মাতৃত্বের স্বাদ পর্ব – ১১

0
1705

#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-১১
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা

৩৯.

রাতের অন্ধকারে নির্জন জায়গায় এক গুপ্ত কুঠুরির মধ্যে কোনো একজন মেয়ে রক্তের খেলায় মেতে উঠেছে। চারিদিকে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেয়ালের সাথে টাঙ্গিয়ে রাখা আছে অসংখ্য ঝুলন্ত কঙ্কাল। জানালা খোলা থাকায় দমকা হাওয়া ভেতরে আসার ফলে কঙ্কালগুলো দুলছে। রক্তের ভ্যাপসা গন্ধে যে কারোর গা গুলাবে নিশ্চিত। এক কোণে হসপিটালে অপারেশন করার সময় যা যা লাগে সেই সকল যন্ত্রপাতি রাখা আছে। মাঝখানে একটা স্ট্রেচারে একজন নগ্ন পুরুষ ঘুমিয়ে আছে চিরতরে। ছেলেটাকে দেখে মেয়েটা উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।

“মিস্টার রাব্বি! আজ সকালেও জীবিত ছিলে। কিন্তু এখন তুমি মৃত। খুব শান্তি লাগছে তোমাকে এভাবে দেখে। নিজের হাতে মানুষ মা*রার মাঝে আলাদা শান্তি আছে জানো তো। তোমার মতো ছেলেদের একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যু।”

লা*শের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চোখের পানি মুছে একটা ডায়েরিতে আজকের দিন, তারিখ, সময় এবং ছেলেটার সমস্ত ডিটেইলস লিখে রাখলো মেয়েটা। তারপর ছেলেটার শরীরে এসিড ঢেলে দিলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ছেলেটার শরীর থেকে মাংস গলে গলে পড়তে লাগলো। কি সেই বিভৎস দৃশ্য। তবুও মেয়েটার চেহারার কোনো পরিবর্তন হলো না। চোখে ক্রোধের সাথে সাথে পানি টলমল করছে। অন্যদিকে ঠোঁট জুড়ে রয়েছে বিস্তৃত রহস্যময় হাসি। এই হাসির মানে কেউ জানে না। শুধু দুজন ব্যক্তি জানে। কারা সেই দুজন ব্যক্তি? তা খুব শীঘ্রই জানবে সবাই। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা! অপেক্ষা করা কঠিন হলেও এক্ষেত্রে অপেক্ষা করা আরো বেশি কঠিন। কারণ,

“একটি কথাকে পুঁজি করে সবাই সবার সাথে খুব বাজে খেলা খেলছে। এই খেলার শেষ কোথায়? কী হবে শেষ পরিণতি?”

৪০.

রায়ান নিজের অফিসে বসে আছে। চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট।

“আসবো?”

দরজায় দাঁড়িয়ে তানভীরকে কথাটা বলতে দেখে রায়ান বললো,

“আরে তানভীর তুমি? এসো এসো ভেতরে এসো।”

“হ্যা আমি। রাজের কেসের বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।”

রায়ান একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তানভীরকে বসতে বললো।

“বলো কী বলতে চাও?”

“রায়ান, তোমার সাহস এবং ধৈর্য আছে বলতে হবে। নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে লড়তে খুব কম মানুষই পারে।”

“তুমিও যেমন আইনের লোক। আমিও তেমনি একজন আইনের লোক। নিজের পেশায় আসার সময় আমাদেরকে শপথ গ্রহণ করতে হয় যেন কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ না করি আমরা। সেই শপথ ভাঙ্গা আমার বা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। রাজ আমার ভাই। ওকে আমি অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আজ সে একজন অপরাধী। আদালতে যখন সে অপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়ায়, ঠিক সেই সময় আমি গায়ে উকিলের পোশাক জড়িয়ে আদালতে আসি। তখন কে আপন আর কে পর সেটা দেখা আমাদের জন্য অন্যায়। আজ রাজ যদি আমার ভাই না হতো তাহলে কত সহজে তার বিরুদ্ধে লড়তে পারতাম আমি। কিন্তু যখন সে আমার ভাই তখন আদালতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমারো কন্ঠস্বর কাঁপে। কিছুই করার নেই। আইন সবার জন্য সমান। পরের ক্ষেত্রে যেমন আমাদের মধ্যে এতটা সংকোচবোধ হয় না, তখন আপন কারোর বিরুদ্ধে লড়ার সময়েও আমাদের পেছন ফিরে তাকিয়ে নিজের কাজ থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়।”

রায়ানের কথা শুনে তানভীর চুপ করে রইলো। রায়ান ঠিকই বলেছে। আইনের লোকদের কে আপন আর কে পর এসব ভাবতে নেই। এসব ভাবলে যে সুষ্ঠু বিচার হবে না।

“রাজ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। নিজের থেকেও ওকে বেশি ভালোবাসি। হ্যা, সে আমার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। তবে আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু আজ আর আমার হাতে কিছু নেই। রাজের এতটা অধঃপতন আমি সত্যি মানতে পারছি না। আচ্ছা রাজের স্ত্রী অজান্তা কোথায় আছে এখন?”

“অজান্তা ভাবি আর ভাইয়ার ডিভোর্স হয়েছে কয়েক মাস আগে। এই কেস শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস আগেই ভাইয়া আর ভাবির ডিভোর্স হয়েছে।”

“রাজ আর অজান্তার না প্রেমের বিয়ে? তারপরেও এত কিছু কেন হলো এটাই বুঝে উঠতে পারছি না আমি।”

“ভাবি কখনো মা হতে পারবে না। এই জন্যই ওদের মধ্যে ঝামেলা চলছিল। এক পর্যায়ে ভাইয়া ভাবিকে বলে হয় ওকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে অনুমতি দিবে। নয়তো ডিভোর্স দিবে। ভাবি ডিভোর্সকে বেছে নেয়। কারণ কোনো মেয়েই নিজের স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে পারবে না।”

“রিংকি তো প্রেগন্যান্ট ছিল। তাহলে কেন রাজ রিংকিকে মারলো?”

“এটাই তো ধোঁয়াশা। ভাইয়া যদি বাচ্চার জন্যই আরেকজনকে নিজের জীবনে নিয়ে আসে তবে তাকে কেন মারবে?”

“এই কেন এর উত্তর আমাদের কাছে নেই। এর উত্তর জানাটা খুব জরুরি আমাদের জন্য। একমাত্র তাহলেই এই কেসের রায় দেওয়া সম্ভব।”

হঠাৎই রায়ানের কন্ঠ নিচু হয়ে গেল। রায়ান অসহায় চোখে তানভীরের দিকে তাকালো।

“তানভীর ভাইয়ার কী ফাঁসি হবে?”

রায়ানের এমন কথায় তানভীর কি বলবে বুঝতে পারলো না।

“কী হলো? বলো না ভাইয়ার কী ফাঁসি হবে?”

“দেখো রায়ান এই কেস প্রতিনিয়ত যেদিকে আগাচ্ছে তাতে ফাঁসি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। ফাঁসি না হলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো হবেই। কিন্তু ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”

তানভীরের কথা শুনে রায়ানের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। হাজার হোক, রাজ তার ভাই। নিজের চোখে ভাইয়ের শাস্তি দেখা কম কঠিন নয়। আজ আফসোস হয়। ইশশশ, আগে যদি ভাইয়ের এই অধঃপতন সম্মন্ধে জানতো তাহলে হয়তো আজ এই দিনটা দেখতে হতো না কারোর। আজ তানভীর, রায়ানসহ সবাই অসহায়। চাইলেও রাজকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। রাজ যা করেছে তাতে তার শাস্তি পাওয়া জরুরি। আর সব মানা গেলেও একজন গর্ভবতী নারীর জীবন নেওয়া কোনো মানুষের কাজ হতে পারে না। এমন মানুষ নামক অমানুষদের শাস্তি প্রাপ্য।

“এরপর কী করবে?”

তানভীরের কথায় রায়ানের ধ্যান ভাঙ্গলো।

“তুমি বলো কী করতে চাচ্ছো?”

“রিংকির পরিবারে কে কে আছে এটা আগে জানতে হবে আমাদের। কিন্তু রিংকি তো ভাড়া বাসায় থাকতো। এখানে ওর আত্মীয় স্বজনও তেমন নেই। তাহলে আমরা কীভাবে জানবো ওর পরিবারে কে কে আছে?”

“এই রিংকি কী কাজ করতো?”

“রিংকি একজন বার ড্যান্সার।”

“কিহ?”

“হ্যা রায়ান।”

“আমার ভাই শেষমেশ একজন বার ড্যান্সারের সাথে? ছিঃ ভাবতেই লজ্জা লাগছে আমার।”

“রিংকি নিজেও ভালো মেয়ে নয়। রাজ ছাড়াও আরো অনেক ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল। আর শুধু রাজ নয়। আরো অনেকের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে রিংকি।”

“তাহলে কী রিংকির গর্ভের সন্তান?”

“প্রথমে আমিও এটাই ভেবে ছিলাম। হয়তো রিংকির পেটের সন্তান রাজের নয়। কিন্তু রাজ নিজেই স্বীকার করেছে এটা ওরই সন্তান ছিল।”

“ড্যাম ইট। আমার ভাই নিজের দোষেই আজ কারাবন্দী। জানিনা কি কারণে সে এমন জঘন্য কাজগুলো করেছে।”

“আমিও ভেবে পাই না রাজ এমনটা কীভাবে করতে পারলো? অজান্তা আর রাজের প্রেম কাহিনী আমাদের ভার্সিটির মোটামুটি সবাই জানতো। সবাই রীতিমতো হিংসা করতো ‘রাজান্তা’ জুটিকে। ওদের দু’জনের ভালোবাসা সবার কাছেই স্মরণীয়। সেই জুটি আজ আর নেই। কী থেকে কী হয়ে গেল এসব?”

“আমিও জানিনা তানভীর। ভাইয়া কেন এমন করলো? এর উত্তর আমার নিজের কাছেও নেই।”

“অজান্তা কী জানে রাজের এসব বিষয়ে?”

“যেভাবে টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, ফেসবুক সবকিছুর হেড লাইনে ভাইয়ার এই নিউজ বেরিয়েছে তাতে তো কারোরই অজানা থাকার কথা না। ভাবি ও হয়তো এতদিনে সবকিছু জেনে গিয়েছে।”

“যোগাযোগ হয় তোমাদের? কেমন আছে অজান্তা?”

“যোগাযোগ করার সাহস পাইনি। কোন মুখে কথা বলবো বলো? লজ্জায় তার সামনে দাঁড়াতে পারি না আমি। তবে শুনলাম ভাবি ডিএমসিতে চান্স পেয়েছে। এই কয়েক মাস নাকি সে খুব কষ্ট করেছে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য। দৃঢ় মনোবল ছিল বলেই ভাবি এতকিছুর পরেও অসম্ভবকে জয় করেছে। আসলে যখন মানুষ খুব বড়ো আঘাত পায় তখন একটা ইচ্ছাকে আঁকড়ে বাঁচতে শেখে। ভাবিরও ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়ার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। তাই হয়তো এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সে।”

“যাক তবুও ভালো। এতকিছুর পরেও নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছে এটাই অনেক।”

“আচ্ছা এরপর কী করতে চাচ্ছো?”

“অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পেরেছি রিংকি সিলেটের মেয়ে। এখন আমাদের পরবর্তী কাজ হচ্ছে সিলেটে যাওয়া।”

“তোমাদের টিমের সাথে আমিও যেতে চাই।”

“আমি কাউকে নিয়ে যাবো না। একাই যাবো। কিন্তু এক্ষেত্রে তুমি যেতে চাইলে যেতে পারো। তবে গোপনে। আমি কাউকে জানাতে চাচ্ছি না। এই কেসে ঘাপলা আছে। আমরা ছাড়া কোনো তৃতীয় পক্ষ এই কেসের সাথে জড়িত।”

“ঠিক আছে। তাহলে আমরা আগামীকাল রাতের বাসে রওনা দিবো সিলেটের উদ্দেশ্যে।”

“আচ্ছা। তুমি প্যাকিং করে নাও। আমি আজ আসি। কাল দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”

“ঠিক আছে যাও।”

এরপর তানভীর চলে গেল। রায়ানও অফিস থেকে বের হয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা দিলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে