#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৮০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)
মানুষ সবসময় চেষ্টা করে নিজের জীবনটাকে পরিকল্পনা মাফিক পরিচালনা করতে কিন্তু এই এত পরিকল্পনা ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে এটাই ভুলে যায় মানুষের জীবন তার নিজের পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় না। বরং মানব জীবনের সম্পূর্ণ পরিকল্পনটাই অন্য একজনের হাতে। যার পরিকল্পনার বাইরে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আর সেই পরিকল্পনাকারীর কোনো পরিকল্পনাকে উপেক্ষা করার সাধ্য ক্ষুদ্র মানুষের নেই। অন্যথায় রওনকের পরিকল্পনা মাফিক এই সময় তার প্রিয়তমাকে নিয়ে ব্যাংককে একান্তে সময় কাটানোর কথাছিল অথচ আজ পাঁচদিন ধরে সে অবচেতন হয়ে হাসপাতালের আইসিউতে পড়ে আছে। আর এই সময়টাতে যে মানুষটার তার পাশে থাকাটা সবচাইতে জরুরী ছিল সেই মানুষটার কোনো খবর নেই। রওনকের এক্সিডেন্ট হয়েছে পাঁচদিন আগে অথচ এখন পর্যন্ত চিত্রলেখার কোনো খোঁজ নেই। সে কোথায় আছে, কোথায় গেছে সেই খবর কেউ জানে না। যেই শুনছে তার কাছেই মনে হচ্ছে মানুষটা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এক হাতে শুরু থেকে সবটা লাবিবকে সামাল দিতে হচ্ছে। একদিকে বিজনেস, আরেকদিকে মিডিয়া, সেই সঙ্গে চিত্রলেখার মিসিং হওয়াটা সব মিলিয়ে বেশ একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হয়েছিল যা বর্তমানে অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। কারণ পাঁচদিন পরে এখন পর্যন্ত না তো রওনকের জ্ঞান ফিরেছে আর না চিত্রলেখার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রথমে লাবিবসহ অন্যরা সবাই ধরেই নিয়েছিল চিত্রলেখাকে হয়ত কেউ অপহরণ করেছে। হয়ত যেকোনো মুহূর্তেই অপহরণকারীদের ফোন আসবে মুক্তিপণ চেয়ে। চিত্রলেখা এমনিতে একজন সাধারণ মানুষ হলেও মানুষটা সাধারণ নয়। যেদিন সে বিয়ে করে জামান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিসের সিইও রওনক জামানের বউ হয়েছে সেদিন থেকেই সে আর সাধারণ কেউ নেই। রওনক জামানের বউ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার সব শত্রু বলি আর রাইভ্যাল সবার চোখের নিশানা হয়ে গেছে চিত্রলেখা। সেজন্যই রওনক যখন নিজে পারেনি তখন তার ড্রাইভার চিত্রলেখাকে বাইরে নিয়ে গেছে। যেখানে যেটা প্রয়োজন হয়েছে হয় রওনক নয় তার অবর্তমানে লাবিব সামলেছে। তবুও চিত্রলেখার একা কোথাও যাবার পারমিশন ছিল না; তার নিজের সেফটির জন্যই।
অপহরণকারীরা যেকোনো সময় মুক্তিপণের জন্য ফোন করবে এমন একটা প্রস্তুতি লাবিব আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিল। এমনিতেই রওনকের এক্সিডেন্টের পর থেকে সব সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে লাবিবকে তবুও শুরু থেকেই একনিষ্টভাবেই সবটা সামাল দিয়ে আসছে সে। রওনকের এক্সিডেন্টের কথা শুনে বিচলিত হলেও তৎক্ষণাৎই নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে। ঐ মুহূর্তে সবকিছু সামাল দিবে এমন কেউ নেই। এমনকি রাদিনও বাংলাদেশে নেই। লাবিবের বুঝতে সময় লাগেনি তাকেই সব সামাল দিতে হবে। বুঝতে পারার পর একমুহূর্ত সময় সে অপচয় করেনি। কিন্তু আচমকা চিত্রলেখার গায়েব হয়ে যাওয়াটা সে নিজেও হিসেব মিলাতে পারেনি। তাই টাকার ব্যবস্থা করতে ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে আগেই কথা বলে রেখেছিল সে। যদিও এই কাজে তানিয়ার বিশেষ ভূমিকা আছে। কিন্তু একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে এক একটা দিন কেটে যাবার পর এখন বুঝতে পারছে চিত্রলেখাকে কেউ অপহরণ করেনি। অপহরণ কেস হলে নিশ্চয়ই এতদিনে ফোনকল চলে আসতো। এক একটা করে দিন যাচ্ছে আর সবার সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে। চিত্রলেখা অপরহণ হয়নি এটা নিশিন্ত হচ্ছে সবাই। প্রথমদিন মিডিয়া জানতো না চিত্রলেখার অনুপস্থিতির কথা কিন্তু দ্বিতীয়দিন নিউজটা ফ্ল্যাশ হয়ে যাবার পর মিড়িয়ায় নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। যে যেভাবে পেরেছে রঙ, চঙ্গ লাগিয়ে নিউজ বানিয়েছে। কিন্তু নতুন আপডেট না পেয়ে আপাতত মিডিয়াও খানিকটা ঠান্ডাই আছে। কোনোরকম নতুন ক্লু ছাড়া নতুন নিউজ করতে পারছে না। এছাড়া লাবিব সুতায় টান দেয়ার ফলে উপর মহলেও চাপে সাংবাদিকেরাও খানিকটা চুপ মেরে আছে। কারণ কেউ কেউ নিউজ বানাতে গিয়ে চিত্রলেখার পরিবার ও আর্থিক অবস্থা পর্যন্ত টান দিয়েছিল। এমনকি ওদের আচমকা বিয়ে নিয়েও নানারকম গুঞ্জণ ওঠা শুরু করেছিল। বাধ্য হয়েই লাবিবকেও উপর মহলের সাহায্য নিতে হয়েছে। পারিবারিক, স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে কোনোরকম রঙ মাখিয়ে নিউজ করার ব্যাপারে উপরের চাপ পেয়ে সবাই মোটামোটি ওসব নিয়ে কিছু বলছে না এইমুহূর্তে আর। কিন্তু গুঞ্জন চাইলেই তো দাবিয়ে রাখা যায় না। চারিদিকে কানাঘোষা ঠিকই চলছে। ওসবে লাবিব পাত্তা দিচ্ছে না। আপাতত টিবি চ্যানেলগুলোর হেডলাইনে কিছু আসছে না সেটাই যথেষ্ট। বাকিটা পরে দেখা যাবে। রওনকের জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত লাবিবের যেটা ঠিক মনে হচ্ছে আপাতত সে সেটাই করছে। নিজের পাওয়ারে যতটুকু সম্ভব সেটুকু কাজে লাগিয়েই চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে লাবিব; সফল হবে কিনা আপাতত সেই ভাবনা ভাবছে না সে।
প্রথম কয়টা দিন চারিদিক সামাল দিতে অনেকটা বেগ পেতে হয়েছে লাবিবকে যার অর্ধেকটাই এখন কমে গেছে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছেই রওনকের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে একটা কঠিন ধাক্কা খেয়েছে তানিয়া। পৌঁছেই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই লাবিবের সাথে যোগাযোগ করেছে। একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ফিরতি ফ্লাইট নিয়ে গতকালই ফিরে এসে পৌঁছে সে। তানিয়া চলে আসাতে যেনো লাবিবের কাঁধের বোঝা অর্ধেকটাই নেমে গেছে। এসেই লাবিবকে অফিসের দায়িত্ব থেকে ছুটি দিয়েছি সে। অফিসের সবকিছু তানিয়া এসেই নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। এছাড়া উপায়ও নেই কোনো। লাবিবকে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। রওনকের এক্সিডেন্টের কথা শুনে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে এরপর আর একমুহূর্তের জন্য হাসপাতাল তো দূরের কথা আইসিউর করিডোর ছেড়ে অন্যত্র যাবার সু্যোগ হয়নি তার। চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করতে একশ এক ফোনকল করতে হচ্ছে তাকে। এমন অবস্থায় রওনকের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তাকে রেখে বের হবার কথা ভাবতেও পারছে না সে, ভরসাও পাচ্ছে না।
রওনককে না জানিয়ে এমনিতে কোথাও যায় না চিত্রলেখা ওইদিন সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় গেছে সেটা কেউ জানে না। এমনকি চিত্রলেখার একমাত্র প্রাণের সই আফিফাও জানে না সে কোথায় আছে। আচমকা মানুষটার এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পেছনে ঠিকঠাক কোনো লজিক দাড় করাতে পারছে না কেউ। সবাই একপ্রকার বিভীষিকাতে আছে।
এতক্ষণ একটা জরুরী ফোন কলে ছিল লাবিব। ফোনকলে কথা শেষ করেই মোবাইলটা পকেটে পুরে নিয়ে আইসিউর করিডোরে বসে অপেক্ষারত লিখনের পাশে গিয়ে বসে সে। লাবিবকে দেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে লিখন কিন্তু মুখে হাসি কুলায় না তার। কীভাবে কুলাবে? যার প্রাপ্তবয়স্ক বোন এমন নিরুদ্দেশ তার কি মুখে হাসি জোগানোর কথা? লিখন নিজেও নিজের মতো নানা জায়গায় চিত্রলেখার খোঁজ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। চিত্রলেখার পৃথিবীটা ছোট। দুই ভাই, এক বোন আর খালা বাদে রওনকের পরিবার। আগে অফিস করলেও বিয়ের পর থেকে অফিস করছে না সে। এছাড়া অফিসে ঐ এক লাবিব ছাড়া কারো সাথে বিশেষ কোনো শখ্যতা বা বন্ধুত্ব ছিল না তার। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবী বলতে ঐ একজন আফিফা। এরপর অন্যকোনো বান্ধবীও নেই তার। সবসময়ই চিত্রলেখার দুনিয়াটা কেবল নিজের পরিবারকে কেন্দ্র করেই ছিল। পরিবারের বাইরে কারো সাথে কোনো ধরনের কোনো সম্পর্ক বা সখ্যতা তৈরি করেনি সে। মলিন দৃষ্টি নিয়ে লাবিবের দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-আপার কোনো খবর পাওয়া গেল লাবিব ভাই?
লিখনের প্রশ্ন শুনে সামনের দিকের দেয়াল থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে লিখনের দিকে তাকায় লাবিব। ঐ চোখে এক অসহায় ভাইয়ের বোনের জন্য চিন্তা, অস্থিরতা, আকূলতা স্পষ্ট দেখতে পায় সে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই অসহায় ভাইকে দেয়ার মতো কোনো শান্তনা জানা নেই লাবিবের। সে নিজের সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চিত্রলেখাকে সে খুঁজে না পেলেও অন্তত রওনক না ওঠা পর্যন্ত সে নিজের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। লিখনের পায়ের উপর থাকা তার একটা হাতের উপর হাত রেখে তাকে আশস্ত করার চেষ্টা করে লাবিব বলে,
-চিন্তা করো না লিখন। আমি কোনো আপডেট পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তোমাকে জানাবো।
-পাঁচদিন হয়ে গেল লাবিব ভাই। এখন পর্যন্ত আমার বোনটার…
লিখনের গলা ধরে আসে। আর কথা বলতে পারে না সে। মায়ের মতো বড়বোনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের কুচিন্তা করতে চাইছে না যদিও কিন্তু কুচিন্তা তো আর না চাইলে বসে থাকে না। লিখন না চাইলেও নানারকম কুচিন্তা তার মস্তিষ্কে এসে ভর করছে। হাজার চেষ্টা করেও ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। লিখনের হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
-আরেকটু ধৈর্য্য রাখো ভাই। আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করছি। স্যার ঠিক থাকলে হয়ত এতক্ষণে আমরা চিত্রলেখাকে পেয়ে যেতাম। তবুও আমি কোনো ত্রুটি রাখছি না লিখন।
এটা লিখন নিজেও জানে। লাবিব সত্যিই তার সাধ্য মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে কোনো ত্রুটি রাখছে না। আবার এটাও সত্যি রওনক সুস্থ থাকলে এতক্ষণে আকাশ, জমিন এক করে হলেও চিত্রলেখাকে খুঁজে বের করে ফেলত। আপাতত ধৈর্য্য রাখা ছাড়া কিছু করার নেই কারোই। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে লাবিব জানতে চায়,
-খালার শরীরের কি অবস্থা এখন?
-ঔষধ দিয়ে প্রেসার খানিকটা নিয়ন্ত্রনে আছে আপাতত।
চিত্রলেখাকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনার পর থেকে নারগিস বেগমের শরীরের অবস্থা ভালো নেই। প্রেসার বেড়েছে যা নামতেই চাচ্ছে না। জরুরী ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। সেখানেও লাবিব বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। চিত্রলেখার খালার চিকিৎসায় যেনো কোনো ধরনের ত্রুটি না থাকে সেদিকেও খেয়াল রেখেছে সে। রওনককে দীর্ঘদিন ধরে চিনে লাবিব। সেই চেনা জানা থেকেই তার যা মনে হয়েছে, রওনক সুস্থ থাকলে যা করত লাবিব নিজ দায়িত্বে সেটাই করেছে, করছে।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,
-ডাক্তাররা কি বলছে?
-যা বলার তা তো আগেই বলে দিয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা। আরও দু’দিন যাবার পর নতুন করে কিছু বলা যাবে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-আজকের মতো আসি তাহলে।
-স্যারের সাথে দেখা করবে না?
-কাল আবার আসবো।
প্রতিদিনই একবার করে এদিক আসছে লিখন রওনকের খবর নিতে, সেই সাথে নিজের বোনের কোনো আপডেট পাওয়া যায় কিনা সেই আশায়। লাবিব নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায়। লিখনকে বিদায় দিয়ে রওনকের আইসিইউর কেবিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। গ্লাসের দরজার এপাশ থেকেই দেখা যাচ্ছে শান্ত ভঙ্গিতেই ঘুমিয়ে আছে সে। এই বিশ্রামটা তার দরকার, ডাক্তাররাই জানিয়েছে। এক্সিডেন্টে রওনকের মস্তিষ্কে অতিরিক্ত প্রেসার পড়েছে। যার ফলে তার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে আছে। ডাক্তাররা জানিয়েছে সাময়িক কোমায় আছে সে। সেই সাথে এটাও জানিয়েছে দিন সাতেকের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে তার। আশা করছে, ব্রেইন তার পর্যাপ্ত বিশ্রাম পেয়ে গেলেই আবার সজাগ হবে সে। ডাক্তারদের বলে দেয়া সময়ের মধ্যে আজ পঞ্চম দিন চলছে। আগামী দু’দিনে জ্ঞান না ফিরলে ব্যাপারগুলো কমপ্লিকেটেড হতে শুরু করবে। আজ সারাদিনও আশাবাদী ছিল লাবিব, হয়ত যেকোনো সময় রওনকের জ্ঞান ফিরে আসবে। কিন্তু দিন ঢেলে যাবার পরেও যখন দেখলো কোনো হদিশ নেই তারপর থেকেই দুশ্চিন্তায় অন্ধকার লাগছে সবকিছু। মনে মনে প্রতিমুহূর্ত আল্লাহকেই ডেকে যাচ্ছে সে। এই মানুষটা থাকা, না থাকার উপর অনেককিছু নির্ভর করছে। অনেকের ভালো, মন্দ জড়িয়ে আছে এই একজন মানুষের সাথে।
চলছে…