেছে। রোজ তুহিনের কবরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

-“ আচ্ছা ম্যাম এখন ইন্দুর কি খবর?

বাচ্চাটার কথা শুনে নারী টা স্মিত হাসলো। এর মধ্যে ছুটির ঘন্টা বেজে যায়। নারী টা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলে-

-“ আছে ইন্দু কোনো এক ছদ্মবেশে এই পৃথিবীর এক কোনে।
-“ ম্যাম একটা বলি?
-“ হুম বলো।
-“ আপনার আর ইন্দু প্রভার নামের মধ্যে অনেক মিল। এই যেমন ইন্দুপ্রভা আর আপনার নাম প্রভা।

প্রভা নামের মেয়েটি হেঁসে উঠলো। বাচ্চা মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো।

ষোল বছর হয়ে গেলো তুহিন নেই। তুহিনের কবরের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রভা। কবরের দিকে চেয়ে ব্যাগ থেকে তুহিনের ডায়রিটা বের করলো।

ডায়রিতে লিখা আছে ইন্দুর সাথে তার কাটানো প্রত্যেক টা মুহূর্ত। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,,আমার ইন্দুপ্রভা, ষোল বছর ধরে বইয়ে বেড়াচ্ছে এই ডায়েরি। মানুষ টা নেই কিন্তু তার স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায়।
❝ তুহিন দেখতে পারছেন?#যে_প্রেম_এসেছিল ধরণীর বুকে সেই প্রেমই আজ নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে এই আমাকে।❞ সময় থাকতে আপনার হাত ধরতে পারি নি যখন ধরলাম তখন ছেড়ে চলে গেলেন আমাকে একা করে। পৃথিবী আবার প্রমাণ করে দিলো। যাদের স্বাভাবিক জীবন নেই তাদের স্বপ্ন ও দেখতে নেই। স্বপ্ন দেখতে গেলেই সে পৃথিবীর নিয়ম ব্রেক করে। আর তার শাস্তি স্বরূপ পৃথিবী তাকে একা করে দেয়। এখন থেকে না হয় পৃথিবীর নিয়মেই চলবো। আপনার শেষ স্মৃতি টুকু নিয়ে বাকি জীবন পাড় করে দিবো। আচ্ছা শুনুন না আপনাকে আজ একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে। আপনি ডায়রিতে লিখে গেছেন আমার নামে অনেক অভিযোগ সেগুলো কি আস্তে আস্তে শুধরে নিতে পেরেছি? আপনি বলেছেন আমি আপনাকে ভালোবাসি না কখনও মুখে বলি নি। এই দেখুন রোজ এসে ভালোবাসি বলে যাই। আপনার সাথে কথা বলি। জানেন আপনাকে হারিয়ে রোজ হারানোর যন্ত্রণা ঢের উপলব্ধি করছি। পেয়েও হারানোর বেদনা অত্যাধিক পুড়ায় বুকের মধ্যে। আমি পরের জন্মে আবার আপনাকে চাই তুহিন,এই অভিশপ্ত জীবনে নয়। একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে আমি আমার তুহিন কে ফেরত পেতে চাই।
যেই ছেলে রোজ ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মাথা খেয়ে ফেলবে। রোজ স্কুল শেষে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আসবেন তো পরের জন্মে ইন্দুর তুহিন হয়ে? আজ আসি বুঝলেন তো তুহিন বাসায় দুই দুইটা আম্মাজন অপেক্ষা করছে, চিন্তা করে আমায় নিয়ে অনেক। কাল আসবো আবার।

ইন্দু আর একবার তুহিনের কবরের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। তুহিনের সাথে তর সংসার আর হলো না। লোকটার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ শুনতে পেলো না ইন্দু। তুহিন কি ভেবেছিল শেষ পরিনতটা এমন হবে? হঠাৎ করে জীবনের সব স্বপ্ন যেভাবে পূরণ হতে লাগলো এক নিমিষেই তা দুঃস্বপ্নে পরিনত হলো। কিছু মানুষ সুখের নাগাল পেয়েও সুখ ছুঁতে পারে না। আমরা মানুষ জাতি সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে জানি না যখন দেই তখন আর সময় থাকে না। ইন্দুও তেমন প্রকৃতির মানুষ। সময় থাকতে হাত ধরলো না তুহিনের যখন ধরলো তখন ধরেও রাখতে পারলে না।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে