মাতাল হাওয়া পর্ব-৮১ এবং শেষ পর্ব

0
849

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৮১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

রাত সাড়ে ১০ টার মতো বাজে ঘড়িতে। আইসিইউর কেবিনের বাইরে ট্রান্সপারেন্ট দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা রওনকের দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া, লাবিবের পাশে। বেশ কিছুক্ষণ মৌন থেকে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তানিয়াই প্রথমে বলে,

-রওনক টার জলদি ফেরা ভীষণ জরুরী।

তানিয়ার কথার প্রেক্ষিকে কিছু বলে না লাবিব। সে এখনো রওনকের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঘড়ির কাটা টিক টিক করে এগিয়েই চলেছে, সেই সঙ্গে এক একটা মুহূর্ত এগিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টাকে বেঁধে রাখা গেলে হয়ত খুব ভালো হতো। কিন্তু আফসোস সময়কে বেঁধে রাখার কোনো উপায় নেই। মানুষকে সম্পর্ক নামক দোহাই দিয়ে বেঁধে রাখা গেলেও সময়কে কোনোভাবেই বেঁধে রাখা যায় না। আর না সময় নিজের গতির পরিবর্তন করে। হতাশ ভঙ্গিতে নিজের চুলে হাত চালায় লাবিব। একটু আগেই যে তালে তানিয়া নিঃশ্বাস ছেড়েছিল, একই তালে হতাশা মিশ্রিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাপা ঠোঁটে বলে,

-আমার ভয় লাগছে।

তানিয়া জানে লাবিবের এই ভয় অযৌক্তিক নয়। এই মানুষটার সাথে কেবল গুটি কয়েক মানুষ নয় বরং অনেকগুলো মানুষ, তাদের জীবন, একটা গোটা জামান ইন্ডাস্ট্রিস জড়িয়ে আছে। এই মানুষটার অবর্তমানে কি হবে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনের কথা ভেবেই লাবিবের এই ভয় পাওয়া। লাবিবকে কি শান্তনা দিবে বুঝে পায় না তানিয়া। সে নিজেও কি ভয় পাচ্ছে না? পাচ্ছো তো। প্রকাশ করতে পারছে না তবে ভয় সে নিজেও পাচ্ছে। রওনক মানুষটা তার আশেপাশের মানুষগুলোর জীবনে অনেক গুরত্বপূর্ণ একজন। ঠিক উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের মতো, যে চরিত্রের অনুপস্থিতিতে মূল গল্প তার খৈ হারাবে সেরকম গুরুত্বপূর্ণ।

-ভয় পেও না লাবিব, ভয় পেও না। রওনক ঠিক ফিরবে।

বিড়বিড় করে বলে কথাগুলো তানিয়া, যেনো তার নিজের বলা কথা সে নিজেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে চায় কিন্তু কোথায় যেনো একটা কিন্তু থেকেই যায়। মৃ ত্যু র উপর মানুষের হাত থাকলে কেউ কখনোই মৃ ত্যু কে বেছে নিতো না। সবাই কেবল বেঁচে থাকতে চায়, সুখে থাকতে চায়।

সামনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে লাবিব বলে,

-জানি না কি হবে। আমার সত্যি ভয় করছে।

একমুহূর্ত থেমে লাবিব তার কথায় আরও যোগ করে বলে,

-আমি কি একটু আপনার হাতটা ধরতে পারি? প্লিজ!

অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিক থেকে চোখ নামিয়ে লাবিবের মুখোমুখি তাকায় তানিয়া। সে জানে, ভুলে যায়নি এইমুহূর্তে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই পুরুষ তাকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসাকে আঁজলা ভরে গ্রহণ করার ক্ষমতা তার নেই। আবার চাইলেও সে একবার জেনে যাবার পর এই ভালোবাসা অস্বীকারও করতে পারছে না। ভালোবাসাটা বড়ই ব্যাক্তিগত অনুভূতি। ভালোবাসা কারো বাঁধা মানে, কোনো নিষেধ বুঝে না। একবার কোনো মন কাউকে ভালোবেসে ফেলার পর নিজের মতো ভালোবাসতেই থাকে। তানিয়া জানে, বুঝতে পারছে লাবিব কখনো তার সামনে নিজের ভালোবাসার দাবি নিয়ে আসবে না তবুও এই যে জেনে যাওয়াটা, জানার পর কিছু করতে না পারাটা ভীষণ কষ্টদায়ক। বাকিটা জীবন যতবার লাবিবের সাথে তার দৃষ্টির আদান-প্রদান হবে, লাবিবের ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার, তার ভালোবাসার বিনিময়ে তাকে ভালোবাসতে না পারার অনুশোচনা একটা জীবন ভর প্রতিমুহূর্ত তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। কারণ সে জানে ভালোবাসার মানুষটার থেকে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা না পাওয়াটা কতখানি পীড়াময়। কতখানি বুক জ্বালাপোড়া করার মতো অশান্তির। কতখানি নিঃশ্বাস ভার হওয়া।

লিফট কল করে দাঁড়িয়ে আছে লাবিব, তানিয়া পাশাপাশি। নীরবতাদের শব্দের প্রহারে চূর্ণবিচূর্ণ করে তানিয়া বলে,

-আজকের রাতটা নাহয় আমি থেকে যাই রওনকের কাছে। তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট করো। তোমার নিজেরও বিশ্রাম করাটা জরুরী লাবিব। এই সময় তুমি বা আমি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে সমস্যা বাড়বে। তাই আজ না হয় আমি…

তানিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লাবিব বলে,

-বাসায় গিয়ে আমার রেস্ট হবে না। এখানেই ঠিক আছি আমি। স্যারের জ্ঞানটা ফিরুক, উনি বাসায় ফিরুক তারপর না হয় একেবারেই বিশ্রাম করা যাবে। আপনি বাসায় যান। আমার থেকে আপনার বিশ্রাম বেশি প্রয়োজন। ওদিকটা তো আপনাকেই একলা হাতে সামাল দিতে হচ্ছে।

-চিত্রলেখার কোনো খবর পেলে লাবিব?

-নাহ!

লাবিবের কন্ঠের হতাশা বাড়ে। এই না টা বলতে তার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। চিত্রলেখা কেবল রওনকের বউ সে জন্য নয়, লাবিবের অনেক ভালো একজন বন্ধুও সে। নিজের সবটুকু চেষ্টা করেও তার বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারছে না। শেষপর্যন্ত পাবে কিনা সেই আশাও রাখতে পারছে না। এতগুলো মানুষ তাকিয়ে আছে তার দিকে অথচ কাউকে দেয়ার মতো কোনো আশা, ভরসা নেই তার কাছে। বড় অসহায় লাগে নিজেকে লাবিবের। লিফটটা খুলে গেলে ভেতরে প্রবেশ করে লাবিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তানিয়া বলে,

-আসছি, নিজের খেয়াল রেখো।

লাবিব জবাব দেয়ার সুযোগ পায় না। সে কিছু বলার আগেই লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকেই লাবিব মনে মনে আওড়ায়, “আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন, আমার ভালোবাসার মানুষ।“

তানিয়াকে বিদায় দিতে না দিতেই একটা জরুরী কল এটেন্ড করতে হয় লাবিবকে। ফোনকলে কথা শেষ করে রওনকের কেবিনের দিকে আগায় সে। কিন্তু খানিকিটা কাছাকাছি আসতে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় রওনকের কেবিন থেকে দ্রুত কদমে ব্যস্ত হয়ে নার্সকে বের হতে দেখে। নিজের কদমের জোর বাড়িয়ে কেবিনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তার পেছন থেকে এগিয়ে এসে একজন নার্স বলে,

-আপনি বাইরে থাকুন প্লিজ। এখন ভেতরে যাবেন না। ডাক্তার সাহেব ভেতরে আছেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই।

লাবিব বুঝতে পারে না হচ্ছে টা কি! সামান্য কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কি হয়ে গেল এমন? ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে? স্যার ঠিক আছে তো?

-পেশেন্টের জ্ঞান ফিরে এসেছে।

-সত্যি!

