#মিসেস_চৌধুরী
#Part_12
#Writer_NOVA
কেটে গেল বেশ কিছু দিন।আজ অফিসে বেশ বড় করে মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ক্লায়েন্ট থাকবে আজ মিটিংয়ে। ফিহার আজও বেশ ভয় ভয় করছে।যদিও সেদিনের মতো নয়।আকশি, আদিয়াতও আজ থাকবে মিটিংয়ে। সকাল থেকে ফিহার মনটা কু-ডাকছে। মনে হচ্ছে আজ কোন খারাপ কিছু ঘটবে।কিন্তু কি ঘটবে সেটাই বুঝছে না।অনিকে কোলে তুলে নিয়ে কেবিনের আবছা সবুজ রঙের কাচের দিকে তাকিয়ে আছে। আজও মনটা ছটফট করছে। কোনকিছু ভালো লাগছে না। অনিয়া তার মায়ের মুখে চোখে হাত দিয়ে খেলছে।ফিটারে দুধ গুলে অনিয়ার মুখে দিলো।কিন্তু অনি ফিটার খাওয়া নিয়ে দুষ্টুমী করছে।চুষনি মুখে নিয়ে বসে আছে।
ফিহাঃ মাম্মাম তুমি কিন্তু বেশ দুষ্টু হয়ে গেছো।খাবার খাওয়ার সময় তোমার দুষ্টুমী বেড়ে যায়।সকাল থেকে কিছু খাওনি।এখন একটু খেয়ে নেও। আজ আমার মিটিং আছে।অনেক সময় সেখানে থাকতে হবে।তুমি তো টেবলেটের সাথে এখানে থাকবে।টেবলেট তো তোমাকে খাওয়াতে পারবে না।আমি তোমায় না খাইয়ে গেলে মিটিংয়ে মনোযোগ দিতে পারবো না।এমনিতেই মনটা আজ খারাপ কিছু হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মা-মণি জলদী গিলো।মুখে চুষনি কামড় দিয়ে বসে থাকলে কি হবে?দুধ গিলতে হবে তো।এই টেবলেট আবার কোথায় গেলো?
অনিয়া দুষ্টুমী করছে।মুখে তার মিষ্টি হাসি।মায়ের সাথে দুষ্টুমী করে সে বেশ মজা পাচ্ছে। ফিহা নিরাশ চোখে ওর মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।তবে সে চাহনীতে নেই কোন রাগ, নেই কোন অভিমান।আছে একরাশ মায়া,স্নেহ,ভালোবাসা।আবদুল আজিজ সাহেব দরজায় টোকা দিলো।
আবদুলঃ আসবো ছোট বউমা।
ফিহাঃ চাচা আমিতো বলেছি আপনি আমার কেবিনে আসলে অনুমতি নিবেন না।আরেক দিন এমন করলে আমি কিন্তু আপনার সাথে কথা বলবো না।
ফিহা ঠোঁট উল্টে গাল ফুলিয়ে কথাটা বললো।যেটা দেখে আবদুল সাহেবে না হেসে পারলো না।কেবিনে ঢুকে মুচকি হেসে ফিহার মাথায় হাত রাখলো।
আবদুলঃ পাগলী মেয়ে।এতবড় হয়ে গেছো একটা মেয়ের মা তুমি। তারপরও বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে রাখো। কেউ দেখলে বিশ্বাস করবে না তো। তোমার যে একটা মেয়ে আছে।
ফিহাঃ আমি এমনি চাচা😁😁।টেবলেট কোথায় চাচা?ওকে অনেক সময় ধরে দেখছি না।
আবদুলঃ টেবলেটকে দেখলাম বাইরে ঘুরঘুর করছে।
ফিহাঃ ওহ আচ্ছা।আপনি কিছু বলবেন চাচা?
আবদুলঃ আজলের ফাইলগুলো কমপ্লিট করেছো বউমা।তোমাকে যেগুলো চেক করতে ও সিগনেচার করতে দিয়েছিলাম।
ফিহাঃ হ্যাঁ,চাচা। সব রেডি করে রেখেছি আমি।
আবদুলঃ ফাইলগুলো আমাকে দেও বউমা।আমি আজকের মিটিংয়ের প্রেজেন্টেশন রেডি করে ফেলি।
ফিহাঃ আপনি একটু অনিয়াকে ধরুন।আমি ডেস্ক থেকে ফাইল বের করে দিচ্ছি।
আবদুলঃ দেও বউমা,আমার অনি দিদিভাইকে।
ফিহা অনিয়াকে আবদুল সাহেবের কোলে দিয়ে ডেস্কে ফাইল খুঁজতে লাগলো। আকশি ও আদিয়াত চলে এসেছে। হল রুমে অপেক্ষা করছে তারা দুজন।টেবলেট মালিকের শরীরে ঘ্রাণ পেয়ে আকশির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। আবদুল সাহেব অনিয়ার সাথে কথা বলা শুরু করলো।
আবদুলঃ কেমন আছো অনি দিদিভাই?মাম্মিকে একদম জ্বালাবে না।তুমি তো ভালো মেয়ে। মাম্মি সারাদিন কত কাজ করে?এখন মাম্মিকে জ্বালালে মাম্মি কোথায় যাবে বলতো?তুমি কি মাম্মিকে বিরক্ত করো।ওহ,তুমি বিরক্ত করো না।তুমি ভদ্র মেয়ে তাই না।কোন দুষ্টুমী করো না। আমি জানিতো তুমি খুব ভালো মেয়ে।অনেক লক্ষ্মী, শান্ত, ছোট কিউট বেবি।
ফিহাঃ হুম অনেক ভালো মেয়ে। এভাবে কোন জ্বালাতন করে না।তবে খাওয়ার সময় ও ঘুমের সময় তার পাঁজিপানা শুরু হয়ে যায়।আমি আপনাদের নাতনির এক দন্ডও চোখের আড়াল হতে পারি না।ওয়াশ রুমে গেলেও শান্তি নেই। খাবার খাওয়ার সময়ও তাকে কোলে নিয়ে খেতে হবে।নয়তো হাত-পা ছুঁড়ে, চিৎকার করে কেঁদে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে।যত বড় হচ্ছে তত বজ্জাতপনা বেড়ে যাচ্ছে। এক মিনিটের জন্যও কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। যা করবো সব ওকে কোলে নিয়েই করতে হয়।
আবদুলঃ এখনকার বাচ্চারা তো একটু বেশি দুষ্টু হয়।খাবার খেতে তাদের সবচেয়ে কষ্ট। বাচ্চারা তো মায়ের পাগল থাকবেই।ওরা তো জানে কে তাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে?নিজের মাকে ভালবাসবে না তো কাকে বাসবে?সারাদিন তো তোমার কাছেই থাকে।তুমি ওর খেয়াল রাখো,আদর করো,ওর যত্ন নেও।সেটা তো দিদিভাই বুঝে।যার জন্য তোমাকে চোখের আড়াল করতে চায় না।ও মনে করে তুমি কাছে থাকলে ওর সব দুঃখের অবসান।
ফিহাঃ হয়তো এমনটাই। আমারতো মা ছিলো না। তাই মায়ের আদর কিরকম হয় সে ব্যাপারে কোন ধারণা নেই। তবে জানি মায়ের অভাবটা কিরকম?আঁচল দিয়ে চোখের পানি,মুখ মুছার ভাগ্য আমার হয়নি।
আবদুলঃ মন খারাপ করো না বউমা।আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো।তিনি যা করেন সব আমাদের ভালোর জন্য করেন।আমাদের জন্য কোনটা মঙ্গলজনক সেটা একমাত্র আল্লাহ জানে।তাই নিজের জীবনের ওপর নিরাশ হয়ো না।বরং আল্লাহর ওপর আস্থা রাখো। নিশ্চয়ই দুঃখের পর সুখ আছে।
