#মায়া
#পর্ব_০২
#ওয়াহেদ_মাহমুদ
সুরাইয়া নিজের স্বামীর সদ্য বিয়ে করা বাসর ঘরে ঢুকে গেলেন সবার সামনে দিয়ে। এটা দেখে সবাই হতবাক। বাইরে অনেকেই অনেক কথা বলছে। ঘরে ঢুকেই সুরাইয়া নতুন বোউ এর ঘোমটা খুলে তার উদ্দেশ্যে বললেন তুমি যদি কখনো ওয়াহেদ কে কষ্টি দিয়ে কথা বলেছো বা খারাপ ব্যবহার করেছো তাহলে আমি নিজ হাতে তোমাকে সেদিন শাস্তি দিব। আমার কথা ভালো করে শুনে নাও। ওয়াহেদ আর নতুন বিয়ে করা বোউ সুরাইয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ওয়াহেদ ভাবতেই পারছে সুরাইয়া এমন করতে পারে।
সুরাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই শ্বাশুড়ি এসে সুরাইয়ার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে সবার সামনে থেকে অন্য ঘরে নিয়ে চলে যায়। আর একটা থাপ্পড় মরে বলে আমার কথা ভালো করে মনে রাখ আমার ছেলে তোকে ছেড়ে দিয়েছে। এই বাসায় তোর কোনো অধিকার নেই। যদি এখানে থাকতে হয় তোর, আমার কথা অনুযায়ী থাকতে হবে। আরো অনেক কথা শুনিয়ে সুরাইয়ার ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে চলে যায়।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কান্না করতে থাকে সুরাইয়া। মাত্র দুই সপ্তাহের ছোট বাচ্চা। মায়ের দুঃখ আর কি করে বুঝবে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সুরাইয়া বলতে থাকে তোর যদি জন্ম না হতো তাহলে আমি আমার এই জীবন শেষ করে দিতাম। রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে যায় তাও দরজা খুলে দেয়নি এখনো কেউ। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল হয়ে যায় তাও কেউ দরজা খুলে দেয়নি। পরের দিন ও দরজা খুলে দেয় না কেউ। এদিকে সুরাইয়া দুইদিন থেকে কিছু খাওয়া দাওয়া করে নাই। মেয়েকে খেতে দেয়ার জন্য বুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দুধ নেই। আর দুধ দিলে সুরাইয়ার শরীর দূর্বল হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
দুইদিন পরে সুরাইয়ার শ্বশুরি এসে দরজা খুলে কিছু খাবার রেখে যায় আর যাওয়ার সময় বলে যায় আজ ওয়াহেদের শ্বশুর বাড়ি থেকে মানুষ আসবে ওয়াহেদ আর ওয়াহেদের স্ত্রীকে নিতে। আমি কোনো ঝামেলা চাই না তোর জন্য। যতক্ষণ না ওরা এখান থেকে চলে যায় তোকে আর তোর মেয়েকে এই ঘরে মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে হবে। এটা বলে সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি আবার ঘরের তালা দিয়ে চলে যায়।
ক্ষিধা পেয়েছে অনেকে সুরাইয়ার, মেয়ে এদিকে কান্নায় ছটফট করছে তাড়াতাড়ি দুধ দিতে হবে। আর কোনো কথা না ভেবেই তাড়াতাড়ি করে খেয়ে মেয়েকে দুধ দেয়। এবার মেয়েটা কান্না বন্ধ করে। কোনো কিছু মেনে নিতে পারছে না সুরাইয়া । সুরাইয়া সব সময় চাই ওয়াহেদ ভালো থাকুন। কিন্তু আজ তিন দিন একটুও খোঁজ খবর নিলো না ওয়াহেদ তার। কিন্তু এক সময় ওয়াহেদ, সুরাইয়াকে ছাড়া থাকতে পারতো না। অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে ওয়াহেদ।
ওয়াহেদের ফোনে অনবরত ফোন দিয়ে চলছে সুরাইয়া কিন্তু ফোন যাচ্ছে না। আর ফোন গেলেও ফোন রিসিভ করছে না। যেভাবে হোক ওয়াহেদের সাথে দেখা করতে হবে। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সুরাইয়া। ঘরে তালা দেয়া ফোন যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পরে সুরাইয়ার কানে একটা আওয়াজ ভেসে আসে। ওয়াহেদ সুরাইয়া সুরাইয়া করে সারা বাড়িতে চিল্লাচিল্লি করছে।
দরজার ওপাশে থেকে সুরাইয়া বলে আমি এখানে ওয়াহেদ।
কিন্তু ঘরে তো তালা দেয়া। ওয়াহেদের চিল্লাচিল্লি শুনে ওয়াহেদের মা চলে আসে আর বলে–
কি হয়ছে বাবা চিল্লাচিল্লি করো কেনো।
ওয়াহেদ তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে তুমি কাল বললে সুরাইয়া বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছে ওর বাবা অসুস্থ। কিন্তু তুমি তো ঘরে তালা দিয়ে রেখে দিছো। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দাও। আমি সুরাইয়ার সাথে কথা বলবো। চাবি নিয়ে এসে সুরাইয়ার শ্বশুরি দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সাথে সাথে ওয়াহেদ সুরাইয়ার হাত ধরে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়ার সময়। ওয়াহেদের নতুন স্ত্রী আফসানা এসে সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে কি এমন কথা বলবেন যেটা আমার সামনে বলা যাবে না। যা বলার আমার সামনে বলেন এখন আপনার প্রতি আমার অধিকার আছে।
ওয়াহেদ রাগি চোখে আফসানার দিকে তাকিয়ে বললো সুরাইয়া আমার স্ত্রী যেমনটা তুমি। তোমার সাথে যেমন পার্সোনাল বিষয় আছে ঠিক তেমনি সুরাইয়ার সাথেও পার্সোনাল বিষয় আছে।
সুরাইয়া লক্ষ্য করলো শ্বাশুড়ি তার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে গিলে খেয়ে দিবে। তাই কিছুটা ভয় পেয়ে ওয়াহেদ কে বললো যা বলার এখানেই বলো সমস্যা নেই কোনো।
সুরাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ওয়াহেদ বললো এতো কিছু হয়ে গেলো আমাকে জানালে না কেন? একটা ফোন তো দিতে পারতে। আম্মা আমার সাথে মিথ্যা কথা বলেছে তুমি বাপের বাড়িতে আছো এখনো কয়েকদিন পরে আসবে ওর বাবা অসুস্থ কয়েকদিন থেকে।
তোমার ফোনে তো কয়েকবার ফোন দিলাম ফোন যায় না। সুরাইয়া তখন কান্না কন্ঠে বলে আমিও তোমার সাথে কথা বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। ফোন দিয়েছি অনেকবার কিন্তু যায় না। পাশে থেকে সুরাইয়ার শ্বশুড়ি মিটমিট করে শয়তানের মতো করে হাসি দিচ্ছে। তখন আর কারো বুঝতে রইলো না। কেউ তাদের ফোন নিয়ে দুজনের ফোন থেকে দুজনের নাম্বার ব্লকলিস্ট করে রেখে দিয়েছে। সে জন্য ফোন যাচ্ছে না।
এসব কথা বলতে বলতেই আফসানার বাসার লোকজন চলে এসেছে। প্রায় পাঁচ জনের মতো মানুষ এসেছে। অনেক মিষ্টি নিয়ে এসেছে অনেক তরকারি নিয়ে এসেছে মাছ, মাংস ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব জিনিস দেখে সুরাইয়ার শ্বশুড়ির মুখে আর হাসি ধরে না। এই মেয়েটা সব সময় লোভি প্রকৃতির। যে যত দিতে পারবে সেই তার কাছে ভালো। আর যে দিতে পারবে না সে ভালো না।
সুরাইয়া কিচেনে রান্না করছে এমন সময় আফসানা এসে সুরাইয়াকে বললো তুমি ওয়াহেদের থেকে দূরে দূরে থাকবে। ওয়াহেদ শুধু আমার। বেশি অধিকার দেখাতে আসলে তখন বুঝবে আমি কি জিনিস। আর হ্যাঁ ওয়াহেদ নাকি তোমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছে ছোট লোক ঘরের মেয়ে। আমার বাসা থেকে অনেক কিছু পাঠিয়েছে। বিয়ের সময় তোমার বাসা থেকে নাকি কিছু দেয়নি। আর আমি যেন এসে তোমাকে এখানে না দেখি।
সুরাইয়া কাজ করছে আর অনবরত কান্না করছে। এমন সময় শ্বাশুড়ি এসে বললো বেশী ঢং না দেখিয়ে ভালো করে রান্না কর। রান্না যদি খারাপ হয় তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।
রান্না শেষে সুরাইয়া সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে। আর ওয়াহেদ গিয়েছে বাইরে দোকান থেকে পানি কিনতে। খাবার পরিবেশন করার সময় মাংসের এক ফোঁটা ঝোল আফসানার শাড়ি লেগে যায়। রাগান্বিত অবস্থায় আফসানা খাবারের হাত দিয়ে সুরাইয়ার গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিয়ে বলে
ছোটলোকের বাচ্চা জানিস তুই এই শাড়ির দাম কত। আর তুই এটা নষ্ট করে দিলি। তোর বাবার ক্ষমতা আছে কি এতো টাকার শাড়ি কেনার।
সুরাইয়ার মুখ ধুয়ে এসে আবার খাবার পরিবেশন করতে শুরু করে। থাপ্পড়ে সুরাইয়ার মুখে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে গিয়েছে। ওয়াহেদ যাতে বুঝতে না পেরে সেজন্য শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়াহেদ বাসায় চলে আসে। ওয়াহেদ আর সুরাইয়ার শ্বশুড়ি কে খেতে দিচ্ছে সুরাইয়া এমন সময় ওয়াহেদের মা খাবারের প্লেট টা আছাড় দিয়ে ফেলে দিয়ে ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বলে তোর এই বোউ আমাকে আমাকে মেরে ফেলবে তরকারিতে আমি বেশি ঝাল খেতে পারি না আমি। সে জন্য বেশি করে ঝাল দিয়েছে।
ওয়াহেদ তরকারি খেয়ে বুঝতে পারে তরকারিতে বেশি ঝাল হয়নি। মা ইচ্ছা করে এমন করছে। যাতে সুরাইয়াকে ডিভোর্স দিয়ে এই বাসা থেকে তাড়িয়ে দিই। সুরাইয়াকে তার চোখে খারাপ করতে চায়। কিন্তু মায়ের মন রাখার জন্য সুরাইয়াকে একটু বকে দেয়। আর বলে দেয় এরপর থেকে যেন ঝাল কম দেয়া হয়।
ওয়াহেদ পরে সুরাইয়া কে ডেকে বলে তখন বকা দিলাম কিছু মনে করোনা প্লিজ। সুরাইয়া তখন মুচকি হেঁসে বললো কিছু মনে করে নাই। কিছুক্ষণ পরে বাসা থেকে সবাই চলে যায় শুধু থেকে যায় সুরাইয়া, সুরাইয়ার শ্বশুড়ি আর মেয়ে। সুরাইয়ার অনেক ভয় করছে শ্বশুড়ি যদি খারাপ কিছু করে বসে তার সাথে। এখন তো ওয়াহেদ নেই।
কিছুক্ষণ পরে সুরাইয়া রুমে থেকে বাহির হয়ে ডাইনিং এ গিয়ে দেখে শ্বাশুড়ি খাবার খাচ্ছে। সুরাইয়া তখন বললো মা আমি রান্না করে দিচ্ছি আবার, বেশি ঝালের তরকারি খেতে হবে না। শ্বাশুড়ি তখন ভিলেনের মতো হাসতে হাসতে বলে তোমার কি মনে হয় আমি সত্যি বলেছি। ওয়াহেদের চোখে খারাপ করার জন্য এমন করেছি। তোমাকে এই বাসায় শান্তিতে থাকতে দিব না।
পাশের রুম থেকে সুরাইয়ার মেয়ে পূর্ণতার কান্নার আওয়াজ আসে। সুরাইয়া ছুটে পাশের রুমে পূর্ণতার কাছে চলে যায়। আর এখানে সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি চিৎকার করতে করতে হাসতে থাকে।
চলবে,,,,,