মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-০৮

0
443

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৮

ধ্রুবর বলা তিন তালাক শুনে বেলা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। পা ভেঙে আসছে তার, শরীর কাঁপছে। ভাইকে কান্না আটকানো গলায় বলে,” ভাইয়া, আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, বুকটা ভারী ভারী লাগছে, ওই লোকটা আজ থেকে আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল! সে আমার ব্যক্তিগত মানুষ হয়ে কেন থাকল না? প্রিয় মানুষগুলো কেন থেকে যায় না, ভাইয়া? তারা কি জানে না তাদের অভাবে আমরা তিলেতিলে শেষ হয়ে যাই? আত্মহ*ত্যা অপরা**ধ অথচ বেঁচে থাকা কত কঠিন হয়ে গেল আমার জন্য!”

ওয়াহাজ বোনকে শক্ত করে ধরে সবার উদ্দেশ্যে বলে, ” এখানে তো সব কাজ শেষ তাই না? আমি আমার বোনকে এখন নিয়ে যেতে পারি? আমি চাই না আমার বোন এখানে আর একটা মুহূর্ত কাটাক।”

সেখানে বসা কয়েকজন জানায় এখানে সব কাজ শেষ এখন বেলাকে নিয়ে ওয়াহাজ চলে যেতে পারে।

ওয়াহাজ আন্তরিকতার সাথে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বেলাকে জিজ্ঞেস করে, ” তোমার সব জিনিসপত্র তো গুছিয়ে রাখা হয়েছে তাই না? আমি চাই তোমার একটা কাপড়ের টুকরোও যেন এখানে না থাকে বুঝতে পেরেছ আমার কথা? তোমার ব্যবহারের সব জিনিস তুমি নিয়েছ? সেটা নতুন হোক বা পুরাতন হোক। ”

বেলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, ” হ্যাঁ আমার সব নেওয়া হয়েছে। ”

বেলা থেমে অসহায়ের মত আবার বলে ওঠে, ” ভাইয়া, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি। বাড়ির ভেতরে আমি আর ঢুকবো না। তুমি কি প্লিজ ওগুলো বাহিরে নিয়ে আসবে? ”

ওয়াহাজ মুচকি হেসে বলে, ” তুমি এখানে পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করো, আমি সবকিছু নিয়ে আসছি। ”

বেলা তার ভাইয়ের কথা অনুযায়ী সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওয়াহাজ জাহিদা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আপনাদের আবার মনে হবে না তো যে আমার বোন আপনাদের বাড়ি থেকে কোন কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে? না মানে, হতেই পারে মনে। আপনারা কেউ চাইলে বেলার ব্যাগ পত্র চেক করে দেখতে পারেন, আমার এখানে কোন আপত্তি থাকবে না। ”

জাহিদা বেগম বিরক্ত হয়ে বলে,” ঊনিশ লাখ টাকা দিলাম, সব গহনা ফিরিয়ে দিলাম বাড়িতে আর কি আছে যে আপনার বোন নিয়ে যাবে? ”

বেলা বলে ওঠে,” আমাকে নিজে থেকে আপনারা কিছু দেননি। আর বললেন ঊনিশ লাখ টাকার কথা, সেটা পুরোপুরি আমার টাকা এখানে আপনাদের এক পয়সাও নেই। আর যা গহনা ছিল সেটাও আমার ছিল। আপনারা তো আমাকে বিয়েতে কিছু দেননি, তাই এখানেও আপনাদের কোন অধিকার নেই। এই পাঁচটা বছর আমিই আপনাদের যা দেওয়ার দিয়েছি।”

ওয়াহাজ বেলা মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে সে একজন লোককে সাথে করে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যায় বেলার জিনিসপত্র নিয়ে আসতে।

বেলা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই একভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। আশেপাশে থেকে কিছু মহিলা বেলার কাছে এসে কথা বলে। বিকেলে যে মহিলাটি বেলা কে কথা শুনিয়েছিল তিনিও এসে বেলার কাছে মাফ চান।

বেলা মুচকি হেসে বলে, ” আমি তো মাফ করে দিচ্ছি কিন্তু আমার রুহু কাউকে মাফ করছে না। তবে একটা কথা বলবো আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিবেক দিয়েছে আমাদের উচিত বিবেককে কাজে লাগানো। নিজেদের প্রতীক খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন বিবেকহীন পশুর মত হয়ে না যাই। ”

ওয়াহাজ সব জিনিসপত্র নিয়ে বাহিরে আসে। সেগুলো নিয়ে সোজা রাস্তার পাশে রাখা গাড়িতে উঠায়। লোকজন বেলার চলে যাওয়া দেখার জন্য দলবেধে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওয়াহাজ জিনিসপত্র গাড়িতে রেখে বেলার পাশে এসে দাঁড়ায়।

বেলাকে বলে,” চল, আমাদের বাসায় যেতে হবে। অনেকরাত হয়ে গেছে। ”

বেলা ওয়াহাজকে বলে,” ভাইয়া তুমি এগোও, আমি আসছি। না না, দাঁড়াও একসাথেই যাই। ”

ওয়াহাজ বোনের কথামতো সেখানেই দাঁড়ায়। বেলা ধীরপায়ে লিলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লিলি বিরক্তমুখে অন্যদিকে তাকায়। বেলা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” স্বামীকে দেখে রাখবেন। সে আমাকে ছেড়ে আপনাকে বেছে নিয়েছে, আপনার কাছে গিয়েছে। আমার মতো তাকে অন্ধবিশ্বাস করবেন না, পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করতে নেই৷ আপনার মতো নারী অনেক আছে। তাদের রাস্তাঘাতে অহরহ দেখা যায়৷ এদের বিবেক নেই, ঠিক আপনার মতোই এরা অন্যের স্বামীকে নিজের রূপ-যৌবন দেখিয়ে বশ করে নেয়।”

লিলি বেলার দিকে আঙুল উঠিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” দেখুন, আপনি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে….”

বেলা লিলিকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে,” আমি সীমা অতিক্রম করিনি৷ আপনাকে সাবধান করে দিলাম, স্বামীকে দেখে রাখবেন। আপনি একা না যে অন্যের স্বামীকে কেড়ে নিলেন, আপনার মতো অনেকে আছে। সো সচেতন থাকবেন।”

লিলি আবার কিছু বলবে ঠিক তখনই বেলা ধ্রুবকে বলে,” প্রথম বউকে ভালো না লাগায় দ্বিতীয় বিয়ে করলেন৷ দ্বিতীয় বউকে ভালো না লাগলে কি তৃতীয় বিয়ে করবেন? তারপর তাকেও ভালো লাগলে চতুর্থ? তারপর এভাবে কতগুলো বিয়ে করবেন? রাস্তার কুকুর কি বাদ যাবে? ”

ধ্রুব চিৎকার দিয়ে ওঠে,” বেলা!”

ওয়াহাজ দ্রুত পায়ে এসে বেলার পাশে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর দিকে রাগী চোখে তাকালে ধ্রুব চোখ নামিয়ে নেয়৷

বেলা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,” আপনার পছন্দ করা বউকে ভালো রাখবেন৷ আর হ্যাঁ চরিত্র ঠিক করে রাইখেন৷ আমি কোনকিছু না করে ছেড়ে যাচ্ছি, সবাই কিন্তু তা করবে না।”

ধ্রুব আর কিছু বলে না। জাহিদা বেগম বেলার কথাবার্তা সহ্য করতে না পেরে চলে যাবে এমন সময় বেলা তাকেও উদ্দেশ্য করে বলে,” আর আপনি৷ আপনি শেষে এসে অন্ধ হয়ে গেলেন? পৃথিবীর নিয়মের বাহিরে আপনি আসতে পারলেন না। কী জঘন্য খেলা খেললেন আপনি শেষে! আপনার মতো ধূর্ত শাশুড়ী আমার কোন কাছের মানুষের না হোক। শেইম অন ইউ। নারী হয়ে নারীর পাশে থাকতে পারলেন না। গিরগিটির মতো রঙ ঠিকই পাল্টালেন৷ আল্লাহ আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করবে না৷ আমি আপনার সম্মানের কথা ভেবে আর কিছু বললাম না তবে এর ফল আপনাকে পেতেই হবে। নাহ, আমি নিজে আপনাদের কোন ক্ষতি করব না। আমি আমার রবের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি, তার চেয়ে বড় বিচারক আর কেউ হতে পারবে না। প্রত্যেকে ফল পাবেন।”- তানিয়া মাহি(নীরু)

সব কথা আর সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটিয়ে বেলা তার ভাইয়ের সাথে এসে গাড়িতে বসে। ওয়াহাজ আর এক মুহুর্তও এখানে দেরি করতে চায় না। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে অন্যদিকে এখানে যত দেরি হবে বেলার তত কষ্ট বেশি হবে। – তানিয়া মাহি

গাড়ি চলতে শুরু করে৷ বেলা একভাবেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন তাদের যাওয়া দেখছে আবার কেউ কেউ নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করেছে।
***
গাড়ি নিজে গতিতে চলছে। বেলা চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। বেলার মাথা গড়িয়ে যেতে লাগলে ওয়াহাজ বাম হাত দিয়ে বেলার মাথা সোজা করে দেয়৷ বেলার গালে হাত লাগতেই সে বুঝতে পারে বেলা কান্না করছিল। কান্না করতে করতেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে৷

বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে আসলে বেলার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ ডলে এদিক ওদিক তাকিয়ে পাশে ওয়াহাজকে দেখে বলে,” ভাইয়া, আর কতক্ষণ লাগবে?”

ওয়াহাজ মিষ্টি হেসে বলে,” এইতো আর দশ- বারো মিনিট লাগবে। তোমার ঘুম হলো?”
” হ্যাঁ, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।”
” পিছনে দেখো বোতল আছে, একটু চোখেমুখে দিলে দাও।”
” না থাক, সমস্যা নেই। এটা কার গাড়ি?”
” এটা তোমার গাড়ি।”
” মানে?”
” মানে এই গাড়িটা তোমার।”
” আমার কেন হবে?”
” কারণ এই গাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনেছে গতকাল দেশে ফিরেই।”
” কেন?”
” প্রথমে কিনেছিলাম আমার জন্যই কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা তোমার প্রয়োজন।”
” এত দামি গাড়ি আমাকে কেন দিতে যাবে?”
” কারণ তুমি আমার অর্ধেক পৃথিবী। আমি নিজের জন্য তোমাকে সময় দিতে পারিনি। আমাদের শৈশব নষ্ট হয়েছে, একটা ঝড়ে সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমরা দুই ভাইবোন নতুন করে সব শুরু করব। আমরা আমাদের অতীতের সবকিছু ভুলে যাব। তোমাকে কঠোর হতে হবে। তোমার দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে।”

বেলা সোজা হয়ে বসে ওয়াহাজের দিকে তাকিয়ে বলে,” কীসের দায়িত্ব? আমি তো আজ থেকে মুক্ত, আমার কোন দায়িত্ব নেই৷ আমি আজ থেকে, না কারো স্ত্রী, না কারো ছেলের বউ, না কারো ভাইয়ের বউ।”
” তুমি কারো কলিজার টুকরা। কেউ তোমাকে তার সবটা দিয়ে দিতে রাজি। এই পৃথিবীতে তোমার জন্য কেউ না থাকলেও আমি তোমার জন্য সবসময় থাকব। প্রতিটা নারীর আইডল হতে হবে তোমাকে। তোমাকে তাদের সাহায্য করতে হবে।”

বেলা উৎসুক চোখে ওয়াহাজের দিকে তাকায়,” কী করতে হবে আমায়?”
” সেটা খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবে৷ আমি তোমার ব্যাপারে আরিবের সাথে কথা বলব। যে তোমাকে ইন্সট্রাকশন দিতো।”
” কিন্তু উনার নাম তো…”
” তোমাকে ভুল নাম বলা হয়েছিল। তার নাম আরিব। এখন আর এসব নিয়ে কোনো কথা হবে না। আর শোনো আমি ছাড়া তোমার জবের ব্যাপারে কারো সাথে কোনো কথা বলবে না।”

গাড়ি এসে একটা বাড়ির সামনে থামে। হর্ণ বাজাতেই ভেতর থেকে কেউ বাড়ির গেইট খুলে দেয়। ওয়াহাজ গাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে আসে। গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দারোয়ানের কাছে এসে বলে,” চাচা, গাড়িতে কিছু ব্যাগ আছে। আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। আমি আমার বোনকে নিয়ে এসেছি। বাড়িওয়ালার সাথে আগেই কথা হয়েছে।”

দারোয়ান হেসে বলে,” আমাকে সাহেব বলেছে, স্যার। চলুন আমি সাহায্য করছি।

বেলা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলে ওয়াহাজ বলে,” এটা রফিক চাচা, পরিচিত হয়ে নাও। আমি বাসায় না থাকাকালীন কোনো প্রয়োজন হলে তুমি চাচাকে বলবে।”

বেলা সম্মতি জানায়। ওয়াহাজ আর করিম চাচা গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র বের করে ভেতরে যেতে থাকে। বেলাও ওয়াহাজের পিছন পিছন যাচ্ছে। বাসাটা দোতলা, তুলনামূলক পুরোনো একটা বাড়ি।

ওয়াহাজ নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে কাউকে ফোন দিয়ে বাসার চাবি নিয়ে আসতে বলে। সে বাহিরে যাওয়ার সময় কাজের মহিলাকে আসতে বলেছিল তাই চাবিটা বাড়ির মালিকের মেয়ের কাছে দিয়েছিল যেন সেটা কাজের মহিলাকে দেয়।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে ওয়াহাজের ফ্ল্যাটের সামনাসামনি আরেকটা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যায়। বেলা আর ওয়াহাজ দুজনই একসাথে সেদিকে তাকায়।
দরজা খুলে একটা প্রায় সাতাশ-আটাশ বছর বয়সী ছেলে বের হয়ে আসে। ওয়াহাজ আর উক্ত ছেলেটা প্রায় সমবয়সী। ওয়াহাজ খানিকটা বড় হবে তার বয়স ত্রিশ-একত্রিশ বছর।

ওয়াহাজ ছেলেটার থেকে চাবি নিয়ে বেলাকে বলে,” এটা বাড়িওয়ালার ছেলে, নাম ফারাজ আহসান৷ চিনে রাখো, চিনে রাখা প্রয়োজন আছে।

ফারাজ বেলার দিকে তাকিয়ে আন্তরিকতা দেখিয়ে মৃদু হাসে। ওয়াহাজকে বলে,” উনি কে? চিনলাম না ঠিক।”
ওয়াহাজ বলে,” আমার অর্ধেক পৃথিবী এটা। আমার বোন, ওয়াজিহা।”

# চলবে…….

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে