মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-০২

0
494

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্বসংখ্যা_০২

বরের পাশে লালশাড়িতে নতুন বউকে দেখে ভাঙা ভাঙা গলায় বেলা বলে ওঠে,” আমার জামাই আমার জন্য বিদেশ থেকে সতীন নিয়ে আসছে! ”

বেলার কথায় ধ্রুবর মুখটা যেন চুপসে গেল। পাশে দাঁড়ানো নতুন বউয়ের দিকে একবার আর বেলার দিকে একবার করে তাকাচ্ছে সে।

নতুন বউ লিলি পাশে থেকে বলে ওঠে,” কে উনি?”

ধ্রুব বউয়ের হাত ধরে বলে, ” বাড়ির মধ্যে চল একটু বিশ্রাম নাও তারপর সবকিছু বলছি।”

বাড়ির বাহিরের উঠোনে মানুষ দিয়ে ভর্তি। সবার সামনে থেকে ধ্রুব তার নতুন স্ত্রী লিলির হাত ধরে বাড়ির মধ্যে থেকে নিয়ে যেতে থাকে। দুজনকে বলে তাদের ব্যাগগুলো বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে।
সবাই বেলাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বলাবলি করছে। এদিকে নিজের স্বামী অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে সেটা বেলার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে। বুকের ভেতর ঝড় শুরু হয়েছে তার।

পাশে থেকে একজন বলে উঠল,” নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে পারলে না? কেমন বউ তুমি? সারাদিন- রাত সংসারের পিছনে সময় দিয়েছ কিছু সময় যদি স্বামীরে দিতে তাহলে আর এরকম হতো না।”

কথাটা শুনে যেন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে বেলার। পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে ওঠে,” সে আমাকে ঠকিয়ে অন্যকাউকে বিয়ে করেছে এটাও আমার দোষ? মেয়ে হয়ে মেয়ে মানুষের ভুল ধরতে এত মরিয়া কেন আপনারা? আমি যদি এখানে থেকে অন্যকারো সাথে সম্পর্কে জড়াইতাম তাহলে তো আমাকেই দোষ দিতেন তখন কেউ বলতেন না যে স্বামীর কারণে বউ এমন করছে। আল্লাহ আপনাদের জবান দিয়েছে মেয়েজাতিকে কথায় আহ*ত করে কবরস্থ করার জন্য তাই না? স্বামী বিয়ে করে নিয়েছে এসময় আগের স্ত্রীর মনের অবস্থা কেমন হতে পারে বুঝতে পারেন না আপনারা? আপনাদের মতো পাশের বাসার আন্টিরা রেডি থাকেন কখন কোথায় কী ঘটবে আর আপনাদের জবান ছাড়বেন, ননস্টপ বকে চলবেন। বয়স হচ্ছে, ভালো হয়ে যান। ব্রেইনকে কিছু খাইতে দেন। এরকম নারী বিমুখী হইলে শেষ বয়সে পস্তাতে হবে। নিরপেক্ষ হতে শিখুন। যেটা ভুল সেটাকেই ভুল বলুন।”

বেলার এতগুলো কথা শুনে মহিলা রাগে চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে,” মুখ থেকে এরকম কথা বের হইলে জামাই টিকবে কীভাবে? ধ্রুব তো মনে হয় এমনিতে আর বিয়ে করে নাই তোমার এই মুখের জন্যই বিয়ে করছে।”
” শুনেছি আপনিও ডিভোর্সি। আপনি জামাই টিকিয়ে রাখতে পারেন নাই কেন? আমি আর আপনি একই ধরনের হলাম না!”

মহিলা আর কোন কথা খুঁজে পায় না বলার জন্য। বেলা আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসে। বড়ো উঠোন পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।

বারান্দায় দুজন চেয়ারে বসে আছে। জাহিদা বেগম বেলার ঘর লক করে রেখেছে। চাবি তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে মুষ্টিকরে রাখা। ছেলেকে কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন তিনি। নতুন বউ চুপচাপ বসে আছে। পাশে থেকে রিমি মাকে চুপ করতে বলছে বারবার।

বেলা ধীরপায়ে অচেতন কোন মানুষের মতো হেটে আসছে। নীরব তার চাহনি৷ ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে সেদিকেই এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। জাহিদা বেগম বেলার কাছে এসে বলে,” আমি তোমার রুমে ওদের কিছুতেই ঢুকতে দেব না, বেলা। ওই রুমে এই বাড়ি করার পর তোমার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, এই মেয়ে ওই রুমটায় কিছুতেই যাবে না। শুধু ওই রুম কেন আমি ওদের দুজনকে এই বাড়িতেই রাখব না, এই বাড়ির প্রতিটা কোণায়, ইটে তোমার গায়ের গন্ধ লেগে আছে। এই বাড়িটা তোমার পরিশ্রমের ফল। আমি এই অনাচার কিছুতেই হতে দেব না, মা।”

জাহিদা বেগম কান্না করে ফেলেন। গাল বেয়ে চোখের পানি ঝড়ছে। কান্নায় যেন রাগ তার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ছেলের দিকে তেড়ে গিয়ে তার দুই গালে বিরামহীন চড় দিতে থাকে। রিমি গিয়ে মাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দূরে দাঁড়ায়।

বেলা নির্জীব গলায় বলে ওঠে,” স্বামীটাই তো আজ অন্যকারো হয়ে গেছে, আম্মা। ”

বেলার কথা শুনে ধ্রুব তার দিকে তাকাতেই বেলার চোখে চোখ পড়ে যায়। বেলা চোখ নামিয়ে নেয়। সিদ্ধান্ত নেয় ভেতরে ভেতরে ম*রে গেলেও চোখের পানি সে কাউকে দেখাবে না৷ সে দূর্বল হয়েছে এটা কেউ আন্দাজ করতে পারলে তাকে বারবার আ*হত করবে।

বেলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আবারও বলে ওঠে,” স্বামীই আজ একেবারে দান করে দেব। বর যেহেতু দিয়েই দেব ঘর দিতে আর কী সমস্যা?”

বেলা তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দরজা খুলতে গিয়ে দেখে সেটা লক করা হয়েছে। সে বুঝতে পারে এ কাজ জাহিদা বেগম ছাড়া আর কারো না। এই একটা মানুষই হয়তো সারাজীবন তার হয়ে থেকে যাবে কিন্তু সে আর কাউকেই তার জীবনে রাখতে পারবে না।

বেলা তার শাশুড়ির কাছে গিয়ে তার রুমের চাবি চায়। জাহিদা বেগম ভাবেন বেলা হয়তো ওদের দুজনকে তার রুমে পাঠাবে তাই তিনি চাবি দিতে নারাজ।

বেলা সহসা মৃদু গলায় বলে,” আম্মা আমার ঘরে আমি যাব। আমাকে চাবি দিবেন না?”

জাহিদা বেগম সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে বেলার দিকে তাকায়। বলে, ” তুমি নিজের জন্যই চাইছ?”
” হ্যাঁ আম্মা। আমি কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের নাটক দেখব নাকি? এসব আমার একদম ভালো লাগছে না। ”

ধ্রুবর নতুন বউ লিলি ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,” তুমি আমাকে বলেছিলে, তুমি তোমার প্রথম বউকে ডিভোর্স দিয়েছ। এখন এখানে এসে দেখছি আরেক কাহিনী৷ তুমি তোমার বউকে ডিভোর্স দাওনি কেন ধ্রুব?”

লিলির কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বেলা। বিদ্রুপ করে বলে,” তোমার বরের ক্ষমতা আছে নাকি আমাকে ডিভোর্স দেয়ার। আমাকে ডিভোর্স দিতে হলে তোমার বরের বাড়ি, জায়গা-জমি সব বিক্রি করতে হবে। আমাকে প্রসন্ন রেখেছে এতদিন তবে তোমাকে বিয়ে করার সাহস কোথায় পেল সেটাই ভাবছি আমি।”

লিলি ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে ভ্রু বিস্তৃত করে বলে,” এসব কী বলছে উনি?”

ধ্রুব দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করে বলে,” ও যা বলছে ভুল বলছে। আমি বিদেশে কত টাকা উপার্জন করেছি সেটা সে জানে না। আমি ওর সব টাকা দিয়ে দেব।”

বেলা তার শাশুড়ীর কাছে থেকে চাবি নিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,” শোধ করো আগে আর হ্যাঁ কাবিনের টাকা কিন্তু সাত লাখ, মনে করিয়ে দিলাম।”

বেলা নিজের ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই দরজার খিল এঁটে দেয়। সোজা চলে যায় আয়নার সামনে। নিজেকে এপাশ ওপাশ ভালো করে দেখে, মুখের বিভিন্ন জায়গায় কালো কালো দাগও পড়েছে অথচ আগে না ছিল গায়ের রঙে কোন ময়লা আর অসুন্দর কিছু অথচ এই সংসারের হাল ধরতে ধরতে বয়সের তুলনায় যেন বেশি বয়সের ছাপ পড়েছে শরীরে। বেলা ভাবতে থাকে শুধু চেহারার জন্য ধ্রুব এমন করল! কই সে তো কোনদিন চেহারা নিয়ে কোন কথা বলেনি! কয়েকদিন আগে আসলে তো ধ্রুব বেলার আরও খারাপ অবস্থা দেখত। ধ্রুব আসবে বলে সে দুই সপ্তাহ যাবৎ নিজের শরীরের, ত্বকের যত্ন নিচ্ছিল। তার সবটা ছিল শুধুমাত্র তার স্বামীর জন্য অথচ কী থেকে কী হয়ে গেল!

বেলা খেয়াল করে কষ্টগুলো বুকে চেপে বসায় কষ্টের লক্ষণ হিসেবে চোখ দুটো টলটল করছে। সে বারবার চোখের পাতা ফেলে চোখের পানি স্বাভাবিক করে নেয়। তার চোখের আর টলমল অবস্থা নেই। নিজেই নিজেকে বলতে থাকে,” বেলা, তুই হেরে যাওয়ার জন্য জন্মাসনি। তুই একা থাকাকালীনও কাঁদবি না। যে মানুষ তোকে ভালোবাসবে না তার দিকে এক কদমও এগুবি না। যে যেমন দেবে তাকে তুই দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিবি, হোক সেটা ভালোবাসা বা ঘৃণা। এই পৃথিবী বড্ড স্বার্থপর, সবই শুধু গিভ অ্যান্ড টেক- এর সম্পর্ক। তোকেও এখানে টিকে থাকতে হলে তাদের মতোই হতে হবে, হতেই হবে।”

বেলা খেয়াল করে তাকে ভীষণ অবিন্যস্ত দেখাচ্ছে। এ বাড়ির সবাই এখন শ*ত্রুপক্ষ। তার শাশুড়ীও পাল্টে যেতে পারে। পৃথিবীর কোন মা তার ছেলেকে রেখে শেষ মুহূর্তে ছেলের বউয়ের পক্ষ নেবে না। সুতরাং এই শ*ত্রু পক্ষের সামনে নিজের দূর্বলতা কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না।

বেলা নিজের ওয়ারড্রব খুলে খুঁজে খুঁজে একটা লাল টকটকে শাড়ি বের করে৷ খেয়াল হয় বাহিরের মেয়েটিও লাল শাড়ি পরে আছে। সাথে সাথে শাড়িটা আবার ভেতরে রেখে বেছে বেছে হালকা গোলাপি রঙের সুন্দর একটা শাড়ি বের করে। আয়নার সামনে গায়ে জড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে।
নিজেকে আজ সাজাবে বলে ঠিক করে বেলা। আজ কোনরকম বিষন্নতা যেন ছুঁতে না পারে সেটার জন্য যা যা করা উচিৎ সেগুলো সব করবে সে।

**
জাহিদা বেগম ছেলেকে বসা থেকে টেনে দাঁড় করায়৷ অশ্রাব্য ভাষায় গা*লি দিয়ে বলেন,” কী করেছিস এটা তুই? যে পাত্রে খাবার খাইলি ওই পাত্র ফুঁটো করলি!”

” আম্মা, আমি লিলিকে ভালোবাসি। এসব কথা আমার শুনতে একদম ইচ্ছে করছে না। বেলা আমার থেকে বারো লাখ পাবে আর কাবিনের সাত লাখ, আমি আজই ওকে দিয়ে দেব আর আজই আমি ওকে তালাক দেব। ” সংক্ষেপে বলল ধ্রুব।

জাহিদা বেগম বলে ওঠেন,” ওই মেয়ে বিয়ের পাঁচটা বছর এ বাড়িতে সংসার টেনেছে। তুই শুধু মাসের টাকা দিয়েই শেষ, আমি আমার অসুখের জন্য কাজ করতে পারি না, বেলা সবকিছু নিজের হাতে সামলেছে এতদিন। মেয়েটার আঠারো বছর হতে না হতেই তোর হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিল তাকে এভাবে ঠকাতে পারলি?”

ধ্রুবকে কিছু বলতে না দিয়ে লিলি নিজেই বলে ওঠে,” মা, আপনার ছেলের ভালো দেখছেন না কেন? ওই মেয়ের দিক এত দেখছেন কেন? আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। আমি এখানে সংসার করতে এসেছি, নাটক দেখতে আসিনি। প্রয়োজনে কাবিনের সাত লাখ টাকা আমি দিয়ে দেব।”

জাহিদা বেগম লিলির দিকে চোখ বড় করে তাকায়, ধমকের সুরে বলে,” তুমি চুপ করো মেয়ে। তোমার বিবেকে বাঁধলো না মেয়ে হয়ে মেয়ের সংসার ভাঙতে? কোন যাচাই-বাছাই না করে একজনের সাথে নাচতে নাচতে চলে এলে!”

মায়ের কথা শুনে রিমি বলে ওঠে,” আম্মা, আমি এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম। তুমি অতিরিক্ত করছ কিন্তু। নতুন ভাবিকে তুমি এভাবে বলতে পারো না। তারা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।”

লিলিকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে,” ভাবি, আমার সাথে আমার ঘরে চল, এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে?”

জাহিদা বেগম বিলম্ব না করে হিংসা**ত্মক ভঙ্গিতে রিমির উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,” তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর মুখ আমার দেখতে মন চাইছে না।”

***

বেলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে যাচ্ছে। নিজের চোখেই নিজেকে অপ্সরী লাগছে অথচ তার স্বামী কি না অন্য একজনকে……
আর ভাবতে পারে না সে। বিছানা থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে সোজা মেসেঞ্জারে চলে যায়। মেসেঞ্জার ঘেটে ‘ আঁধার’ নাম দেয়া একজনের ইনবক্সে চলে যায়৷ দেরি না করে অডিও কল দেয় সে। অনেকদিন মানুষটার সাথে কথা হয় না তার। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই কল রিসিভ হয়ে যায়।

” আমার স্বামী আমার জন্য সতীন নিয়ে আসছে জানো? আমি আমার পুরুষটাকেও মায়ায় বাঁধতে পারলাম না। আমি আর কত হারাবো বলতে পারো?” কল রিসিভ হতেই বেলা সাথে সাথে বলে ওঠে।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে