যেমন শাশুড়ি তেমন বউ
(পর্ব- ২)
আমার জন্য শাশুড়ি’মা না খেয়ে থাকবে তা আবার হয় নাকি! এ তো আমারই ব্যর্থতা, পরাজয়। কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছু একটা করতেই হবে আমাকে, নতুন বাড়িতে এসে নতুন সম্পর্কের মানুষগুলোকে অভুক্ত রাখবো, তা কি করে হয়। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তোলে তেমনি রাগ দিয়েই রাগ জয় করতে হবে।
আমি টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে শান্ত গলায় বললাম, আপনি খান বা না খান, তাতে আমার কি। মা আপনি যে বললেন, রাত পোহালেই কেরামতি করে আমায় বাড়ি ছাড়া করবেন তাই ভাবলাম কেরামতিটা দেখবো কিন্তু তা আর আমার ভাগ্যে নেই। আপনি যদি না খেয়ে থাকেন তাহলে মাথা ব্যথা করবে, পেটে ইঁদুরের কিচিরমিচির আওয়াজ পাওয়া যাবে আর তখন মাথায় কোন বুদ্ধি আসবে না। তাই আমার আর কেরামতি দেখা হল না। আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়ুন মা, না খেয়ে কি কেরামতি দেখানো যায়! চিন্তা করবেন না, আমি সবাইকে বলে দেব মা কেরামতি দেখাতো যদি পেটে ইঁদুরগুলো চুপচাপ থাকত। কেরামতির কথা ভুলে যান মা..
শাশুড়ি’মায়ের রাগান্বিত লাল চোখ আর চিন্তিত চেহারাই বলে দিচ্ছে আমার আর কিচ্ছু করতে হবে, যা করার উনি নিজেই করবেন। আমি শাশুড়িকে কিছু বলার সু্যোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমি জানি উনি ঠিক খাবেন, উনিও প্রচণ্ড জেদি আর জেদি মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি ভয় পায় হারতে। তাই উনি ঠিক খাবেন। ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে বাহিরে রাহাতকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মায়ের ভয়ে কেমন বাহিরে চুপচাপ অপেক্ষা করছে, কি ভীতু রে বাবা!
– ঘরের বাহিরে কি করছ তুমি? আমাদের মা আর মেয়ের কথা শোনার জন্য আড়ি পেতেছ!
– বয়েই গেছে,,আঙ্কেল ফোন করেছে!…
– আঙ্কেল? কে আঙ্কেল?
– কে আবার, তোমার বাবা!
– ও আচ্ছা, তোমার বাবা- মা আমার বাবা মা আর আমার বাবা মা কি না তোমার আঙ্কেল আন্টি! খুব ভালো।
বলতে বলতেই বাবার ফোন
– বাবা..
– হ্যা মা, কেমন আছো? একবার ফোন ও দাওনি! তোমাকে নিয়ে কোন অশান্তি হচ্ছে না তো?
– ভালো আছি বাবা, তুমি ভালো আছো? না বাবা কোন অশান্তি হচ্ছে না, এ বাড়ির সবাই খুব ভালো। বাবা মা তো ভীষণ ভালোবাসে আমাকে। মেয়ে করে নিয়েছে।
– ও, সেজন্যই বুঝি বাবা মাকে ভুলে গেছো?
– না বাবা, একটু ব্যস্ত ছিলাম। বোঝোই তো…
আচ্ছা বাবা এখন রাখছি, কেমন?
-আচ্ছা মা, ভালো থেকো।
রাহাত হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-ওই ভিতুরাম, মুখে মাছি ঢুকে যাবে! কি দেখছ এভাবে?
– দেখছি জেদি মেয়েটা কেমন সংসারটা আগলে নিচ্ছে!
– ইসসস, এটা বুঝি আমার সংসার না! আর ওরা সবাই আমার খুব আপন। তুমি তো জানো আমি এমনই স্বপ্ন দেখতাম আমি কখনোই একাকী থাকবো না, একাকীত্ব আমায় ছুতেই পারবে না।
– তুমি পারবে তো?
– না পারলে আর কি! তোমার ঘরে নতুন আরেকটা বউ আসবে আর আমি চলে যাব তোমার থেকে দূরে বহুদূরে।
– কি যে বলো না!
– হুম, তোমার মা আমাদের বিয়েটা মেনে না নেয়া পর্যন্ত এই বিয়ের কোন মূল্য নেই তোমার বা আমার কাছে, শুধু মাকে বলা যাতে কিছু করতে না পারে।
– আচ্ছা। মা খেয়েছে?
– না খাবে।
আমার জন্য তোমাদের মা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরে গেল! আমি তোমাদের সবার সামনে যখন মাকে হেনস্তা করি তখন তোমাদের খুব কষ্ট হয় আমি জানি, আমারও হয় কিন্তু শক্ত না হলে যে মা আমাকে তোমার থেকে, তোমার পরিবার থেকে আলাদা করে দেবে। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না রাহাত। প্লিজ..
– পাগলী মেয়ে, আমি সব জানি। আমি তোমার পাশে সবসময় আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।
– হুম, আমার ভিতুরামটা।
– আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পোহাতে হচ্ছে, অথচ আমার কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই!
বলতে গিয়ে রাহাতের চোখ ছলছলিয়ে উঠল।
– একদমই না, ভালোবাসায় কষ্ট না থাকলে প্রাপ্তির মূল্য থাকেনা আর কেউ মনেও রাখেনা, বুঝেছেন মি.ভীতুর ডিম।
– আমি একটু বাবার কাছে যাই, কিছুক্ষণ গল্প করে আসি।
বলেই বাবার ঘরের দিকে রওনা দিলাম। রাহাতের কিছু বলতে গিয়ে থেমে যাওয়াটা চোখ এড়ালো না।
-বাবা, আসবো?
-আয় মা।
– বাবা কি করছেন?
– কিছুনা রে মা মা, একটু বই পরছি। তুই ঘুমাসনি যে?
-এমনি।
বাবা একটা প্রশ্ন করবো?
– কর?
– মাকে তোমরা খুব ভয় পাও তাইনা?
– হু, যা রাগ! সামলানো খুব কঠিন কাজ।
– তবে তোমরা যাই বলো মা কিন্তু মনে মনে ভীষণ শিশু, রাগ করে বটে কিন্তু হৃদয়ের ভেতরের পুরোটা ভালোবাসায় ভরা। ভালোবাসাগুলো প্রকাশ করতে পারেনা বলেই সবসময় রাগ দেখায় আর তোমরাও তো মার আশেপাশে খুব কম যাও, হয়তো তারও ভালোবাসার প্রয়োজন তাই জন্য না পাওয়ার যন্ত্রনায় এমন রাগী হয়ে থাকেন। মা কিন্তু আসলে মনের দিক দিয়ে ভীষণ নরম মানুষ।
-আমরা এতোদিনে ও যে মানুষটার মধ্যে ভালোবাসা খুঁজে পাইনি আর তোকে এতোটা অপমান করার পরও তুই কিনা তার হয়ে কথা বলছিস!
– বা রে, বলব না? উনি তো আমার মা আর আমি মেয়ে, মা মেয়ের মধ্যে অমিল অশান্তি হয়না বুঝি!
-পারবি না মা ওকে মনের মত করে সাজাতে?
– তোমরা পাশে থাকলে ঠিক পারবো।
আচ্ছা বাবা, আমি তোমার ছেলেকে এভাবে বিয়ে করেছি এতে তোমার আমার উপর কোন রাগ নেই!
– না রে মা।
অনেক রাত হয়েছে যা ঘুমিয়ে পর, সকাল হলেই আবার শুরু হয়ে যাবে দেখিস। সামলাতে হবে তো তোকেই…
– আচ্ছা বাবা, শুভরাত্রি।
– শুভরাত্রি।
রাত এখন আর কত! সবে তো সাড়ে এগারোটা, রাত একটা দুইটায় ঘুমায় আর সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠাটা আমার অভ্যাস কিন্তু এ বাড়ির সবাই নিশ্চয় খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠে, আমি কি পারবো! আমাকে কেউ তুই করে বললে আমার তার ওপর খুব রাগ হয় কারন আমার বাবা একমাত্র আমায় বকার সময়টাতেই তুই বলতো, এজন্য মনে হত কেউ তুই বললেই আমাকে বকছে। অথচ বাবার মুখে আজ তুই ডাকটা এতো মধুর লাগলো কেন? যেন কতটা ভালোবাসায় ঘেরা ডাক এটা, কতশত মায়া মাখা এই ডাকে। কত অপূর্নতা ছিল আমার, এই বাড়িতে একদিনেই কত কিছু পেয়ে গেছি তাও আবার না চাইতেই!
ভাবতে ভাবতেই ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু একি! আমার ভীতুরামটা ঘুমায়। কি মায়া ভরা এই ছেলেটার চেহারা, ওকে ভালো না বেসে কেউ থাকতেই পারবে না!! ঘুমের ঘোরে ভীতুরামটাকে দুঃখ কষ্ট ছুতে না পারা ছোট্ট শিশুটার মতোই লাগছে। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি ঠিক মনে নেই।
…..
ননদের চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে উঠলাম, কোন বিপদ হয়নি তো! বাড়িতে কি আগুন লেগেছে? না কি বাড়িতে ডাকাত পরেছে? চোখ মলতে মলতে রাহাতকে বললাম।
-আমাকেই মা পাঠিয়েছিল তোমাকে ডাকতে কিন্তু তুমি কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলে তাই ডাকতে ইচ্ছে হয়নি।
– কেন জাগাও নি তুমি? মা মনে হয় প্রচণ্ড রেগে গেছে।
ঘুমে ঢুলতে ঢুলতেই ঘর থেকে বের হলাম। ঘড়িতে এখনও ৭টায় বাজেই নি, ১০টার আগে কখনো ঘুম থেকে জেগেছি কি না আমার নিজেরই জানা নেই। আহা শ্বশুরবাড়ি! আহা সংসার! একদিনেই কেমন সব নিয়ম আমি মানতে শিখে গেছি। বসার রুমে প্রায় সবাই উপস্থিত, শুধু আমি আর রাহাত বাদে। রাহাত আমার পিছনে পিছনে আসছে। মায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে! মা মনে হয় খুব ক্ষেপেছে, সত্যিই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। আজ কপালে কি আছে আল্লাহই জানে!!
(চলবে…)
কামরুন নাহার নিকষ্ কালো স্মৃতি