#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সিজন_2
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
ভাগ্যের নির্মমতার শিকার একটা মেয়ের জীবনে ঝড়ো হাওয়ার মতো দ্বিতীয় বার এলো প্রেম! ভালোবাসায় রঙিন হয়ে উঠলো তার দুনিয়া। কিন্তু বাস্তবতা যে আরও কঠোর!!.মেয়েটির সেই রঙিন জীবনে নজর পড়লো এক কালো ছায়ার।….
” অফিসে যাবে না!..?”
ছোট বোনের ডাকে ডায়রি থেকে চোখ তুলে পেছনে তাকায় মহুয়া। দ্রুত ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেলে।
মিম বড় বোনের চোখে পানি দেখে ব্যস্ত পায়ে কাছে এসে বললো,’ কি হয়েছে তোমার!.? আজ এতোগুলা বছর পর তোমার চোখে পানি। কিছু কি হয়েছে আপু.?’
মহুয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো। মিমের দিকে তাকিয়ে বললো,’ বাবু কই.?’
মিমঃ এখনো ঘুমিয়ে আছে।
মহুয়াঃ ঘুম ভাঙলে ওকে ফ্রেশ করিয়ে তুই ভার্সিটিতে চলে যাস।
মহুয়া ডায়েরিটা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
মিমের মনে হলো তার বোন জেনো ওর কাছ থেকে পালিয়ে গেলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকালো মিম। কখন কার জীবন পাল্টে যায়, ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
মহুয়া শাড়ির আঁচল ঠিক করে মায়ের রুমে প্রবেশ করলো।
রাবেয়া বেগম নাতিকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছেন৷ মহুয়া ডাকতে গিয়েও ডাকলো না আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে রিক্সার জন্য। কিছু সময় দাঁড়াতেই একটা রিক্সার দেখা পেল। রিক্সায় উঠতেই রিক্সা চলতে শুরু করলো গন্তব্যের দিকে। মহুয়া রাস্তার পাশে চোখ ফেলতেই বুক কেঁপে উঠল, এলোমেলো দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো, আবার তাকালো রাস্তার পাশে বাঁকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে একটা যুবক , মহুয়ার রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল, ইচ্ছে করলো এই চোখ দিয়ে এই যুবকটাকে শেষ করে দিতে, পৃথিবী থেকে বিলীন করে দিতে, আজ ওর পরিস্থিতি ভিন্ন হতো,জীবন সুন্দর হতো যদি না এই কালো ছায়া ওর জীবনে পা না রাখতো। মহুয়া রাগে বিরবির করে বলে উঠলো, ‘ মাহিন!!!’
___________________
ছাঁদের রেলিঙের উপর বসে গিটারের টুংটাং শব্দ তুললো একটি মেয়ে, চুল ছাড়া,এলোমেলো দৃষ্টি আকাশের পানে তাকিয়ে গান ধরলো ” তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম, কি দোষ দিবি তাতে..?
বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই,সকাল দুপুর রাতে..।’
আগুন জ্বেলে পুড়লাম আমি,দিলাম তাতে ঝাঁপ,
তোর আমার প্রেমে ছিলো রে বন্ধু, ছিলো পুরোটাই পাপ।”
চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো হাতে। গান বন্ধ করে হাতের দিকে তাকালো। পাশেই বিয়ের কার্ডটা অবহেলায় পড়ে আছে।
” ছোঁয়া! ”
নিজের নাম কারো মুখে শুনেও ছোঁয়া কোনো রেসপন্স করলো না। সেই আগের মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিয়ের কার্ডের দিকে, কি সুন্দর করে ভালোবেসে বানিয়েছে কার্ডটা! আজ এই কার্ডে ওর নাম থাকার কথা! আজ তো ওর হাতে মেহেদীর রঙে রঙিন হওয়ার কথা, আজ তো ওর প্রিয় মানুষটির হলুদে নিজের শরীর ছুঁয়ে যাওয়ার কথা! তাহলে আজ ওর জায়গায় অন্য কেউ কেনো.!?? ছোঁয়ার নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হলো। গিটার হাত থেকে ফেলে রেলিঙের থেকে নিচে তাকালো চার তলা থেকে পড়লে কি সে মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে!.? ছোঁয়া আর কিছু ভাবতে পারলো না লাফ দিতে গেলেই কেউ একজন ওর হাত ধরে টান দিয়ে রেলিঙ থেকে নিচে ফালিয়ে দিল।
ছোঁয়া ছাঁদে পড়ে হাতে ব্যথা পেলো।তাও কোনো শব্দ না করে উপরে তাকালো।
মেঘলা রেগে বলে উঠলো, ‘ তোমার সমস্যা কি!!.? ভয় বলতে কি কিছু নেই! আজ যদি কিছু হয়ে যেত.? এটা কেমন পাগলামি ছোঁয়া! তুমি বাচ্চা না।রেলিঙের উপর এভাবে কেউ বসে!..?।
ছোঁয়া চোখের পানি মুছে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল।
মেঘলা ছোঁয়ার পাশে বসলো।
ছোঁয়া নিজেকে সামলাতে না পেড়ে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে শুরু করলো।
আজ যে ওর মহুয়াকে খুব বেশি প্রয়োজন কোথায় আছে মহুয়া!…? ও কি বেঁচে আছে.?
মেঘলার নিজেরও কান্না পেলো, এই চঞ্চল মেয়েটার জীবন কেনো এমন হলো! ভালোবাসা তো পাপ নয় তবুও কেনো এতো যন্ত্রণা দেয়!.?। এই যে চোখের সামনে প্রিয় মানুষের বিয়ে দেখার চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। এটা যে মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়েও কষ্টের। অথচ বিপরীত মানুষটি কতো আনন্দে আছে নতুন হবু বউ নিয়ে। কথায় বলে না” যেই পুরুষের নাকে লেগে আছে হাজারো নারীর ঘ্রাণ সেই পুরুষ কিভাবে বুঝবে এক নারীর টান।” আজ জেনো নির্জনের মাঝে সেই সব পুরুষদের খুঁজে পেলো মেঘলা।
মেঘলাঃ তোমাকে নিতে এসেছে তোমার মামা মামী নিচে চলো।
ছোঁয়া নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।
মেঘলাঃ লম্বা করে শ্বাস নাও। তুমিও দেখিয়ে দাও তুমি দুর্বল নও। সে পারলে তুমিও পারো প্লিজ ছোঁয়া তোমাকে আর এভাবে দেখতে পারছি না। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি নির্জ….
ছোঁয়াঃ প্লিজ ভাবি ভাগ্য আমার খারাপ আমি কেনো অন্য কাউকে দোষ দিব! সে আমার নয় আমি মেনে নিয়েছি আমার নিয়তি। আমি দুর্বল নয় তার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়ে ছিলাম। তুমি মামা-মামী কে বলো আমি আর আমার আম্মু কাল সকালে আসছি।
মেঘলাঃ তুমি আসবে এটাই অনেক ছোঁয়া নিজেকে শক্ত করো। নিজেকে সময় দাও, নিজের কাজে মন দাও। আজ কতোদিন হসপিটাল যাও না, এভাবে অনিয়ম করলে প্যাশেন্টের কি হবে.?
ছোঁয়া বুঝলো মেঘলা কথা ঘুরিয়ে ওকে এই যন্ত্রণার দুনিয়া কিছু সময়ের জন্য ভুলাতে চাচ্ছে!
ছোঁয়া হাসলো…
মেঘলার ফোন বেজে উঠলো, ফোনে তাকিয়ে দেখে শ্রাবণ কল দিয়েছে।
মেঘলা ফোন কেটে ছোঁয়ার দিকে তাকালো।
ছোঁয়া বসা থেকে উঠে মেঘলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
ছোঁয়াঃ উঠে আসো প্রেগন্যান্ট অবস্থায় রাতে ছাঁদে থাকা ভালো না।
মেঘলা সাত মাসের পেটটা নিয়ে ছোঁয়ার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো।
ছোঁয়া নিচে আসতেই আজাদ চৌধুরী আর আমেনা বেগম কে দেখলো।
নিরুপমা চুপচাপ রান্না করছেন তাদের জন্য।
ছোঁয়াদের নতুন বাসার রুম গুলো ছোট ছোট, দুই রুম একটা ড্রয়িং রুম, একটা কিচেন, একটা বাথরুম। দুই মা মেয়ের এতেই সুন্দর চলে যায়। এই প্রথম আজাদ চৌধুরী এসেছেন বোনের বাড়িতে।
ছোঁয়া মামা-মামী কে সালাম দিয়ে কথা বলে মায়ের কাছে রান্না ঘরে গেলো পিছু পিছু মেঘলাও গেলো।
নিরুপমা মেঘলাকে বকা দিয়ে সোফায় বসালো।এই সময় কোনো কাজ করা ঠিক নয়, সাবধানে চলতে হয়। আমেনা বেগম কেও বকা দিয়ে বললেন,’ কেনো মেঘলাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। ‘
আমেনা বেগমঃ বউমা আমার কথা শুনলে তো আপা। আমি নিষেধ করে ছিলাম তাও ছোঁয়াকে নিতে এসেছে।
নিরুপমার হাত থেকে গেলো। নিজেকে সামলে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো, ‘ বুঝলাম না ভাবি।’
আজাদ চৌধুরীঃ আমরা এসেছি তোকে আর ছোঁয়া মাকে নিতে।
নিরুপমা শক্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ ক্ষমা করবেন ভাই আমার মেয়ে কখনো ওই বাড়িতে পা রাখবে না। আপনারা এসেছেন খুশি হয়েছি। এই বিষয় আর কোনো কথা হোক আমি চাই না।’
আজাদ চৌধুরী কিছু বলতে গেলে আমেনা বেগম চোখের ইশারায় নিষেধ করলেন।
ছোঁয়া রান্নাঘর থেকে মেয়ের সব কথা শুনলো। হঠাৎ করে নরম মনের মা টা আজ কতো কঠিন হয়ে গেছে। ছোঁয়া নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে এমন একজন মা পেয়ে,যে কিনা যে কোনো বিপদে ডাল হয়ে এসে দাঁড়ায় ছোঁয়ার সামনে।
মেঘলার ফোনে আবার কল আসলো শ্রাবণের।
মেঘলাঃ হ্যালো
শ্রাবণঃ………
মেঘলাঃ সত্যি!!..???
শ্রাবণঃ……
মেঘলাঃ ঠিক আছে।
কল কেটে মেঘলা আজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ আব্বু আহনাফ দেশে আসছে।’
আমেনা বেগম নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলেন না। আজ কতোগুলো বছর পর ছেলে আসবে শুনলেন।
আমেনা বেগমঃ তুমি মজা করছো তাই না বউমা!.?
মেঘলাঃ না আম্মু সত্যি বলছি, আজ রাতেই আসছে।
আমেনা বেগম খুশিতে কাদতে শুরু করলেন আজ পাঁচ বছর ছেলেটা রাগ,অভিমান আর এক বুক কষ্ট নিয়ে দেশ ছেড়ে ছিল। এই পাঁচ বছর কারো সাথে এক মিনিটও কথা বলেনি। আমেনা বেগম সাথে সাথে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলেন। নিরুপমাও জোর করলো না থাকতে, আহনাফ আসছে তাই। নিরুপমা খুব যত্ন করে নিজের চোখের পানি আড়াল করে নিলো। যেই বাড়ি থেকে এতো অপমানিত হয়ে বের হতে হয়েছে সেই বাড়িতে আর কখনো তাদের ছায়াও পড়বে না।
_______________
রাত দশটায় বাড়ি ফিরলো মহুয়া সাথে সাথে ছোট একটা বাচ্চা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মহুয়া কে। আদুরে গাল গুলো মহুয়ার কাঁধে রেখে বলে উঠলো, ‘ মাম্মা ডিম আমাতে মেরেতে..’
বাচ্চাটার সকল অভিযোগ শুনলো মহুয়া মন দিয়ে। তারপর কাঁধ থেকে মাথা তুলে গালে পাপ্পি দিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমার আলভি আব্বুকে খালামুনি মেরেছে!? খালামুনিকে ইচ্ছে মতো মেরে দিব আম্মু।’
আলভি বুঝদার বাচ্চার নতো মাথা দুলালো।
পেছনে কোমরে হাত দিয়ে কালি মাখা মুখে দাঁড়িয়ে আছে মিম।এক তো ওকে ডিম বলেছে, ওর এতো সুন্দর নামটাকে ডিম বানিয়ে দিল!! সাথে ও ঘুমিয়ে ছিল এই বিচ্ছু গিয়ে সারামুখে কালি মেখে খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। মিম আয়নায় নিজের মুখ দেখে শুধু রেগে তাকিয়েছে তাতে এই ছেলে মাকে দেখে অভিনয় শুরু করেছে।
আলভি মিমের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে চোখ মারলো তাতে মিমের মুখ হা হয়ে গেলো। এই ছেলে সারাদিন টিভি দেখে বাঁদর হয়ে যাচ্ছে।
মহুয়া মিমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,’ তোর এই অবস্থা কেনো!.?’
মিমঃ তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো।সব তো আমার নামে বিচার দিল, নিজে কি করেছে সেটাও বলুক।
মিমের রাগী ধমকে ভয়ে আলভি মায়ের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো এক চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইলো মিমের দিকে।
______
রাবেয়া বেগম মহুয়ার জন্য খাবার গরম করে ডাকলো।
মহুয়া ফ্রেশ হয়ে আলভিকে নিয়ে টেবিলে বসলো।
মহুয়াঃ তোমরা খেয়েছো।
রাবেয়া বেগমঃ মিম খেয়েছে।
মহুয়াঃ আর তুমি.? মা কতোবার নিষেধ করেছি আমার জন্য অপেক্ষা কর না, আমার আসতে রাত হয়ে যায়।
রাবেয়া বেগমঃ তুই বুঝবি না মায়ের কি টেনশন হয় সন্তানের জন্য। সারাদিন কি খেইলি না খাইলি নতুন শহরে একা এতো রাতে অফিস থেকে একা আসতে হয়।
মহুয়াঃ মা নতুন কোথায় আজ পাঁচ বছর এই শহরে, তোমার এখনো নতুন মনে হয়। আসো বসো আগে খেয়ে নাও।
আলভি চুপচাপ তাকিয়ে দেখছিল।। মা মেয়ের কথা শুনছিল। সে তো কিছুই বুঝে না শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
মহুয়া খাওয়া শেষ করে রুমে আসলো, মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ।
” কতোদিন এই চার দেওয়াল আমাকে বন্ধি করে রাখবে! তোমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে!,পালিয়ে বেড়ালেই কি বাঁচা যায়! ওই জেল খানায় চার দেওয়াল আমাকে আটকে রাখতে পারেনি ফিরেছি তোমার দরজায়। আমার সন্তানের কাছে”
মহুয়ার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেলো ভয়ে, ঘৃণায় কেঁপে উঠল সারা শরীর। তাহলে কি ও সত্যি দেখেছিল সকালে!! মাহিন ছাড়া পেলো কবে..?আর ওকে খুঁজে পেলো কিভাবে!.? পাঁচ বছর আগের সেই কালো অধ্যায় কি আবার জীবনে আসতে যাচ্ছে!! ? মহুয়া আলভিকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘ এই সন্তান আমার আর…
চলবে…
(যারা সিজন 1 পড়েননি আগে সিজন 1 পড়লে বুঝতে ভালো হবে।.)
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।