মাতৃত্বের স্বাদ পর্ব – ১০

0
1458

#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-১০
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা

৩৫.

দেখতে দেখতে বেশ অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে। এই কয়েক মাসে সবার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে। সবাই সবার থেকে আলাদা। কিন্তু কোথাও গিয়ে সবাই একই স্থানে এসে থেমেছে।

নন্দিনীর প্রেগন্যান্সির নয় মাস চলছে। উঁচু পেট নিয়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হয় নন্দিনীর। এত বড়ো পেট দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে সে। ছোট থেকে সবার আদরে বড়ো হওয়ায় তেমন একটা কষ্ট সহ্য করতে হয়নি নন্দিনীর। কিন্তু ইদানিং তার খাওয়াদাওয়ার উপর থেকে রুচি উঠে গেছে। তবুও সবাই জোর করে খাওয়ায়। এখন না খেলে সন্তানের সাস্থ্য ভালো হবে না। তাই কষ্ট হলেও খেতেই হবে। আর আটদিন পর নন্দিনীর ডেলিভারির ডেট।

তানভীর অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। এমন সময় নন্দিনীর কান্নার আওয়াজে ওর সামনে গিয়ে বসলো তানভীর। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“কী হয়েছে নন্দু? তুমি কাঁদছো কেন?”

তানভীরকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে নন্দিনী তানভীরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

“আরে কী হয়েছে বলবে তো? তুমি না বললে আমি কীভাবে বুঝবো যে কেন কাঁদছো তুমি?”

নন্দিনী থেমে থেমে বললো,

“আমার খুব ভয় হচ্ছে তানভীর। আমার কিছু হবে না তো? বেবি হওয়ার সময় যদি আমি মারা যাই?”

তানভীর নন্দিনীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

“ধুর বোকা মেয়ে। কিছু হবে না তোমার। আমাদের বেবি আর তুমি একদম সুস্থ থাকবে ইনশাআল্লাহ।”

“তবুও খুব ভয় হচ্ছে আমার।”

“ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো তোমার পাশে।”

“তুমি আছো বলেই ভরসা পাই আমি তানভীর।”

“সব সময় ছায়া হয়ে তোমার পাশে থাকবো আমি। চিন্তা করো না তুমি।”

তানভীরের কথায় নন্দিনী হেসে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। তানভীর মুচকি হেসে নন্দিনীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

“এখন আমি আসি। অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”

“আচ্ছা সাবধানে যেও। আর আমার কিছু হলে সাথে সাথে চলে এসো। ভয় হয় আমার। তুমি থাকলে একটু ভরসা পাই আমি।”

“হ্যা আসবো। তুমি একদম চিন্তা করো না। কিছুই হবে না তোমার।”

কথাটা বলেই তানভীর অফিসের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাইরে চলে গেল। নন্দিনী মুচকি হেসে নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। এই বাচ্চার জন্য সে এত কষ্ট করছে। এখন উপরওয়ালার কাছে শুধু একটাই চাওয়া।

“বাচ্চাটা যেন সুস্থভাবে এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারে।”

৩৬.

তানভীর থানায় এসে সর্বপ্রথম রাজের কেস ফাইল নিয়ে বসলো। রাজকে এখনো জেলে রাখা হয়েছে। রাজের পরিবার অনেক চেষ্টা করেও রাজের জামিন করাতে পারেনি। একজন খু*নের আসামীকে এত সহজে ছাড়ানো যায় না। আদালতে রাজের বিরুদ্ধে তানভীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানায়। আদালত কখনো কারোর মুখের কথায় বিশ্বাস করে না। সে আইনের লোক হলেও না। তাই তানভীর নিজের কাছে থাকা সমস্ত প্রমাণ আদালতে পেশ করে। তখন এটা প্রমাণিত হয় যে, রাজের সাথে রিংকির বহুবার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। এবং রিংকি সত্যিই রাজের অনাগত সন্তানের মা হতে চলেছিল। রাজ এটা অস্বীকার না করলেও রিংকিকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। এক পর্যায়ে রিংকির জোরাজুরিতে রাজ হুমকি দেয়,

“বেশি বাড়াবাড়ি করলে আগামীকাল আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না।”

এতটুকুতে স্পষ্ট যে রাজ প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে হলেও এই খু*নের সাথে জড়িত। এখন তানভীর আরো প্রমাণ খুঁজছে রাজের সঠিক শাস্তির জন্য। কারণ এখনো এটা প্রমাণিত হয়নি যে রাজই রিংকিকে মেরেছে।

তানভীর ফাইল চেক করছিল। তখনই একজন হাবিলদার এসে বললো,

“স্যার আজকে রাজ সাহেবকে দশটার সময় কোর্টে নিয়ে যেতে হবে।”

তানভীর একবার নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,

“ওহ্ হ্যা দশটা বাজতে চললো। আমাদের এখনই বের হতে হবে। রাজকে জিপে বসাও। আমি আসছি।”

“ইয়েস স্যার।”

কথাটা বলেই হাবিলদার চলে গেল। তানভীর ফাইলের কাগজপত্র গুছিয়ে রাজকে নিয়ে বের হয়ে গেল কোর্টের উদ্দেশ্যে।

৩৭.

রাজ অনেক ভেঙ্গে পড়েছে। না, তার জেলে থাকা বা জামিন না হওয়ার জন্য নয়। নিজের বিপরীতে রায়ানকে কোর্টে দেখে রাজ চরম পরিমাণে চমকে যায়। নিজের ভাইকে নিজের বিপরীতে দেখে কোনো মানুষই এটা সহ্য করতে পারবে না। রাজ এবং রায়ানের মা মিসেস রাফিয়া বেগমও চমকে গিয়েছেন রায়ানের এহেন কাজে। রায়ানকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে সে উত্তরে বলে,

“রাজ আমার ভাই বাড়িতে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সে একজন অপরাধী এবং আমি একজন আইনের লোক। তাই এই বিষয়ে আমি কারোর কোনো কথা শুনবো না।”

এরপর আর কারোরই কিছু বলার থাকে না। দুই ভাইয়ের এমন দন্ড দেখে মিসেস রাফিয়া বেগম দুশ্চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ভেবেছিলেন এবার হয়তো রায়ান সরে দাঁড়াবে। কিন্তু না, রায়ান সরে দাঁড়ায়নি। তার কথা একটাই,

“অন্যায়কারীর সাথে কোনো আপোষ নয়। হোক সে অচেনা অথবা নিজের আপন কেউ। অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। এখন অপরাধী আইনের লোকের পরিবারের কেউ হলেও শাস্তি তাকে পেতেই হবে। আইন সবার জন্য সমান!”

রাজ নিজের ভাইয়ের এমন কঠিন রুপের সাথে পরিচিত নয়। ছোটবেলা থেকে রাজ আর রায়ান একে-অপরকে ছাড়া থাকতে পারতো না। রায়ান অভিমান করলে রাজ খুব সহজে ভাঙ্গাতে পারতো না। কারণ রাগ আর অভিমানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। রাগ করলে সহজে ভাঙ্গানো যায়। কিন্তু যারা অভিমান করে তাদের অভিমান ভাঙ্গানো বড্ড কঠিন। এরপরেও রাজ কোনো বিপদে পড়লে সবার আগে রায়ান বাঁচাতে আসতো। একেই হয়তো বলে রক্তের টান। কিন্তু সেই ভাই-ই যে রাজের বিরুদ্ধে ওকালতি করবে সেটা সবার কল্পনার বাহিরে ছিল।

৩৮.

ঢাকা মেডিকেল কলেজ। যারা মেডিকেলে পড়তে চায় সেই সকল শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের ঠিকানা। এখানে চান্স পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানে এসে হেরে যায়। সেই সকল শিক্ষার্থীর মতো অজান্তা ও ভয়ে ছিল তার চান্স হবে কিনা। তার ভয় এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলে সে জয় করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি আসন। এই আসন পাওয়া সহজ ছিল না। টানা দুই মাস নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সব সময় বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিল অজান্তা। লক্ষ্য একটাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ! নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। তবুও অজান্তা থেমে থাকেনি। চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এবং আজ সে সফল! পরিক্ষা দেওয়ার পর রেজাল্টের আগ পর্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছিল অজান্তা। কিন্তু যখন রেজাল্ট প্রকাশিত হয় সেখানে নিজের নাম দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে অজান্তা। অজান্তার মুখে এতদিন পর হাসি দেখে অনুসহ অজান্তার বাবা-মা এবং বন্ধরাও খুশি হয়।

অজান্তা ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তখনই অজান্তার মা দরজায় কড়া নাড়লেন,

“আসবো?”

“আরে মা, আসো তো। পারমিশন নেওয়ার কী আছে?”

“মেয়ে আমার বড়ো হয়েছে। হুটহাট ঘরে আসা শোভা পায় না।”

“কি যে বলো না তুমি। আমার মায়ের আমার ঘরে আসতে কোনো পারমিশনের দরকার নেই বুঝলে?”

“আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। এখন বস তো একটু। তোকে খাওয়ায় দেই আমি।”

“মা এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন খেতে গেলে আরো দেরি হবে।”

“কিছু হবে না। তুই বস। আমি চটজলদি খাওয়ায় দিচ্ছি তোকে।”

“কিন্তু মা..”

“কোনো কিন্তু নয়। চুপচাপ বস বলছি।”

অগত্যা! মায়ের কথায় বিছানায় বসে চুপচাপ খেয়ে নিলো অজান্তা। খাওয়ার পর তাড়াতাড়ি নিজের ব্যাগ নিয়ে দৌড় লাগালো ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে।

ক্যাম্পাসে এসেই নতুন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল অজান্তার। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই আট/দশ জনের সাথে ভালোই শখ্যতা তৈরি হয়েছে তার। অজান্তা ছোট থেকেই মিশুকে স্বভাবের। খুব দ্রুত সবার সাথে মিশতে পারে সে। এখানে এসেও নিজের এই গুণের জন্য ইতোমধ্যে একটা বন্ধু মহল বানিয়ে ফেলেছে সে। বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে লাইব্রেরিতে চলে গেল অজান্তা। কিছু নোট সংগ্রহ করতে হবে। মূলত আজ এই নোট নেওয়ার জন্যই অজান্তা ক্যাম্পাসে এসেছে। নোটগুলো নিয়ে বাড়িতে আসার আগ মুহূর্তে সবাই মিলে জেদ ধরলো ঘুরতে যাবে। সামনেই একটা কফিশপ আছে। ওখানেই যাবে সবাই। অজান্তাকেও যেতে হবে। অজান্তা যাবে না বললেও এক প্রকার জোর করেই সবাই মিলে অজান্তাকে নিয়ে চলে গেল সেই কফিশপে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে