#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
২মাস পর,
দেখতে দেখতে ২মাস চলে গেলো।এই দুই মাসে অনেক কিছু পরিবর্তন না হলেও ছোটখাটো কিছু হলেও পরিবর্তন হয়েছে।প্রিসা আর অয়ন পুরোপুরি প্রেমিক-প্রেমিকা না হলেও নিয়ম করে তাদের ফোনে কথা হতো,তাও বেশি না ১ কি ২ মিনিট।তাদের কথা বলার টপিক সবসময় একিই ছিল।এই যেমন সকালে খেয়েছে কিনা,ভার্সিটিতে প্রিসা পৌঁছেছে কিনা বা অয়ন অফিসে গিয়েছে কিনা,বাড়িতে ফিরেছে কিনা এইসব।বেশিরভাগ সময় অয়নই প্রিসাকে ফোন দিত তবে মাঝে দুএকবার প্রিসাও ফোন দিয়েছিল।এভাবেই চলছিল তাদের দিনকাল।কয়েকদিন আগেই প্রিসা পরীক্ষা শুরু হয়েছে।পরীক্ষা তাই অয়ন বলেছে শুধু একবারেই তাদের কথা হবে তাও অয়ন নিজে ফোন দেবে।প্রিসাও অয়নের কথাই রাজি হয়ে যায়।তবে গত তিন-চারদিনে অয়ন শুধু একবারেই তাকে ফোন দিয়েছে।প্রথমে তো প্রতিদিন একবার হলেও ফোন করতো প্রিসাকে কিন্তু আসতে আসতে তা কমতে শুরু করে।কালকে প্রিসার পরীক্ষা কিন্তু সে কোনভাবেই পড়াই মন বসাতে পারছে না,তার মনে আর মাথায় তো শুধু একটাই চিন্তা ঘুরছে এখন আর সেটা হচ্ছে ‘অয়নে ফোন দেবে কি দেবে না’।
অনেক সময় নিয়ে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব সাইডে রেখে অয়নের নম্বরে ডায়াল করে।কিন্তু আফসোস অয়নের ফোন তো বাজছে কিন্তু সে রিসিভ করছে না।কিছুটা সময় পর আবার ফোন দেয় প্রিসা কিন্তু এভাবো ফলাফল শূন্য।
প্রিসাঃকি হলো?অয়ন ভাইয়া ফোন তুলছে না কেন?আচ্ছা উনি কি কোন বিষয় নিয়ে আমার উপর রাগ করেছেন?কিন্তু আমি তো এমন কোন কাজ করিনি যাতে উনি রাগ করেবেন বা কষ্ট পাবেন।তাহলে?আরে ধুর,হয়তো উনি ব্যস্ত আছে।মাএ নতুন নতুন অফিস শুরু করেছে তো তাই হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে।আমি বরং এখন পড়তে বসি,নয়তো কালকে পরীক্ষায় কিছু লিখতে পরবো না।আর যদি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়তো আমি কি গেলাম।
প্রিসা নিজেকে অয়ন ব্যস্ত আছে বলে শান্তনা দিয়ে আবার পড়তে বসে।
__________________________________________
অবশেষে দীর্ঘ সময় পর আজ প্রিসার পরীক্ষা অবশেষে শেষ হয়েছে কিন্তু তার মন মোটেও ভালো নেয়।কারণ আজ প্রায় ১ সপ্তাহ অয়নের সাথে প্রিসার কোন যোগাযোগ নেই।না অয়ন নিজে ফোন দেয় আর না প্রিসা ফোন দিলে রিসিভ করে।সেইদিনের পর অয়নের সাথে প্রিসার সর্ব্বোচ তিন বার কথা হয়েছে তাও কিছু সময়ের জন্য।আজও প্রিসা অয়নে ফোন দিয়েছিল কিন্তু তার ফোন প্রত্যেক বারেই বন্ধ বলছে।তাই প্রিসা ঠিক করেছে পরেরদিন সে অয়নের অফিসে যাবে কাউকে না বলে।
পরেরদিন সকালে,
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে প্রিসা।তারপর নিজ হাতে অয়নের জন্য রান্না করতে শুরু করে।প্রিসা রান্না তেমনটা জানে না,তাই ইউটিউব দেখেই রান্না শেষ করে।রান্না শেষ হলে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।তারপর অপেক্ষা করতে তাকে কখন সময় হবে আর কখন সে অয়নের সাথে দেখা করতে পারবে।অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টা এলো।প্রিসা তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে অয়নের অফিসের উদ্দেশ্য।অফিসে এসে রিসেপশনিস্ট থেকে অয়নের কেবিন কোনটা জিজ্ঞেস করে নেয়,তারপর লিফটে উপরে উঠে যায়।কিন্তু অয়নের কেবিনে গিয়ে প্রিসার মন ভেঙে যায় কারণ কেবিনে কেউ নেই পুরো কেবিন খালি।দুঃখী মন নিয়ে প্রিসা নিচে নেমে আসে।রিসেপশেনিস্ট থেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন অয়ন এখন অফিসে নেই,কিছু কাজে নাকি বাইরে গিয়েছে।সায়নের কথা জিজ্ঞেস করলে রিসেপশেনিস্ট বলে সে নাকি মিটিং এ আসে।প্রিসা খাবার গুলো রিসেপশেনে রেখে বলে এগুলো যাতে তিনি সায়নকে দিয়ে দেয় কারণ প্রিসা দুজনের জন্যই খাবার এনেছিল।
দুঃখী মন নিয়ে বাড়ি ফিরছে প্রিসা।কত আশা করে এসেছিল সে যে এতোদিন পর আবার অয়নের সাথে তার দেখা হবে,অয়নকে তার নিজের হাতে রান্না করা খাওয়ার খাওয়াবে কিন্তু কোন আশায় তার পূরণ হয়নি তার।ট্রাফিক জ্যামে আটকে পরে প্রিসা গাড়ি হঠাৎ তার চোখ পরে কিছুটা দূরে গাড়িতে থাকা একটা লোকের দিকে।প্রিসা ভালো করে তাকিয়ে দেখে,না সে ভুল না ঠিকই দেখেছে লোকটা আর কেউ না অয়ন।ট্রাফিক জ্যাম খুলে গিয়েছে প্রিসা তার ড্রাইবারকে বলে অয়নের গাড়িকে ফলো করতে।প্রিসার মনে আবার একটা আশা জেগেছে যে সে অয়নের সাথে দেখা করতে পারবে।অয়নের গাড়ি একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামে।প্রিসা অয়নের বের হওয়ার অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষণ পর অয়ন বের হয় তবে সে একা নয় তার সাথে আরো একজন বের হয়,সে কোন পুরুষ না একটা কমবয়সী মেয়ে।অয়ন আর মেয়েটি রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে পরে।প্রিসার কেন যে ভেতরে ঢুকতে ভয় ভয় লাগছে,ভিন্ন নেগেটিভ চিন্তা তার মাথায় ভর করছে।প্রিসা সবকিছু সাইডে রেখে তারপর ভেতরে ঢুকে।প্রিসা নিজের মুখ ঢেকে নিয়েছে যাতে অয়ন তাকে দেখলেও যাতে চিনতে না পারে।প্রিসা ভেতরে গিয়ে একটা টেবিলে বসে।এদিক-ওদিক তাকিয়ে অয়ন আর ওই মেয়েটাকে খুঁজতে থাকে আর একসময় পেয়েও যায়।প্রিসা খুব খারাপ লাগছে অয়নকে একটা মেয়ের সাথে দেখে।অয়ন আর মেয়েটা হেসে হেসে কথা বলছে,যেটা দেখে প্রিসার আরো বেশি খারাপ লাগছে।কি মনে করে যেন প্রিসা অয়নকে ফোন দেয় কিন্তু অয়ন ফোন রিসিভ করে না।প্রিসা আবার দেয় কিন্তু এবারো অয়ন দেখেও ফোন রিসিভ করেনি।প্রিসার চোখে পানি জমতে শুরু করে,প্রিসা আবারো অয়নে ফোন দেয় কিন্তু এবার অয়নের ফোন বন্ধ বলছে।প্রিসা কোনবতে নিজের চোখের পানি গরিয়ে পরা থেকে আটকাচ্ছে।প্রিসা ওখান থেকে উঠে বাইরের দিকে চলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরে তবে শেষবারের মতো আরেকবার পেছনে ফিরে তাকাই কিন্তু যেটা দেখে তাতে প্রিসা আর নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি কারণ ওই মেয়েটা অয়নের হাতে হাত রেখে কথা বলছে।প্রিসা আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।গাড়িতে প্রিসা চুপচাপ বসে থাকে কারণ এখন কান্না করলে ড্রাইবার বাসাই কাউকে না কাউকে বলে দেবে।বাড়িতে এসে প্রিসা সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়,সাওয়ার ছেড়ে নিচে বসে পড়ে আর চিৎকার করে কান্না করতে থাকে।কেন যেন প্রিসার কান্না পাচ্ছে,প্রচুর কান্না পাচ্ছে।
প্রিসাঃকেন উনি আমার সাথে এরকম করছেন?কেন,কেন?কি করেছি আমি যে উনি আমাকে এভয়ড করছেন?আজকে কেন উনি আমার সাথে এরকম করলেন?কি হতো একবার ফোনটা তুললে?ফোনটা না ধরুক অন্তত একটা মেসেজ তো করতে পারতো।কিন্তু উনি,উনি তো ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছেন।(কান্না করতে করতে)
আরো কিছুক্ষণ সাওয়ারের নিচে বসে কান্না করে প্রিসা।
