#যে_পাখি_ঘর_বোঝে_না
পর্ব-১০(অন্তিম পর্ব)
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
বহ্নিশিখা হোটেল রুমে বসে নতুন প্রজেক্টটা দেখছিল। গত কালই জরুরি ভিত্তিতে কক্সবাজার আসতে হয়েছে ওকে। এখানে ইতোমধ্যে একটা বিলাসবহুল হোটেল গড়েছেন আলিম শেখ। আরেকটার জন্য জমিও কেনা হয়েছিল। তাঁর অসুস্থতা খবরে কিছু লোক জমিটা নিয়ে ঝামেলা পাকাচ্ছে। ম্যানেজারের পরামর্শে তাই বহ্নিশিখাকে আসতে হয়েছে। স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং ওসির সাথে কথা বলেছে সে। তাঁরা ওকে আশ্বাস দিয়েছে জমি নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে তাড়াতাড়ি। ম্যানেজার বলছিলেন জমিটা এভাবে ফেলে না রেখে দ্রুত একটা কাজ শুরু করলে ভালো হয়। বহ্নিশিখা তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছে না। এমনিতে কিছু ভুলে বেশ লস হয়েছে। এখন বুঝেশুনে কাজ করতে হবে ওকে। দিনরাত এক করে এই পেশা সম্পর্কে জ্ঞান নিয়েছে। আফরাজ এবং আলিম শেখ এর সম্পদ আর কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না ও। নতুন প্রজেক্টের ম্যাপটা ভালো করে দেখল। বায়ারদের চাহিদা মাথায় রেখে এগোতে হচ্ছে ওকে। ম্যানেজার খুব হেল্পফুল একজন মানুষ। তাঁর সাহায্য ও নিষ্ঠার কারণেই এত দ্রুত সবটা সামলে নিতে পেরেছে ও। নতুন প্রজেক্ট নিয়ে তাঁর সাথে একবার চূড়ান্ত আলাপের প্রয়োজন। ল্যাপটপ বন্ধ করে মাথা তুলতে ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করল। অনেকক্ষণ একইভাবে বসে থেকে ঘাড় লেগে এসেছে। বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ লাগিয়ে সোজা হয়ে বসল। এখান থেকে খোলা জানালার বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আজকে আবহাওয়া ভালো নয়। কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। সমুদ্রতীরবর্তী স্থানে দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত দেখানো হয়েছে। এমন কালো মেঘ দেখে ওর মনের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল। মুখ সামনে এনে দুচোখ বন্ধ করল। মনে পড়ল হাসপাতালে কথা হয় না অনেকক্ষণ হলো। তখনই মোবাইলে রিংটোন বেজে ওঠে। নীহারিকার নাম ভাসছে স্ক্রিনে। শঙ্কিত হলো কেন যেন। দ্রুত কল রিসিভ করল। ও কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে নীহারিকার উত্তেজিত গলা শুনতে পেল।
“বহ্নি আপা, আফরাজ ভাইয়া কোমা থেকে জেগে উঠেছেন।”
বহ্নিশিখা ক্ষণিকের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। চোখে পানি এলো আনন্দে।
“বহ্নি আপা, শুনছেন? হ্যালো?”
“আমি এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি নীহার। প্লিজ ওকে দেখে রেখো। আমি এক্ষুনি ফিরছি।”
খুশিতে দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল। কাঁপা হাতে ম্যানেজারের নাম্বারে কল দিলো।
“ম্যানেজার চাচা, ও কোমা থেকে ফিরে এসেছে। আমি এক্ষুনি ঢাকা যাব।”
ম্যানেজার আল্লাহ তাআ’লার শুকরিয়া করলেন এই সংবাদ শুনে। তিনি ওকে আশ্বস্ত করলেন দ্রুত ঢাকা ফেরার ব্যবস্থা করবেন। বাসায় কল করল ও। সকলকে জানাল এই খুশির সংবাদ। বকুল তখনই ছুটে যায় হাসপাতালে। রোজিনাও গেলেন। এতদূর বসে বহ্নিশিখার কেবলই মনে হলো আজ যদি দুটো পাখা দিতো ওকে সৃষ্টিকর্তা!
বাইরে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। আকাশপথে যাওয়ার পথ বন্ধ। সড়কপথে যাবে সেটাতেও ম্যানেজার নিষেধ করলেন। এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যে গেলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা আছে। বহ্নিশিখার মনের অবস্থা তখন করুণ। সে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না। নীহারিকাকে একটার পর একটা কল করছে। আফরাজকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। এখনই তাঁর সাথে কারো দেখা করা কিংবা কথা বলার অনুমতি নেই। বহ্নিশিখার ধৈর্য বাধ মানছে না। অস্থির লাগছে। একবার শুধু একবার যদি আফরাজকে ও এই মুহূর্তে দেখতে পেত!
ঝড় থামতে থামতে বিকেল গড়িয়ে এলো। এখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বহ্নিশিখা সকল নিষেধ উপেক্ষা করে রওনা হলো সড়কপথে। এই দীর্ঘ পথ যেন সহস্র বছরের মতো লাগছে আজ। ওর বুকের বা’পাশ উত্তেজনায় থেমে যাওয়ার উপক্রম। আফরাজকে দেখার আগে কি মরে যাবে? বুকের বা’পাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ম্যানেজার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে রেয়ার ভিউ মিররে মেয়েটাকে দেখলেন। হাঁপ ছাড়লেন তিনি। বৃষ্টি আস্তে আস্তে আরো বাড়ল। সামনেটা ঝাপসা হয়ে এলো। তারপর ঘন অন্ধকার। সারারাত গাড়ি চললো। ড্রাইভারকে কোথাও ব্রেক নিতে দিলো না বহ্নিশিখা। কিন্তু সড়কের জ্যামে গাড়ি থামাতেই হলো। এত রাগ হলো এই জ্যামের ওপর। ম্যানেজার খেতে বললেও ও কিছু খেল না। খেতে ইচ্ছে করছে না। বার বার বলল,
“চাচা, একটু দেখেন না জ্যাম কেন ছাড়ছে না।”
ম্যানেজার ওর মন রাখতে নেমে দেখল কয়েকবার। অনেকদূর পর্যন্ত জ্যাম। কেন এই জ্যাম বেঁধেছে কে জানে? তবুও বহ্নিশিখাকে তিনি মিথ্যা সান্ত্বনা দিলেন একটু পরই জ্যাম ছাড়বে বলে। বহ্নিশিখা অপেক্ষা করে। অস্থিরতার মধ্যেই কয়েক ঘন্টা কাটল। একটু একটু করে এগোচ্ছিল গাড়ি। মধ্যে রাতের পরে পুরোদমে গাড়ি চলল। ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়।
গাড়ি থামল হাসপাতালের গেটে। বহ্নিশিখার সমস্ত শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়। কী বলবে আফরাজের সামনে গিয়ে? একটু যেন থামল পা। ইতস্তত কাটিয়ে আবার সামনে এগোয়। আফরাজের মুখোমুখি আজ হবে ও। ওর খোলা চোখে চোখ রাখবে এত মাস বাদে। ও চোখে কার বাস বহ্নিশিখা জানে না। জানার কি প্রয়োজন আদৌ আছে? সে সব জেনেই ভালোবেসেছে। আফরাজকে পাবে না জেনেও ভালোবেসেছে। সবাই কি পাবে বলেই ভালোবাসে?
“হ্যাঁ” বহ্নিশিখার অন্তরাত্মা জবাব দিলো।
“কিন্তু আমি যে জানি তাকে পাওয়া আমার হবে না। সে ঘর বোঝে না, মন বোঝে না।”
বহ্নিশিখার চোখ দুটো বার বার ভিজে আসছিল। লিফটে চড়ে উঠে এলো ওপরে। একটু হেঁটে সামনে এগোলেই আফরাজের কেবিন দেখা যায়। বহ্নিশিখার পা ভার হয়ে এলো আফরাজের কেবিন দেখতে। দরজার কাছাকাছি আসতে ওর সমস্ত শক্তি যেন ফুরিয়ে এলো। থামল খানিকক্ষণ। তারপর এগিয়ে গেল আবার। দরজা ঠেলে সরাতে বুকটা কেঁপে উঠল। সামনে শূন্য বেড। কোথায় আফরাজ?
“বহ্নি আপা!”
নীহারিকা আর মিনা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। বহ্নিশিখা আর্ত মুখে ছুটে এসে বলল,
“ও কোথায়?”
ওদের মুখটা আরো মলিন হলো। বহ্নিশিখার হাতটা শক্ত করে ধরে নীহারিকা বলল,
“আফরাজ ভাইয়া চলে গেছে আপা।”
“চলে গেছে? কোথায়?”
“জানি না।”
“জানো না মানে কী? সে কি এখনও সুস্থ যে একা একা চলে যাবে? বলো নীহার? বলো ও কোথায়?”
“সত্যিটা বলে দাও নীহার।” মিনা গম্ভীর গলায় বলল। বহ্নিশিখা ভুরু কুঁচকে তাকায়।
“সত্যি?”
নীহারিকা বলল না বলে মিনা বলতে লাগল,
“আফরাজ সাহেব আপনার সাথে দেখা করবেন না বলেই তাড়াহুড়ো করে এখান থেকে চলে গেছেন। তাকে যেতে সাহায্য করেছে ডাক্তাররা। আমরা সামান্য নার্স। ডাক্তারদের ওপর আমাদের খবরদারি চলে না।”
বহ্নিশিখা স্তব্ধ হয়ে গেল। আফরাজ ওর সাথে দেখা করতে চায় না? এতটাই খারাপ ও আজ? টলতে টলতে বাইরে এসে বসল। নীহারিকা ওর কাঁধে হাত রাখে।
“আমার সাথে দেখা করবে না বলে চলে গেল সে? এত খারাপ হয়ে গেছি আমি তার কাছে নীহার? এত খারাপ?”
দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদল খুব। নীহারিকা জড়িয়ে ধরে দু’বাহুতে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই ওর। দু’চোখ মুছে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায় বহ্নিশিখা। অনেক কেঁদেছে আর না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। পেছনে নীহারিকা ডাকছে,
“বহ্নি আপা, বহ্নি আপা।”
না, আর পিছু ফিরে দেখবে না ও। হাসপাতালের গেটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ম্যানেজার এগিয়ে এলেন। তিনি সবাই জেনেছেন এখানে বসে। রোজিনা কল করেছিলেন তাঁকে।
“মা জননী__”
বহ্নিশিখা তাঁকে পাশ কাটিয়ে সামনে পা বাড়ায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির এক এক ফোঁটা সুচ হয়ে গায়ে বিঁধছে। ম্যানেজার ছাতা নিয়ে দৌড়ে ওর সামনে দাঁড়ালেন।
“কোথায় যাচ্ছো মা?”
“জানি না চাচা। শুধু জানি পরিচিত এই শহর ছেড়ে বহুদূরে।”
“তুমি গেলে আমরা যে পথে বসব মা। আলিম শেখ এর সব ধ্বংস হয়ে যাবে।”
বহ্নিশিখা ঠোঁট কাঁপতে লাগল কান্নার তোড়ে।
“সে তো ঠিক হয়ে গেছে চাচা। এখন আর আমাকে কী প্রয়োজন?”
“ও ঠিক হলে কি আর এভাবে আড়ালে চলে যেত? রাজ বাবা এখনও এই দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই মা।”
“আমাকে মাফ করুন চাচা। যেত দিন আমাকে। আমার বড়ো কষ্ট হচ্ছে এখানে থাকতে। যেতে দিন আমাকে।”
কাঁদবে না কাঁদবে না করেও বহ্নিশিখা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ম্যানেজার ওর মাথায় হাত রেখে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে যাও। আমাদের এক ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু আলিম শেখ এর কিছুই টিকে থাকবে না। সব শেষ হয়ে যাবে। ওই বুড়ো বুড়ির তুমিই ছিলে মা। ওই ঘরের আলো, আশা, ভরসা। তুমি গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। মানবিকতার খাতিরে হলেও একটু ভেবো কথাগুলো।”
ম্যানেজার ছাতাটা ওর হাতে ধরিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন। বহ্নিশিখা দাঁড়িয়ে রইল অশ্রুসিক্ত চোখে। সকলে স্বার্থপর হলো। একা বহ্নিশিখা কেন নিজের স্বার্থ ত্যাগ করবে তবে? কেন ভাববে ওই লোকগুলোর জন্য? কী হয় তাঁরা? যার দ্বারা সম্পর্কের সুতোয় বেঁধেছিল সেই তো সুতো ছিঁড়ে চলে গেছে। তাহলে আর কীসের দায় ওর? ছাতা হাতে আবার সামনে হাঁটে। কোনো দায় নেই, পিছুটান নেই ওর। কারো কথা ও আর ভাববে না। কিন্তু শেষমেশ সেসব কথার ওপর স্থির থাকতে পারল না বহ্নিশিখা। ঘণ্টা খানেক রাস্তায় বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে ঘুরে শেষে ফিরে এলো শ্বশুরালয়ে। রোজিনা ওর এই অপ্রত্যাশিত আগমনে আনন্দিত হলেন। জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন খুব। বহ্নিশিখার এই ফেরা কেবল শরীরের। মন থেকে সে এ বাড়িতে ফেরেনি। আফরাজ সুস্থ হলেই সে আবার চলে যাবে। ততদিনে নিজের জন্য একটা ব্যবস্থাও করে নেবে এখান থেকে বহুদূরে। মনে মনে এই ভাবনায় ভাবল ও।
দিন পেরিয়ে মাস আসে। তারপর মাসের পর মাস চলে যায়। বহ্নিশিখা আলিম শেখ-এর ব্যবসাকে আবার আগের মতো দাঁড় করিয়ে ফেলে। কক্সবাজারের ওই জমিটা নিয়ে ঝামেলা মিটে গেছে। ম্যানেজার পরমর্শ দিলেন ওখানে কিছু করার জন্য। বহ্নিশিখা তাতে সায় দেয় না। নতুন করে কোনো কাজে ও আর হাত দেবে না। ওর খুব জানতে ইচ্ছে করে আফরাজের কথা। কেমন আছে সে? কবে ফিরবে? বহ্নিশিখা কবে পাবে মুক্তি? বেতনভুক্ত কর্মচারী হয়ে আছে এখানে ও। যা বেতন পায় তার বেশিরভাগটাই জমিয়ে রাখে। কিছু মা’কে পাঠায়। বকুলের নিজের গ্যারেজ হয়েছে। এর জন্য কিছু টাকা দিয়েছিল বহ্নিশিখা। গ্যারেজটা ভালোই চলছে। বকুলরা নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। মায়ের কান্না, ভাইয়ের অনুনয়ে আর রোজেলের মায়ার টানে একবার গিয়েছিল সেখানে। ওর প্রতি নিশিতার ব্যবহার এখন অনেক নরম। পূর্বের আচরণের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে। অনুরোধ করেছে সব ভুলে যাওয়ার। সব কি ভোলা যায়? হয়তো যায়, হয়তো না, কিন্তু সম্পর্কের খাতিরে ভুলে থাকার একটা প্রয়াস তো করাই যায়।
“মা জননী আসব?”
ম্যানেজার অফিস কক্ষের দরজায় নক করেন।
“আসুন চাচা।”
“অনেক রাত হলো বাসায় যাবে না?”
“এই তো এখনই যাব।” বহ্নিশিখা ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ম্যানেজার কেন যেন উশখুশ করছিলেন। বহ্নিশিখা শুধায়,
“কিছু বলবেন চাচা?”
“না।” অপ্রস্তুত হেসে জবাব দিলেন তিনি। বহ্নিশিখার কপাল কুঁচকে যায় ম্যানেজার মুখ দেখে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলছেন না। ম্যানেজার ওর কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। বহ্নিশিখাও আর দাঁড়াল না। গাড়ি চড়ে চলে এলো শ্বশুরালয়ে। বুয়া দরজা খুলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
“ভাইজান ফিরে আইছে গো ভাবি।” দরজার মুখে থমকে গেল বহ্নিশিখা।
“ভাইজান?”
“হ, আম্মার ঘরে বইসা আছে। আমি যাইয়া খবর দিইগে আপনি আইছেন।”
বুয়া একপ্রকার দৌড়ে গেল আলিম শেখ এর ঘরের দিকে। বহ্নিশিখা দ্রুত পায়ে চলে এলো নিজের থাকার ঘরটাতে। ও এখন আর আফরাজের ঘরে থাকে না। ক্লজেট থেকে কাপড় বের করে ব্যাগে ভরল। তারপর জমানো টাকা পার্সে নিলো। ওর হাত কাঁপছে। ব্যাগে কাপড় ভরে চেইন লাগাবে তখনই শুনল রুমের লক খোলার শব্দ। খুলে গেল দরজা। বহ্নিশিখার হাত জমে রইল ব্যাগের চেইনের ওপর। কোনো শব্দ নেই এরপরে। বহ্নিশিখা নিজেকে সামলে ব্যাগের চেইন বন্ধ করল। উঠে দাঁড়াতে শুনতে পেল দরজা সশব্দে বন্ধ হলো। লকটা আবার আঁটকে দেওয়া হয়েছে। অস্থিরভাবে হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ছে ওর। শক্ত করে ধরল ব্যাগের হাতল। সেই পরিচিত পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে কাছে এগোচ্ছে। খুব কাছে আসার আগে ঘুরে দাঁড়ায় বহ্নিশিখা। ঘরটাতে আলো জ্বালানো হয়নি। বাইরে পূর্ণ চাঁদের আলো। জানালা ভেদ করে সেই আলো এসে পড়েছে আফরাজের মুখের ওপর। শান্ত, স্বাভাবিক মুখ। চোখ দুটো ছলছল। একদৃষ্টে চেয়ে পরস্পরের দিকে ওরা। আধো আলো আধো অন্ধকারে মিশে আছে বহ্নিশিখার মুখ। চোখের চাহনী স্থির, নিস্প্রভ। আফরাজ এক কদম এগোতে ও পিছিয়ে গেল অন্ধকারে। আহত হলো আফরাজ। ডাকল,
“বহ্নিশিখা!”
বহ্নিশিখার জবাব নেই। আবার বলল,
“কথা বলবেন না আমার সাথে বহ্নিশিখা?”
“আমাকে যেতে দিন।” নিরস গলায় বলল বহ্নিশিখা। আফরাজ সরে না ওর সামনে থেকে।
“চলে যাবেন?” হতাশ শোনাল গলা। তারপর পকেট থেকে দুটো খাম বের করে ওর সামনে ধরে।
“এটা কী?”
“আমার নির্দোষ হওয়ার প্রমাণপত্র আর_” আফরাজের গলা থেমে যায়। বহ্নিশিখা বলে,
“আর?”
“খুলেই দেখুন।”
বহ্নিশিখা এগিয়ে এলো আলোতে। ব্যাগটা নিচে নামিয়ে খাম দুটো হাতে নিয়ে ঘরের লাইট জ্বালালো। আফরাজকে এখন আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পরনে আকাশী রঙের শার্ট আর কালো প্যান্টের ক্যাজুয়াল লুক। চুলগুলো বিন্যস্ত করে ব্রাশ করা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখ নামিয়ে নিলো বহ্নিশিখা। ওর পাশ কাটিয়ে বিছানার এককোণে বসল। খামের মুখ ছিঁড়তে আফরাজের গলা শুনল,
“আপনি অনেক শুকিয়ে গেছেন বহ্নিশিখা।”
তাচ্ছিল্যের সাথে হাসে ও। আফরাজের নজর এড়ায় না সে হাসি। আজ বহ্নিশিখার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করে। অপরাধী মুখে ওর পাশে বসল। দু হাঁটুর ওপর রাখল কনুই। দুহাত এক করে থুতনির নিচে রেখে অপলক চেয়ে রইল। বহ্নিশিখার অস্বস্তি হচ্ছে। এসব খামটাম খোলার দরকার কী ওর? এতকিছুর পরেও আফরাজের পাশে বসে থাকা একপ্রকার আত্মসম্মানহীনতা। চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু যেতে পারল না। যে ভালোবাসে সে সহজে ছেড়ে যেতে পারে না। হয়তো সেই জন্যই ও যেতে পারল না। প্রথম খামটাতে রাহা এবং আফরাজের সেই ছবিগুলো। যেখানে ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে। একেকটা একেক এঙ্গেলে তোলা, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের। বহ্নিশিখার চোয়াল শক্ত হলো। যা দেখলে হৃদয় পোড়ে তাই কেন বার বার দেখতে হচ্ছে? ছবিগুলো একপাশে সরাতে ভেতরে কাগজ দেখতে পেল। খুলে দেখে ওটা ওই হোটেলের কাগজ। আফরাজ এবং রাহার হোটেলের কক্ষ আলাদা।
“কক্সবাজারের হোটেল তৈরির সময়কার কথা। আব্বু অসুস্থ ছিলেন। তাই আমাকেই যেতে হয়েছিল সেখানে। আমি জানতাম না ওই একই হোটেলে রাহা উঠেছে। রাতে রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছিলাম। তখনই দেখা ওর সাথে। একই কলেজে পড়তাম আমরা। পরিচয় আগে থেকেই ছিল। সেদিন টুকটাক কথাবার্তা হলো। এর পর নাম্বার আদার প্রদান। আস্তে আস্তে সম্পর্কে জড়লাম। আমাকে তখন মিথ্যা বলেছিল ও সিঙ্গেল। আমি বরাবরই সিরিয়াস সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলাম না। কেন ছিলাম না তা হয়তো তুমি জানো। রাহাকে সবটা বলেওছিলাম। তারপরও ও বলেছিল একটা চেষ্টা করতে দোষ কী। আমিও ওর কথাতে রাজি হলাম। আমি জানতাম না আমাকে এবং আরশাদকে ও একই সময়ে ডেট করত। আমার কাছে রাহা ছিল টাইম পাস কিন্তু আরশাদ ওকে মনপ্রাণে ভালোবাসত। টাইম পাস হলেও ওর প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম একসময়। আমার এখনও মনে আছে সেদিনের কথা, রাহার সাথে বেশ সময় কাটাতে শুরু করেছিলাম। শারীরিকভাবে আকর্ষণ বোধ করছিলাম দুজনই। হ্যাঁ, ওর সাথে আমার ফিজিক্যাল কোনো রিলেশন হয়নি। হয়তো হতো সেদিনই। হোটেল রুমে দুজনই দাঁড়িয়ে। হঠাৎ রাহা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি নিজেও আর আপত্তি করলাম না। অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছিলাম। কে জানত এসব ফাঁদ। আমাকে পাওয়ার জন্য ফাঁদ পেতেছিল ও। কারণ অবশ্যই আমার বাবার অঢেল সম্পদ। আরশাদের পারিবারিক অবস্থা আমাদের মতো অতটা ভালো নয়। সুতরাং আমি ওর কাছে ফার্স্ট চয়েস ছিলাম। সবই ওর প্লান মতো হচ্ছিল। ওই যে ছবি ওটা সেই সময়ের। খুব কাছাকাছি ছিলাম তখন দুজন। হঠাৎ রাহার মোবাইল বেজে উঠল। আসছি বলে ও চলে গেল ব্যালকনিতে। ফিরল ফ্যাকাসে মুখে। জিজ্ঞেস করতেও ঠিক জবাব দিলো না। জরুরি কাজ আছে বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। আমার বেশ সন্দেহ হলো ওর হাবভাবে। পিছু নিলাম। এবং তখনই সামনে এলো ওর আসল চেহারা। আরশাদ হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর এই আগমন হঠাৎ। ওর বাহু ধরে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রাহা। রাহা বোধহয় আপাতত চাইছিল না আমাদের একসাথে ওই অবস্থা আরশাদ আবিষ্কার করুক। আমাকে পেছনে দেখতে পেয়ে ওর মুখের রঙ উড়ে গেল। নিজের ওপর এত হাসি পেয়েছিল সেদিন। মেয়েদের প্রতি বিশ্বাসই উঠে গেল। আরশাদ আমাকে দেখার আগেই সেখান থেকে সরে পড়েছিলাম। আমি ওর মনে কষ্ট দিতে চাইনি বহ্নিশিখা, কোনোদিনই না। পারিবারিক কারণে আমি এমনইতেই সংসার বিমুখ ছিলাম। সেদিনের পর সব রকমের সম্পর্কে বিতৃষ্ণা চলে এলো। রাহা আমাকে এই ছবি দেখিয়ে ব্লাকমেইল করতে লাগল। আব্বুর পর্যন্ত এলো ছবিগুলো। ওইদিনই আব্বুর হাতে প্রথম চড় খেয়েছিলাম। খুব রেগে ছিলেন আমার ওপর তিনি। মানসম্মানের ভয়ে আমাকে ফ্রান্স পাঠিয়ে দিলেন। পরে শুনেছিলাম রাহাকেও মোটা অংকের টাকা দিয়েছিলেন মুখ বন্ধ রাখতে। আমার অনুরোধে আরশাদকে আব্বু কিছু বলেননি। ভেবেছিলাম সময় সুযোগে বলব। কিন্তু আরশাদ হঠাৎ পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে রাহাকে বিয়ে করাতে ওর সাথে না চাইতেও যোগাযোগ বন্ধ করতে হয় তখন। এর পর রাহার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।” বহ্নিশিখার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“রাহাকে আমি সতর্ক করেছি। ওর নামে জিডিও করা হয়েছে। বুদ্ধিমতি হলে আমার রাস্তায় কোনোদিন আসবে না ও। ও আমার কিছু ছিল না, কিছু নয়ও, বহ্নিশিখা। আমার যদি কেউ কিছু হয় তবে সেটা একজনই।”
বহ্নিশিখা চোখ নামিয়ে নেয়। জিজ্ঞেস করে না সেই একজন কে। আফরাজ এক পলকের জন্য ওর ওপর থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না। এই মেয়েটিকে দেখবে বলে সে মাসের পর মাস ধৈর্য ধরেছে। নিজেকে তৈরি করেছে ওর যোগ্য হিসেবে। ও যদি আজ চলে যায় আফরাজ বাঁচতেই ভুলে যাবে আবার। ওর কারণেই তো ওর বাঁচার এত আগ্রহ। ওর কারণেই ও আবার ফিরে এসেছে মৃত্যুকে হারিয়ে। ও চলে গেলে কেমন করে চলবে আফরাজ? হঠাৎ খাম দুটো বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ায় বহ্নিশিখা। আফরাজ ওর হাতটা ধরে আর্ত কণ্ঠে বলল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
ক্ষিপ্র গতিতে হাত ছাড়িয়ে নেয় বহ্নিশিখা। ব্যাগটা হাতে তুলে নিলো। আফরাজ ওর ব্যাগ টেনে ধরে।
“আমি আপনাকে কোথাও যেতে দেবো না।”
“কেন? কেন যেতে দেবেন না?”
আঁজলা ভরে বহ্নিশিখার মুখটা তুললো। কাতর গলায় বলল,
“আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না বলে যেতে দেবো না। ভালোবাসি আপনাকে আমি বহ্নিশিখা।”
“মিথ্যে কথা। গত আট মাস তো আমাকে ছাড়াই চলছে বাকি মাস, বছরও চলবে। ছাড়ুন।”
“আট মাস চলেছে তবে বড়ো দুঃসহভাবে, প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায়। আগামী জীবনে আপনাকে আপন করে পাওয়ার আশায় কেটেছে গত আট মাস আমার।”
“মিথ্যে বলছেন। আপনি আমাকে চান না। আর তাইতো হাসপাতাল থেকে ওমন করে চলে গিয়েছিলেন। আমি আপনার কেউ না বলেই চলে যেতে পেরেছিলেন।”
বহ্নিশিখার চোখ ভরে আসে জলে। আফরাজ ওর মুখ আরও কাছে এনে বলে,
“মাফ করুন আমাকে। আপনাকে কষ্ট দিতে নয় বরং আপনার কষ্ট চিরতরে ঘুচাতে ভীরুর মতো পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। দ্বিতীয় খামটা ছিল আমার থ্যারাপিষ্টের। আমার সুস্থতার প্রমাণ ওটা।আমার জন্য অনেক সয়েছেন আপনি। এর শেষ চেয়েছিলাম। তাইতো আপনার উপযুক্ত হতে আড়ালে ছিলাম। জানি ঠিক হয়নি তখন ওভাবে চলে যাওয়াটা। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি আমি। এই যে আমি, এই আমি সম্পূর্ণ আপনার বহ্নিশিখা। আপনার হয়েই এসেছি। আপনাকে ভালোবেসে এসেছি। বিশ্বাস করুন আমাকে।”
বহ্নিশিখা মাথা নাড়ায় দুদিকে। সরে দাঁড়ায় দু কদম পিছিয়ে। আফরাজের মুখটা করুণ হয়।
“আপনি আমাকে বিশ্বাস করলেন না?”
“না।”
আফরাজ মাথা হেট করে রইল। বিশ্বাস কি হুট করে আসে? ওর থ্যারাপিষ্টের কথা মনে পড়ল। বিশ্বাস অর্জন করতে হবে সময় নিয়ে। সম্পর্কে তাড়াহুড়ো করতে নেই। ধৈর্য ধরতে হবে। মুখ তুলল ও।
“আমাকে তবে একটা সুযোগ দিন আপনার বিশ্বাস অর্জনের। কথা দিচ্ছি এবার আর হতাশ করব না।”
ফের মাথা দুদিকে নাড়ায় বহ্নিশিখা।
“না।”
“না?” আফরাজ আশাহত মুখে চেয়ে রইল। বহ্নিশিখা চোখ মুছে বলে,
“যে লোক বিয়ে করা বউকে আপনি আপনি করে তাকে আমি সুযোগ দেবো না।”
ব্যাগটা পুনরায় নিতে গেলে আফরাজ ওটা টেনে দূরে ফেলে দিলো।
“এটা কী হলো?”
“তোমাকে যেতে দেবো না আমি বহ্নিশিখা। এর জন্য আপনি বলা কেন আরও অনেক কিছু ছাড়তে পারি আমি। আর আপনি বলব না, কোনোদিনই না। প্লিজ যেয়ো না আমাকে ছেড়ে।”
“আমাকে একটু একা থাকতে দিন মি.শেখ। প্লিজ।”
পিঠ আফরাজের দিকে করে বিছানার এককোণে বসল ও। আফরাজ হাঁপ ছেড়ে দরজার দিকে যায়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
“আমি আর সেই ভীরু, দুর্বল আফরাজ নেই বহ্নি। তোমাকে হারানোর ভয়ে আত্মহত্যা করতে যাব না আজ আর। তোমাকে জয় করতে এসেছি এবং জয় করবই।”
আফরাজ ওর রুম ছেড়ে যেতে বহ্নিশিখা বিছানার উবু হয়ে কাঁদতে লাগল। যাকে পাবে না বলে ভেবেছিল আজ সেই মানুষটা ওকে জয় করতে চায়। আফরাজ ওকে ভালোবাসে রাহাকে না। বহ্নিশিখা বুঝতে পারে না আজ ও কেন কাঁদছে। এই আফরাজকেই ও চেয়েছিল। সে তো আজ ওর হয়ে এসেছে। তবে কেন ওকে পাওয়ামাত্রই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারল না? কীসের এত সংকোচ, বাধা?
