#মায়া
#পর্ব_১১
#ওয়াহেদ_মাহমুদ
মেয়ের সন্তান হওয়ার খুশির সংবাদ শুনে বর্ষার মা বর্ষার বাসায় রওনা হয়। কিন্তু যাওয়া পথে যেই বাসে বর্ষার মা ছিল, সেই বাস এক্সিডেন্ট করে। অনেক মারাত্মক ভাবে আহত হয়। তারপর বাসে যারা ছিল সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় বর্ষার মা আসে না। বর্ষার আর বর্ষার শ্বশুর বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এখনো কেন আসছে না? এতোক্ষণ তো পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। আর কোন উপায় না পেয়ে বর্ষা তাঁর ভাই ওয়াহেদের কাছে ফোন দেয়।
হ্যালো ভাইয়া মা কোথায়? বাসায় আছে?
মা কেন বাসায় থাকবে? মা তো তোদের বাসায় গিয়েছে। আর আমরা কালকে যাচ্ছি তোদের বাসায়। একসাথে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু মা আজ চলে গিয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম তাই যেতে পারিনি। না হলে একসাথে যেতাম।
কিন্তু ভাইয়া মা সেই কখন বাসা থেকে বাহির হয়েছে এখনো আমাদের এখানে আসিনি।
তোর ওখানে নেই তাহলে কোথায় যেতে পারে। ফোন দিয়েছিস।
হ্যাঁ দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাই। অনেকবার ফোন দিয়েছি।
দুই দিন ধরে মায়ের কোন খোঁজ নেই। হাসপাতাল থেকে আজ বাসায় চলে আসে বর্ষা তার মেয়ের সাথে। বাসায় সবাই চিন্তিত মাকে নিয়ে। আজ সকালে গিয়ে পুলিশ রিপোর্ট করে এসেছে ওয়াহেদ।
বিকালে পুলিশের থেকে খবর আসে দুই দিন আগে একটা বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ওখানে অনেকেই আহত হয়েছে আবার অনেকেই নিহত হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা চলছে আর নিহতদের মর্গে রাখা হয়েছে। আমরা সঠিক বলতে পারছিনা আপনার মা নিহত নাকি আহত। আর আপনার মায়ের কোনো ছবি ছিল না আপনাদের কাছে সেজন্য আপনি আমাদের ছবি দিতে পারেননি।
তাই আপনার মা নিহত হয়েছে নাকি আহত হয়েছে সেটা জানার জন্য আপনাদের অতি তাড়াতাড়ি হাসপাতাল আসতে হবে।
তারপর সবাই ছুটে হাসপাতালে উদ্দেশ্যে রওনা দেয় বর্ষা বাসায় থেকে যায় তার সিজার করা হয়েছিল সেজন্য হাসপাতালে যেতে পারিনি। বাস একসিডেন্টে নিহতদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল তাই প্রথমে সবাই মর্গে যায়। কিন্তু মর্গে ওয়াহেদের মাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারপর সবাই কিছুটা আশা পেল হয়তো বেঁচে আছে।
চিকিৎসাধীন রত রোগীদের কাছে গিয়ে ওয়াহেদ তার মাকে খুঁজে পাই। ডাক্তার বলেছে তার মা আর কোনদিন চোখে দেখতে পাবে না দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
ওয়াহেদ তখন বলে দুটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আপনার মায়ের দুটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর চোখে দেখতে পাবে না। যদি কেউ আপনার মায়ের জন্য চোখ দান করে তাহলে দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসবে। দুটা চোখ দান করার প্রয়োজন নেই। যদি কেউ একটা চোখ দান করে তাহলে ওই এক চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে পারবে। আর যদি কেউ দুইটা চোখ দান করতে পারে তখন অনেক ভালো। সেটা আপনারা পরিবারের কেউ হোক বা বাহিরের কেউ হোক সমস্যা নেই।শুধু তাদের সম্মতি থাকা লাগবে।
কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় নিয়ে আসে ওয়াহেদ তার মাকে। কিন্তু চোখ দান করার জন্য কেউ ছিল না। এক্সিডেন্ট হয়েছে প্রায় দশ দিন হয়ে গিয়েছে। ওয়াহেদের বোন বর্ষা এসেছ তার মাকে দেখার জন্য।
কেমন আছো মা?
কেমন আর থাকতে পারি। অনেক ইচ্ছা ছিল তোর মেয়েকে দেখার জন্য কিন্তু দেখার জন্য তো আমার চোখ নেই। তোর মেয়েকে দেখার ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। তোর মেয়েকে আমার কোলে একটু দিবি।
বর্ষা তার মেয়েকে মায়ের কোলে দেই।
আচ্ছা বর্ষা তোকে তো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল এবোরশন করানোর জন্য। তাহলে তোর মেয়ে কিভাবে হলো। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
আসলে এটা আমার শ্বাশুড়ি আর আমার স্বামীর সাজানো একটা নাটক ছিল। তোমার আর ওয়াহেদ ভাইয়ার ভুলটা বোঝানোর জন্য। সুরাইয়া ভাবির মেয়ে হয়েছিল বলে ভাইয়া দ্বিতীয় বিয়ে করে। সুরাইয়াকে অনেক নির্যাতন করা হয়। আফসানা ভাবির মেয়ে হবে শুনে তুমি বলেছিলে এবোরশন করিয়ে নিতে। সেই জন্যই আমরা এবোরশনের নামে এমন করেছিলাম।
আসলে কি জানো মা ছেলে মেয়ে কোনটি হবে এটা আল্লাহর হাতে। এটা স্বামী স্ত্রীর হাতে না। তোমার নিজের মেয়ের জন্য তোমার যতটা ভালোবাসা, দয়া, মায়া ঠিক তেমনি তারাও তো কারো মেয়ে তাদের প্রতি তো তাদের বাবা মায়ের ভালোবাসা, দয়া, মায়া আছে।
আজ সুরাইয়ার বান্ধবী মারিয়ার মেয়ে সন্তান হবে আলট্রাস্নোগ্রাফের মাধ্যমে জানা যায়। এর আগেও একটা সন্তান আছে মারিয়ার সেটাও মেয়ে এটাও মেয়ে হবে। কিন্তু মারিয়ার স্বামীর বিন্দু মাত্র আফসোস নেই। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার পরে সবাই চায় দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হোক। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলে অনেকেই আফসোস হয়। কিন্তু মারিয়ার স্বামী যেন আরো খুশি। এখন থেকেই অফিস হাফ ডিউটি করে। বাসায় কাজের জন্য কাজের লোক রেখেছে। আর মারিয়ার স্বামী তাড়াতাড়ি রাতে চলে আসে যাতে মারিয়ার সমস্যা না হয়।
এসব দেখে সুরাইয়ার অনেক ভালো লাগে। আর আফসোস হয় নিজের প্রতি। সবাই চায় এমন একটা স্বামী পেতে যে সব সময় স্ত্রীর পাশে থাকুক।
এভাবে বেশ অনেকদিন কেটে যায়। একটা সময় সুরাইয়ার উপর অনেক নির্যাতন করেছিল তার শ্বাশুড়ি, কিন্তু এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। ছেলের বোউ এর কাছে নির্যাতন হয় শ্বাশুড়ি বাসার একজন অবহেলিত মানুষ আফসানার শ্বাশুড়ি।
রাতে যখন ওয়াহেদ বাসায় আসে তখন আফসানার বলে এভাবে আর কত দিন চলবে? আমি আর একদম সহ্য করতে পারছি না।
ওয়াহেদ তখন বলে কেন কি হয়েছে? তোমার কোন সমস্যা হয়েছে কী?
সমস্যা আর কি হবে। সমস্যা আমার তো কিছুই না। সমস্যা হলো তোমার মায়ের।
মা আবার কি করেছে?
আমার ছোট একটা বাচ্চা আছে। আর তোমার মা তো চোখে দেখে না। এখন আমি আমার ছেলে কে দেখব নাকি তোমার মা কে দেখব। প্রতিদিন গোসল করানো বাথরুমে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা। খাইয়ে দেয়া, গোসল করিয়ে কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয়া। এক কথায় তার সবকিছুই আমাকে করতে হয়।
ওয়াহেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে। তাহলে এখন আমি কি করতে পারি। তুমি যদি না পারো তাহলে আমি তো আর করতে পারব না।
আমি কি কখনো বলেছি তোমাকে করতে। এক কাজ করতে পারো? তাহলে সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে।
কি কাজ?
তোমার আম্মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখে আসো। আর তাছাড়া তো কিছু করার নেই। আমার ছোট বাচ্চা আছে। সবকিছু একসাথে সামলিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।
তোমার মাথা ঠিক আছে আফসানা। এসব কি কথা বলো। এসব করলে মানুষে কি বলবে। মানুষ থুতু ফেলবে আমাদের উপর।
আফসানা তখন রাগান্বিত হয়ে বলে। আমি কিছু জানি না লোকে কি বলবে। হয় তুমি তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে না হয় আমাকে ভুলে যাবে।
ওয়াহেদ তখন বলে আমাকে দুইদিন সময় দাও দেখি কি করা যায়।
অনেকক্ষণ ভাবতে থাকে ওয়াহেদ। কি করবে বুঝতে পারছে না।কয়েকদিন পরে ওয়াহেদ তার আম্মার কাছে বলে। আমি সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকি। রাতে এসে তোমাকে সময় দিতে পারি না। তোমার বোউ মা সারাদিন ব্যস্ত থাকে বাচ্চা নিয়ে তোমার প্রতি তার নজর থাকে না বেশি। তোমার এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে আমি জানি। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাকে ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি। ওখানে তুমি ভালো থাকবে। গল্প করার জন্য মানুষ পাবে। তাড়াতাড়ি সময় কেটে যাবে।
ওয়াহেদের মা তখন বলে তোমার যেটা ভালো মনে হয় করো। আর ভাবতে থাকে এটাই মনে হয় আমার কপালে ছিল, পাপের শাস্তি। অন্যায় যা করেছি তার শাস্তি ভোগ করতেই হবে।
তারপর ওয়াহেদ তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।
প্রায় অনেকদিন পার হয়ে যায়। আজ পূর্ণতার দ্বিতীয় জন্ম বার্ষিকী। আগের বারের মতো এবারো কেক কাটা হয়নি পার্টি দেয়া হয়নি। সবাই একসাথে বৃদ্ধাশ্রমে যায়। ১০৪৫
চলবে,,,,
(বি.দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।