যে প্রেম এসেছিল পর্ব-০২

0
502

#যে_প্রেম_এসেছিল
#পর্ব২
#Raiha_Zubair_Ripte

“ কিরে তুই কই, রাত তো অনেক হলো বাসায় আসবি কখন?”

হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে ছিল তুহিন । মায়ের ফোন আসতেই ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই কথাটা বলে উঠে তনয়া বেগম। তুহিন কাঁধের সাথে ফোন চেপে এক হাত দিয়ে ফাইল চেক করতে করতে বলে-“ মা তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আসতে লেট হবে। আর দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ো আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে যাওয়ার জন্য। ”

“ প্রতিদিন রাতে এতো লেট করিস ক্যান বলতো? চিন্তা হয় বাপ বিয়ে টিয়ে করে নে আর এই চিন্তা থেকে মুক্তি দে আমায়।”

“ আশ্চর্য মা আমি এখনো ছোট বিয়ের বয়স হয় নি। আর তুমি বিয়ের কথা বলছো। এটা কোনো কথার কথা বললা তুমি?”

” মারবো এক চ’ড় বিয়ের বয়স হয় নি বলে ছেলের। এই শোন তোর যেই বয়স তখন তোর বাপ এক বাচ্চার বাপ ছিল।”

“ হয়েছে মা রাখো আমার কাজ আছে তুমি খেয়ে ঘুমায় পড়ো।”

কথাটা বলে তুহিন ফোন কে’টে দেয়। ফোনের স্কিনে মায়ের নাম্বারের নিচে ইন্দুর নাম্বার দেখে কোনো কিছু না ভেবে ফোন দিয়ে ফেলে।

ইন্দুপ্রভা বেলকনির রেলিঙে দু হাতে ভর দিয়ে রাতের আকাশে জ্বল জ্বল করতে থাকা তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনের হিসাব মিলছে না তার। জীবন তাকে কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে আসলো দু বছরের মাথায়।

যেই মেয়ে কষ্ট কি সেই জিনিস টাই বুঝতো না। আর সেই মেয়ে আজ পুরো সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে চলে।

যে মেয়ে কখনো বাবা মা কে ছেড়ে বাড়ির বাহিরে বের হয় নি সেই মেয়ে সারাদিন বাহিরে কাজের সন্ধানে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেছে।

আজ খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা নামক ছায়াটা মাথার উপর না থাকলে বোঝা যায় জীবন কত কঠিন। বাবার মুখটা বড্ড ভেসে আসছে চোখের সামনে। এই তো সেদিন বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বলল- “ দু দিন পরই ফিরে আসবো মা তখন তোমায় বই মেলায় নিয়ে যাবো।”

দু’দিন চলে গেলো বাবাও ফিরে আসলো কিন্তু জীবিত নয় মৃ’ত। গাড়ি এক্সসিডেন্ট কেঁড়ে নিল একটা সুখী পরিবারের সব সুখ এক মূহুর্তে।

কথাটা মনে পড়তেই শরীর কেঁপে উঠল ইন্দুর। গলা ধরে আসলো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা অশ্রু। রাত অনেক হয়েছে কাল যেতে হবে স্কুলে কথাটা চট করে মাথায় আসতে রুমের দিকে পা বাড়াতেই হাতে থাকা ফোন টা বেজে উঠে ইন্দুর। ফোনের স্কিনে অচেনা নম্বর দেখে আর রিসিভ করলো না।

পরপর দুবার ফোন আসায় ফোন টা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে আসলো-“ ঘুমাও নি নিশ্চিত তাহলে ফোন ধরতে এতো দেরি হলো কেনো?”

ইন্দুপ্রভা কানের থেকে ফোন টা সামনে এনে নাম্বার টা ভালো করে দেখে। লোকটা তার নাম্বার কোথায় পেলো আবার? -“ আপনি আমার নাম্বার কোথায় পাইছেন?”

“ প্রশ্নকারী যখন প্রশ্ন করে তখন উত্তর দিতে হয় পাল্টা প্রশ্ন করতে হয় না। টিচার হয়েও এ কথা টা জানো না? ”

“ না জানি না। নাম্বার কই পাইছেন। আপনার জ্বালায় অতিষ্ঠ আমি বুঝতে পারেন না। আর কখনো ফোন দিবেন না বলে রাখলাম।”

“ এভাবে কথা বলো কেনো? একটু সফটলি কথা বলো আবেগ দিয়ে।”

“ আমার মনে এতো আবেগ নাই বুঝছেন। ফারদার আর কল দিবেন না।”

“ অবশ্যই কল দিবো। এবার যদি নাম্বার ব্লক করছো তো দেইখো কি করি।”

“ কি করবেন? ”

“ বেশি কিছু না তোমার বাসায় গিয়ে তোমার ফোন টা হাতে নিয়ে ব্লক টা ছুটায় আসবো আর তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো তোমার কথা এতো তিতে কেনো ছোট বেলায় মুখে মধু কেনো দেয় নি।”

“ পাগল আপনি। আপনার মতো পাগলের সাথে কথা বললে আমিও পাগল হয়ে যাবো রাখেন ফোন।”

তুহিন ফোন টা কানে নিয়ে কেবিনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের থাকা চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলে-“পাগল ছেলেটাকে সামলাও না ইন্দু। সে যে দিনকে দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে তোমার জন্য। চোখে কি দেখো না তোমার জন্য আমার মনে সঞ্চিত হওয়া ভালোবাসা। এতো অবুঝ কেনো তুমি? একটু বুঝো আমায়।”

“ দেখুন তুহিন আপনি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না কতবার বলেছি বুঝেন না কেনো। আপনি তো ছোট বাচ্চা নন। আমার থেকেও বেটার সুন্দর শিক্ষিত মেয়ে ডিজার্ভ করেন।”

“ এই মেয়ে আমি কখনও বলছি তোমার থেকে বেটার সুন্দর শিক্ষিত মেয়ে চাই আমার। আমার শুধু এই ইন্দুপ্রভা কে চাই। তার মন আমি ঠিক জয় করে নিবো। ভালোবেসেছি তোমায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয় বুঝলে? রাখি এখন কাল আবার ফোন দিব। রিসিভ করবে কেমনে শুভ রাত্রি। ”

কথাটা বলে তুহিন ফোন কে’টে দেয়। ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলে নাম্বার টা ব্লক লিস্টে রেখে দেয়। এই ছেলের জন্য না জানি কি কি প্রবলেম তাকে ফেইস করতে হয় আল্লাহ ই জানে।

পরপর দুটো লম্বা শ্বাস নিয়ে বেলকনি থেকে রুমে চলে আসে। এবার না ঘুমালেই নয়,ভাই আর মায়ের জন্য অনেক কিছু করা বাকি। তাদের সুস্থ লাইফের জন্য নিজেকে ঠিক রাখতে হবে। উপরে চরকির মতো ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে বলে-” ভুলভাল জিনিসের প্রতি ঝোঁকা যাবে না। এরা হচ্ছে ইন্দুপ্রভার জন্য নিষিদ্ধ। সবার জীবনে বিয়ে সংসার একমাত্র লক্ষ্য থাকে না। কারো কারো জীবনে এসব ব্যাতিত ও অন্য লক্ষ্য থাকে। তুহিন আপনি যে ফুল ভেবে কাটায় হাত দিচ্ছেন এটা আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক উপলব্ধি করতে পারবেন। তখন নিজেকে কি করে ক্ষমা করবো,আপনাকে বারংবার বুঝাচ্ছি ইন্দুর জীবনে কোনো ছেলের প্রবেশ নিষিদ্ধ সে বিয়ে সংসার করতে পারবে না। এসব যে তার করতে নেই তবুও বুঝেন না কেনো আপনি?”

——————-

সকালের ঝলমলে রোদ জানালা ভেদ করে রুমে ঢুকে সোজা ইন্দুর চোখে মুখে উপচে পড়ছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে ইন্দু। চোখ বন্ধ রেখেই বলে-“ দেখ ইলিয়াস মাইর খেতে না চাইলে তাড়াতাড়ি জানালার পর্দা টা টেনে দে। আমি উঠলে কিন্তু মাইর দিবো।”

এখন ও পর্দা টা সরায় নি যার কারনে চোখ মুখে রোদ এখনো লাগছে-“ কি হলো ইলিয়াস বলছি তো পর্দা টা টেনে দিতে। সাত সকাল বেলা প্রতিদিন এমন করিস কেনো?” কথাটা বলে চোখ খুলে রেগে সামনে তাকাতেই দেখে তুহিন জানালার সামনে বুকে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।

তুহিন কে এই মুহূর্তে তার রুমে দেখে যেনো ইন্দু ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। চোখ দুটো ভালো মতো কচলে আবার সামনে তাকায়। সত্যি তুহিন এটা। সহসা বিছানা থেকে নামলো ইন্দু। তুহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-“ এই আপনি আমার বাসায় আসছেন কেনো?”

তুহিনের সোজাসাপটা কথা-“ ফোন কোথায় তোমার?”

“ আমার ফোন যেখানে খুশি সেখানে থাকুক আপনি আমার বাসায় এসেছেন কেনো তার উপর আমার বেডরুমে। ম্যানার্স শিখেন নি? মা, মা এই ছেলে আমার রুমে আসলো কি করে। বাসায় ঢুকতে দিছো কেনো অপরিচিত ছেলে কে?”

মেয়ের ডাক শুনে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে মনোয়ারা বেগম। মনোয়ারা বেগম কো দেখে তুহিন বলে-“ দেখছেন আন্টি বলেছিলাম ইন্দু আমার সাথে রুড ব্যাবহার করবে দেখলেন তো তাই করলো। এখন আবার বলছে আমি নাকি অপরিচিত! আন্টি আমি কি অপরিচিত আপনিই বলেন?”

মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-“ এমন ব্যাবহার করছিস কেনো ইন্দু তুহিনের সাথে। ছেলেটার নাম্বার তুই ব্লক লিস্টে রাখছিস কেনো? সেজন্য ছেলেটা সেই ভোর বেলা থেকে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ইন্দু অবাক হয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-“ আপনার কি মাথা খারাপ। এমন করতেছেন কেনো কি চান আপনি বলেন তো?

“ আপাততঃ চাইছি তুমি আমার নাম্বার টা ব্লক লিস্ট থেকে আনব্লক করো। আর আন্টির সামনে কথা দাও আমার নাম্বার আর জীবনেও ব্লক করবা না। আন্টি জানেন আপনার মেয়ের জন্য আমাকে কত গুলো সিম কিনতে হয়েছে? দশ দশ টা, আমার কার্ড দিয়ে সিম আর তুলা যাবে না সেজন্য মায়ের কার্ড দিয়ে তুলছি। এখন যদি এগুলোও ব্লক করে তাহলে আমি সিম কোথায় পাবো তখন কিন্তু আন্টি আমি আপনার কাছে আসবো বলে রাখলাম।”

“ এই আপনি থামবেন। ”

“ ইন্দু নাম্বার টা আনব্লক কর।”

ইন্দু অবাক হয়ে বলে-“ মা তুমি বলছো এই কথা!”

“ হুমম আনব্লক কর। এই যে ছেলে শুনো তোমায় বলছি আমার মেয়ে আর তোমার নাম্বার ব্লক করবে না। এবার নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।

“ ধন্যবাদ আন্টি। আপনার মেয়ের মুখে একটু মধু দিয়েন। সবসময় তেঁতো কথা বের হয় আপনার মেয়ের মুখ দিয়ে। সেই অভ্যাস টা একটু বদলিয়ে ফেলতে বইলেন। এই যে ইন্দু আন্টি কিন্তু বলে দিছে নাম্বার ব্লক না করতে মনে যেনো থাকে। আসি আন্টি পরে আসবো আবার।”

কথাটা বলে তুহিন চলে যায়। ইন্দু তার মায়ের সামনে এসে বলে-“ এটা কি করলা মা তুমি। আমি বিভিন্ন উপায়ে ছেলেটার থেকে নিজের পিছু ছুটানোর চেষ্টা করছি আর তুমি আরো সুযোগ করে দিলে!”

“ তিন মাস ধরে তো চেষ্টা করলি পিছু ছোটাতে পারলি? তাই বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ আছে বল? ছেলেটা তো ভালোবাসে তোকে। ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। প্রায় দেখি ছেলেটা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ভালোবেসে দেখ ছেলেটা তো মন্দ নয়।”

“ মা! তুমি এসব বলছো? আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো। এসব ভালোবাসা সংসার ইন্দুর জন্য নয় এসব নিয়ে অন্য কে মিথ্যা স্বপ্ন দেখানো মানে নিজের সাথে সাথে অন্য একটা মানুষ কে ঠকানো। আমি পারবো না এটা। প্লিজ মা তুমি এটা করতে বলো না আমায়।”

“ সব টা তুহিন কে খুলে বল সত্যি কারে অর্থে ভালেবাসলে তুহিন তোর সব জেনেই তোকে ভালোবাসবে।”

“ দুর্বল জায়গা মানুষ কে দেখাতে নেই মা। তাহলে তারা আরো বেশি করে সেখানে আঘাত করে। আমার স্কুলের সময় হয়ে এসেছে খাবার দাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

কথাটা বলে ইন্দু চলে যায় ওয়াশরুমে। মনোয়ারা বেগম অসহায় হয়ে মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। মেয়ে তার বাস্তবতা দেখতে দেখতে এখন সব কিছুতেই বাস্তবতা খুঁজে।

#চলব?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে