#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১৩
#আরশিয়া_জান্নাত
ঘুম জড়ানো চোখে ফোনটা হাতে নিলো ইসরা, সেই কখন থেকে কল বেজেই যাচ্ছে। সবেই ঘুমটা এসেছিল, এখন কেউ কল করে? করলেও কি সে ধরবে নাকি? তাই এতোক্ষণ অবহেলায় এড়িয়ে গেছে। ভেবেছে কলকারী নিশ্চয়ই একসময় হাল ছেড়ে দিবে। কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা! স্ক্রিনে আরুশের নামটা দেখে খানিকটা বিরক্ত হয়েই কলটা রিসিভ করে বলল, কি ব্যাপার এতোবার কল দিচ্ছেন কেন?
রুশফিকা, আপনাদের গেইট বন্ধ, দারোয়ান চাচা উঠছেনা। আপনি কি কষ্ট করে নীচে আসবেন?
ইসরা লাফিয়ে উঠে বলল, কয়টা বাজে এখন? আপনি আমাদের বাসার সামনে!! ওয়েট আমি আসছি,,,
ফোনের দিকে চেয়ে দেখে ৪:৩০। ইসরা ফ্রেশ হয়ে চাবি নিয়ে দ্রুত নিচে নামলো। গেইট খুলে দেখে আরুশ গাড়িতে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় নির্ঘুম রাতের ছাপ স্পষ্ট। ইসরা তার সামনে গিয়ে বলল, আপনি এই সময়ে এখানে!
আরুশ মনোযোগ দিয়ে ইসরার দিকে তাকালো, ইসরার চোখের পাতা ফুলে ভারি হয়ে আছে, কাঁচা ঘুম ভাঙার ফলে চোখজোড়া লালাভ ও বটে। চেহারাটা অন্য সময়ের চেয়ে বেশ কোমল লাগছে। আরুশের কাছে মনে হলো ইসরা ভীষণ সুন্দর আর মায়াবী চেহারার অধিকারী। এই মুখটার দিকে চেয়ে অনায়েসে এক জীবন পার করা যাবে।
ওহ হ্যালো?
হুম বলুন।
কি বলবো? আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করেছি?
এতো জিজ্ঞাসাবাদ কেন? আমি কি ইন্টারভিউ দিতে এসেছি? চুপ করে দাঁড়াতে পারছেন না?
ইসরা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আরুশের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো। আরুশ নরমস্বরে বলল, রুশফিকা? আমি কি আপনার কাছ থেকে কিছু চাইতে পারি?
ইসরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, কি ?
আরুশ হেসে বলল, যে চেহারা করলেন যেন আপনার গর্দান চাইবো এই ভয়ে আছেন! থাক আর ভয় পেতে হবেনা। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কিছু চাই না আমার।
ইসরাকে অবাক করে দিয়ে আরুশ যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল। ইসরা ঘটনার আগামাথা কিছুই বুঝলো না।
আরুশ মনে মনে বলল,আপনি নিষ্ঠুর রুশফিকা, আপনি ভীষণ নিষ্ঠুর! আপনার সব মায়ামমতা চেহারাতেই। মনে একটুও নেই, ছিটেফোঁটাও নেই।
বাসায় আত্মীয়স্বজনরা গমগম করছে। উৎসবের আমেজে পুরো বাড়ি সেজে উঠেছে। কাজিনরা সবাই রেহার্সেলে ব্যস্ত। বড়রা একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত হয়ে দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছে না। এদিকে সবচেয়ে বেকার ব্যক্তি ইসরা। সবার কাজকর্ম দেখে এসে ফের নিজের রুমে বসলো। হাতে আরো ৩দিন সময় আছে অথচ সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে সময় বুঝি একদমই নেই। এমনই হয় তাদের বাসায়; সবাই যখন একত্রিত হয় ওতেই হৈহৈ রব উঠে যায়।
এলাইনা দরজায় নক করে বলল, ইসরা আসতে পারি?
হ্যাঁ এসো।
কি করছো?
তেমন কিছু না, তোমার রেহার্সেল শেষ?
ব্রেক নিয়েছি। তোমার ফ্যামিলিটা দারুণ। আমার তো খুব ভালো লাগছে এখানে এসে।
শুনে অনেক ভালো লাগলো।
তারপর বলো, আরুশের সঙ্গে তোমার কেমন কাটছে?
উনাকে যতোটা এগ্রেসিভ ভেবেছিলাম, ততোটা হয়নি। ইনফ্যাক্ট সাপোর্টিব বলা যায়।
ইসরা, তুমি কি তাকে তোমার ইনসিডেন্টটা শেয়ার করেছ? তোমার রুমমেট হবার দরুন আমি যেসব দেখেছি সেও নিশ্চয়ই সেসব ফেইস করেছে। সে কি কিছু জানতে চায়নি?
বলেছিল ডাক্তার দেখাতে,,,তবে বিস্তারিত কিছু বলি নি।
আমি জানি তুমি এটা শেয়ার করতে চাও না।
এলাইনা, আমাদের দেশে এই ব্যাপারটা সাধারণ নয়। অনেক প্রিয় মানুষও হাত ছেড়ে দেয়। সেখানে আরুশ কেন মেনে নিবে বলো? উল্টো কথাটা বলে নিজের দূর্বলতা দেখানো কি ঠিক হবে?
ইসরা, এজ এ সাইক্রিয়ার্টিস্ট আমি তোমাকে বলবো ভয়টাকে ফেইস করো। পালিয়ে বেড়ালে চলেনা। তোমার কেইসটা আমি যতটুকু অবজার্ব করেছি আমার মনে হয় তুমি সে*য়াল ব্যাপারটাকে হ্যাভেনলি ভাবো না। বরং এটা তোমার কাছে জঘন্য এবং পীড়াদায়ক অনুভূতি । বিয়ের পর স্বভাবতই তোমাকে একটা ফিজিক্যাল রিলেশন তৈরি করতে হবে। এখন তুমি সেটা এড়াতে পারবেনা, এড়ানোর মতো এটা কিছু নয়। সব স্পর্শ ঘৃণ্যকর নয় ইসরা।
আমি কি করবো বলো? আমি পুরুষ মানুষের কাছাকাছি ঘেষাও সহ্য করতে পারিনা, আমার ভয় হয়।
সিডনী থাকতেই বলেছিলাম আমাদের প্রফেসরের কাছে সেশন করো। উনি দারুণ মানুষ। তুমি তো করলে না।
আসলে ভাবিনি সময় হয়ে উঠবেনা,,,,
আমি মন থেকে চাই, মিস্টার আরুশ তোমার লাইফে একটা পজিটিভ এনার্জি হয়ে আসুক। তোমাদের সম্পর্কটা সুস্থ স্বাভাবিক হোক। তুমিও নিজেকে গ্রুম করো ইসরা। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই বায়োলজিক্যাল নিডস আছে। সেটা অস্বীকার করার কিছু নেই। নিজের সহজাত অনুভূতিকে বাড়তে দাও, বেঁধে রেখো না। মনের দিকটা সহজ হলেই দেখবে শরীরটা কিছুই নয়।
ইসরা নিরবে এলাইনার কথা শুনলো। এলাইনা সাইকোলজির স্টুডেন্ট হবার দরুন প্রথমদিকেই বুঝে ফেলে ইসরার লাইফে ট্রমা আছে। যতটুকু সম্ভব হয় সে তাকে মোটিভেট করার ট্রায় করে।
ইসরার এই ঘটনা কেবল মিদাত আর এলাইনাই জানে। ওরা দুজনই তাকে সাপোর্ট করে, ইসরা ভাবে ওরা ভালো মনের মানুষ অথবা ওর প্রতি সহানুভূতিশীল বিধায় তাকে সান্ত্বনা দেয়। জীবনসঙ্গী হিসেবে কেউই এমন মেয়েকে চাইবেনা। তবে আরুশের ব্যাপারে সে সন্দিহান। মাঝেমধ্যে মনে হয় আরুশ ওকে মেনে নিবে, কোনো অভিযোগই করবে না। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয় সে খুব সিন ক্রিয়েট করবে। ইসরার মনে ক্লান্তি ভর করে। সে কি একবার বলে দেখবে? যা হবার হোক সত্যিটা জানার অধিকার তার আছে। লুকিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছেনা,,,
।
হলুদের আগেরদিন ইসরা আরুশের সঙ্গে দেখা করতে বের হয়। আরুশকে কি কি বলবে মনে মনে গুছিয়ে নেয়। ওদিকে আরুশ ব্যস্ততা একপাশে রেখে প্রফুল্লচিত্তে ইসরার পাঠানো লোকেশনে উপস্থিত হয়। ইসরা তার সঙ্গে নিজ থেকে মিট করতে চাইছে এটাই তার আনন্দের মূল কারণ। কুশল বিনিময়ের পর ইসরা বলল, আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে, আশা করি আপনি সেটা রাখবেন। আজ আমি আপনাকে যা বলবো সবটা শোনার পর আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমি চুপচাপ মেনে নিবো। তবে শর্ত একটাই এটা আপনাকেসিক্রেট রাখতে হবে। কোনোমতেই তা প্রকাশ করতে পারবেন না!
আরুশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, যদিও আমার মনে হয় না আমাদের বিয়ের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে। তবুও আমি আগ্রহী আপনার কথা শুনতে।
ইসরা পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। তারপর বলতে শুরু করল,আরুশ, আমি ভা*র্জি*ন নই। আমার একটা বিদঘুটে অতীত আছে………….
চারদিকে পিনপতন নিরবতা, ইসরা শক্ত গলায় সবটা বললেও গাল বেয়ে অবিরাম ধারায় নোনাজল ঠিকই গড়িয়ে পড়ছে। আরুশ নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ইসরা নিজেই নিজেকে সামলে নিলো, টিস্যুবক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ নাক মুছলো। তারপর হাসিমুখে বলল, এখনো কি ডিভোর্সটা দিতে আপনার আপত্তি থাকবে?
আরুশ চেয়ারে হেলান দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে গোল করে নিঃশ্বাস ফেলল। বুকটা এতো ভার লাগছে, যেন কয়েক মণ বোঝা কেউ চাপিয়ে দিয়েছে। আরুশ আগেই অনুমান করেছিল ইসরার অতীতে খারাপ কিছু আছে তাই বলে এতোটা নির্মম হবে সেই ঘটনা সে কল্পনাও করতে পারেনি। ইসরার বর্ণনা তাকে বাকরূদ্ধ করে দিয়েছে, মস্তিষ্ক একদম ফাঁকা লাগছে। সে জানে না কি বলা উচিত। সান্ত্বনাই বা কি দিবে। আরুশকে নিরব থাকতে দেখে ইসরা বলল, আমি উঠি তাহলে, আপনি সময় নিন। ভেবেচিন্তে জানাবেন।
ইসরা ধরেই নিয়েছে আরুশের চ্যাপ্টার এখানেই শেষ। তাই পার্সটা হাতে তুলে বেরিয়ে পড়লো। আরুশ ও তাকে আটকালো না।
হলুদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি আগের মতোই চলছে। ইসরা অপেক্ষা করছে কখন আরুশদের ওখান থেকে ফোন আসে আর সব বন্ধ হয়ে যায়। আবার মনে মনে এ ও ভাবে এতো বড় অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াটা দৃষ্টিকটু দেখাবে। সেজন্য হয়তো আরুশ এখন কিছু বলবেনা। নিজেকে অনেক কথা বলেই বুঝ দিতে থাকে। মিদাত এসেছে একটু আগে। ওর বৌটা ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। আপনমনে কত কথা বলে যাচ্ছে যেন কতদিনের চেনা। ঘর ভর্তি কত মানুষ, সবাই তার পরম আপনজন। এর মাঝে ভিনদেশী এলাইনা, এন্ড্রো, ম্যাথিনও যোগ হয়েছে। ইসরা ভাবে এই ভরা মজলিসে সবাই যে উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে তা যদি ভেঙ্গে যায় তবে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে? ওর কি উচিত ছিল আরো পরে বলার? বা আরো আগে? ইসরা অস্থির হয়ে উঠে।আরুশ কেন তাকে কিছু বলছে না? এতোদিন এই বিয়েটা থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে থাকা মনটা এখন কেন আনন্দিত হচ্ছেনা? ইসরা তো জানতোই ফলাফল পজিটিভ আসবেনা। তবুও কেন খারাপ লাগছে?
ইসরা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে ঠিক করে নেয় এই মাসেই সে সিডনী ব্যাক করবে। আর কখনো বাংলাদেশে ফিরবে না। কখনোই না…
চলবে,,,