মিষ্টার লেখক পর্ব-০৬

0
972

#মিষ্টার_লেখক(৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
[কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ]

সূর্য মামা অবশেষে আঁধারের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তার সময়সীমা অতিবাহিত বলে।রাত্রী তার মহিমায় ধীরে ধীরে গোটা শহরে ঢেলে দিচ্ছে নিকোষ কালো রঙের আবরন।তখনো শহুরে নিয়ন আর সোডিয়াম আলোয় আলোকিত হয়নি। তবে হতে আর বিলম্ব নেই।

ত্রিশ মিনিট সময়,বেশ দীর্ঘ সময় মনে হলো মহিনের কাছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে মেয়েটা কেঁদেই চলেছে! থামাথামির কোন নাম গন্ধ নেই। কিভাবে পারে এভাবে কাঁদতে? মহিন আর সহ্য করতে পারছে না।তাই ইমার হাত দুটো মুঠোয় বন্দি করে বললো,
— শুনেছি এখনকার মেয়েরা নাকি বিয়েতে কান্নাকাটি করে না। নিজের বিয়েতে নিজেই নাচে।আর যারা করে তারা প্রকৃতপক্ষে বিয়েতে অমত থাকে, তাদের বর পছন্দ হয় না। জোর করে বিয়ে দেয় বলে কান্নাকাটি করে ভাসায়। আচ্ছা তাহলে কি আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি? কিন্তু আমাকে অপছন্দ হ‌ওয়ার মতো কারণ ও আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এমন নয় যে আমি কালো, খাঁটো,মোটা, বিদগুটে চেহারা দেখতে, আমার চরিত্রের সমস্যা আছে।তাও নয় তাহলে এতো কাঁদছো কেন তুমি?

মহিনের কথায় কান্না থামিয়ে দেয় ইমা তারপর বলে,
— যেসব বর্ননা গুলো দিলেন তাঁরাও কিন্তু মানুষ। এবং আমাকে আপনাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই তাদের সৃষ্টি করেছেন। তাই তাদের নিচু করে দেখার কোন অধিকার নেই আমাদের।আর আমার কান্নাকাটি করার কারণ আপনজনদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। এই ব্যথা আপনি কি করে বুঝবেন? আপনাকে তো আর প্রিয়জনদের ছাড়তে হচ্ছে না ‌। আপনি কিভাবে বুঝবেন আমার যন্ত্রনা?

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইমা। মহিন এবার বুঝতে পারে ইমা আসলে কি জন্য কাঁদছে। তাই আলতো করে চোখের পানি মুছে দিয়ে ইমাকে নিজের বাহুতে চেপে ধরে।ইমা আদরে,আহাল্লাদে হেঁচকি তুলে।মহিন দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বলে,
— আমার বউ কেঁদে কেটেই সব সাজ নষ্ট করে দিল। আমি একবার দেখতেও পারলাম না।সাজলে আমার বউ’টাকে কেমন লাগে? কোথায় সাজ নষ্ট করবো আমি!আর সে কিনা নিজেই নষ্ট করে দিয়েছে।ইমা সোজা হয়ে বসে ছোট ছোট চোখ গুলো আরো ছোট করে তাকায় মহিনের দিকে।

এতে করে মহিন প্রসন্ন হাসে। তারপর আবার ইমাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নেয়।
.
.
ঢাকা এসে জ্যামে আটকে পড়ে তাদের গাড়ি। একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছে। মহিন খুব বিরক্ত নিয়ে আসেপাশে তাকায়।
ইমার খুব খারাপ লাগছে এভাবে বসে থাকতে। প্রাইভেট কারে এসি চালানো তবুও যেন ভ্যাপসা গরমে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার ওপর ভাড়ি বেনারসি গায়ে খুবই অস্বস্তিকর পরিবেশ। তারপর বেশ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জ্যাম কাটিয়ে ছুটে চলে গাড়ি।
ইমা আর সহ্য করতে না পেরে মহিন কে বললো, জানালা খুলে দেওয়ার জন্য।মহিন ড্রাইভার কে বললে তিনি বললেন,স্যার এসি চলছে এর মধ্যে জানালা খুলবো কিভাবে?তখন মহিন বললো,এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিতে।
পরে ড্রাইভার তাই করলেন।
ইমা যেন প্রাণ ফিরে পেল। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে প্রকৃতির হাওয়ার মধ্যে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেল।ইমার মাথা গুলিয়ে এলো, ফলস্বরূপ বাহিরে মাথা বের করে গলগল বুমি করে দিল।
মহিন ড্রাইভার কে বলে গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করতে। তারপর ইমাকে ধরে নামিয়ে পানির কন্টিনার হাতে দিয়ে বললো হাত মুখ ধুয়ে নেওয়ার জন্য।ইমা তাই করে মহিনের কথা মতো। তারপর রাস্তার পাশে বসে পরে। পাশে মহিন ও বসে বললো,
— এখন কেমন ফিল করছো? আগের থেকে বেটার লাগছে একটু?

ইমা তার দূর্বল শরীরের ভার ছেড়ে দেয় মহিনের উপর।
মহিন ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
তারপর নরম গলায় জিজ্ঞাসা করে,
— তোমার দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার অভ্যাস নেই?

এটুকু বলে একটু থেমে তার পর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বললো,
— তাহলে তো তোমার আর বাবার বাড়ি আসা হবে না! সারাজীবন শ্বশুরবাড়ি তেই কাটিয়ে দিতে হবে। তখন কি হবে তোমার?

ইমা দূর্বল কন্ঠে বললো,
— আপনার এই স্বপ্নে এক বালতি সমবেদনা। আমার এসব অভ্যাস নেই। আজকেই এরকম হয়েছে।
— আচ্ছা তাহলে এবার চলো যাওয়া যাক?
— আচ্ছা।

তারপর আবার গাড়ি চলতে শুরু করে তার নিজস্ব গতিতে।
.
.
মাগরিবের আযান হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। হঠাৎ ইমার মনে হলো নামায পড়তে হবে। শয়তান তাকে নামায থেকে ভুলিয়ে রেখেছে। আল্লাহ মাফ করুন।
ইমা মহিন কে বললো, গাড়িটা কেবলামুখি করে সাইড করে রাখার জন্য সে নামায পড়বে। এবং সাথে মহিন কে ও বললো পড়ার জন্য।

স্বাভাবিকভাবে যানবাহনে যাত্রার সময় নামাজ আদায়ের দুইটি সুরত হতে পারে—

এক.
এমন সময় যানবাহনে ওঠা উচিত নয়, যাতে করে নামাজ আদায়ে সমস্যা হতে পারে। তবে একান্ত প্রয়োজনে রওয়ানা করতে হলেও যেন নামাজ কাজা না হয়; সে ব্যাপারে যত্নবান থাকা চাই।

জেনে রাখা উচিত, গাড়ি থেকে বার বার ওঠানামা কষ্টকর মনে হলেও নামাজ কাজা করা যাবে না। বরং নামাজের সময়গুলোতে বাস থামিয়ে নিচে কোনো স্থানে কিয়াম ও রুকু-সিজদার মাধ্যমে নামাজ আদায় করে নেবে।

এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- অনেক সময় পুরুষরা বাস থামিয়ে নামাজ পড়লেও নারীরা পর্দার কারণে কিংবা লজ্জার দরুন নামাজ পড়েন না। অথচ এটা গোনাহের কাজ। তারা যথা নিয়মে ওজু করে মসজিদের একপাশে বা অন্য কোনো স্থানে বোরকা পরিহিত অবস্থায় নামাজ আদায় করে নিতে পারেন। পাশাপাশি তাদের জন্য নিরাপদ ও আরামদায়ক নামাজের স্থান রাখা অন্যদের কর্তব্য।

দুই.
গাড়ি, যানবাহান বা বাস যদি থামানো না যায় কিংবা যানবাহন থেকে নামলে সঙ্গী ও বাস চলে যাওয়ার এবং পরবর্তীতে সে বাসে আর উঠতে না পারার আশঙ্কা থাকে— তাহলে বাসে নামাজ পড়া জায়েজ। এ ক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে নেবে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ বসে নামাজ পড়লে, তার নামাজ হবে না।

দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার সময় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে, কিছুতে হেলান দিয়ে দাঁড়াবে। কারণ হাত বাঁধা সুন্নত আর দাঁড়ানো ফরজ। তাই ফরজ রক্ষার্থে সুন্নতের ক্ষেত্রে শিথিলতা মার্জনীয়। পক্ষান্তরে দাঁড়ানোর কোনো রকম সুযোগ না থাকলে, বসে ইশারা করে নামাজ পড়ে নেবে। পরে এই নামাজ আর পুনরায় পড়তে হবে না।

যানবাহনে নামাজ পড়ার সময় যথাসাধ্য চেষ্টা করবে— কেবলামুখি হতে। যদি গাড়ি কেবলামুখ থেকে অন্যদিকে ঘুরে যায়, তবে নামাজে থাকা অবস্থায় কিবলার দিকে ঘুরে যাবে। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে যেদিকে মুখ থাকে, সেদিকে মুখ রেখেই নামাজ শেষ করবে। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কেবলামুখি হয়ে নামাজ আদায় না করলে, এই নামাজ পরে আবার পড়ে নেওয়া আবশ্যক। আর কেবলামুখি হয়ে নামাজ আদায় করলে, পরে তা আবার আদায় করতে হবে না।

প্রসঙ্গত, যদি অজু না থাকে এবং অজুর পানিও না থাকে— তাহলে তায়াম্মুম করে নামাজ আদায় করে নেবে। তবে এই নামাজ পুনরায় পড়তে হবে না। আর যদি তায়াম্মুম করারও সুযোগ না থাকে, তবুও ইশারায় নামাজ পড়ে নেবে। অবশ্য পরে এই নামাজের কাজা করতে হবে।[১]
.
.
এরকম ভাবে এশার নামায সহ দুই নাম্বার নিয়ম অনুযায়ী ড্রাইভার সহ তারা নামায আদায় করে নিল।
তারপর একটা ভালো রেস্তোরাঁয় হালকা কিছু খেয়ে তারা আবার পুনরায় র‌ওনা হয়। বাসায় পৌঁছায় রাত প্রায় সাড়ে বারোটায়।
আর রাত বেড়ে যাওয়ায় কারণে কোনো রকম ফর্মালিটি বাদ দিয়ে যার যার শয়নকক্ষে অবস্থান করে সবাই। তেমনি মহিন আর ইমা ও।ইমা রুমে ঢুকেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মহিন সাথে সাথে চেঁচিয়ে বললো,
— এই তুমি কি করলে এটা?বাহির থেকে এসে প্রথমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হয় তুমি জানো না?সকল রোগব্যধি থেকে মুক্ত থাকতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হল রোগমুক্ত থাকা।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা মানে ব্যাকটেরিয়া মুক্ত থাকা।

ইমা ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
— ডিস্টার্ব করবেন না। আমাকে ঘুমাতে দিন খুব ক্লান্ত লাগছে আমার।
— একদম না আগে ফ্রেশ হবে তারপর ইচ্ছে মতো ঘুমাবে।

ইমার কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে মহিন আগে গেল ফ্রেশ হতে। তারপর একেবারে শাওয়ার নিয়ে তবে বের হয়ে আসলো। এসে আবার ইমাকে ডাকতে শুরু করে।

ইমা কিছুতেই উঠছে না।তাই মহিন টেনে তুলে জোর করে বাথরুমে নিয়ে যায়।
এতে ইমা ভিশন বিরক্ত হয়, তারপর উপায় না দেখে ফ্রেশ হয়ে আসে।
এসে টলি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট কালারের সুতির থ্রিপিস নিয়ে আবার বাথরুমে যায় বেনারসী চেঞ্জ করতে।
একে একে শাড়িতে লাগানো পিন খুলতে শুরু করে।পরে বিপত্তি ঘটে পিছনে লাগানো পিন গুলো নিয়ে। কিছুতেই হাতে নাগাল পাচ্ছে না।বহুত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন মতেই সফলতা লাভ করতে পারছে না। শেষে মহিনের কথা মনে পড়লো ইমার। কিন্তু মহিনের কথা ভাবতেই লজ্জায় শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শেষে অনেক ভেবে চিন্তে দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে মহিনের উদ্দেশ্যে বললো,
— এই শুনছেন?

মহিন মাথায় লম্বা করে হাত রেখে শুয়ে ছিল।ইমার ডাকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— কিছু লাগবে?

ইমা কাচুমাচু হয়ে বললো,
— শাড়ির পিন খুলতে পাচ্ছি না।

ইমার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় মহিন। এতে আরো কাচুমাচু হয়ে যায় ইমা…..
______
তথ্যসূত্র : মাআরিফুস সুনান ৩/৩৯৪-৯৬; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৮৮ ও ১/২৯১; রদ্দুল মুহতার: ২/১০২,৪৯১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২৮, ১৪৪
_______

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে