#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৮
#আরশিয়া_জান্নাত
হ্যালো এলাইনা, কেমন আছ?
আমি বেশ আছি, তোমার কি খবর তাই বলো?
বিশেষ ভালো নেই,
আমি জানি তুমি তোমার দাদীকে হারিয়ে খুব আপসেট আছ। কি করবে বলো, এই পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী নয়।
সেটা বাদেও অনেক কিছু ঘটে গেছে এলাইনা।
কি রকম?
মনে আছে মিস্টার আরুশের কথা? যাকে তুমি নার্সিসিস্ট বলেছিলে?
হ্যাঁ, তোমার প্রথম ডিল যার সঙ্গে ছিল সেই তো?
হুম।
কি হয়েছে তার?
ইসরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবটা খুলে বলল এলাইনাকে। এলাইনা শুনে বিশেষ অবাক হলো না। বরং সে যেন জানতো এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক না।
দেখেছ আমি তো আগেই বলেছি, এরা খুব প্রতিশোধ পরায়ণ হয়। তোমার কাছে সেটা ছোট হলেও তার জন্য ছোট নয়।
তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার শোনো, তার ঘরে অনেক আয়না কিন্তু সবগুলোই ঢেকে রাখে সবসময়। আমি তাকে আয়না দেখতে দেখিনি এ কয় দিন। এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
এলাইনা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ইসরা ব্যাপারটা এমন নয়তো তোমার কমেন্ট শুনে সে আয়না দেখার সাহস হারিয়ে ফেলেছে?!
আমি কি এতোটাই কঠিন কথা বলেছি?
সেটা বুঝতে পারছি না।তবে একটা কথা কি জানো, আমরা যখন কমেন্ট পাস করি বিশেষ করে কোনো ব্যক্তির বাহ্যিক রূপ নিয়ে সেটা যত সিম্পল হোক না কেন মন থেকে সহজে মুছে না। ধরো একটু চাপা রঙের কাউকে তুমি বললে, তোমার রংটা আরেকটু উজ্জ্বল হলে সুন্দর হতো। কিংবা মোটা কোনো মেয়েকে বললে একটু হাঁটাচলা করো, শরীরটার যত্ন নাও। এটা শুনতে অতোটা খারাপ না লাগলেও যাকে বলেছ তার কয়েকদিন মন খারাপ হবার জন্য যথেষ্ট। এটা একটা সাধারণ মানুষের জন্যই ভুলে যাওয়া কষ্টকর হয়, চিন্তা করো আরুশের মতো পেশেন্টের বেলা কেমন হতে পারে?
ইসরা লজ্জিত গলায় বলল, আমি আসলেই বুঝতে পারিনি ঘটনাটা এতো দূর গড়াবে। তাহলে কখনোই বলতাম না।
ইসরা আমি জানি তুমি খুব ভালো আর ভদ্র মেয়ে। তোমার ম্যানার্স নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আসলে সেদিনের ঘটনাটাই এমন ছিল তুমিও চটে গিয়েছিলে। তবে যেহেতু বিয়েটা হয়েই গেছে কি আর করবে, দেখো তাকে কনভিন্স করতে পারো কি না,,
আমার মাথা কাজ করছেনা,, ফেডাপ লাগছে।
ওহ কাম অন ইসরা, আমি জানি তুমি এটা তুড়ি বাজিয়ে সলভ করতে পারবে। আচ্ছা তুমি কি আর সিডনী ব্যাক করবে না? এতো ভালো পজিশন থেকে কুইট করবে?
আসলে এতো কিছু ঘটে গেছে এসব নিয়ে ভাবার সময় পাইনি। আমি তো ৬মাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। দেখি এরমধ্যে ব্যাক করতে পারি কি না।
আমাদের প্ল্যান ছিল তোমার বিয়েতে বাংলাদেশ যাওয়ার। তা আর হলো না,,
এখনি হতাশ হয়ো না,ইনভিটিশন পেলেও পেতে পারো।
ওয়াও! তাহলে অবশ্যই আমরা আসবো।
আচ্ছা, রাখছি এখন ভালো থেকো।
ওকে টেক কেয়ার।
ফোন রেখে ইসরা ড্রইং রুমে গেলো। সেখানে সারিকা বসে টিভি দেখছিল। ইসরাকে দেখে বলল, ভাবী এসো, জ্বর কমেছে তোমার?
হুম। বাকি রা সব চলে গেছে?
ঐটা তো পরদিনই গেল। তুমি অসুস্থ থাকায় দেখো নি। আমিও কাল পরশুর মধ্যে চলে যাবো। এরপর পুরো বাড়িতে তোমার রাজত্ব হিহি।
কি যে বলো তুমি!
একমাত্র ছেলের বৌ হলে এমনটাই হয়। আমার শ্বশুরবাড়িতে আবার মানুষের অভাব নেই।
আচ্ছা সারিকা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
হুম?
তোমার ভাইয়ার রুমে অনেক আয়না দেখলাম, তার বুঝি আয়নার অনেক শখ?
সারিকা হেসে বলল, ভাইয়ার কথা আর বলো না। সে সারাক্ষণ নিজেকে দেখতে পছন্দ করতো। আয়না পেলেই হলো দাঁড়িয়ে নিজের গুণগান গাইতে শুরু। ওর লাইফে ও সবচেয়ে বেশি নিজেকে ভালোবাসে। আমি মেয়ে হয়েও যা করিনি আমার ভাই তা করেছে। নিজের সম্পর্কে এক চুল ও ছাড় দিতো না।
সব দেখছি পাস্ট ফর্মে বলছো। উনি এখন তেমন নেই?
নাহ। কি জানি হয়েছে এখন। চেইঞ্জ হয়ে গেছে। ওরকম এখন আর করেনা।
ওহ!
ভাবী কফি খাবে? আমি বানিয়ে আনছি?
নাহ তুমি বসো আমি করে আনছি,,
আচ্ছা চলো গল্প করতে করতে বানাই।
।
পতেঙ্গা বিচে বসে আছে আরুশ। চারদিকে বিশেষ কোলাহোল নেই। ঢেউয়ের গর্জন আর বাতাসের শব্দ ব্যতিত শুধু জাহাজের বাঁশিটাই প্রকৃতি আর যান্ত্রিক জীবনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে উপভোগ করতেই সে সন্ধ্যার পর বিচে আসে। রাতের আধারে সাগরটা অন্যরকম মনে হয়। আরুশ মনের অজান্তেই কত কি ভাবতে থাকে। মানুষের ভাবনা চেইন রিয়েকশনের মতো। একবার শুরু হয় তো থামতেই চায় না যতক্ষণ না বাধাগ্রস্থ হয়। আজকাল অফিসে তেমন চাপ নেই। তাই তাড়াতাড়িই বের হওয়া যায়। কিন্তু বাসায় ফেরার ইচ্ছে হয় না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিলে ওদের টিটকারিতে টেকা যায় না। সবার এক কথা নতুন বিয়ে করেছিস তবুও এখন আমাদের কাছে কেন!
আরুশ তাই একাই সময় কাটায় একেক জায়গায়। ইসরাকে বিষয়টা নিয়ে সে অনেক ভেবেছিল। শুরুতে ভেবেছে এমন কিছু করবে যাতে ইসরা ভালো না থাকে। কিংবা ওর বাকি জীবনটা অন্তত শান্তিময় না যাক। ওর ক্যারিয়ার ধ্বংস করলেও কিছু হতো না। ইসরাদের ফ্যামিলি যথেষ্ট রিচ। মেয়ে কিছু না করলেও মাথা ব্যথা হবার নয়। হয়তো দেশে ফিরে ওয়েল সেটেলড ছেলে বিয়ে করে ভালোই থাকবে। তাই ঐ আইডিয়া মনে ধরেনি। সে ভেবেছিল বিয়ে করে ওর লাইফ পার্টনার হওয়াটাই বেস্ট হবে। সামনে রেখে জ্বালাবে, পোড়াবে, মনে শান্তি পাবে। কিন্তু বিয়ে সম্পর্কটা কেমন যেন। এই বাঁধনে যারা পড়ে সবকিছু অন্যরকম হয়ে যায়। অপরপাশের মানুষটার প্রতি চৌম্বক আকর্ষণ অনুভব হয়। আরুশ বুঝে উঠে না এ কি কেবল নারী পুরুষের শারীরিক আকর্ষণ নাকি অন্য কোনো ব্যাপারও আছে।
আরুশ ছোট থেকেই কেবল নিজেকে ভালোবেসেছে। তাই অন্য কারো দিকে দৃষ্টি দেবার ফুরসত পায় নি। তবে ওর জন্য মেয়েরা মরিয়া ছিল সবসময়। আরুশ ও ভাবতো তাকে কোনো মেয়ে রিজেক্ট করবে না। নিজের উপর শতভাগ আত্মবিশ্বাস তার ছিল। এই আত্মবিশ্বাসে ইসরা চরমভাবে আঘাত হেনেছে। এখন ও চাইলেই নিজের খুঁত এড়াতে পারেনা। মানুষ পজিটিভ কথার চেয়ে নেগেটিভ কথায় দ্রুত প্রভাবিত হয় এটার জীবন্ত প্রমাণ সে নিজে হয়ে গেছে। এসবের মাঝেও তার যেটুকু আত্মবিশ্বাস বেচে ছিল, সেই রাতে ইসরার রিয়েকশন সেটাও ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। তার স্পর্শ কোনো মেয়ে এতোটা ঘৃণা করবে সে কল্পনাও করেনি। মেয়েদের সৃষ্টিকর্তা এমনভাবেই তৈরি করেছেন পুরুষমানুষ চাইলেও এদের মোহ এড়াতে পারেনা। সদ্য গোসল করে বের হওয়া রমণী, স্নিগ্ধ শিশিরের মতোই মোহনীয় হয়। আর সেই রমণী আর কেউ নয় তারই অর্ধাঙ্গিনী যার উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। ফুলে ফুলে সাজানো বিশেষ রাত্রী, যেটা তাদের জন্যই বরাদ্ধকৃত। তেমন এক বিশেষ মুহূর্তে আরুশ কেন কোনো সাধু পুরুষের ক্ষেত্রেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতো। আরুশের নিজের প্রতি হীনম্মনতা আরো বাড়ে। ওর মনে হয় ও ভুল করেছে। আগ বাড়িয়ে অপমানিত হয়েছে। ইসরা নিশ্চয়ই তাকে ছেচড়া ভেবেছে! ভেবেছে ওর শরীর পেতে সে মরিয়া হয়ে গেছে। ছিঃ এই লজ্জা আর অপমান কোথায় রাখবে সে?
রুশফিকা! আপনি আমাকে এতো ভাঙছেন কেন বলুন না? আমিতো ছাই হয়ে উড়ে যাবো, অস্তিত্ব থাকবেনা আমার। আমি বুঝি আপনার এতোই অযোগ্য? ডিভোর্সী খেতাব নিতেও আপনার কষ্ট হবে না, সব কষ্ট আমার স্ত্রী হয়ে থাকাতেই? …..
ভেতরটা তেতো হয়ে উঠে। ঠোঁটের মাঝে স্থান পায় নিকোটিনের কাঠি। অথচ একটা সময় ছিল আরুশ স্মোক করতো না। ঠোঁট কালো হবে, হৃদপিন্ড ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভেবে। এতো সাবধানে থেকেও কি হলো? একটা নারী তো জলজ্যান্ত মানুষটাকেই পুড়িয়ে দিয়েছে, এ আর তেমন কি?
।
বিছানার মাঝে বিস্তর জায়গা খালি রেখে দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। যেন মাঝখানে অদৃশ্য একটা কাটাতার আছে, এটা টপকানো মানেই মৃত্যুদন্ড অবধারিত। নিরবতা ভেঙে ইসরাই কথা বলল, আপনি কি জেগে আছেন?
হুম
আন্টি বলছিলেন আপনি আগে এতো রাত করে বাসায় ফিরতেন না, ইদানিং এমনটা করছেন। আমি জানতে চাইছি এটা কি আমার জন্য? আমার উপস্থিতি কি আপনার সাধারণ জীবনযাপনে খারাপ প্রভাব ফেলছে?
এমনটা ভাববার কারণ?
এটা ভাবতে রকেট সায়েন্স জানতে হয় না। যে কেউ বুঝবে।
বুঝলে বুঝুক হু কেয়ার্স?
ইসরা এবার উঠে বসলো। জোর গলায় বলল, এমনটা করে আপনি কি ভাবছেন আমি ছোট হবো সবার কাছে? সবাই আমার দিকেই পয়েন্ট করবে এতেই আপনি আনন্দ অনুভব করবেন!
আরুশ উঠে চেয়ারে গিয়ে বসলো। গ্লাস থেকে পানি পান করে গলা ভেজালো। কিন্তু কিছুই বললো না। ইসরা খানিকবাদে বলল, আমার কথাটা শুনুন, এই বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি কোনোদিকেই আপনার স্বস্তির কারণ হবো না আরুশ। বরং আপনার জীবনে ক্ষতিকর পদার্থ হয়ে সব দূষিত করবো।
আরুশ শান্ত দৃষ্টিতে ইসরার দিকে তাকালো। কেমন করুণ সেই চাহনী। ইসরার ভেতরটা নড়ে উঠলো যেন। এভাবে তাকিয়ে কি বোঝাতে চাইছে আরুশ?
রুশফিকা! একটা সত্যি কথা বলবেন? আমি কি সত্যিই এতো নগন্য আপনার চোখে? আমার সঙ্গে সংসার করা যায় না?! আপনার কাছে বিয়ে মানে কি আমি জানি না। তবে আমার কাছে এটা খুব দামী একটা সম্পর্ক। আমি বিশ্বাস করি এই সম্পর্ক আমাদের ইচ্ছেতে হয় না। উপরওয়ালা কলকাঠি নাড়েন, আমরা কেবল তার ইশারায় সব করি। বাহ্যিকভাবে হয়তো মনে হয় আমাদের হাতেই বুঝি সব। আদৌতে তা নয়।
যদি ভাগ্যে থাকে আমরা আমৃত্যু একসঙ্গে থাকবো, আর যদি না থাকে তবে আলাদা হবো। তবে আমি বিনা প্রচেষ্টায় ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিতে চাই না। সম্পর্কটাকে সুযোগ দিয়ে দেখতে চাই,,,,
ইসরা উঠে বেলকনীতে চলে গেল। দূর আকাশে দশমীর চাঁদ, ধূসর রাঙা কিছু মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। তার জীবনটা এ কোন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে? একটা সোজাসাপটা প্ল্যান ছিল, সে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিল। হঠাৎ ট্র্যাকটাই বদলে গেল যেন। আরুশের কথাই ঠিক আমাদের জীবনের কলকাঠি আমাদের হাতে নেই, এটা উপর থেকে একজন নিজের ইচ্ছেমতো নেড়ে যাচ্ছেন।
চলবে,,,