#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১৭
#আরশিয়া_জান্নাত
চৌরাস্তার নাথমুলে বসে খাঁটি দার্জিলিং এর চা পান করতে করতে ইসরা বলল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? সত্যি বলবেন?
আমি মিথ্যা বলি?
প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন না প্লিজ!
আচ্ছা আচ্ছা করবোনা। জিজ্ঞাসা করো।
আপনি হানিমুনে দার্জিলিং কেন চুজ করলেন?
রোমান্স করতে ঠান্ডা জায়গায়ই প্রাধান্য পায়। তাই!
তাহলে অপশন আরো অনেক ছিল। এটাই কেন?
আরুশ নড়েচড়ে বলল, তোমার কেন মনে হলো অন্য কোনো কারণ আছে?
ইসরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আমি আমার ব্যক্তিগত জিনিস এমনভাবে রাখি যে সেটা কেউ ধরলে যতোই আগের মতো রাখুক না কেন, সূক্ষ্ম প্রমাণ ঠিকই রেখে যায়। অর্থাৎ আমি বুঝে ফেলি কেউ ধরেছে,,,
হুম তো?
জানিয়ে রাখলাম আর কি।
তোমার কি মনে হয় আমি তোমার ডায়েরী থেকে জেনেছি দার্জিলিং আসতে চাও?
ইসরা ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বলল, আমি কি একবারো বলেছি ডায়েরীর কথা?
আরুশ মুখ পাংশু করে বলল, নাহ তবে ইঙ্গিত তো এদিকে।
চোরের মন পুলিশ পুলিশ!
হুহ!
এই দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন?
আরুশ অভিমান দেখিয়ে বিল পে করে বেরিয়ে গেল, ইসরা তার পেছন পেছন এলো।
এই শুনুন, রাগ করলেন নাকি? আরুশ?
আরুশ অনেকটা পথ এগিয়ে গেল,, হঠাৎ ইসরার কোনো শব্দ না পেয়ে পেছন ফিরে দেখে ইসরা নেই। ইসরা তা পেছনে আসেনি! তবে কোথায় গেল? আরুশ চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে, কিন্তু কোথাও ইসরা নেই। চিন্তায় অস্থির হয়ে ফোন বের করে ইসরাকে কল করে কল রিসিভ হয় না। দ্রুত সেই রেস্তোরায় যায় যেখানে ওরা চা খেয়েছিল, সেখানেও ইসরাকে না পেয়ে এবার সত্যিই সে ঘাবড়ে যায়। এই অচেনা শহরে ইসরা পথ হারিয়ে ফেলল না তো!
উফফ চিন্তায় তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,,,
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই আরুশ পেছন ফিরে তাকায়। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে পেছনে ফিরতেই দেখে এটা ইসরা নয় অন্য কেউ.
আরুশ!
রুমিতা?
কেমন আছ? তোমাকে এভাবে হঠাৎ দেখতে পাবো আমি কল্পনাই করিনি!
আমিও আশা করিনি।
বিজনেসের কাজে এলে নাকি?
নাহ,
তাহলে?
হানিমুনে এসেছি।
তুমি বিয়ে করেছ? কবে কখন?
এই তো কয়েক মাস আগে।
ওহ। তা সে কোথায়?
আশেপাশেই আছে।
চলো বসি কোথাও?
স্যরি রুমিতা, আমার একটু তাড়া আছে।
এনিথিং রং?
নাহ তেমন কিছু নয়। আমি যাই, পরে কথা হবে।
ওকে বায়।
রুমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টোপথে হাঁটা দিলো। ওদিকে আরুশ সবজায়গায় খুঁজেও ইসরাকে না পেয়ে রাস্তার পাশে মাইলফলকে বসলো। মাথা নীচু করে চোখের পানি মুছলো,কোথায় হারিয়ে গেলে রুশফিকা!
হঠাৎ ইসরার হাসির শব্দ শুনে পাশে তাকায় আরুশ। ইসরা একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে কি বলে খিলখিলিয়ে হাসছে, তার পাশেই একজন মহিলা বসা। আরুশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সময় নিলো নিজেকে সামলানোর। ইসরা তাদেরকে বিদায় জানিয়ে আরুশের সামনে এসে দাঁড়ালো।
এসবের মানে কি রুশফিকা? আমি কতবার কল করেছি তোমাকে রিসিভ করো নি কেন? একটা মানুষকে টেনশনে ফেলে এমন নিশ্চিন্তে থাকতে পারো কিভাবে? আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আইডিয়া আছে?
ছেড়ে তো আমি যাই নি, আপনি গিয়েছেন।আমার কি দোষ?
আমি ছেড়ে যাই নি রুশফিকা!
ওভাবে হুট করে ফেলে আসাকে ছেড়ে আসাই বলে।
আরুশ ওকে হেঁচকা টানে বুকে এনে বলল, সবকিছুর অন্য মিনিং বের করবেন না। আমি রেগে আছি আপনার উপর বুঝতে পারছেন?
ইসরা টুপ করে ওর গালে চুমু দিয়ে বলল, রেগে থাকলে চেহারায় বলিরেখা পড়ে। রাগ করে না সোনা!
আরুশ মনে মনে গলে গেলেও রেগে থাকার ভান করে ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। ইসরা তার বাহু জড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো পাহাড়ী পথ,,,
।
বহুক্ষণ ফোন হাতে রেখেও কাউকে কল করলেন না তিনি। সমঝোতার ভঙ্গিতে বললেন, কি চাই আপনার? এই মিথ্যে ব্ল্যাকমেইল করে কি হাসিল করতে চাইছেন?
লোকটি আড়মোড়া ভেঙে বলল, আপনার ল্যাপটপের কিছু ক্লিপ হ্যাক করা হয়ে গেছে। এখন আমি যদি সেসব পুলিশকে দেই বা অনলাইনে আপলোড করি কি তুলকালাম বাঁধবে খবর আছে?
আমার ল্যাপটপ থেকে হ্যাক করা! অসম্ভব…
দেখুন মাশুক সাহেব আপনি পাকা খেলোয়াড় মানছি। এতো বছর ধরে যে চতুরতার সঙ্গে আপনি নিজের কৃতকর্ম লুকিয়ে রেখেছেন তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। তবে তথ্যপ্রযুক্তির যুগের উপর ভরসা রাখা আপনার জন্য পঁচা শামুকে পা কাটার মতোই হয়েছে। নিজের কুকর্মের প্রমাণ নিজেই রেখেছেন! কি অদ্ভুদ সময়ের ঘাত তাই না? যেটাকে হাতিয়ার করে আপনি অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিদের মেয়েদের চাপে রেখেছিলেন, মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছেন অনেককেই, সেই হাতিয়ারই আজ আপনার গলায় ছোড়া বসাবে!! সবই ওপরওয়ালার লীলাখেলা,,
মাশুক সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে বসে থাকা লোকটাকে পরোখ করলেন। তিনি এত সহজে হার মানবার মতো লোক নয়। নিজের যে ইমেজ তার তৈরি হয়েছে ওটাকে ধ্বংস হতে দিবেন না কিছুতেই। মস্তিষ্কে জোর দিচ্ছেন কিভাবে প্রতিহত করা যায় সামনের ব্যক্তিটাকে।
কত টাকা চাই আপনার?
কত টাকা আছে আপনার?
দেখুন আমি বুড়ো মানুষ, কয়দিন ই বা বাঁচবো। এই শেষ সময়ে এসে মানসম্মান নষ্ট হলেও বিশেষ ক্ষতি কি হবে? তাছাড়া আমার পরিবার এসব কখনোই বিশ্বাস করবেনা। তারা জানে আমি আদর্শ শিক্ষক। ইনফ্যাক্ট আমার চারপাশের কেউই বলতে পারবেনা আমি খারাপ মানুষ। আপনি অযথাই কিছু ঠুনকো জিনিস নিয়ে মাতামাতি করছেন।
এমনটাই মনে হচ্ছে আপনার? আচ্ছা তবে উঠি, দেখি ঠুনকো হাতিয়ার দিয়ে দেশের নামকরা গবেষকের কিছু করতে পারি কি না! পরে কিন্তু বলতে পারবেন না ওয়ার্ন করিনি। আমি আবার বিনা মেঘে বৃষ্টিপাত ঘটাই না,,,
লোকটি চলে যেতেই মাশুক সাহেব ঢকঢক করে পানি পান করলেন। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কে এই লোকটা? কি চায় সে?
৩দিন বহু চিন্তাভাবনা শেষে মাশুক সাহেব নিজের ব্যক্তিগত ল্যাবে গেল। ওখানের লকারে থাকা পেন ড্রাইভ টা বের করে ল্যাপটপে ইন করলো। এতো হাই সিকিউরিটি মেইনটেইন করে রাখা ভিডিও ক্লিপ গুলো এতো সহজে হ্যাক হবে? অসম্ভব। তবুও নিশ্চিত হতে মাশুক দ্রুত পাসওয়ার্ড দিয়ে চেক করতে থাকে সব ঠিক আছে কি না,,, তখন কেউ একজন হেসে উঠে। চমকে পেছনে তাকাতেই দেখে ঐ লোকটা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠে।
অফিসার নিন প্রমাণসহ আপনার আসামীকে গ্রেফতার করুন,,,
দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে মাশুক সাহেব বেছে বেছে মেধাবী উদ্যমী ছাত্রীদের সুযোগ বুঝে ধ*র্ষণ করেছেন। মেধাবীদের প্রতি তার আলাদা একটা লোলুপ দৃষ্টি আছে। প্রতিটি মানুষের আলাদা রুচি বা পছন্দ থাকে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে শারীরিক সৌন্দর্য বা শারীরিক গঠন ম্যাটার করলেও তার কাছে মেধাটাই মুখ্য বিষয়। তার এই বিকৃত মনোভাবের শিকার হয়েছে অল্পবয়সী অনেক মেধাবী ছাত্রী। সুনিপুণভাবে নিজের ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচারণ দিয়ে এসব মেয়েদের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেন তিনি। তারপর সুযোগ বুঝে ই*জ্জ*ত ন*ষ্ট করে তাদের ম্যানুপ্লেট করে এমনভাবে প্যাঁচে ফেলেন সম্মা*নহা*নীর ভয়ে কেউই মুখ খুলেনা।
প্রযুক্তির উন্নয়নের ধারায় তার কৌশলেরো পরিবর্তন ঘটেছে। সে সিসি ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করে সেসব প্রচার করার ব্ল্যাকমেইল করে তাদের চুপ থাকতে বাধ্য করতেন।
কথায় আছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। নিজের এই তৈরিকৃত জালে তিনি নিজেই যে এভাবে আটকে পড়বেন এ তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।আইটি সেক্টরে তার বিশেষ দক্ষতা আছে, তাই নিজের উপর শতভাগ আত্মবিশ্বাস ছিল। কিন্তু হ্যা*কারদের বিশ্বাস নেই। আজকাল ওরা অনেককিছুই করে ফেলতে পারে। মূলত সেই জন্যই তিনি নিজের ল্যাবে এসেছেন এবং বিশেষভাবে লুকিয়ে রাখা মেমোরীকার্ড বের করে পেনড্রাইভে যুক্ত করেছেন । এটাই ছিল তার করা আরেকটি ভুল!! সে এসব এতোটাই চালাকির সঙ্গে হাইড করে রাখতেন তিনি ছাড়া আর কেউই তা সহজে বের করতে পারতো না। তাই বলা যায় তিনি নিজের হাতে নিজের জন্য কবর খুঁড়েছেন
সারাদেশের টিভি চ্যানেলে তার খবর ব্রেকিং নিউজ হয়ে যায়। দেশের নামিদামী পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন পোর্টালে ঘটা করে এই নিউজ ছড়িয়ে পড়ে, মুহূর্তেই সে ভাইরাল টপিক হয়ে যায়। মানুষ পজিটিভ নিউজ ছড়াতে আগ্রহী না হলেও নেগেটিভ নিউজ দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। মাশুক স্যারের সকল সুখ্যাতি তার কৃতকর্মের দ্বারা অন্তরায় চলে যায়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কাস্টডিতে নিয়ে যায়।
একে একে অনেকেই তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে শুরু করে। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না তিনি আসলেই ক্ষমতাবান মানুষ। হুজুগে বা*ঙা*লী খুব দ্রুতই সব ভুলে নতুন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাদের কথা সে থোরাই পাত্তা দেয়। কাস্টডিতে ১সপ্তাহ ও রাখতে পারেনি পুলিশ। এর আগেই সে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
।
দার্জিলিং এ কাটানো ৭দিন ইসরার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো সুন্দর। আরুশের ভালোবাসাময়ী সান্নিধ্যে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য সে উপভোগ করে তা আজীবন স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। টাইগারহিলে সূর্যোদয় দেখা, মাউন্ট এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরুপ দৃশ্য দর্শন সবকিছুই মনে আঁকা থাকবে। দার্জিলিং আসলেই স্বপ্নের শহর! এই শহর নিয়ে বর্ণনা করে শেষ করা যাবেনা। ইসরা যতটা ভেবেছিল তারচেয়ে কয়েকশোগুণ বেশিই সুন্দর এই শহরটা। হয়তো আরুশ সাথে ছিল বলেই! ইসরা সুযোগ পেলে ফের আসবে এই শহরে। অবশ্যই আরুশকে সঙ্গী করেই,,,
আরুশ ইসরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, মন খারাপ হচ্ছে? আপনি বললে এখানে একটা প্লট নিয়ে ফেলি? আপনার পছন্দসই কটেজ তৈরি করবো!
ইসরা হেসে বলে, আমার ইচ্ছে এতো মূল্যবান আপনার কাছে?
আমি রাজা বাদশাহ নই, উনারা তাদের স্ত্রীদের ইচ্ছে মতোন যেখানে সেখানে প্রাসাদ নির্মাণ করে দিতেন। তবে যেটুকু সামর্থ্য আছে এখানে অন্তত একটা ছোট বাড়ি করতেই পারি!
ধন্যবাদ আরুশ! তবে আমি চাই এখানে আসার জন্য আকূলতা থাকুক। আসার পথটা সহজ হয়ে গেলে একই উদ্দীপনা থাকবেনা,,
যথা আজ্ঞা মহারাণী।
আরুশ শুনুন?
জ্বি?
আমি কি বলেছি; আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি?
আরুশ বাঁকা হেসে বলল, বলেছিলাম না আরুশকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না!
ইসরা ওর নাক টেনে বললো, আসলেই থাকা যায় না।
চলবে,,