প্রিসাঃআচ্ছা এমনটাও তো হতে পারে মেয়েটা ওনার কোন ক্লাইন্ড।হয়তো ওনারা কোন মিটিং করার জন্য রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল।আর কথা বলতে বলতে হয়তো মেয়েটা ওনার হাতে উপর ভুলে হাত রেখে দিয়েছে।হ্যাঁ এটাই হবে।ধুর আমিও না পাগলের মতো ওনাকে ভুল বুঝছিলাম।
প্রিসা সাওয়ার অফ করে ড্রেস চেঞ্জ করে বাইরে বেরিয়ে আসে।প্রিসার এখন মোটেও খাবার খাওয়ার ইচ্ছা নেই তাই সে না খেয়েই শুয়ে পড়ে।কিন্তু প্রিসা যতই এটা সেটা বলে নিজেকে বোঝাক না কেন কিন্তু তার মাথা থেকে বিষয়টা বেরই হচ্ছে না।যতবারই সে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা মনে করছে ততবারই তার চোখ থেকে আপনা-আপনি পানি পড়ছে।এসবকিছু ভাবতে ভাবতে আর কান্না করতে করতে প্রিসা একসময় ঘুমিয়ে পরে।
রাতে,
প্রিসার কিছুই ভালো লাগছে না তাই সে মিলার কাছে যায়।মিলার রুমে এসে দেখে মিলা নেই,ওয়াশরুমের গিয়ে দেখে সেখানেও নেই।তাই প্রিসা বিছানায় বসে মিলার অপেক্ষা করতে থাকে।তখনই ফোনের আওয়াজ তার কানে আসে,তাকিয়ে দেখে মিলার ফোন বাজাচ্ছে।প্রিসা ধরতে চাইনি তাও কেন যেন ফোনটা তুললো।স্ক্রিনে লেখা ‘অয়ু’,প্রিসা কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে কিন্তু রিসিভ করে যার গলা শুনতে পাই এতে প্রিসা প্রচুর অবাক হয়।কারণ ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি আর কেউ না বরং অয়ন।প্রিসা ফোনটা কান থেকে সরিয়ে স্ক্রিনে থাকা নামটা দেখে,এবার সে বুঝতে পেরেছে ‘অয়ু’ মানে কি।প্রিসা ফোনটা আবার কানে দেয়,ওপাশ থেকে অয়ন হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে।
অয়নঃহ্যালো মিলা,শুনতে পাচ্ছো?
প্রিসাঃহুম।
অয়নঃকি হয়েছে মন খারাপ?
প্রিসাঃউহু…..(কোনভাবে নিজের কান্না আটকে)
অয়নঃআচ্ছা বাবা সরি রাগ করো না আসলে মিটিং ছিলাম তাই ফোন করতে পারিনি।
প্রিসাঃহুম।
অয়নঃআচ্ছা এসব কথা ছাড়ো তুমি বাসাই বলেছো?
প্রিসাঃ(কি বলার কথা বলছেন উনি?— মনে মনে)
অয়নঃকি হলো?তুমি বাসাই আমাদের কথাগুলো বলেছো?
অয়নের এরকম কথাশুনে প্রিসার ভয় হতে থাকে।মুখে কোন কথাই বের হচ্ছে না,সে চাইছে অয়নের সাথে কথা বলতে কিন্তু কথা যেন গলাই আটকে রয়েছে।
অয়নঃহ্যালো মিলা?শুনতে পাচ্ছো?হয়তো শুনতে পাচ্ছে না,হ্যালো?
অয়ন ফোন কেটে দেয় কিন্তু প্রিসা এখনো ফোনটা কানের কাছে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আস্তে আস্তে ফোনটা সে নিচে নামাই।কি মনে করে যেন প্রিসা মিলার ফোন কল’স চেক করে।কিন্তু যেটা দেখে সেটা প্রিসা মোটেও আশা করেনি।অয়নের সাথে মিলার প্রায় প্রতিদিন কথা হতো,বেশিরভাগ কল তো অয়নই মিলাকে দিয়েছে।আর কথা বলার সময়ও অনেকটা বেশি প্রায় দশ-পনেরো মিনিট।প্রিসা মোবাইলটা রেখে চুপচাপ চলে আসে।নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।প্রিসার চোখ থেকে পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।মাথা ব্যথা করছে প্রিসার,প্রচুর মাথা ব্যথা করছে।তাই একটা মাথা ব্যথার ওষুধ আর একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে প্রিসা।ঘুমানো আগে বলে এসেছে যাতে কেউ তাকে ডিস্টার্ব না করে।
পরেরদিন সকালে,
হালকা শোরগোলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে প্রিসার।ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বাইরে যায় কিন্তু বাইরে এসে যে এরকম কিছু দেখবে সেটা সে মোটেও আশা করেনি।
চলবে……