ফিহাঃ হুম। আপনি ঠিক বলেছেন।থাক,এসব বাদ দিন।এখন এসব কথা বললে মিটিংয়ে দেরী হয়ে যাবে।
এই নিন আপনার ফাইল।আমি সব দেখে নিয়েছি।তারপরেও আপনি একটু চেক দিয়ে নিয়েন।
আবদুলঃ আচ্ছা, আসি বউমা।নেও ধরো দিদিভাইকে।সাবধানে রেখে, খাবার খাইয়ে তারপর মিটিংয়ে জলদী করে চলে এসো।
আবদুল আজিজ সাহেব অনিয়াকে কোলে দিয়ে ফাইল হাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।ফিহা অনিয়াকে কোলে নিয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করতে লাগলো।অনিয়াকে জাগনা রেখে যাওয়া যাবে না।চোখের সামনে ফিহাকে না দেখলে তো কান্না করে সারা অফিসের কর্মচারীদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাবে।জেগে থাকলে ফিহা মিটিংয়েও অনিয়ার জন্য চিন্তা করবে।কিছুতেই মন দিতে পারবে না।
🌿🌿🌿
হল রুমে যে যার যার নির্ধারিত সিটে বসে আছে। আকশি ও আদিয়াত সামনের সারিতে বসেছে।আকশি কিছু সময় পর পর এদিক সেদিক তাকিয়ে ফিহাকে খুঁজছে। আদিয়াত যে ওর সাথে কথা বলছে সেদিকে তার মোটেও খেয়াল নেই। শুধু কথার মাঝে হু হা বলে উত্তর দিচ্ছে।
আদিয়াতঃ আমি তোকে কিছু বলছি😡।তুই কি শুনছিস?এদিক ঐদিক কি দেখছিস।
আকশিঃ হু হু শুনছিতো বল।(এদিক সেদিক চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে বললো)
আদিয়াতঃ আমার মাথা শুনছিস😡।কখন থেকে এদিক সেদিক তাকিয়ে যে তুই ফিহাকে খুঁজছিস সেটা আমি ভালো করেই জানি।ফিহা একটু পরে আসবো।
আকশিঃ পরে আসবে মানে।এটা কোন কথা নাকি।কোম্পানির ওনারকে এতো দেরী করে আসলে কি হয়?সামান্য কোমন সেন্স কি নেই?সবাই কত সময় ধরে অপেক্ষা করছে।আর ফিহা ওনার হয়ে এখনো আসলো না।এদিকে নজর না দিলে যে কত কত টাকার টেন্ডার লস হয়ে যাবে তুই জানিস।
আকশি রেগে কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেললো।আদিয়াত দুই গালে হাত দিয়ে মনোযোগ সহকারে ওর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলো।
আকশিঃ এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি কিছু ভূল বলি নি।
আদিয়াতঃ কেউ অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছে না।একমাত্র তুই ওর জন্য অপেক্ষা করছিস।মিটিং শুরু হতে আরো ১০ মিনিট সময় বাকি আছে। তুই তো দেখছি ফিহার জন্য দিনকে দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিস।এতো ভালবাসা রাখবি কোথায় দোস্ত?
আকশিঃ মিটিং তো শুরু হয়ে গেল।তাই এসব বলছিলাম।(শুকনো হাসি দিয়ে)
আদিয়াতঃ দাঁত বের করে লাভ নেই। তুমি যে ফিহার ভালোবাসায় বুদ হয়ে আছো, আমি তা ভালো করেই বুঝতে পারছি।মিটিং এখনো শুরুই হলো না।এদিকে তুই কত শত কথা বলে ফেললি।
আকশিঃ কত দিন ধরে ওকে দেখি না তুই জানিস।
আদিয়াতঃ হুম জানি।বেচারী তো তোর মতো হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় না।অনেক কাজ করতে হয় তার।তোর ভাতিজীকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খায়।তারপরেও অনিয়ার যত্নের কোন ত্রুটি করে না।অফিস,সংসার,তোর বাবা,বাচ্চা, মিটিং,আজ এই ঝামেলা, কাল ঐ ঝামেলা।এগুলো সামলিয়ে যে ফিহা বেঁচে আছে, ভালো আছে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ বল।আমার তো মনে হয় না তুই এসব একা সামলাতে পারতি।ফিহা কাঁচা হাতে সবদিকে সমান নজরে চালাচ্ছে। ভাই নামাজ পড়ে দোয়া করিস এমন একটা মেয়ে তোদের সবকিছু চালানোর জন্য পেয়েছিস।
আকশিঃ হয়েছে আর জ্ঞান বিতরণ করতে হবে না।তুই না একটু আগে বাইরে গিয়েছিলি।ফিহা কেন আসছে না সেটা বল।নিশ্চয়ই ফিহার কেবিনে উঁকি ঝুঁকি মেরেছিস।অবশ্য মারবি না কেন?তোর তো অভ্যাসই অন্যের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারা।
আদিয়াতঃ কি বললি তুই? আবার আমার মান-সম্মান নিয়ে টান দিস।ঐ কার রুমে উঁকি ঝুঁকি মারতে দেখেছিস তুই? বল জলদী বলবি।যদি না বলতে পারিস তাহলে তোকে এখন মেরে ছাদে শুকাতে দিবো।উল্টো পাল্টা কথা না বললে কি তোর পেটের খাবার হজম হয় না।
আকশিঃ কেন তুই অনন্যার রুমে উঁকি ঝুঁকি মারিস নি।সেবার যে তোকে হাতে নাতে ধরলাম। পা টিপে টিপে যে অনন্যার রুমে গিয়েছিলি।সেটা ভূলে গেছিস।
আদিয়াতঃ হারামী, অনন্যা আমার হবু বউ।সেই কবের থেকে ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।ওর রুমে উঁকি ঝুঁকি মারলে তোর সমস্যা কি?
আকশিঃ বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বাট বিয়ে এখনো হয়নি।তাহলে তুই ওর রুমে উঁকি মারতে গিয়েছিলি কেন?এখন আমায় বলবি।নয়তো তোর হবু বউকে গিয়ে বলবো তোর চরিত্রে দোষ আছে,রাতে বারে গিয়ে ড্রিংক করিস,তোর অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে।ব্যাস তোর বিয়ে ক্যান্সেল।
আদিয়াতঃ এগুলো তো ডাহা মিথ্যা কথা।
আকশিঃ সেটা তুই আর আমি জানি।কিন্তু দিনা তো নয়।সো চুপ হো যা মেরি দোস্ত 😜।
আদিয়াতঃ ব্যাপারটা কিন্তু ভালো হবে না আকশি।
আকশিঃ কেন রে এখন জ্বলে কে?আমারও সেম এমনি লাগে।যখন তুই ফিহাকে নিয়ে বলিস।
আদিয়াতঃ তুই ব্যাটা সুবিধাবাদী।তোর কপালে শনি আছে।সময় সবসময় সবার এক যায় না।আমারও সময় আসবে।তখন দেখবি কত ধানে কত চাল?
আকশিঃ যত ধান থাকবে ততই চাল হবে।তোর এসব নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে।তুই শুধু অনন্যাকে নিয়ে ভাবতে থাক।নয়তো তোর হবু বউ কিছু দিন পর অন্য কারো বউ হয়ে যাবে।
আদিয়াত চুপ হয়ে গেলো।অনন্যা, আদিয়াতের খালাতো বোন।ছোট বেলা থেকে ওদের দুজনের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে ওদের দুই পরিবার।অবশ্য অনন্যা,আদিয়াত দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে।টেবলেট বেশ কয়েকবার আকশির আশেপাশে ঘুরে গেছে। যেই আকশি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো অমনি খুশি মনে ফিহার কাছে চলে গেল।
অন্য দিকে ফিহা বেশ কষ্টে অনিয়াকে ঘুম পারালো।ঘুমের ঘোরেও অনিয়া শক্ত করে তার মা-কে ধরে রেখেছে। অনিয়াকে নিজের থেকে ছারিয়ে দোলনা শুইয়ে দিলো ফিহা।কি ভেবে জানি আবার অনিকে দোলনা থেকে উল্টো করে তুলে নিলো।নিজের সাথে শক্ত করে ধরে রাখলো বেশ কিছুখন।
#চলবে