#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-১
#লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা
১.
“তোমার কাছে এখন দুইটা অপশন আছে। প্রথমত, আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে কোনো প্রকার বাঁধা দিতে পারবে না। এবং আমার দ্বিতীয় স্ত্রীকে সাদরে গ্রহণ করবে। দ্বিতীয়ত, প্রথম শর্তে রাজি না হলে ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে।”
কথাটা বলেই রাজ অজান্তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অজান্তা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সোফায়। পাশেই ডিভোর্স পেপার পড়ে আছে। আর অজান্তাকে ঘিরে বসে আছে অজান্তার শশুড়, শাশুড়ি, ননদ আর নন্দাই। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অজান্তার উত্তরের আশায়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে অজান্তা ডিভোর্স পেপারে সাইন করে উঠে দাঁড়ালো।
রাজ অজান্তার এমন কাজে দু পা পিছিয়ে গেল। অজান্তা সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
“রাজ, তোমার কী মনে হয়? অজান্তা এতটাই ফেলনা? শুধুমাত্র একটা বাচ্চা জন্ম দিতে পারবো না বলে আমাকে সতিনের ঘর করতে হবে? এই সংসার নিজের মতো করে সাজানোর পর চোখের সামনে অন্য আরেকজন এসে রাজত্ব করবে, আর এটা আমাকে নিয়তি ভেবে মেনে নিতে হবে? সব কিছু এত সহজ? আমি এসবকিছু হয়তো মেনে নিতাম যদি আমাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হতো। কিন্তু আমাদের তো ভালোবাসার বিয়ে। আমরা দু’জন একে-অপরকে ভালোবেসে হাত আঁকড়ে ধরেছিলাম সারাজীবন একসাথে বাঁচার জন্য। তোমার পরিবারও আমাকে পছন্দ করেই এই বাড়ির বড়ো বউয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে আজ কেন তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাও? মনে পড়ে তোমার? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে পৃথিবী উল্টে গেলেও তুমি আমার হাত ছাড়বে না। অথচ আজ সেই তুমিই তিন বছর আগের এই কথা ভুলে গেলে। তোমার জন্য আমি নিজের লেখাপড়া ছেড়েছিলাম। তোমার জন্য নিজের প্যাশন ফটোগ্রাফি করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। যার জন্য এত স্যাক্রিফাইস করলাম সেই মানুষটা আজ আমার থেকে ডিভোর্স চায়। কারণ? কারণ আমি তাকে বাবা ডাক শোনাতে পারবো না। এই একটা কারণে মাত্র তিন বছরের মাথায় সব ভালোবাসা শেষ! আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব মেনে নিলাম। তোমাকে ডিভোর্স দিলাম। তুমি যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখী হও তাহলে এখানে আমি আর সবার মতো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না। আজ এই বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি। আর কথা দিচ্ছি, কখনো তোমার সামনে নিজ ইচ্ছায় আসবো না। ভালো থেকো তোমরা সবাই। আর কখনো যদি কোনো ভুল করি তাহলে মাফ করে দিয়ো।”
কথাটা বলেই অজান্তা চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে এক হাতে ফোন আর অন্য হাতে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেল ওর স্বপ্নের নীড় থেকে! লাগেজ আগে থেকেই প্যাকিং করে রেখেছিল অজান্তা। কারণ ওও জানতো আজই এই বাড়িতে ওর শেষ দিন। গতকাল রাতেই অজান্তা আলমারির ড্রয়ারে ডিভোর্স পেপার দেখেছিল। প্রথমে একটা ধাক্কা খেলেও সারারাত ভেবে অজান্তা সিদ্ধান্ত নেয়, এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবে।
অজান্তা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই রাজ ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। রাজ নিজেকে সামলাতে না পেরে টি টেবিল থেকে একটা শো পিস নিয়ে ছুঁড়ে মারলো দেয়ালে। বিকট আওয়াজে সবাই কেঁপে উঠলো। তখনই রাজের ছোট ভাই রায়ান এসে দাঁড়ালো ওর সামনে।
“এখন এসব করে কী হবে ভাইয়া? তুই নিজের হাতেই সবটা শেষ করেছিস। তাই এখন এমন পাগলামি করে লাভ নেই। একটা বাচ্চার জন্য তুই ভাবিকে ছেড়েছিস! কথাটা কতটা কষ্টের সেটা তুই নিজেই একবার ভাব। অজান্তা ভাবি আমাদের এই পরিবারে আসার ফলে আমরা কতটা আনন্দে ছিলাম সেটা আমরা সবাই জানি। আর সেই আনন্দ তুই আমাদের জীবন থেকে কেড়ে নিলি। ছিঃ ভাইয়া ছিঃ!”
রায়ান রাগে হনহন করে নিজের ঘরে গিয়ে জোরে দরজা লাগিয়ে দিলো। এতক্ষণে মিসেস শাহানা মুখ খুললেন।
“রাজ আমরা সবাই চাই এই পরিবারে একটা সন্তান আসুক। সত্যি বলতে আমি নিজেও অজান্তাকে এর জন্য অনেক কথা শুনিয়েছি। কিন্তু আমি ভাবিনি ওও আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে। আমরা সবাই ভেবেছিলাম অজান্তা তোকে ডিভোর্স না দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে অনুমতি দিবে। কারণ ওও তোকে ভীষণ ভালোবাসে।”
“ভালোবাসলেই কী সব মেনে নেওয়া যায় মা? আজ আমি যদি আপনার মেয়েকে ছেড়ে চলে যেতাম সে মা হতে পারবে না বলে। তখনো কী আপনি এই একই কথা বলতেন?”
মেয়ে জামাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে চুপ করে গেলেন মিসেস শাহানা। সবার মুখেই বিষন্নতার ছাপ। রাজের বাবা মিস্টার আশরাফ সাহেব কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ হয়ে উঠে গেলেন। একে একে সবাই উঠে গেল বসার ঘর থেকে। রাজ একা একা মাথায় হাত দিয়ে নিরব হয়ে বসে আছে। রাজের প্ল্যান যে এভাবে উল্টে দিবে অজান্তা এটা রাজ কখনোই ভাবেনি।
২.
“বউ মা প্রতিদিন তোমার এমন বাইরে যাওয়া মোটেও শোভা পায় না। আমরা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। সেখানে তুমি এমন বেপরোয়াভাবে জীবনযাপন করতে পারো না। মনে রেখো তুমি আহমেদ পরিবারের ছোট বউ।”
শাশুড়ী মায়ের কথায় নন্দিনী বিরক্তি প্রকাশ করলো।
“মা প্লিজ থামুন এইবার। আমি ছোট থেকেই এমনভাবে বড়ো হয়েছি। তাই আমাকে এসব বলে লাভ নেই।”
“মানে কী? তুমি প্রতিদিন সকালে বের হও। আর বাড়িতে আসো রাত বারোটা/একটার দিকে। পাড়া-প্রতিবেশিরা পর্যন্ত এসব নিয়ে কানাঘুষা করে। বড়ো বউমাকে নিয়ে তো কখনো কেউ একটা বাজে কথা বলার সুযোগ পায়নি। তবে তোমার জন্য কেন আমাদের পরিবারের সবার ফেস লস হবে? তোমাকে তো আমাদের মানসম্মান নষ্ট করার জন্য আমি আমার ছেলের বউ করে আনিনি।”
“আপনি একজন মডার্ন মেয়ে চেয়েছিলেন না নিজের ছেলের জন্য? তাহলে এখন কেন রাগ করছেন? আমি এমন আগেও ছিলাম, এখনো আছি আর ভবিষ্যতেও এমনই থাকবো।”
কথাটা বলেই নন্দিনী প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে গেল তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।
মিসেস আহমেদ নন্দিনীর এমন ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে বসে পড়লেন পাশে রাখা একটা চেয়ারে। দিন দিন এই মেয়ের জন্য সমাজে তাদের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আগে যদি জানতো নন্দিনী এতটা অভার স্মার্ট একটা মেয়ে তাহলে তিনি কখনোই তার ছোটো ছেলে তানভীরের সাথে নন্দিনীর বিয়ে দিতেন না। কথাগুলো নিজের মনে আওরাতে আওরাতেই বসে রইলেন বারান্দায়।
৩.
কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলতেই সামনে থাকা ব্যক্তিকে দেখে জড়িয়ে ধরলো অনু। বেশ কিছুক্ষণ পর অনু তাকে ছেড়ে দিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
“আপু তুই এখন এখানে? তুই আজকে আসবি সেটা আগে বলবি না আমাকে? তাহলে তো তোর জন্য এত্তগুলো রান্না করতাম আমি নিজের হাতে। কতদিন পর তোকে দেখছি। আমার যে কী খুশি লাগছে তোকে দেখে সেটা বলে বোঝাতে পারবো না।”
অনুর কথা শুনে অজান্তা মলিন হেসে ভেতরে ঢুকে বললো,
“বলে আসিনি তো কী হয়েছে? এখন থেকে এমনিতেও আমি এখানেই থাকবো। প্রতিদিন তোর ইচ্ছা মতো রান্না করে খাওয়াবি আমায় তাহলেই হবে।”
“কী হয়েছে আপু? তোকে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। জিজুর সাথে কী কিছু হয়েছে? আর জিজু কোথায়? তুই তো জিজুকে ছাড়া কখনো আসিস না।”
“সে আর কখনোই আসবে না অনু।”
বড়ো বোনের এমন রাগ মিশ্রিত কথায় অনু কিছুটা ভরকে গেল।
“এই আপু বল না কী হয়েছে?”
“বাইরে আমার লাগেজ আছে। ওটা নিয়ে আয়। আমি ঘরে যাচ্ছি। এখন দয়া করে আর কোনো প্রশ্ন করিস না।”
অজান্তা নিজের ঘরের সামনে গিয়ে কথাগুলো বললো অনুকে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের উপরে ফোন রেখে দিলো। মাথাটা অসম্ভব ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে এখনই ফেটে যাবে। এখন শাওয়ার না নিলে একটুও শান্তি লাগবে না। কথাটা ভেবেই নিজের আলমারি থেকে একটা থ্রি পিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল অজান্তা।
এদিকে বোনের এমন ব্যবহারে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে আছে অনু। বোনের কী এমন হয়েছে যার জন্য এমন এলোমেলো লাগছে তাকে তা নিয়ে গবেষণা করতে করতেই বাইরে থেকে লাগেজ এনে অজান্তার ঘরে রেখে মাকে কল দিলো অনু। আজকে অনুর মা কিছু কেনাকাটা করার জন্য বাইরে গিয়েছে। আর অনুর বাবা তো বিদেশে থাকে। তাই অনু বাড়িতে একাই ছিল। বড়ো মেয়ের আসার খবর পেলে মিসেস রেহেনা রাহমান অনেক খুশি হবে। তাই তাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসার জন্যই কল দিল অনু।
চলবে?