#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৯
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
নিরুপমা বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
মেঘলা সোফায় বসে আলভির সাথে খেলছিল।
আলভি মেঘলাকে পেয়ে মহুয়াকে একদম ভুলেই গেছে। খাবার খায় মেঘলার হাতে, ঘুমানোর জন্য বায়না ধরে মেঘলার সাথে মোট কথা মেঘলা বলতেই আলভি পাগল। কথায় আছে খালামুনির শরীরে মায়ের গন্ধ থাকে, খালামুনি সামনে থাকলে মায়ের কথা ভুলেই যায় বাচ্চারা।
মহুয়া চুপচাপ বসে ওদের খেলা দেখছে।
শ্রাবণ অফিসে, আহনাফ নিজের রুমে, নির্জনের খবর ঠিক জানা নেই। নির্জন আর আগের নির্জন নেই, সারাদিন দরজা বন্ধ করে রাখে ঠিক মতো অফিসেও যায় না। মহুয়া ত এখনো নির্জনের দেখাই পায়নি।
নিরুপমা মেঘলার দিকে এগিয়ে আসলো। মেঘলার কোলে বাচ্চা দেখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো।
আলভি বল মারলো সেই বল গিয়ে পরলো নিরুপমার কপালে।
নিরুপমা কপালে হাত দিতেই আলভি ভয়ে চুপসে গেলো।
নিরুপমা আলভির দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকলো।
মেঘলা নিরুপমা কে দেখে অবাক সাথে ভীষণ খুশি হলো।
আলভি ছোট ছোট পায়ে নিরুপমার সামনে গিয়ে বললো,’ সরি আনতি’
নিরুপমা আলভির সামনে বসে গালে হাত রেখে বললো,’ এ যে আমাদের ছোট আহনাফ’
মেঘলা হেঁসে বললো,’ একদম বাবার মতো হয়েছে। ‘
নিরুপমাঃ আহনাফের ছেলে.?
মেঘলাঃ হুম
নিরুপমা আলভিকে বুকে চেপে নিলো।
আমেনা বেগম নিরুপমা কে দেখে খুশিতে বলে উঠলো, ‘ নিরু তুই কখন আসলি.?’
নিরুপমাঃ এই ত এখনি।
আমেনা বেগমঃ বস, কতোদিন পর আসলি।
নিরুপমাঃ নাহ্ ভাবি বসার সময় নেই বাসায় অনেক কাজ ফেলে এসেছি।
আমেনা বেগমঃ এমন কি কাজ তোর বাসায়! চুপচাপ বস ত।
নিরুপমা হেঁসে বললো,’ অনেক কাজ ভাবি একটা দরকারে এসে ছিলাম। ‘
আমেনা বেগমঃ পরে শুনবো তোর দরকারী কথা আগে বস আমি কিছু নিয়ে আসি।
নিরুপমাঃ না,না ভাবি আমার এখনি চলে যেতে হবে।
আমেনা বেগমঃ মহুয়া এসেছে..
নিরুপমা এতোক্ষণ মহুয়াকে খেয়াল করেনি। সোফার পাশে মহুয়াকে দেখে কাছে গেলো।
মহুয়া উনাকে জড়িয়ে ধরলো নিরুপমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।কেমন আছে.? টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করে বললো একদিন সময় করে বাসায় যেতে অনেক আড্ডা দিবে।
নিরুপমা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো হালিমা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। নিরুপমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। ওই দিনের অপমান উনাকে আজও রাতে ঘুমাতে দেয় না।
নিরুপমাঃ ভাবি এই নেন ছোঁয়ার বিয়ের কার্ড।
ছোঁয়ার বিয়ে শুনতেই সবাই অবাক হয়ে তাকায়।
আমেনা বেগমঃ ছোঁয়ার বিয়ে মানে!.?
নিরুপমা হেঁসে বললো,’ হ্যাঁ গো ভাবি ছোঁয়ার বিয়ে, ছেলে ভালো আগে থেকে ওকে চিনে, একই সাথে পড়াশোনাও করেছে ভালো জব করে ইন্জিনিয়ার।’
আমেনা বেগমঃ নিজে নিজেই ঠিক করে নিলি!
নিরুপমাঃ মেয়ে ত আমার নিজের তাই না!
আমেনা বেগমঃ অথচ আমরা ওর কেউ না.?
নিরুপমাঃ প্লিজ ভাবি মন খারাপ করো না, আর কতো জ্বালাবো তোমাদের! আমাদের জন্য ত অনেক করলে।
মেঘলা, মহুয়া অবাক হয়ে বললো,’ ছোঁয়া রাজি!.?’
নিরুপমাঃ হুম, আমার মেয়ে আমার অবাধ্য কখনো হবে না।
নিরুপমা সবাই কে দাওয়াত দিয়ে গেলো। বিয়ে তিনদিন পর সবাই জেনো আগামীকাল চলে যায় বলে গেল নিরুপমা। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
_________
রাতে ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে মিম। আকাশের দিকে তাকিয়ে গুণগুণ করে গেয়ে উঠলো, ‘ সখি তোরা প্রেম করিও না, পিরিত ভালা না…
সখি তোরা প্রেম করিও না।
” তুমিও কখনো কাউকে ভালোবাসতে নাকি!.?”