সারারাত আফরাজের ঘুম হলো না। বহ্নিশিখারও একই অবস্থা। দুইজন দুই বিছানায় এপাশ ওপাশ করে রাতটা পার করল। খুব ভোরে উঠল আফরাজ। নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেল। সৃষ্টিকর্তার ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাসেই মানুষ বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বিশ্বাসের খুঁটি মজবুত হয়। নিজের ওপর যে বিশ্বাস রাখতে পারে সে অপরের বিশ্বাস অর্জনে এক কদম এগিয়ে যায়। নামাজ আদায় করে এসে আব্বুর কাছে কিছুক্ষণ বসল। ক্ষমা করতে পারাতেও সুখ আছে। যত অসুখের মূল তো ঘৃণা, ক্রোধ আর দোষ ধরে রাখার প্রবৃত্তি। পিতাকে আফরাজ ক্ষমা করে দিয়েছে। পিতার সুস্থতার জন্য রোজ দোয়া করেছে। রোজিনা ছেলের মাথায় হাত রেখে আদর করে দিলেন। আপন সন্তান নেই তাঁর। আফরাজ আর বহ্নিশিখাকেই আপন সন্তানতূল্য মনে করেন। বাবা আর মামনির সাথে সকালের কিছু সময় কাটিয়ে উঠে এলো। আরশাদের সাথে একবার দেখা করা দরকার। মোবাইল কথা হয়েছে ওদের। আফরাজের কথা বিশ্বাস করেছে ও। ফিরে আসতে বলেছে আফরাজ ওকে। আরশাদ সময় চেয়েছে। কথা দিয়েছে ফিরবে একদিন ও। সেদিনের অপেক্ষায় আছে আফরাজ।
বহ্নিশিখা ঘুম থেকে জেগেছে। বুয়ার সাথে রান্নাঘরে নাস্তার ব্যবস্থা করছে এখন। আফরাজ দরজায় দাঁড়িয়ে অপলক ওকেই দেখতে লাগল। বহ্নিশিখা প্রথমে খেয়াল করেনি। বুয়ার মিটিমিটি হাসি দেখে পেছন ফিরতে আফরাজকে দেখল। সাদা পাঞ্জাবিতে চমৎকার লাগছে ওকে। ঠোঁটে সেই মোহনীয় মুচকি হাসে। বহ্নিশিখা চোখ ঘুরিয়ে আবার কাজে ব্যস্ত হলো। নাস্তা বানানো শেষ হতে আফরাজকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে গেল। গোসলটা সেরে অফিসের জন্য তৈরি হবে। ক্লজেট থেকে নতুন একটা শাড়ি বের করল। মেরুন আর নীলের মিশেলে শাড়িটা। গোসল শেষে ভেজা চুলে তোয়ালে জড়িয়ে বের হলো ও। বিছানার ওপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে আফরাজ। বহ্নিশিখা ওকে দেখতে শুকনো ঢোক গিললো।
“আপনি?”
আফরাজ উঠে এলো। ওর চোখে চোখ রাখতে পারল না বহ্নিশিখা। বড়ো নেশাতুর দৃষ্টি। আফরাজ ওর খুব নিকটে এসে দাঁড়ায়। তর্জনীতে থুতনি তুলে বলে,
“দুরত্ব এবার কমাও না বহ্নিশিখা। আমার অপরাধ মার্জনা করো। কাছে আসার অনুমতি দাও আমাকে। তোমাকে সুখী করার আরেকটা সুযোগ আমাকে দাও বহ্নি।”
ওর চোখে চোখ রেখে নির্বাক বহ্নিশিখা। ঠোঁট দুটো ঈষৎ কেঁপে ওঠে। আফরাজ ঝুঁকে সেদিকে চেয়ে বলে,
“একটা আবদার রাখবে?”
“হুঁ?”
“চুমু খেতে দেবে?”
দুচোখ বন্ধ করে মৃদু মাথা নাড়াতে আফরাজের উষ্ণ অধর নেমে এলো ওর ঠোঁটের ওপর। মুখের সবটা যেন দখল করে নিলো। বহ্নিশিখার হাত দু’টো আঁকড়ে ধরে ওর চুল। দুরত্ব যথার্থই ঘুচে যায়, চিরতরের জন্য ঘুচে যায়। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেশে। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে আছরে পড়ে মিলনের তানপুরার উন্মত্ত সুর লহরী। সুরের মূর্ছনা যখন শিরায় শিরায় থিতু হয় তখন সব শান্ত। সর্বত্র কেবল সুখ আর সুখ। আফরাজের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে বহ্নিশিখা। ওর কপালে চুমু দিয়ে গালে হাত বুলিয়ে আফরাজ বলে,
“আমি ঘর বুঝি না বহ্নিশিখা কেবল তোমাকেই বুঝি। তুমিই আমার ঘর, তোমাতেই আমার সব।”
সমাপ্ত
ছবিঃ সংগ্রহীত