#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#পর্ব_৩
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল আহনাফ।
আমেনা বেগম বার বার নিষেধ করলেন আজ বাড়ি থেকে বের হতে। বাড়িতে এতোবড় একটা অনুষ্ঠান। হালিমা বেগম ছেলের বিয়েতে কোনো কিছুর কমতি রাখেননি।
আহনাফ মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে দরকারী কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেলো। এইসব বিয়েতে ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। নিরুপমা বাড়ি থেকে চলে গেছে, কোথায় গেছে.? কেনো গেছে.? কি হয়েছিল.? আহনাফ জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায়নি সবার এক কথা আগে বিয়ে শেষ হোক তারপর বসে এই বিষয় কথা বলবে।
ছোঁয়া ঘোমটা দিয়ে বাসা থেকে বের হতেই নিরুপমা মেয়েকে ডাকলেন৷
ছোঁয়া ভয়ে চুপসে গেলো।
নিরুপমাঃ কোথায় যাচ্ছ..?
ছোঁয়াঃ আম্মু..
নিরুপমাঃ আমি জিজ্ঞেস করছি কোথায় যাচ্ছ.?
ছোঁয়া ভয়ে মাথা নিচু করে নিল। নিরুপমা যা বুঝার বুঝে নিল।
একবার ভালো করে মেয়ের দিকে তাকালো। সাদা সেলোয়ার-কামিজ, চুল বিনুনি করা, চোখে চশমা.. চোখে মুখে কোন সাজ নেই ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে ছোঁয়াকে।
নিরুপমাঃ আমি নিষেধ করে ছিলাম ওই বাড়িতে পা রাখতে।
ছোঁয়াঃ এটাই শেষ আম্মু, আমি ভাবিকে কথা দিয়েছি।
নিরুপমাঃ তাই বলে বিধবা সেজে যাচ্ছ কেনো.?
ছোঁয়াঃ আমার হসপিটালে যেতে হবে আম্মু। ওই বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য যাচ্ছি।
নিরুপমা মেয়েকে আর কিছু বললো না৷, মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে সে এখন একজন ডাক্তার।
ছোঁয়া কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে বের হয়ে গেল। পেছন থেকে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে তাকিয়ে রইলো নিরুপমা, কাছের মানুষ গুলো বদলে গেলে এতো কষ্ট হয় কেনো.? আমরা যাদের আপন ভাবি তারা আমাদের আপন ভাবে না কেনো.? এক জীবনে যন্ত্রণা শেষ হলো না নিরুপমার।শান্তি কোথায়.??? বিশ্বাস আর ভালোবাসার উপর আজকাল বিশ্বাস উঠে গেছে, দিন শেষে সবাই স্বার্থ খুঁজে।
_________________
সকাল থেকেই মিম একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে মহুয়াকে। আজ অফিসে কাজ থাকায় একটু জলদি অফিসে চলে আসতে হয়েছে।
মিম মহুয়ার অফিসের নিচে এসে আবার কল দিল মোবাইল বন্ধ। সেই আটটা থেকে কল দিয়ে যাচ্ছে এখন বাজে এগারোটা।
মিম অফিসের ভেতরে গিয়ে খুঁজ করলো মহুয়ার। ভাগ্য ভালো পেয়েও গেলো।
মহুয়া অবাক হলো মিম কে দেখে।
মিম কে এক সাইডে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কি হয়েছে.? অফিসে কেনো এসেছিস.? জানিস ত বস কেমন.?’
মিমের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।
মহুয়া ভয় পেয়ে গেলো।
মহুয়াঃ কি হয়েছে মিম.?
মিম হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করলো।
” আলভি কে সকাল থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ”
কথাটা শুনতেই মুহূর্তে মহুয়ার মুখের রং পাল্টে গেলো।
মহুয়াঃ ভালো করে সব জায়গায় দেখেছিস তুই.?
মিমঃ কোথাও বাকি রাখিনি।
মহুয়া কোনো দিকে না তাকিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। কোথায় খুজবে প্রথমে.?
খুঁজতে খুঁজতে কোথাও বাকি রাখেনি মহুয়া। বাসায় এসে নিচে বসেই কাঁদতে শুরু করলো।
মোবাইলের টুংটাং শব্দ শুনে মিম হাতে নিল। মেসেজ পড়ে দ্রুত মহুয়ার হাতে দিল।
মহুয়া মেসেজটা দেখেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। বুঝতে বাকি নেই আলভি এখন কোথায়! আলভির কোনো ক্ষতি করবে না ত.?
মহুয়া এড্রেস দেখে বেরিয়ে পড়লো, মহুয়ার পিছু পিছু বের হলো মিমও।
_______________
ছোঁয়া বাড়ির সামনে এসে চারপাশে একবার নজর বোলালো। কি সুন্দর করে পুরো বাড়ির আশপাশ সাজানো হয়েছে, এতো জাঁকজমকের ভেতর ছোঁয়া কে ভীষণ নরমাল দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে।
বাড়ির বাগানে বড় করে আয়োজন করা হয়েছে । ফুল গাছগুলো অর্ধেক নেই, ভীষণ কষ্ট লাগলো ফুলগাছ গুলোর জন্য, ছোঁয়ার খুব প্রিয় ছিল ফুলগাছ গুলো।
স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে নির্জন, এলিনা। এলিনার মুখ থেকে হাসি সরছে না নির্জন পাথরের মতো বসে আছে। ফটোগ্রাফার বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে নির্জনের আচরণে। না হাসলে কি ছবি সুন্দর হয়!.? এই জন্য লোকে বলে পুলিশ মানুষ কসাই এদের মনে ভালোবাসা নেই, আজ বিয়ের দিনেও রোবট সেজে আছে। বিরবির করে ক্যামেরা ম্যান আবার ছবি তুলছে।
ছোঁয়া দূর থেকে হাসলো। হাতের চিরকুটের দিকে তাকিয়ে বললো,’ এটাই আমার দেওয়া শেষ উপহার তারপর আপনি সম্পূর্ণ অন্য কারো। ‘
” অনেক দিন পর দেখা”
ছোঁয়া চমকে পেছন ফিরে তাকালো।
ছেলেটা মিষ্টি হেঁসে বললো,’ অনেক দিন নয়, বছর পর দেখা।’
ছোঁয়া তাকিয়ে বললো ছেলেটার দিকে।
~ চিনতে পারছেন না.?
ছোঁয়াঃ রাফি!!..
রাফিঃ যাক অবশেষে চিনতে ত পেরেছেন।
ছোঁয়া হাসার চেষ্টা করলো।
রাফি ছোঁয়ার দিকে ভালো করে তাকালো, চোখের নিচে কালো দাগ, ফেঁকাসে মুখ, খুব সাধারণ একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। ছোঁয়া ত এমন নয়, কতো চঞ্চল একটা মেয়ে ছিল, এই ছোঁয়া আর আগের ছোঁয়া মধ্যে বিশাল এক তফাত ।
রাফির এভাবে তাকানোতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ছোয়া।
ছোঁয়াঃ আপনি এখানে.?
রাফিঃ কাজিনের বিয়ে, এলিনা আমার খালাতো বোন। আজ থেকে আপনি আমার বেয়াইন।
ছোঁয়া হাসলো। পেছন ফিরে চলে যেতে নিলে রাফি বলে উঠলো, ‘ এখন কি করছো.? তোমার স্বামী কেমন আছে.?’
হাসলো ছোঁয়া, এখনো বিয়ে করেনি আর স্বামী!! তাও পেছন ফিরে বললো,’ ভালো ‘
রাফি তাকিয়ে রইলো ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে। ছোঁয়া কারো সাথে দেখা না করে বিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। হসপিটালে যেতে হবে, নিয়ে আসা চিঠিটা রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। মনে মনে বলে উঠলো “লোকে যাহার নাম দিয়াছে প্রেম,
আমি তাহার নাম দিয়াছি বি’ষপান!”
রাস্তার পাশে একটা বিড়াল ছাড়া দেখে হাঁটু গেড়ে বসলো মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো ” মানুষের চেয়েও পশু পাখির ভালোবাসা স্বার্থহীন ”
ছোঁয়া বাড়ি থেকে বের হতেই একদল লোক বাড়িতে প্রবেশ করলো। বিয়ে বাড়ির সব কিছু ভাঙচুর শুরু করলো। হইচই বেঁধে গেলো পুরো বিয়ে বাড়িতে।
ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া চিঠি খুব যত্ন করে কেউ কুড়িয়ে নিল ।
__________________
মহুয়া রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখলো আলভি আইসক্রিম খাচ্ছে বসে।
মহুয়া দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আলভিকে। চোখ থেকে পানি পড়ছে, কতোটা ভয় পেয়ে ছিল ছেলের জন্য। একটুর জন্য মনে হয়ে ছিল পৃথিবীটা বুঝি অন্ধকার হয়ে আসলো।
আলভিও আম্মুকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো।
মহুয়া আলভির সারা মুখে চুমু দিয়ে বুকে টেনে নিল।
আলভি চুপটি করে মায়ের বুকে মাথা রেখে আছে।
মহুয়া চোখের পানি মুছে রেগে তাকালো সামনে।
পকেটে এক হাত দিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে মাহিন।
মহুয়া রেগে আলভিকে সরিয়ে মাহিনের কলার চেপে ধরলো।
রাস্তার মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
মহুয়াঃ তোকে আগেও সাবধান করেছি আমাদের মা ছেলে থেকে দূরে থাকতে, কোন সাহসে আমার ছেলেকে নিয়ে এসেছিস!..
মাহিন হেঁসে তাকিয়ে আছে হিংস্র বাঘিনী মহুয়ার দিকে। মহুয়াকে দেখতে এখন একটা হিংস্র বাঘিনী মনে হচ্ছে।
মাহিনের হাসি শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল মহুয়ার।
মহুয়াঃ আমার থেকে আর কি চাই …? সব কেঁড়ে নিয়েও শান্তি হয়নি তোর!.?
মাহিনঃ তোমাকেই ত পাওয়া হলো না।
মহুয়া মাহিনের কলার চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘ এই জীবনে হয়তো কখনো পাওয়া হবে না, অন্যের বউয়ের দিকে তাকানো পুরুষদের আমার ঘৃণা হয়। ‘
মাহিনঃ তুমিও এখন অন্যের বউ নেই, এই জীবনে না পাওয়া হলে পরের জন্ম বলে কিছু থাকলে তখনো আমি তোমার পিছু নিব৷
মহুয়াঃ তোর মতো পুরুষদের দেখলেই ঘৃণা হয়।
মাহিনঃ ঘৃণা থেকে একদিন ভালোবাসা হয়ে যাবে, ভালোবাসায় না রাখলেও ঘৃণায় রেখেছো এটাই অনেক।
মহুয়াঃ সাইকো! তোর মৃত্যু আমার কাছে নিয়ে এসেছে।
মাহিনঃ এর আগেও অনেক বার চেষ্টা করে ছিলে পেরেছো.?
মহুয়া রাগে দুঃখে মাহিনের কলার ছেড়ে দিল।
মহুয়াঃ আমার থেকে আমার স্বামী সংসার সব কেঁড়ে নিয়েছো এখন ত থেমে যাও, না হয় আমি নিজেই শেষ হয়ে যাব!।
মাহিনঃ তোমার স্বামী কতোটুকু বিশ্বাস করত তোমাকে? সে কি একবার তোমার খুজ নিয়েছে.?
মহুয়াঃ আমার স্বামীর বিষয় আর একটা কথাও শুনতে চাই না তোমার মতো পাপীর মুখে। সে তোমার মতো জঘন্য মানুষ নয়। আমি তার বিশ্বাস, ভালোবাসা কে ঠকিয়েছি তোমার জন্য। আমার থেকে যেভাবে আমার সব কেড়ে নিয়েছো ঠিক সেভাবে এক এক করে সব হারাবে তুমিও।
মাহিন হাসলো বিশ্রী হাসি। মহুয়ার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে এক চিৎকারে সবাই পেছন ফিরে তাকালো।
মিম চিৎকার দিয়ে ছুটে গেল রাস্তার পাশে আলভির ছিটকে পড়া শরীরের কাছে।
মহুয়া ছেলের রক্তমাখা হাতটা দেখেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।