#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৫
#আরশিয়া_জান্নাত
আকাশের একটা বিশেষত্ব হলো পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাও না কেন এটি দেখতে একই রকম। সন্ধ্যার পরের সময়টা আমার কাটতেই চায় না, বিশেষ করে ছুটির দিনে। এলাইনাও এই দিনে মহাব্যস্ত থাকে। আমাকে ম্যাথিনসহ কলিগরা বলে আড্ডায় বসতে, কিন্তু কেন জানি সব উইকেন্ডে এটা করতে বোর লাগে! আমি ঘরে বসে মুভি দেখি, বাসায় কল দেই, আঁকিবুকি করি। ঘর গোছাই। তবুও সন্ধ্যায় বিস্তর অবসর থেকেই যায়। আমার ইচ্ছে করে পতেঙ্গায় গিয়ে নিরবে বসে সাগরের গর্জন তোলা ঢেউ দেখি, দূর দূরান্তের জাহাজগুলোর বাতি জ্বলছে, পাথরের উপর বসে রাতে সেই দৃশ্য দেখার সাথে কোনোকিছুর তুলনা হয় না। আমি আমার প্রাণের শহরকে মিস করি। মিস করি সিআরবির প্রশস্ত রাস্তায় কাটানো বিকেলগুলো, আগ্রাবাদের স্ট্রিটফুড কিংবা চকবাজারের কিয়ারির ঝাল ফুঁচকা! বিদেশী মিষ্টি খাবারে স্বাদ পাই না, ইচ্ছে করে ওয়ার্লেসের মেম্বার হোটেলে গিয়ে ভরপেট ঝাল ভর্তা মাখা ভাত খেয়ে আসি।
আমাদের মন কত অদ্ভুদ। দেশে থাকতে বিদেশী খেতে ছুটি, তখন থাই স্যুপ, চাইনিজ খাবার কত টানে। অথচ যখন বিদেশে এলাম অমনি দেশী খাবারের জন্য মন কেমন করে উঠে। মানুষ আসলেই কোনোকিছুতে স্থির হতে পারেনা,,,
তাসফি নামে এক বাঙালী মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছি। মেয়েটা স্বপরিবারে এখানে সেটেলড। কথায় কথায় বলেছিল তার বাসায় একদিন যেতে বাঙালী আইটেম করে খাওয়াবে। বর্ণচোরা আমিটা সেই দাওয়াত এড়িয়ে গেছি। আমার মানুষের সান্নিধ্য ভয় লাগে। মনে হয় মানুষের কাছাকাছি থাকলে আমার ভেতরের খবর দ্রুত বেরিয়ে আসবে। তাই সবসময় একটা সীমারেখা টেনে রাখি। আমার ভেতরটা কেউ না পড়ুক!
দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় ২বছর। এই ২বছর বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি আমার জীবনে।তবে বাংলাদেশে অনেককিছুই ঘটেছে। দাদীর শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো যাচ্ছেনা। তিনি তোড়জোর শুরু করেছেন মৃত্যুর আগে নাতজামাই দেখে যেতে চান। তার ধারণা উনি বিয়ে দিয়ে না গেলে আমাকে আর কেউ বিয়ে দিতে পারবেনা। আমি নাকি বিয়ে থেকে পালাতেই দেশত্যাগ করেছি!
অবশ্য এতে ভুল কিছু নেই। আমি আসলেই বিয়ে এড়িয়ে যাই। এর কারণ ইতোমধ্যেই আপনারা জেনেছেন। আমি রূপকথার রাজকন্যা নই, না আমি অসহায় সিনড্রেলা। ঐ দুই ক্যাটাগরীর জন্য রাজপুত্র বরাদ্দ থাকলেও ইসরার জন্য কেউ নেই। ইসরার রাজকুমার তার মনের দরজায় পা রাখার আগেই ত্যাগ করে চলে যাবে। ধ*র্ষি*তার জীবনে আসবে আবার রাজকুমার!
আচ্ছা মাশুক স্যার আমায় কয়বার ধ*র্ষণ করেছে বলেছি কাউকে? বলা হয় নি হয়তো। কি কঠিন ছিল সেই ডুকরে মরা দিনগুলো। না পারছিলাম কাউকে বলতে না পারছিলাম চুপচাপ সয়ে যেতে। জানাজানি হলে আমারই যে সব হারাবে।ধ*র্ষ*কের দোষ সমাজ দেখে না।সমাজ শুধু পারে ধ*র্ষি*তার দিকে আঙুল তুলতে। হয়তো কোনো খুঁড়ো যুক্তি দিয়ে কোনো না কোনো ভাবে আমারই দোষ খুঁজে আনতো। আমার পোশাক/ব্যবহার/ চালচলন এসবই হতো তার মুখ্য বিষয়। সাথে টেস্টে ফেইল করিয়ে দেয়ার হুমকি তো আছেই!
এই এতো বড় পৃথিবীটায় নিজেকে তখন কি ভীষণ অসহায় লেগেছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমার সাথেই কেন? ওখানে তো আরো অনেকেই ছিল তাদের সাথে তো ঘটেনি। আমারই বুঝি দোষ? কত রাত ফ্যা*নে উড়না বেঁ*ধে*ছি ঝু*লে পড়ার নিমিত্তে, হাতে ধা*রালো চা*কু নিয়ে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল এই নরকসম যন্ত্রণা থেকে বাঁচার একটাই উপায় তা হলো মৃ*ত্যু! কিন্তু মা-বাবার প্রতি তীব্র ভালোবাসা আমায় দূর্বল করে তোলে। মনে হতে থাকে মরে গেলে তাদের মুখে চুনকালি পড়বে।মানহানী হবে,,,,সবমিলিয়ে আমি ছিলাম জলে কুমির ডাঙায় বাঘের মতো বিপদের অথৈ সাগরে। এসব কিছু আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক বেশিদিন নিতে পারেনি। একসময় মেন্টালি সিক হয়ে পড়ি। ডাক্তার বললেন হাওয়া বদল করুন। অবস্থা বেগতিক দেখে ছোট মামার ওখানে শিফট করলো।এক বছর ড্রপ গেল সুস্থ হতে। আমার জোরাজুরিতে স্কুল বদলি হলো, মামার ওখান থেকেই এসএসসি দিলাম, ইন্টার ও দিলাম। এতে ঐ জানোয়ারের শারিরীক টর্চার থেকে বেঁচেছি ঠিকই কিন্তু মনের উপর যে প্রভাব পড়েছেতা তো কাটেনি।আমি মধ্যবয়স্ক পুরুষদের ভীষণ ভয় পেতে শুরু করি। ওদের সাধারণ চাহনীও আমার ভয় লাগে। মনে হয় ওরা সবাই মাশুক স্যারের প্রতিবিম্ব। আমি জানি না আমার ক্ষমতা কতখানি, তবে আমি চাই তার মুখোশ খসে পড়ুক। সে যে ধ*র্ষক সেই কথা প্রকাশ হোক। তার সম্মানহানীহোক। সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখুক। পরক্ষণেই ভয় হয়। ধ*র্ষি*তার লিস্টে নিজের নাম প্রকাশের তীব্র ভয়!
জানি ভীতুর মতো শোনাচ্ছে কথাগুলো। হয়তো আমি সেটাই। তাই তো সবসময় ঘায়েলের মতো পালিয়ে এসেছি ময়দান ছেড়ে। রুখে দাঁড়াবার দুঃসাহস করিনি। তবে মোক্ষম সুযোগ আমার আসবেই এই প্রত্যাশায় বেঁচে আছি সহস্র বছর!
।
সারিকার বিয়ে নিয়ে বেশ ব্যস্ততায় সময় কেটেছে আরুশের পরিবারের। একমাত্র মেয়ের বিয়ে এবং এর আগে পরের নানান ঝাক্কি শেষে অবশেষে ফুরসত মিললো সবার। এর মাঝে আরুশের বাবার হার্টের অপারেশন হয়। বিজনেসটা একাই সামলাতে হয়েছে তাকে। তাই বেশ ব্যস্তময় সময় পার করলো সে।
আরুশ সেইসব ব্যস্ততার মাঝেও ইসরাকে ভুলল না এক মিনিটের জন্যও। মনে মনে প্রতিশোধের তীব্র অনল ঠিকই জ্বলেছে। কিসব যে চলছে তার মনে কেনই বা চলছে সে বুঝতে পারছেনা। তার জীবনে ও যে এর প্রভাব তীব্রভাবেই পড়েছে বলা বাহুল্য! অথচ কথাটা বলার সময় ইসরা ভাবেইনি এই ছোট্ট ঘটনা তার জীবনে বিস্তর পরিবর্তন ঘটাবে,,,,,
মা আসবো?
আয়, কিছু বলবি?
হ্যাঁ একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।
বল কি বলবি?
আমার উপর কতখানি ভরসা করো?
নিজের উপর যতখানি করি,,
আমি যদি কাউকে তোমার সামনে এনে বলি ওকে আমি বিয়ে করবো তুমি কি আপত্তি করবে?
সিত্তুল মুনামনোযোগ দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করলো, তারপর হেসে বললো, তুই কাউকে পছন্দ করতে পারিস এতো আমার জন্য বিস্ময়কর ঘটনা! আমরা সবাই তো ভাবি তুই অন্য কারো দিকে তাকানোর ফুরসত পাস না।
মা, বিষয়টা তেমন নয়।
তবে কেমন?
আরুশ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, এড্রেস দিচ্ছি প্রপোজাল পাঠাও। রিজেক্ট হবার অপশন রেখোনা,,,
ঘটনা কি হয়েছে খুলে বল তো?
বলার মতো কিছু নয় মা।জানো তো আমি না শুনে অভ্যস্ত নই।
কিন্তু মেয়েপক্ষ তোকে রিজেক্ট করবে কেন? যদি তোদের পছন্দের বিয়ে হয়?
এটা লাভ ম্যারেজ হবেনা মা!
তবে একপাক্ষিক? তুই পছন্দ করিস?
আরুশ ইসরার ছবি তার মায়ের সামনে রাখলো। সিত্তুল মুনা ছবিটার দিকে তাকালেন। গোলগাল চেহারা, গায়ের রং শ্যামলার চেয়ে একটু উজ্জ্বল, চোখ জোড়ায় অপার মায়া। এই মায়ায় বুঝি বাধা পড়লো তার ছেলেটা? তাই বুঝি এমন উদাসীনতা? বিরহের সূক্ষ্ম চিহ্ন আকা? মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট হলেও প্রকাশ করলেন না। চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বললে, মেয়ে তো আহামরি নয়। অন্য সাধারণ বাঙালী মেয়ের মতোই। ও তোমায় রিজেক্ট করবে এমন ভাবছো কেন? আর যদি করেও তাতেই বা আমাদের কি করার থাকবে? সবারই ব্যক্তিগত মতামত আছে।
আরুশ থমথমে গলায় বললো, আমি তোমার কাছে কখনো কিছু চাই নি। এই প্রথম চাইছি। তাও খালিহাতে ফেরাবে?
খালি হাতে ফেরাবো বলিনি। চেষ্টা করবো ত্রুটি রাখবোনা। তবে চাই নেগেটিভ হলেও যেন ভেঙে না পড়ো।
বুঝেছি।
আরুশ রুমে এসে বসলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো, আপনার জীবনের শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে নিন মিস রুশফিকা। আমার শান্তি ভঙ্গ করার কঠিন শাস্তি আমি আপনাকে দিবো। এই বিয়েটা হবে আপনার জন্য ওয়ান এন্ড অনলি অপশন। এটা স্কিপ করার কোনো স্কোপ আমি রাখবোনা, এর জন্য যা যা করার সব আমি করবো।
আরুশ আয়নায় ঝোলানো কালো পর্দার দিকে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।
।
“ইসরা তোমার দাদীর কন্ডিশন অনেক খারাপ, শেষবারের মতো দেখতে চাইলে চলে এসো।”
বাবার এমন মেসেজ পেয়ে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। দাদীর কি তবে শেষ সময় এসেই গেল! ফোনে টিকিট কনফার্ম করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
চলবে,,,