মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-০১

0
892

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট

♡আরশিয়া জান্নাত

ছোটবেলায় আমি অন্ধকার ভয় পেতাম। লোডশেডিং হলেই চিৎকার করতাম তখন মা কিংবা বাবা কেউ না কেউ বলতো “আমি আছি তো ইসরা। ওখানেই দাঁড়াও আসছি।”
এখন ঘুটঘুটে আঁধার ভয় পাই না। আধারেই বসে ডুবে থাকি হতাশার চরম শিখরে। অথচ কেউ বলেনা আমি আছি তো ইসরা! অবশ্য জানলে তো বলতো!
আমার ভেতর চুরমার হয়ে যায়, রোজ রাতে সিদ্ধান্ত নেই জীবনটা শেষ করে দিবো। অথচ আমি বেঁচে ফিরি। সকালে ঘুম ভেঙে ভার্সিটি যাই, টপ মার্ক করি। ডিপার্টমেন্টে সবাই আমায় এক নামে চেনে। ম্যামরাও বেশ স্নেহ করেন। পরিবারে আমি একজন ম্যাচিওর গুড গার্ল খেতাবপ্রাপ্তি। আমার প্রশংসা সবসময় চলে। কখনো রেজাল্ট নিয়ে তো কখনো ম্যানার্স নিয়ে। সব কাজিনদের কাছে ইসরা নামের মেয়েটা একটা আদর্শ নমুনা যাকে অনুকরণ করা বাধ্যতামূলক।
অথচ কেউ জানে এই মেয়েটা কি নিদারুণ দুঃখী! ওর যন্ত্রণা হতাশা কত তীক্ষ্ণ। নিশ্চয়ই ভাবছেন কি নিয়ে এতো হতাশা? বলছি বলছি একটু অপেক্ষা করুন। সেই গল্প লিখতেই তো বসেছি আজ। নাহয় কেউ এমন আরামদায়ক শীতের রাতে ঘুম বাদ দিয়ে লিখতে বসে?
শুরুতে পরিচয় টা বলি। আমি রুশফিকা কামাল ইসরা। মোটামুটি ধনী পরিবারের মেয়ে। কিছুদিন পরই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করবো ইউপিএস কোম্পানিতে। সবকিছু মোটামুটি কনফার্ম। শুধু নামমাত্র কিছু ফর্মালিটিস বাকি আছে। সেই সূত্রে বলা যায় বাংলাদেশে আছি হাতে গনা ক’টা দিন। একটা মানুষ তার জীবনে কি কি আশা রাখে? ছাত্রজীবনে চায় ভালো রেজাল্ট, কর্মজীবনে ভালো ক্যারিয়ার। নাম জশ খ্যাতি! এর বাইরে ভালোবাসার কিছু মানুষ যাদের আমরা আপনজন বলি, তাদের সান্নিধ্য। আমার মা-বাবা আর ভাইবোনদের মাঝে ভালোবাসার কমতি নেই।তারা আমায় অসম্ভব ভালোবাসে আমিও তাদের ভালোবাসি। সেই হিসেবে আমার সবই টুকটাক আছে কিন্তু আমি এইটুকুতে ভালো থাকতে পারিনা। সুখী হতে পারিনা। আমার স্মৃতি আমাকে ভালো থাকতে দেয়না। আমাকে বারবার আঘাত করে রক্তাক্ত করে,,,,,,,

—ইসরা? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

–নাহ মা,এসো।

–তোমাকে কি বিরক্ত করলাম?

–কি যে বলো বিরক্তির কি আছে? কোনো দরকারে ডাকলে?

–হ্যাঁ তোমার ছোটমামা জিজ্ঞাসা করছিলেন কোন বই পাচ্ছিলেনা নাকি। ঐটা পেয়েছ নাকি সে যোগাড় করতে হবে?

–পেয়েছি সেটা লাগবেনা আর।

–আচ্ছা ইসরা এদেশে থেকে কিছু করা যায় না? ভিনদেশেই যেতে হবে?

–হোমসিকনেস মানুষকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করে জানো মা? এই যেমন বাবাকে দেখো, তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে কোথাও যাননি। অথচ চট্টগ্রামের বাইরে তার জন্য কত ভালো ভালো সুযোগ এসেছিল। উনি চাইলেই উনার ক্যারিয়ার আরো অনেক ব্রাইট করতে পারতেন। আমি বলছিনা এখন খারাপ আছে! তবুও,,

–হোমসিকনেস বলছিস কেন এটা হচ্ছে মায়া ভালোবাসা। নাড়ীর টান। এটা আছে বলেই মানুষের অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে বুঝলি!

–আমার তো নেই সেটা। বিলুপ্ত হয়ে গেছি?

–তুই তো এখন চোখে রঙিন চশমা লাগিয়েছিস। দুনিয়াকে দেখার ভুত চেপেছে। মঙ্গল গ্রহে যেতেও তোর বুক কাঁপবেনা এখন।

–হাহা বেশ বলেছ বটে!

–হ্যাঁ রে মণি ছুটিতে দেশে ফিরবি তো? আমাদের দেখতে আসবি তো? নাকি বাহানা দিবি?

–মা কি হয়েছে তোমার বলোতো?

–আমি জানি না। তোর যাওয়ার দিন যতো ঘনিয়ে আসছে আমার বুকটা ততোই খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে তোকে কোথাও যেতে না দেই।

–এটা সব মায়েদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া! এতো ভেবোনা তো।

মা আর কিছু বললো না। আমায় জড়িয়ে রাখলো বহুক্ষণ।


“”আমি বুঝি না একটা মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে? এতো সুন্দর জ’লাইন। ক্লিন স্কিন, এমন পেটানো শরীর! যে কালারই পড়ি তাতেই একদম ফুটে উঠে। ওহ আল্লাহ থ্যাঙ্কস এ লট আমাকে তুমি এতো হ্যান্ডসাম করে বানিয়েছ! চুলগুলো পর্যন্ত কি সুন্দর ঝলমল করছে। একটা মানুষ এতো পারফেক্ট হয় কিভাবে?””

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল আরুশ। সারিকা ভাইয়ের দিকে বিরক্তিকর চেহারা নিয়ে বললো, ভাই তুই কি ক্লান্ত হস না? কিভাবে পারোস সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে এতো কথা বলতে! মানছি তুই অনেক হ্যান্ডসাম, তাই বলে সারাক্ষণ তোর রূপের গুণগান ই করতে থাকবি? আমি তোকে ডেকেছিলাম কিজন্য সেটা না শুনেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গেছস। এজন্যই আমি সবসময় আয়নায় কাপড় দিয়ে রাখি।

শোন সাকু, আয়নার সামনে কাপড় দিলেই তো আর তোর ভাই অসুন্দর হয়ে যাবেনা! এমন সুন্দর ছেলেকে ভাই হিসেবে পেয়েছিস এটা ভেবেই তো তোর মন ভালো হবার কথা।

কিজন্য ডাকছি সেটা কি শুনবি নাকি তোর কথা চলতেই থাকবে?

বলে ফেল মিস্টার পারফেক্ট আরুশের কি সাহায্য লাগবে তোর?

এখন যে খবরটা দিবো তা শুনলে তুই টেনশনে পড়বি নিশ্চিত। এই কুলনেস সব ছুটবে।

উহু ভুল বললি, টেনশন রাগ এসব চেহারায় খারাপ প্রভাব ফেলে, হেয়ার ফল ও ঘটায়। আমি এসব করে আমার সৌন্দর্যে হুমকিতে ফেলবো না।

উফফফ। শোন মিথিলা হসপিটালে এডমিট। ও নাকি তোকে প্রপোজ করেছিল। তুই এক্সেপ্ট করিস নি! এখন তোর নামে নোট লিখে ও সুইসাইড করার ট্রাই করছে।

ওহ সিরিয়াসলি। হাহাহা দেখেছিস তোর ভাইয়ের জন্য মেয়েরা মরতে বসে। ওহ আল্লাহ এতো সুন্দর করে আমাকে না বানালেও পারতে!

তুই কি একটুও বিচলিত না? ও নোটে লিখেছে “আরুশকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা। ওকে ছাড়া আমি এক মূহূর্তও বাঁচতে পারবোনা। ও আমাকে রিজেক্ট করেছে তাই আমি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছি। আমার মৃত্যুর জন্য আরুশ দায়ী””

তোহ?

তোহ কিছু না?

নাহ। শোন সাকু তুই আমার বোন ভাবতেই অবাক লাগে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে ডিএনএ টেস্ট করিয়েই ফেলি। শুধু বাবা-মা কষ্ট পাবেন ভেবে করিনা। তুই নিজেই চিন্তা কর আমার মতো স্মার্ট,ইনটেলিজেন্ট,গুড লুকিং হ্যান্ডসাম ছেলের বোন তোর মতো বোকা, ভীতু হতে পারে? কেউ যদি নোটে লিখে সালমান খানকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু ও আমাকে রিজেক্ট করেছে। তাই আমি মরে যাবো। এর জন্য দায়ী সালমান খান। তবে কি পুলিশ দৌড়ে যাবে সালমানকে এরেস্ট করতে? একটা পুঁচকে মেয়ের আবেগ শুনতে যাবে কে? তুই কি না এই টেনশনে না ঘুমিয়ে মুখে ব্রণ উঠিয়ে ফেললি হাহ!

সারিকা মাথা চুলকে বললো, আসলেই তো এটাতো কোনো ম্যাটারই ছিল না। কিন্তু মিথিলার বাবা যেই লোক! সেজন্যই তো অমন ভয় পেয়েছিল। সে কখনোই চায়না মিথিলা তার ভাইয়ের বৌ হোক।

এখন চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আমার জন্য দুধের সর নিয়ে আয়। খবরদার ভুলেও খেয়ে ফেলবিনা।

এতো মজার সর তুই না খেয়ে মুখে লাগাস কিভাবে! আমার তো দেখলেই খাওয়ার লোভ লাগে।

সৌন্দর্য আল্লাহর দেওয়া অনেক বড় নেওয়ামত। এটার যত্ন করা আমাদের দায়িত্ব। তুই কি জানিস হাজরে আসওয়াদ কত সাদা ছিল? পৃথিবীর মানুষের পাপের জন্য সেটা এমন কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। চিন্তা কর একটা সাদা পাথর এই পৃথিবীতে এসে কালো হয়ে গেছে, আমিতো মানুষ মাত্র। এতো পল্যুশনে থাকি, যত্ন না নিলে আমিও কালো হয়ে যাবো।

কিসের সাথে কি তুলনা করলি! তোর লজিক তোর মতোই আজব।

আরুশ আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, যা সাধারণ না তাই আজব। অসাধারণ কে আজব বলা খারাপ না। শব্দ ভিন্ন অর্থ তো একই! ওহ আল্লাহ কথা বলার সময় আমার চেহারাটা কি সুন্দর গ্লো করে! এই চেহারা দেখে মিথিলা কেন আরো কত জনই হাত কাটতে পারে। এটাই তো স্বাভাবিক!
হাহ!
|
|
ঘুমের মাঝে টের পাচ্ছি একটা ভয়ঙ্কর হাত আমার সর্বাঙ্গে স্পর্শ করে যাচ্ছে। আমার সারাশরীর ভয়ে জমাট বেঁধে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। চিৎকার করতে পারছিনা। আমি হাতপা ছোড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই নাড়াতে পারছিনা। হঠাৎ একটা বড় নদী দেখলাম। আমি প্রাণপনে দৌড়ে যাচ্ছি সেই নদীর দিকে। আমি চাইছি সেই নদীর জলে ভিজে নিজেকে ধুয়ে নিতে। সেই নোংরা হাতের স্পর্শ মুছে ফেলতে। কিন্তু যেই নদীতে লাফ দিতে যাই অমনি আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসি। সাইড টেবিলে রাখা পানি ঢকঢক করে শেষ করি। এই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের রেশ আমার মাঝে রয়ে যায়। বাকি রাত আমি ঘুমোতে পারিনা। অথচ আমি ভীষণ ক্লান্ত রাতে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।
ঘুমাতে না পারার যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে? আমি কবে পারবো রাতে ঘুমাতে?

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে