#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-৩
#লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা
৮.
“আমি রাজকে ডিভোর্স দিয়ে এসেছি মা!”
কথাটা শোনা মাত্রই রেহানা বেগম চমকিত দৃষ্টিতে তাকালেন অজান্তার দিকে।
“তুই এসব কী বলছিস অজান্তা? মাথা ঠিক আছে তোর?”
অজান্তা চোখ বন্ধ করে একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
“আমি ঠিক আছি মা। এবং ঠিক কথাই বলছি।”
অনু অজান্তার কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো।
“আপু কী হয়েছে? তোদের তিন বছরের পরিচয়ে কখনো মনে হয়নি জিজু তোকে ভালোবাসে না। তোকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিতো না। সেই মানুষটা তোকে কেন ডিভোর্স দিবে?”
“কারণ আমি মা হতে পারবো না তাই!”
অনু আর রেহানা বেগম বাকরূদ্ধ হয়ে অজান্তার দিকে তাকিয়ে আছে। অজান্তা নির্বাক, শূন্য দৃষ্টিতে এক ধ্যানে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই রেহানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো অজান্তা। রেহানা বেগম আলতো হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।
“দেখ মা আমাদের কারোরই নিয়তির উপরে হাত নেই। কার ভাগ্যে কী আছে সেটা আমরা চাইলেই বুঝতে পারি না। যা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। এখন এসব ভেবে নিজের জীবনটা আর নষ্ট করিস না। রাজের মতো কাপুরুষের সাথে তোর থাকতে হবে না। যে ছেলে তার বউকে শুধুমাত্র একটা বাচ্চার জন্য ছেড়ে দেয় সেই পুরুষ আর যাইহোক সুস্থ মস্তিষ্কের হতে পারে না। বেশ করেছিস ওকে ডিভোর্স দিয়েছিস। এখন একটু শান্ত হ তুই।”
“আর কাঁদিস না আপু প্লিজ। দেখ তোর কান্না দেখলে আমারো কান্না পায়।”
অনু অজান্তার চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দিয়ে উপরোক্ত কথাটা বললো। অজান্তা আর কিছু না বলেই উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। যাওয়ার আগে মা আর বোনকে উদ্দেশ্য করে বলে গেল,
“আমি একটু একা থাকতে চাই। তোমরা কিছুটা সময় আমাকে একা থাকতে দাও।”
অনু আর রেহানা বেগম একে-অপরের দিকে তাকিয়ে অজান্তার কথায় হ্যা বোধক মাথা নাড়লেন। এই সময় একটু একা থাকুক মেয়েটা। এমন পরিস্থিতিতে কারোরই কথা বলার ইচ্ছাশক্তি থাকে না। সবটা বুঝেই চুপ করে রইলেন রেহানা বেগম।
৯.
“অনু প্লিজ আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো।”
“জাস্ট শাট আপ রায়ান। আর কী বোঝাতে চাও তুমি আমাকে?”
“দেখো অনু ভাইয়া আর ভাবির মধ্যে এসব ঝামেলা কবে থেকে চলছিল সেটা আমি সত্যিই জানিনা। আমি তো লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাড়িতে তেমন সময় দিতাম না। কারণ সবার আগে আমার ক্যারিয়ার। আমি এখন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে যে তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। তাই আমি পুরো দমে লেখাপড়া করছি। তারমধ্যে কি করে যে ভাইয়া আর ভাবির ডিভোর্স হলো সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।”
অনু রায়ানের দিকে তেড়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তোমার ঐ কুলা’ঙ্গার ভাইয়ের জন্য আজ আমার বোনটা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আপুর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখমুখ ফুলে একাকার অবস্থা। চঞ্চল মেয়েটা হুট করেই গম্ভীর হয়ে গেছে। কারোর সাথে কথা বলে না। সব সময় চুপচাপ থাকে। নিজেকে একদম ঘরবন্দী করে রেখেছে আপু।”
“আমি বুঝতে পারছি সবটা। বোন হয়ে বোনের এমন অবস্থা কেউই মানতে পারে না। কিন্তু এখানে আমার কী দোষ অনু?”
“তুমি রাজের ভাই। এটাই তোমার দোষ।”
অনুর কথায় রায়ান বিষ্ময়কর চাহুনি নিয়ে ওর দিকে তাকালো।
“অনু!”
“শোনো রায়ান, তোমার সাথে আমার আপুর আর তোমার ভাইয়ের বিয়ের মাধ্যমে পরিচয়। সেখান থেকেই আজ আমরা রিলেশনে আছি। কিন্তু যাদের মাধ্যমে আমাদের পরিচয় সেই তাদের সম্পর্কটা আজ আর নেই। এমতাবস্থায় তোমার বউ হয়ে ঐ বাড়িতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি এই সম্পর্কটা আর রাখতে পারবো না। আমি আর কিচ্ছু বলতে চাই না। ভালো থেকো।”
কথাটা বলেই অনু চলে গেল ক্যাম্পাস থেকে। শেষের কথাটা বলার সময় অনুর গলা ধরে আসছিল। চোখে পানি টলমল করছিল। কিন্তু অনুর যে আর কিছু করার নেই। যেই বাড়িতে ওর বোনের সংসার টেকেনি। সেই বাড়িতে অনুর পক্ষে কোনোভাবেই বউ হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অন্যদিকে রায়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর যাওয়ার পানে। একটা সম্পর্ক গড়তে অনেক সময় লাগে। কিন্তু সেই সম্পর্ক ভাঙতে এক মিনিট ও লাগে না। ভালোবাসার সম্পর্কগুলো কী আজকাল এতটা ঠুনকো! পরিবারের জন্য এমন কতশত সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে। রায়ানের মনে অনুকে নিয়ে এক পাহাড় সমান অভিমান জমেছে। কিন্তু সে বুঝতেও পারলো না অপরপক্ষের মানুষটা কতটা যন্ত্রণা নিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে চলে গেল। একটা সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় অনেক বড়ো কিছু ত্যাগ করতে হয় উভয়পক্ষকে। কিন্তু একটা ছেলে কখনোই একটা মেয়ের বাস্তবতা বুঝতে চায় না। যেন ভাবে সেই মেয়েটা বেঈমান। অথচ মেয়েটা হাজারবার চেয়েও সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে পারে না। পরিবারের জের ধরে প্রতিনিয়ত এমন অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাইলেও সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আর সব ঠিক থাকলেও পরিস্থিতি না বুঝে একজন আরেজনকে বেঈমান উপাধিতে ভূষিত করে। হায়রে ভালোবাসা!
১০.
রাত প্রায় তিনটার দিকে নন্দিনী সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বারান্দার আলো জ্বলে উঠলো। নন্দিনী চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। কারণ সামনে তানভীর দাঁড়িয়ে আছে। তানভীর বরাবরের মতোই নন্দিনীকে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
নন্দিনী আমতা আমতা করতে করতে বললো,
“ঐ একটু বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”
“এতো রাত অবধি কোন ভদ্র পরিবারের মেয়ে বা বউ বাইরে থাকে?”
“আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। আর এমন হবে না।”
“প্রতিবার তোমার এমন আর হবে না আর হবে না শুনতে শুনতে ক্লান্ত আমি নন্দিনী।”
তানভীরের চিৎকারে নন্দিনী কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত চোখে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি এভাবে চিৎকার কেন করছো?”
নন্দিনীর এমন কথা শুনে তানভীর আগের বারের চেয়ে দ্বিগুণ চিৎকার করে বললো,
“তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমি সব সময় সবার কাছে ছোটো হয়ে যাচ্ছি। আমার জুনিয়ররা পর্যন্ত তোমার এমন বেপরোয়াভাবে চলাফেরার জন্য আমাকে খোঁচায়। মজা নেয় আমাকে দেখে। আমার আড়ালে সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তোমার জন্য আর কত হাসির পাত্র হতে হবে আমাকে? অনেক হয়েছে। আর আমি তোমার এসব বেহায়াপনা সহ্য করবো না। খুব শীঘ্রই এর একটা ব্যবস্থা করবো আমি।”
কথাটা বলেই হনহন করে দ্রুত পায়ে তানভীর ভেতরে চলে গেল। নন্দিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তানভীরের যাওয়ার পানে। বিয়ের এক বছর হতে চললো। এর মধ্যে কখনোই তানভীরকে এমন রাগান্বিত হতে দেখেনি নন্দিনী। সব সময় শান্ত হয়ে থাকা ছেলেটার এমন আমূল-পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না নন্দিনী। কী এমন করবে তানভীর? এসব ভেবেই ভয়ে ভয়ে নন্দিনী ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে তার। আজ সারাদিন গান, নাচ, পার্টি করে খুব ক্লান্ত লাগছে। তাই তানভীরের বলা কথাগুলো তেমন একটা না ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো নন্দিনী।
১১.
রাত গভীর। সবাই পৃথিবীর বুকে নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কিন্তু রাজের চোখে ঘুম নেই। একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে সে। চারিদিকে সিগারেটের প্যাকেট আর ছাই ছড়িয়ে আছে। মাথার চুলগুলো অগোছালো। শার্টের বোতামগুলো এলোমেলো করে লাগানো। গলার টাই ঝুলছে। এসবে কোনো ভাবান্তর নেই তার। সে তার মতো করে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে থেকে সিগারেট ফুঁকছে। দুইদিন না ঘুমানোর ফলে চোখগুলো লাল লাল হয়ে আছে। এমন অবস্থায় কেউ রাজকে দেখলে সে নির্ঘাত ভয় পাবে নয়তো রাজকে পাগল ভাব্বে। নিজের জীবনের সমীকরণ মেলাতে ব্যর্থ হওয়ায় মাথার চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো সে।
অজান্তা, রাজ, রিংকি, তানভীর, নন্দিনী, রায়ান, অনু এই সাত জনের জীবনে ঠিক কী হতে চলেছে আগামীতে তা কেউ জানে না। সবাই মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। সবাই ভালোবাসার কাছে হেরে গেছে। কেউ চেয়েও পারছে না ভালোবাসার মানুষটার কাছে গিয়ে তাকে ভালোবাসি বলতে। আবার কেউ ভালোবাসার নাম করে মিথ্যা খেলা খেলছে। ভালোবাসা নামক এই ভয়ংকর খেলার সমাপ্তি কেমন হবে? আদৌ সেই সমাপ্তি সুখের হবে তো? নাকি দুঃখের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে সবাই!
চলবে..