পুরুষের কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকালো মিম।
নির্জন হাতে সিগারেট নিয়ে ধোঁয়া আকাশে ছেড়ে দূর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে।
মিম হেঁসে বললো,’ কই না ত!.’
নির্জন হাসলো। সে খুব করে মানুষের মন পরতে পারে। চার পাশে এত এত বিচ্ছেদ মন ভাঙার গল্প কেন! তার জন্য অবশ্য আমরা নিজেরাই দায়ী।
নির্জনঃ আচ্ছা, তাহলে এই গান কেন!.?
মিমঃ ইচ্ছে হলো।
নির্জনঃ আজকাল আমারও গান গেতে ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে করে আকাশের বুকে কষ্ট গুলো ভাসিয়ে দেই।
মিমঃ কষ্ট গুলোর ওজন অনেক ভারি আকাশে ভাসবে না অতল সমুদ্রে ডুবে যাবে।
নির্জনঃ আমাদের ছোট ছোট ভুলগুলো মানুষ এত বড় করে কেন দেখে! ভালোবাসা গুলো কেন দেখে না.? সারাজীবন ভালোবেসে একদিন কষ্ট দিলে ওরা সব ভালোবাসা ভুলে যায় কেন!.? তাহলে কি ভালোবাসার ওজন নেই! ভালোবাসা খুবই সাধারণ কিছু! আর কষ্টের ওজন বেশি!?
মিমঃ জানিনা, তবে আমরা যেই কষ্ট গুলো ছোট ছোট মনে করি তা হয়তো বিপরীত মানুষটির জীবন পাল্টে দিতে পারে, আমাদের আগে পরিস্থিতি বুঝা দরকার।
নির্জন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমার ভালো থাকতে তাকেই লাগবে, সে না চাইলেও লাগবে।’
মিমঃ তাহলে ত দেরি হয়ে গেল!
নির্জনঃ আমি ওকে মানানোর চেষ্টা করবো, একদিন ঠিক ও মেনে নিবে।
মিম হাসলো।
নির্জনঃ হাসছো কেন!.?
মিমঃ আর সেই একদিন আশার আগেই যদি সে অন্য কারো হয়ে যায়!.?
নির্জনঃ এমনটা কখনো হবে না।
মিমঃ এমনটাই হবে।
নির্জনঃ আমি হতে দিব না।
মিমঃ তুমি তাহলে কিছুই জানো না!
নির্জনঃ কি জানবো.?
মিমঃ ছোঁয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আজ বিয়ের কার্ড দিয়ে গেলো ফুপিমণি, তিন দিন পর বিয়ে।
নির্জন কি বলবে ভাষা হারিয়ে পেললো! এই মুহূর্তে ওর কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত সেটাও ভুলে গেল।
মিমঃ নির্জন…
নির্জন কিছু না বলে ছাঁদ থেকে নেমে যেতে নিলে মিম ওর হাত ধরে থামিয়ে বললো,’ মাথা ঠান্ডা করো, আমি যা বলি শুনো। পরিবার একদিন মেনে নিবে, ছোঁয়াও একদিন সবটা মেনে নিবে তুমি ছোঁয়া কে তুলে এনে জোর করে বিয়ে করে নাও।অভিমান করে, রাগ দেখিয়ে দূরে সরে যাওয়া মানে তাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলা, একবার সে অন্য কারো হয়ে গেলে সারাজীবন আপসোস করবে লাভ হবে না।
নির্জন কোনো উত্তর না দিয়ে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো।
মিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার গুণ গুণ করে বলে উঠলো, ‘ সখি তোরা প্রেম করিও না, পিরিত ভালা না….’
_________________
রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে মহুয়া মেঘলা।
মহুয়া নিষেধ করে ছিল কিন্তু মেঘলার নাকি হাঁটতে মন চাচ্ছে। শ্রাবণ ও বাসায় নেই।
মেঘলাঃ আলভি ঘুমিয়েছে.?
মহুয়াঃ হুম, আলভি ত তোমাকে পেলে আমাকে ভুলেই যায়।
মেঘলা হাসলো।
মহুয়াঃ শুনেছি বাচ্চারা মায়ের থেকে খালার কাছে থাকে বেশি।
মেঘলা অবাক হয়ে বললো,’ খালা!.’
মহুয়া মেঘলার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ আমি ভেবে ছিলাম তুমি অন্তত নিজ থেকে সত্যিটা আমাকে বলবে!’
মেঘলা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,’ কিসের সত্যি!.? কিসের সত্যির কথা বলছো!.?’
মহুয়া হাসলো মেঘলার ঘাঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে হেসে বললো,’ নিজের বোন হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা পাও!.?’
মেঘলাঃ এইসব কি বলছো!.
মহুয়াঃ আমাকে নিষেধ করলে আমিও সবটা গোপন রাখতাম তাও অন্তত একবার বলতে তুমি আমার বড় বোন।
মেঘলাঃ তোমাকে এইসব কে বলেছে.?
মহুয়াঃ আমাকে কেউ বলেনি ওইদিন আমি সব শুনে ছিলাম।
মেঘলাঃ তুমি সব শুনে ছিলে!.?
মহুয়াঃ হুম সবটা শুনে ছিলাম। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যখন তুমি মামিকে বাবা মায়ের মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করছিলে! তোমার ছবি দেখিয়ে সব বলে ছিলে আমি দরজার বাহিরে ছিলাম।
মেঘলা মহুয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,’ তাহলে তুমি আগে থেকেই সবটা জানতে তাহলে কখনো বলনি কেন!.?’
মহুয়াঃ তুমি আমাকে বোন হিসেবে পরিচয় দিতে ভয় পাও, লজ্জা পাও।
মেঘলাঃ উল্টো না বুঝে ভাজটা ত বুঝতে পারো। আমি তোমার ছোট মনটায় কষ্ট দিতে চাইনি, আমি চাইনি বাবা মায়ের মৃত্যুর আসল রহস্য জেনে তুমি কষ্ট পাও,আর তখন মামিকে তোমার ভীষণ প্রয়োজন ছিল।
মহুয়াঃ একবার এসে বোন বলে ত জড়িয়ে ধরতে, সব জায়গায় কেনো লাভ ক্ষতি বিচার করা হয়!
মেঘলাঃ মহুয়া!
মহুয়াঃ বাসায় চলো, অনেক রাত হয়েছে ভাইয়া বকবে।
মেঘলা কিছু বলতে চাইলে মহুয়া শুনতে চাইলো না।
মেঘলা আর মহুয়া বাড়িতে চলে আসলো।
বাড়িতে এসেই দেখে শ্রাবণ সোফায় বসে আছে।
মেঘলা শ্রাবণের গম্ভীর মুখ দেখে ভয় পেল।
শ্রাবণ মেঘলাকে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো , ‘ তুমি ঠিক আছো..?
মেঘলাঃ হুম।
শ্রাবণঃ তোমাকে কতোবার নিষেধ করেছি রাতে বাহিরে না বের হতে! আল্লাহ না করুক কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কি করবে!.?
মেঘলাঃ শান্ত হও।আমি ছাড়া কি আর কেউ প্রেগন্যান্ট হয় না!..? আমার সব কাজ তুমি করে দিতে হবে কেন! আমাকে কিছুই করতে দাও না, খাবারও রুমে নিয়ে যাও। আমার সারাক্ষণ এমন থাকতে ভালো লাগে না কেমন খালি খালি লাগে।
শ্রাবণঃ আর কয়েকটা দিন এভাবেই থাকতে হবে রুমে চলো।
মহুয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের কেয়ার দেখলো৷ কতোটা কেয়ারিং স্বামী। মহুয়ার মনে পরে গেলো নিজের প্রেগন্যান্সির দিনগুলোর কথা। সকালে উঠে গোসল করে কিছু খেয়ে অফিসে চলে যেত আর রাতে আসতো। সারাদিন এতো এতো কাজ, গরম, যানবাহন সব মিলিয়ে দুইদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়তো। কি কষ্টের ছিল দিন গুলো! মহুয়া সেই সব কষ্টের দিনগুলো ভুলে যেতে চায়। এই বাড়ি থেকে যতোদ্রুত সম্ভব চলে যাওয়া ভালো।
_____________
আহনাফ নিজের এসিস্ট্যান্ট কে কল দিল।
~ কোনো খবর পেয়েছো.?
~ স্যার ম্যাডাম যে দিন হোটেলে ছিল সেই দিনের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ পেয়েছি। আমি আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আহনাফ কল কেটে দেখলো ভিডিও এসেছে বসে শান্ত মাথায় সবটা দেখলো। সেই রাতে হোটেলে মহুয়া একা ছিল দরজা বাহির থেকে কেউ লাগিয়ে দেয়, মহুয়া বের হওয়ার চেষ্টা করে। সব দেখে আহনাফ রেগে বলে উঠলো ‘ এই মাহিন কে একদিনের মধ্যে আমার সামনে দেখতে চাই!’
___________
কিছু কিছু মুখের আদল বুকের মধ্যে দাগ কেটে যায়!!বুকটা ধড়ফড়িয়ে ওঠে প্রচন্ড রকমের। দেখে মনে হয়,তুমি আমার কতো আপন! এই তুমি ত শতাব্দী শতাব্দী ধরেই আমার ছিলে! তাই না!.??
পরে বাস্তব জ্ঞান ফিরে পাই, বুঝতে পারি. এই তুমি আমার নও, এই আদলের কেউ কখনো আমার ছিল, ভালোবেসে ছিল হয়তো! ভালোবাসা ছিলো..??
বুঝতে পারি এই তুমি আমার নও…
ডায়রি বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাহিরের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো ছোঁয়া। কাঁদতে কাঁদত চোখ মুখ ফুলে গেছে, মাথা যন্ত্রণা করছে, এক হাতে মাথা চেপে ধরলো, অন্য হাতে ঝাপসা হয়ে আসা চোখের পানি মুছে নিল।
চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।