খুশি হবে না অবাক বুঝতে পারে না লাবিব। তাকে আশস্ত করে নার্স জানায়,

-জি, ডাক্তার চেকআপ করছেন। চেকআপ হয়ে গেলে পরে আপনাকে ভেতরে ডাকা হবে ততক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করুন।

নার্স লাবিবকে বাইরে রেখে ভেতরে চলে গেলে, সে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার নার্সের জন্য রওনককে দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে। তাই কানে শুনা কথা এখন অব্দি বিশ্বাস হচ্ছে না তার। নিজ চোখে দেখার পরেও হয়ত বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। তবুও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষমান সে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার সরতেই লাবিব ট্রান্সপারেন্ট দরজার এই পাশ থেকে দেখতে পায় রওনক কথা বলছে। লাবিবের নিজের অজানতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি তার তানিয়া তো একটু আগেই গেল, নিশ্চয়ই বেশি একটা দূরে যায়নি সে। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন লাগায় সে তানিয়াকে রওনকের জ্ঞান ফেরার কথা জানাতে। তানিয়াকে জানিয়ে দেয় কাউকে এক্ষুনি কিছু না জানাতে। আগে রওনকের সাথে কথা বলবে তারপর সবাইকে জানানো হবে তার জ্ঞান ফিরার কথা। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে তাকে একাই হাসপাতালে ফিরে আসতে বলে। তানিয়ার সাথে কথা বলা শেষ করতে না করতেই লাবিব দেখতে পায় কেবিনের দরজা দিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে আসছে। ডাক্তারের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে লাবিব জানতে চায়,

-এখন স্যারের কী অবস্থা বুঝছেন?

-কথাবার্তা স্বাভাবিক আছে। কাল কিছু টেস্ট করাবো। সবগুলো টেস্টের রেজাল্ট যদি নরমাল থাকে তাহলে আর চিন্তার কোনো কারণ থাকবে। আর কোনো ভয়ও থাকবে না।

হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে ডাক্তারের দিক হাত বাড়িয়ে দিয়ে লাবিব বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ ডক্টর।

হাসি মুখ করে ডাক্তার বলে,

-ইটস ওকে, সব টেস্ট হয়ে যাওয়া অব্দি জামান সাহেব আইসিইউতেই থাকবেন। রেজাল্ট সব নরমাল আসলে তারপরে না হয় কেবিনে শিফট করে দেয়া হবে।

-আমি কি ভেতরে যেতে পারব?

-অবশ্যই। উনি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন।

-থ্যাংকিউ এগেইন ডক্টর।

আইসিইউর দরজার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই লাবিব দেখে রওনক এদিকেই তাকিয়ে আছে। কেনো আর কার জন্য তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। রওনকের বেডের মাথার দিকটা তুলে দেয়া হয়েছে। আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে আছে সে। এইভিতে স্যালাইনের সাথে মেডিসিন যাচ্ছে এখনো। লাবিব কাছাকাছি এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-চন্দ্র কোথায়? আমার এক্ষুনি ওকে চাই। কল হার রাইট নাও।

তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে হিমশিম খায় লাবিব। মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে তাও টানা পাঁচদিন কোমায় থাকার পর। এক্ষুনি এমন একটা নিউজ তাকে দেয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। মনে মনে নিজেকে উদ্ভট গালাগাল দেয় লাবিব ডাক্তারের থেকে আগেই কিছু জেনে না নেয়ার জন্য।

-লাবিব!

-আপনার এখন রেস্ট বেশি দরকার।

-লাবিব, আমার চন্দ্রকে লাগবে। আই ওয়ান্ট হার নাও।

কীভাবে চিত্রলেখার মিসিং হওয়ার খবর জানাবে সেই কথা গুছাতে মনে মনে হিমশিম খায় লাবিব। কথা গুছিয়ে নিতে চোখ বন্ধ করে নিজের কপালে হাত ঘেষে নেয়। ইতোমধ্যে ধৈর্য হারাতে শুরু করেছে রওনক। লাবিব কোনো জবাব দিচ্ছে না দেখে দাঁত চেপে আবার তাকে ডাকে।

-লাবিব! চন্দ্র কোথায়?

-জানি না।

কথাটা বলতে চায়নি লাবিব। বেফাঁস বেরিয়ে গেছে তার মুখ গলে নিজেকে আটকানোর আগেই। লাবিবের কথা শুনে চোখ সরু করে তার দিকে তাকায় রওনক। ঠান্ডা কন্ঠে জানতে চায়,

-জানি না মানে? আর ইউ ইন ইউর সেন্স?

-আমি একা না, আমরা কেউই জানি না চিত্রলেখা কোথায় আছে? কেমন আছে? কিছুই জানি না।

-হোয়াট দ্যা ফা ক আর ইউ টোকিং লাবিব!

রওনক উত্তেজিত হতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এইমুহূর্তে তার উত্তেজিত হওয়া একদম ঠিক হবে না। আরেক কদম তার কাছাকাছি এগিয়ে দাঁড়ায় লাবিব। রওনককে ঠান্ডা করার প্রচেষ্টা বলে,

-প্লিজ আপনি উত্তেজিত হবে না। আমি চেষ্টা চালাচ্ছি চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করার। কিন্তু…

-কিন্তু কী?

-অনেক চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। এখন অব্দি কেউ কোনো আপডেট দিতে পারছে না।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে রওনক। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে লাবিবের প্রেসার বাড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে। মনে মনে আগের চাইতে আরে বেশি জঘন্য গালাগাল দেয় সে নিজেকে। এখনই না বললেও চলতো। বললেই পারতো চিত্রলেখা বাসায় আছে, সকালে আসবে। এতে অন্তত রাতটা সময় পাওয়া যেতো। এমন হতে পারতো সকাল অব্দি চিত্রলেখাকে খুঁজে পাওয়া গেল। একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে সে। হাতের তালু ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কিছুক্ষণ চুপ করে অন্যমনষ্ক হয়ে থাকার পর রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কখন থেকে মিসিং আমার চন্দ্র?

-আপনার যেদিন এক্সিডেন্ট হলো সেদিন থেকেই।

-কয়দিন?

-পাঁচদিন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছে আপনার। আজ সিক্সথ ডে।

-ছয়দিন!

-জি।

-কোনো আপডেট?

-এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নেই। কেউ জানে না চিত্রলেখা কোথায় গেছে, কেনো গেছে।

-ওর মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করেছো?

-করিয়েছি, লাস্ট লোকেশন বাসারটাই দেখায়। খুব সম্ভবত বাসা থেকে বের হবার আগেই নিজের ফোনটা অফ করে ফেলেছিল সে। তাই নতুন কোনো লোকেশনের আপডেট পাওয়া যায়নি।

-পুরো ঘটনাটা খুলে বলো তো। কোথা থেকে আর কীভাবে মিসিং হলো।

-জাহানারা আন্টি জানিয়েছেন ওইদিন সকালবেলায় আপনি অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবার ঘন্টাখানিক বাদেই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে চিত্রলেখা। সঙ্গে ডাইভারকেও নেয়নি। এমনকি জাহানারা আন্টিকেও জানায়নি কোথায় যাচ্ছে, কখন বাসায় ফিরবে। এমন ভাবেই বেরিয়েছে যেনো কেউ তাকে দেখতে না পায়। এমনকি ঐ বাসায়ও যায়নি। লিখনরাও জানে না চিত্রলেখা কোথায় আছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত কিডন্যাপিং কেইস আপনার তো শত্রুর অভাব নেই। তবে তেমনটাও হয়নি। আমি চেষ্টা করেছিলাম চিত্রলেখার মিসিংয়ের ব্যাপারটা যেনো মিডিয়াতে লিক না হয় কিন্ত…

রওনকের বুঝতে অসুবিধা হয় না লাবিব কি বলতে চাইছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরও কিছু একটা ভাবে সে। তারপর জিজ্ঞেস করে,

-আমার মোবাইলটা কোথায়?

নিজের ব্লেজারের ভেতর দিককার পকেট থেকে একটা নতুন মোবাইল ফোন বের করে রওনকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে লাবিব বলে,

-এক্সিডেন্টের সময়ে আপনার ফোনটা ভেঙ্গে গিয়েছিল তাই নতুন একটা ফোন কিনে সিমটা চালু করে রেখেছি আমি আমার কাছে।

-ভালো করেছো।

লাবিবের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে তাতে ব্যস্ত হয় রওনক। প্রথমেই একটা ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে নেয় সে। তারপর তার ব্যাক্তিগত ইমেইল টা কানেক্ট করে একজনকে ফোন করতে হবে। তার একটা ফোন কলই যথেষ্ট চিত্রলেখা এইমুহূর্তে কোথায় আছে, কেমন আছে সেই ইনফরমেশন বের করতে। ইমেইল কানেক্ট করে নম্বর লোড হবার আগেই একটা ইমেইল আসার নোটিফিকেশনে তার নজর আটকায়। তৎক্ষণাৎই ইমেইলের ইনবক্সে যায় সে। অতিবাহিত হওয়া প্রতিমুহূর্তের সাথে রওনকের চোখ-মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হতে থাকলে তা দেখে লাবিব চিন্তিত কন্ঠে জানতে চায়,

-এনি প্রবলেম স্যার?

আরও কিছুক্ষণ নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ফোনটা লাবিবের দিকে এগিয়ে দেয় রওনক। ভ্রু কুচকে তার হাত থেকে ফোনটা নেয় লাবিব। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই দেখতে পায় চিত্রলেখার পাঠানো ইমেইল। বলা যায় ইমেইলের মাধ্যমে চিঠি লিখে রেখে গেছে সে রওনকের জন্য। চিত্রলেখার রওনককে পাঠানো ইমেইলটা এরূপ,

আমি চলে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না। আমি জানি, আমি চাইলেই আপনার দৃষ্টির আড়ালে যেতে পারবো না। আপনি সবসময় ছায়ার মতো আমার সাথেই আছেন। কিন্তু আমি আর আপনার ছায়ায় থাকতে চাই না। আমার সকল দায়দায়িত্ব থেকে অনেক আগেই আমাকে মুক্তি দিয়েছেন সব নিজের কাঁধে নিয়ে, সেই ভরসাতেই চলে যাচ্ছি। আপনি আছেন, আমি না থাকলেও চলবে। আর কোনোদিন কোনোভাবে আমাদের দেখা না হোক। আমি কখনো আপনার মুখোমুখি হতে চাই না। যদি হয়েও যাই তাহলে আগেই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন প্লিজ। আমার শেষ অনুরোধ, ভুলে যাবেন আমাকে। আমি কখনো আপনার জীবনে এসেছিলাম ভুলে যাবেন। প্লিজ আমাকে খুঁজবেন না। আমি যেখানেই থাকি, যেমনই থাকি না কেনো জানবেন আমি শুধু আপনাকেই ভালোবেসেছি। আপনার পর আর কেউ আসবে না আমার জীবনে। যা পেয়েছি আপনার থেকে তা আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকবো না হয়। ভালো থাকবেন, নিজের খেয়াল রাখবেন। আমার সব দোয়া আপনার জন্য।

-আপনার চন্দ্রলেখা।

চিত্রলেখার ইমেইলটা কয়েকবার করে পড়ে লাবিব যেনো নিজের চোখে দেখা লেখা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে রওনকের দিকে তাকায় সে। অন্যদিকের দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে রওনক। সামান্য ধরে আসা কন্ঠে লাবিব জানতে চায়,

-আপনি খুঁজবেন না চিত্রলেখাকে?

-না।

-কেনো!

-যাকে ভালোবাসা দিয়ে আটকে রাখতে পারিনি। যে নিজে থেকে হারিয়ে যেতে চায় তাকে কি দিয়ে আটকাবো আমি? জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না লাবিব। এই কথা তোমার থেকে ভালো কে জানে বলো?

-কিন্তু চিত্রলেখা আপনাকে ভালোবাসে।

আর কোনো জবাব দেয় না রওনক। জবাবের আশায় লাবিব পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও রওনক রা করে না। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়েছে তার। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ইচ্ছা করছে হাতের কাছে যা আছে সব ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে, পৃথিবীতে আ গু ন জ্বালিয়ে দিতে। কিন্তু সে কিছুই করবে না। যে সইচ্ছায় চলে যেতে চায় তাকে সে আটকে রাখবে না। জোর করে, আটকে রেখে কারো ভালোবাসা আদায় করা যায় না। বিয়ের পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত চিত্রলেখাকে সে নিজের ভালোবাসা বুঝিয়েছে। এরপরেও যদি সে চলে যেতে চায় তাহলে রওনকের কিছুই করার নেই। কোনোদিনও নিজের ভালোবাসার দাবি নিয়ে, সম্পর্কের দোহাই দিয়ে চিত্রলেখার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না সে। চিত্রলেখার সাথে পথচলার বুঝি এখানেই সমাপ্তি।

-রওনক!

আচমকা তানিয়ার ডাকে ভাবনার অতল থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসে রওনক। তানিয়াকে দেখে ম্যাকি হাসার চেষ্টা করে যা আসলে কাজে দেয় না। তানিয়ার দৃষ্টিতে সবার আগে রওনকের লাল হয়ে থাকা ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে শূন্যতায় ডুবে যাওয়া চোখ জোড়া ধরা পরে। যারা জানান দেয় সে ভালো নেই। তার ভালো থাকার দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে। আর কোনোদিন ভালো থাকবে না সে। তার জীবনের সব ভালো মুছে গেছে।

ঘরের দক্ষিন দিকের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রলেখা। অন্ধকার রাতে নিঃসঙ্গ, একলা চাঁদটাকে দেখতে ব্যস্ত সে। এইমুহূর্তে সে নিজেও ঐ চাঁদটার মতোই নিঃসঙ্গ আর ভীষণ একলা। তবে তার এই একাকীত্বের দায়ভার একান্তই তার নিজের। এই একাকীত্ব চিত্রলেখার নিজের বেছে নেয়া। তাই বাকি জীবন তাকে একলাই কাটাতে হবে ভালোবাসার মানুষের থেকে অনেক দূরে। এই জীবনে আর সে কোনোদিন মানুষটাকে দেখতে পাবে না। যতবার চিত্রলেখার মনে পড়েছে সে আর কোনোদিন রওনককে দেখতে পাবে না, একটু ছুঁয়ে দিতে পারবে না, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় তার চোখ গলে গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়েছে। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা নিজের সাথেই বলে,

-আমার আর কিছুই করার ছিল না। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আপনার ক্ষতি হতে দেখতে পারতাম না।

চিত্রলেখা চলে গেছে রওনকের জীবন থেকে তাকে ভালোবাসা নামক মাতাল হাওয়ায় পুরোপুরি উন্মাদ করে দিয়ে। যে উন্মাদনা আরোগ্য নেয়। এতখানি ভালো তো সে তিলোত্তমাকেও কোনোদিন বাসেনি। এই মাতাল হাওয়া থেকে বের হবার পথ জানা নেই রওনকের। এমনকি সে এটাও জানে না, কোনোদিন সে চিত্রলেখা নামক এই মাতাল করা অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা। তবে মুখে যাই বলুক না কেনো অবচেতন মনে সে নিজেও কোনোদিন চিত্রলেখা নামক এই মাতাল হাওয়া, এই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না। যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবে তার হৃদয় দেয়ালে চিত্রলেখার নামটাই খোদাই করা থাকবে ভালোবাসা নামক মাতাল হাওয়া হয়ে, উন্মাদনা হয়ে।

ভালোবাসা সম্পূর্ণ অনুভূতিটাই নে শা র মতো। আর নে শা করলে তো সর্বনাশ হবেই। ভালোবাসা নামক মাতাল করা নে শা রওনক, চিত্রলেখা দু’জনেরই সর্বনাশের ডাক দিয়ে ফেলেছে। এখন এই আ গু নে জ্বলে পু ড়ে ছা ড় খা র হওয়া ছাড়া কারো কিচ্ছু করার নেই। কারণ এরপর হয়ত আর কোনোদিন তারা একে-অপরের মুখোমুখি হবে না। দূর থেকেই ভালোবাসা তাদের পো ড়া বে। মৃ ত্যু কারোই হবে না তবুও দু’জনেই প্রতিমুহূর্ত পু ড়ে ম র বে একে-অন্যের শূন্যতায়, একে-অপরের অভাবে। কারণ ভালোবাসা যে মাতাল হাওয়া।

সমাপ্তি।
প্রথম পরিচ্ছদের সমাপ্তি এখানেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে