মায়াদেবের মায়া পর্ব-০৩

0
2001

#মায়াদেবের_মায়া
#পর্ব_৩
#তাহমীম

আমান কিছু না বলে মায়াকে খুজঁছে সব জায়গায় চোখ বুলিয়ে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তার মায়া। মায়া দু-হাত দিয়ে দরজার পর্দাকে বার বার দলা পাকাচ্ছে আবার খুলছে।
আমান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। আমান মায়ার দিকে তাকিয়ে

– কিরে এখনো দূরে দাঁড়িয়ে থাকবি? আমার কাছে আসবি না মায়ারানী?

মায়া কিছু বলতে যাবে তখনি পিছন থেকে মুনিয়া আহমেদ রুমে প্রবেশ করে। আমানকে জড়িয়ে ধরে
– কেমন আছিস এখন আব্বাজান।
– ভালো আছি ফুপিমা।
– এইটা কেনো করলি যদি তোর কিছু হয়ে যেতো? আমাদের কথা একবারো ভাবলি না?

– আমার হাতে আর কোন উপায় ছিলো না ফুপিমা। তুমিই তো যাচ্ছিলে নিঝুমের সাথে আমার মায়ার বিয়ে দিতে। আমি মায়ার জন্য কানাডায় স্কলারশিপ পাওয়ার পরে ও যায়নি। আমি যে মায়াকে ভালোবাসি তোমরা কেউ খেয়ালই করছিলে না।
আমি ওকে ছাড়া কিছু কল্পনা করতে পারি না ফুপিমা। আমি ওকে অন্য কারো হতে কি ভাবে দেখবো? তাই তো এই ডিসিশন নিলাম। কিন্তু ওকে ছেড়ে যেতে পারলাম না। আমি ওকে ছাড়া একটা নিঃশ্বাস কল্পনা করতে পারি না। ওকে ছাড়া আমাকে আমি ভাবতে পারি না। তাহলে বলো আমি কি করতাম?

মুনিয়া আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে
– মায়া তোরই থাকবে চিন্তা করিস না।
– নিঝুম কোথায় ফুপিমা? ও আমাকে দেখতে আসেনি?
– ও অফিসে গিয়েছিলো আসবে বলেছে রাস্তায় হয়তো।
– ওহ আচ্ছা। ছোটমা মায়া ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেনো ভিতরে আসতে বলো।

আমান মায়ার দিকে তাকিয়ে
-আসবি না আমার কাছে মায়া?

মায়া এদিক সেদিক তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে আমানের দিকে এগিয়ে আসে। আমানের মাথার দিক দিয়ে বেডের সাইডে দাঁড়ায়।
সবাই আমানের সাথে কথা বলে বাহিরে যায় আমান আর মায়াকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য। মায়া এখনো সাইডে দাঁড়িয়ে আছে।

-বসবি না মায়ারাণী?

মায়া আমানের সামনে চেয়ারে বসে পরে। আমানের চুলে হাত দিয়ে আমানের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে
– আমাকে এতো ভালোবাসিস আগে বলিস নি কেনো?
– কেনো তুই কি বুঝতি না?
– উমহু
– তোর মনে আছে একবার ভার্সিটিতে একটা ছেলে তোর সাথে বেয়াদবি করেছিলো। তারপর এসব জেনে আমি একাই ওই ছেলেকে মারতে গিয়েছিলাম আর ওই ছেলের আর ছেলের বন্ধুরা মিলে আমায় পিঠিয়ে আমার হাত ভেঙে দিয়েছিলো? ( একটু হেসে) তুই আমায় হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছিলি আর কান্না করছিলি।
সেদিন তোকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছি কিন্তু তুই খেয়াল করিসনি। তুই কান্নায় ব্যস্ত ছিলি। তোকে কিন্তু আমি প্ল্যান করেই আমার ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছিলাম। হি হি হি যাতে তোকে সব সময় চোখের সামনে রাখতে পারি।

শব্দ করে হেসে একটু থেমে মায়ার দিকে মায়াময় চোখে তাকিয়ে
– তোর মনে আছে মায়া?
– কি?
– একবার তোকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম আর তোর হাত কেটে গিয়েছিলো।
– হুম
– কেনো ফেলেছিলাম জানিস? তুই নিঝুমের সাথে খেলছিলি আমি তোকে অনেক বার ডাকার পরে ও শুনছিলিনা তখন ভীষণ রাগ উঠেছিলো আর যখন এসেছিলি রাগে ধাক্কা মেরেছিলাম। কিন্তু জানিস পরে আমি ই কান্না করেছিলাম অনেক তোর জন্য। আমার জন্য তোর হাত কেটে গিয়েছিলো। ভীষণ ভালোবাসি তোকে। আমার ঝগড়া ছিলো ভালোবাসার।

মায়া চুপ হয়ে আছে। আমান মায়ার হাত ধরে রেখেছে।
– কিরে কিছু বলছিস না যে।
– একটু রেস্ট নে ডাক্তার এতো কথা বলতে মানা করেছে।
– ডাক্তার কচু জানে আমি এখন সুস্থ হয়ে গেছি। তুই আছিস তো আমার কাছে।
একটু চুপ থেকে
– মায়া। তুই জানিস তো আমি তোকে মায়ারাণী ডাকি।
– হুম
– আমায় ছেড়ে যাবিনা তো কখনো?

একটু নিরব থেকে
– যাবো না। ( এক হাত দিয়ে ধরে)

হঠাৎ আমানের চোখ যায় দরজায় নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
– নিঝুম দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ভিতরে আয়!

মায়ার ভিতরে ধক করে উঠে নিঝুমের নাম শুনে। মায়া পিছনে ফিরে দেখে সত্যিই নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে।

নিঝুম কিঞ্চিৎ হেসে
– না তোরা কথা আমি বাহিরে আছি পরে আসবো।
বলেই নিঝুম চলে যায় বাহিরে।

মায়া নিচে তাকিয়ে আছে। আমান মায়ার নিরবতা দেখে।
– মায়া একটু পানি দে তো গলা শুকিয়ে গেছে।

মুনিয়া আহমেদ তখন রুমে এসে।
– পানি খেতে হবে না সুপ এনেছি তোর জন্য আগে সুপ খাবি। মায়া নিঝুম এসেছে দেখেছি ওকে একটু বলতো আসতে।
– হুম ফুপিমা।

মায়া খুঁজছে তার মায়াদেবকে কোথাও নেই মায়াদেব। তবে কি চলে গেছে সে? আমানের সব কথা কি শুনেছে মায়াদেব? মায়ার ভিতরে সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। মায়াদেব কে একটু ভালো করে দেখতে ও পারেনি সে। খুঁজতে খুঁজতে নিঝুমকে পাই করিডোরের এক কোনায়। জানালার কাচে একহাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ার মায়াদেব।

মায়া চুপ চাপ গিয়ে দাঁড়ালো নিঝুমের পাশে। নিঝুম বাহিরে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে।
নিঝুম মায়ার দিকে না তাকিয়েই

– তাহলে বিয়ে করছো আমানকে।
মায়া আমানের দিকে নিরব চোখে তাকিয়ে

— ফুপিমা যেতে বলেছে। সবাই অপেক্ষা করছে।
– হুম । ভালোই হয়েছে তোমাকে আর আমার বুঝাতে হবে না আমানকে বিয়ে করার জন্য।
– আমাকে তো অনেক আগেই পণ্য করে দিয়েছেন আপনারা। যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে দিচ্ছেন।
– আমান ভীষণ ভালোবাসে তোমায় তাই না?
– হ্যা আর আ…..

ওদের কথার মধ্যেই মায়ার আম্মু এসে।

– কিরে তোরা এই খানে সবাই খুঁজছে তোদের আয়। আমানকে সন্ধ্যায় রিলিজ করে দিবে।
আমরা ভাবছিলাম আজকে রাতে একটা গেট টুগেদার করলে কেমন হয়? অনেক ঝামেলা গেলো কয়েকদিন।

নিঝুম মামির কথা কেড়ে নিয়ে।
– অনেক ভালো হবে মামুনি সব আত্নীয়স্বজন মিলে একটু রিলেক্স করা যাবে।
– হ্যা এখন চল সবাইকে তো ইনভাইট করতে হবে।

🍂🍂রাতে🍂🍂🍂

খাবার দাবারের অনেক আয়োজন করেছে আশিক আহমেদ আর শফিক আহমেদ। আজকে যেন বাড়ির প্রান ফিরে পেয়েছে। আশিক আহমেদ আর শফিক আহমেদ আলোচনা করছে আজকে আমান আর মায়ার বিয়ের তারিখ ও ফাইনাল করে ফেলবে। মায়া রেডি হয়ে নিচে নামছিলো তখনি ওদের কথোপকথন শুনতে পাই ।

মায়ার বুঝতে বাকি রইলো এই আয়োজন কেনো করা হয়েছে। মায়া আবার রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ওরনাটা দূরে ছুঁড়ে মারে কি করবে সে এখন? আর তো কোনো পথ খোলা নেই। আমানকে কিছু বলবে? কি করে বলবে কিছু বললে যদি আমান আবার সুইসাইড করতে যায় তখন? বার বার তো আর বেঁচে যাবে না। একটা মানুষ আমার জন্য মারা গেলে আমি কি ভালো থাকবো? সবাই তখন আমাকে ভুল বুঝবে। কেউ আমায় ক্ষমা করবে না। কিন্তু মায়াদেবকে না পেলে কি আমি ভালো থাকবো। মায়াদেবকে ছাড়া তো আমি ভালো থাকবো না। বেঁচে থেকে ও মরে যাবো। আমার কি অধিকার নেই একটু ভালো ভাবে বাঁচার? কি করবো এখন আমি। মায়ার কান্না দলা পাকাচ্ছে গলায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মায়া শব্দ করে কান্না করে দেয়। মায়াদেব কি তার এই অবস্থা দেখতে পাই না? বুঝতে পারে না তার মায়া ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছে।

দরজায় ধাক্কাচ্ছে মায়ার আম্মু। মায়া নিজেকে সামলে দরজা খোলে দেয়।
– কিরে এখনো রুমে বসে আছিস কেনো? সবাই চলে এসেছে নিচে। নিঝুম, মুনিয়া আপা, রাশেদ ভাই ( নিঝুমের বাবা) নিঝুমের দাদা, অহনা আর অনি ও ( নিঝুমের দুই বোন) সাথে একটা মেয়ে ও কি যেন নাম বললো ওহ মনে পড়েছে। তিথি।
– তিথি কে?
– নিচে আয় তাহলেই দেখতে পারবি।
– আমি যাবো না নিচে।
– পাগলামি করিস না মায়া। সব সময় পাগলামি মানায় না।
– কি মানায় আম্মু? আমাকে তো তোমরা পাগলই করে দিয়েছো আমাকে চেয়ার টেবিলের মতো বস্তু পেয়েছো যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে দিচ্ছো। কেন আমি পাগল হবো না?

অহনা আর অনি কথার মাঝে এসে মায়া আপু তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি সবাই খুঁজছে তোমাকে।
মায়া চোখ মুছে অহনা আর অনির সাথে নিচে চলে আসে।
মায়ার আম্মু ঐশি শিকদারের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে তার মেয়ের এমন অবস্থা দেখে। না পারছে মায়া কাউকে কিছু বলতে না পারছে সইতে কিন্তু মা তো মা ই হয়। মা এর চোখে যে তার সন্তানের সব ধরা পড়ে যায়।

.
.
.
মায়া নিচে যেতেই দেখে নিঝুম একটা মেয়ের সাথে হাসাহাসি করছে। মায়াকে দেখে নিঝুম তিথিকে নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে।

– মায়া এতো দেরি করে আসলে যে? যায় হোক তিথি ও মায়া। আর মায়া ও হচ্ছে তিথি আমার ফ্রেন্ড। আমরা এক সাথেই পড়াশোনা করেছি।

মায়া মলিন হেসে
– ওহ
তিথি মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে
– নিঝুম তোমার কথা অনেক বলে।

আমান পিছন থেকে এসে অহনা, অনিকে
-কেমন আছো?
– ভালো আছি ভাইয়া ( এক সাথে)

মায়া শুধু নিঝুমকে দেখছিলো মেয়েটার সাথে কতো ক্লোজলি বসছে দাঁড়াচ্ছে মনে হচ্ছে বিয়ে করা বউ। মায়ার এসব দেখে ইচ্ছে হচ্ছে উপরে চলে যেতে কিন্তু পারছে না।

কিছুক্ষন পর

আমান সবার এটেনশন নিয়ে মায়ার দুবাহুতে ধরে আজকে কিন্তু আমাদের মায়া গান গাইবে।

আমানের কথা শুনে
– আমান আমি গান পারি না।
– সবাইকে কি বলবো তুই ভার্সিটির সব ফাংশনে গান গাইতি আর অকেশনে ও। মায়া কিন্তু অনেক ভালো গান জানে কবিতা ও লিখে। ওর সুরে সবাই মুগ্ধ হয়। বিশেষ করে আমি হিহিহিহি।

অনি আর অহনা ও বলছে
– আপু প্লিজ একটা গান গাও।
মায়ার আব্বু ও বলছে
– কতো দিন তোর গান শুনি না মা একটা গান গেয়ে শোনা সবাইকে।

সবার অনুরোধে মায়া গান গাইতে রাজি হয়। চোখ জোড়া বন্ধ করে

ক্ষমা করো আমি ভালো নেই
এলোমেলো হয়ে গেছি,
যেন সব হারিয়েছি,
হে বসন্ত বিদায় ..

পথে পড়ে থাকা মন খারাপ
চুপি চুপি খুঁজে নেয় নির্বাসন,
স্মৃতি টুকু ধুয়ে গেছে পায়ের ছাপ
মনে পড়ে যায় আজ তার শাসন ..
ক্ষমা করো আমি ভালো নেই।

ওই দূরে নক্ষত্র মালায়
তুমিও তারা হয়ে জ্বলো,
আমার কান্না শুনতে কি পাও?
দেখতে কি পাও কিছু বলো? .. ( নিঝুমের দিকে তাকিয়ে)

পথে পড়ে থাকা মন খারাপ
চুপি চুপি বেছে নেয় নির্বাসন,
স্মৃতি টুকু ধুয়ে গেছে পায়ের ছাপ
মনে পড়ে যায় আজ তার শাসন ..
ক্ষমা করো আমি ভালো নেই ..

কে দেবে মুছিয়ে অভিমান
কে নেবে কোলে তুলে মাথা,
এতটা পথ পেরিয়ে এসে
উঠোনে শুধু ঝরাপাতা। ( চোখ মুছে)

ক্ষমা করো আমি ভালো নেই
এলোমেলো হয়ে গেছি,
যেন সব হারিয়েছি,
হে বসন্ত বিদায় …

পথে পড়ে থাকা মন খারাপ
চুপি চুপি বেছে নেয় নির্বাসন,
স্মৃতি টুকু ধুয়ে গেছে পায়ের ছাপ
মনে পড়ে যায় আজ তার শাসন ..
ক্ষমা করো আমি ভালো নেই,
ক্ষমা করো আমি ভালো নেই,

গান শেষেই মায়া সাথে সাথে চলে যায় ড্রয়িংরুমের বেল্কুনিতে। বেল্কুনির রেলিংয়ে এক হাত দিয়ে ধরে আরেক হাতে মুখ চেপে ধরে কাদঁছে মায়া ওই দিকে আরেক বেল্কুনিতে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে………..

চলবে…….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে