মাতাল হাওয়া পর্ব-৭১+৭২+৭৩

0
566

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

রওনকের ব্যস্ততা কমেনি, বলা যায় বরং বেড়েছে। আগে যদিও ব্যস্ততা, কাজের প্রেসারকে তোয়াক্কা করেনি সে। কিন্তু আজকাল সারাক্ষণ কেবল মনে হয় কখন এসব ব্যস্ততাদের পাশে ঠেলে বাড়ি ফিরতে পারবে সে। আগে কখনই বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল না তার। কিন্তু আজকাল চিত্রলেখার কাছে ফিরে যাবার জন্য বুকের ভেতর ব্যাকুলতার ঝড় ওঠে তার। প্রিয়তমাকে দেখার, কাছে পাবার, ছুঁয়ে দিতে অস্থির হয়ে থাকে সে। কাজের মাঝেই যখন আপন মনে চিত্রলেখার কথা ভাবতে ব্যস্ত রওনক। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে কেবিনের দরজায় কারো উপস্থিতি টের পায় সে। একবার নক করে দরজাটা খুলে ভেতর দিকে উঁকি দেয় লাবিব। তাকে দেখে রওনক বলে,

-কাম ইন।

এগিয়ে এসে রওনকের সামনে একটা ফাইল রেখে লাবিব বলে,

-আজ বিকেলের মিটিংয়ের ফাইল।

-ওকে।

বেরিয়ে যাবার জন্য কদম বাড়ায় লাবিব। পেছন থেকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ভাবী কি তার কেবিনে আছে?

-হোপ ফুলি। আমি কি খবর নিবো?

-খোঁজ নিয়ে জানাও আমাকে।

-এক্ষুনি জানাচ্ছি।

রওনকের কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফাইনান্স ডিপার্টমেন্টে ফোন করে লাবিব তানিয়া অফিসেই আছে কিনা জানতে।

তানিয়ার কেবিনে টোকা পড়তেই ফাইলে মুখ গুঁজে রেখেই সে বলে,

-কাম ইন।

তানিয়ার কন্ঠ শুনতে পাবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রওনক। মাথা তুলে তাকে দেখে হাতের ফাইলটা সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজের চেয়ার রিল্যাক্স হয়ে বসে তানিয়া। জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং সিরিয়াস?

এগিয়ে এসে তানিয়ার মুখোমুখি অন্যপাশের চেয়ার টেনে বসে রওনক। কোনো ধরনের ভনিতা না করে সে বলে,

-তুমি জানো এই মুহূর্তে আমার উপর কাজের কত প্রেসার যাচ্ছে। এক্ষুনি আমার প্রেসার আরও বাড়িয়ে না দিলে হচ্ছে না তোমার?

রওনকের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় সে। না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে,

-কি করলাম আমি আবার?

নিজের কোর্টের ভেতর পকেটে থাকা একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ বের করে তানিয়ার সামনে রাখে রওনক। সামনের দিলে ঝুঁকে সেটা হাতে নেয় তানিয়া। ভাঁজ করা কাগজটা খুলতেই বুঝতে পারে সেটা কি, সম্পূর্ণ পড়তে হয় না তাকে। আজ সকালেই রওনককে নিজের ইস্তফা পাঠিয়েছে সে ই-মেইলে। এই মাসের শেষেই রাদিনের সঙ্গে তার ডিভোর্স ফাইনালাইজ হয়ে যাবে। আগামী মাসেই দেশ ছাড়বে সে। তাই আগেই ইস্তফা পাঠিয়ে দেয়া আর কি। যদিও রওনক নিজের স্বার্থে তানিয়াকে আটকে রাখবে না কিন্তু সে চায় না কোম্পানির সবচাইতে প্রয়োজনের সময় সে চলে যাকে। কোম্পানির জন্য না হোক অন্তত তার জন্য। এত দূর আসার পেছনে তানিয়ার অবদান নেহাৎ কম নয়। তানিয়ার মতো ডেডিকেটেড মানুষ পাওয়া ভার। সে পাশে থাকলে কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে হয় রওনককে। এত বড় কোম্পানি চালাতে যে সাপোর্টটা নিজের বড় ভাইয়ের কাছে পাবার কথা ছিল সেটা এতকাল ভাইয়ের বউয়ের কাছে পেয়েছে সে। অথচ এই মানুষ আর বেশিদিন তার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাকে সঙ্গ দিবে না। রওনকের হাতে থাকলে সে তানিয়াকে এখান থেকে যেতে দিতো না। কিন্তু ঐ যে, সে স্বার্থপর হতে চায় না তার ভাইয়ের মতো। তাই তানিয়াকে আটকানোর চেষ্টাও করেনি। নিজের জীবনের সিদ্ধান্তটা তাকেই নিতে দিয়েছে। পাশে থাকার কথাও দিয়েছে। কিন্তু তানিয়া কেবল তার ভাবীই নয় ভালো বন্ধুও৷ একটা ভালো বন্ধু হারানোর বেদনা তার হৃদয়কে ঠিকই আঘাত দিয়েছে। তার হাতে থাকলে তানিয়াকে কখনই যেতে দিতো না সে।

-তুমি চলে গেলে আমি একা এত কিছু সামলাতে পারব না ভাবী।

-তোমার তো দেখছি বিয়ের পর ভারী উন্নতি হয়েছে।

-মানে!

-মানে এই যে ইমোশনাল ডায়লগ দিচ্ছো। আগে তো কখনো এসব বলতে শুনিনি। চিত্রলেখা তো দেখছি রাতারাতি বদলে দিয়েছে তোমাকে।

-আমি কিন্তু একদম মজা করছি না।

-মজাই করছো। আমাকে ছাড়াও তুমি খুব ভালো ভাবেই কোম্পানি চালাতে পারবে একথা তুমিও জানো।

-তারপরেও, তুমি পাশে থাকলে…

-আমি থাকতে চাই না রওনক। নিজের দিক ভেবে আমি কখনই কোম্পানি জয়েন করিনি। যে সাপোর্টটা তোমাকে তোমার ভাইয়ের দেয়ার কথা ছিল তার ওয়াইফ হিসেছে শূন্য জায়গাটা পূরণ করার চেষ্টা করেছি। সেই সম্পর্কটা যেহেতু আর নেই তাই তার হয়ে আমি আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে চাই না। তার কোনো কিছুর দায় আর আমার উপর নেই।

-আমার ভাইয়ের বউ ছাড়াও মীম, মিশকাতে মা তুমি। ওরা দু’জন এই কোম্পানির ফিউচার। সে হিবেসে তোমার পজিজনটা কিন্তু হেলায় ফেলে দেয়ার মতো নয়। চাইলে একবার ভেবে দেখতে পারো। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য আলাদা ফ্ল্যাট রেডি করে দিবো। ভাইয়ার সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে হবে না তোমাকে।

স্মিত হেসে তানিয়া বলে,

-তোমার মনে হয় এসব অপশন আমি ভাবিনি? আমি এইসব কিছু থেকে দূরে থাকতে চাই অন্তত কিছুদিন। যদি কখনো মনে হয় আমি এখানেই ফিরে আসবো এই কোম্পানির একজন ইমপ্লই হয়ে তাহলে অবশ্যই তোমাকে জানাবো।

-সিওর?

-হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

তানিয়ার দিকে হাত মেলে দিয়ে রওনক বলে,

-রিমেম্বার, এনি টাইম এন্ড অলওয়েজ ইউ আর ওয়েলকাম হিয়ার।

নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাত ধরে, হ্যান্ডশেক করে তানিয়া বলে,

-আই উইল অলওয়েজ রিমেম্বার দ্যাট।

উঠে দাঁড়ায় রওনক। তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে তানিয়া বলে,

-তাড়া না থাকলে আরেকটু বসো।

-কিছু বলতে চাও?

মাথা ঝাকায় তানিয়া। পূর্বের জায়গায় বসে পরে রওনক। সে বসলে তানিয়া বলে,

-চিত্রলেখার ব্যাপারে কি ভাবছো?

-কোন বিষয়ে?

-ও অফিস জয়েন করছে কবে?

-আমি ওকে ফোর্স করতে চাই না ভাবী। ও এখনো নিজেকে তৈরি করতে পারছে না।

-কেনো? আগেও তো এখানেই কাজ করেছে তাহলে সমস্যা কোথায়?

-ইউ নো, সমস্যাটা এখানেই। ও এতদিন কোম্পানির একজন সাধারণ কম্পিউটার অপারেটর ছিল। সেখান থেকে একদিন প্রোমোশন হয়ে হঠাৎ আমার অফিসে শিফট হওয়া। তার কয়েক মাস পরেই আমাদের বিয়ে। এখন কোম্পানির একটা বড় পজিশনে জয়েন করলে সবাই বলবে বসকে পটিয়ে বিয়ে করে বড় পজিশন গেইন করেছে। সবাই ওকে নেগেটিভ ভাবে দেখবে।

-আর তুমি এসব কেয়ার করো?

-নো ওয়ে। অন্তত তুমি আমাকে চিনো। কে কি বলল তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু চন্দ্র এসব বিষয়ে খুব সেন্সিটিভ। আমি ওকে আরও ডেলিকেটলি হ্যান্ডেল করতে চাই। আমি চাই ও কোম্পানি জয়েন করুক। আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুক৷ বড় বড় ডিসিশন নিতে আমাকে হেল্প করুক কিন্তু জোর করে নয়। ও যখন নিজে থেকে তৈরি হবে তখনই জয়েন করবে। সবার কথাকে তোয়াক্কা না করে নিজে থেকে এগিয়ে আসবে তখনই জয়েন করবে।

-তোমাদের বিয়ের অলরেডি ৪ মাস চলছে রওনক।

-মাত্র ৪ মাস ভাবী। এখনো সম্পূর্ণ জীবন পরে আছে। শি ক্যান টেক অল দ্যা টাইম টু ম্যাক হার ডিসিশান৷ এন্ড আই এম নট গোয়িং টু ফোর্স হার।

-কিন্তু ওকে আরও শক্ত হতে হবে। নয়ত দেখা যাবে তুমি টের পাবার আগেই কোনোদিক দিয়ে কোনো দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমি চাই না ও সাফার করুক৷

-ডোন্ট ওয়ারি, আই ইউল অলওয়েজ প্রটেক্ট হার উইথ মাই লাইফ।

-আই ট্রাস্ট ইউ।

এবারে উঠে দাঁড়িয়ে রওনক বলে,

-বের হচ্ছি। একটা মিটিং আছে আমার।

-মিটিং শেষে কি অফিস ফিরছো নাকি বাসায় চলে যাবে?

হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে রওনক বলে,

-মিটিং শেষ হতে হতে অলমোস্ট পাঁচটা বেজে যাবে। আজ আর অফিস ফিরবো না। আই এম মিসিং হার এ লট।

মুচকি হেসে তানিয়া বলে,

-বেস্ট অফ লাক।

মিটিং শেষ করে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে রওনক। নিজের ঘরে বসে বই পড়তে ব্যস্ত চিত্রলেখা। গল্প, উপন্যাসের বই নয়। বিজনেস রিলিটেড বই। যদিও এখনো সে কোম্পানি জয়েন করতে মানসিক ভাবে তৈরি নয়। তবে সে বুঝে রওনক খুব করে চায় সে অফিস জয়েন করুক৷ কিন্তু বড় কোনো পজিশনে জয়েন করার মতো যোগ্যতা তার নেই সেটা সে ভালো করেই জানে। ছোট কোনো পজিশনে হলেও তাকে অফিস জয়েন করতেই হবে, অন্তত রওনকের জন্য। সে কেবল হাউজ ওয়াইফ হয়ে থাকুক সেটা রওনক চায় না। সেজন্যই ঘরে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে মীম, মিশকাতের দেখাশুনার পাশাপাশি বিজনেস রিলেটড বইগুলো পড়ে কিছু শিখার চেষ্টায় আছে সে। নতুন করে জয়েন করার আগে অন্তত বিজনেস রিলেটেড কিছু বেসিক শিখে নিতে চায়। যা হয়ত বেটার কিছু করতে হেল্প করবে তাকে।

মীম, মিশকাতকে ভাত ঘুম দিতে তাদের নিজ নিজ ঘরে ঘুম পারিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে ছিল সে৷ একটু পরেই নিচে যাবে সে নাস্তার আয়োজন দেখতে৷ আচমকাই বেড রুমের দরজা খোলার শব্দ পেতেই বই থেকে মুখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা। রওনককে দেখতে পেয়েই মুখ জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে তার। এই সময় তার বাসায় আসার কথা নয়৷ বরং বিগত লম্বা সময়ে রাত ৮টা /৯টার আগের বাসায় ফিরেনি সে। এমনকি কখনো কখনো রাত ১১ টাও বেজেছে তার বাসায় ফিরতে। আজ এত জলদি রওনককে বাড়ি ফিরতে দেখে খুশি হয়ে যায় সে। হাতের বইটা পাশে নামিয়ে রেখে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে যায়। হাসি মুখ করে এগিয়ে এসে রওনকের মুখোমুখি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আজ এত জলদি?

-তোমাকে মিস করছিলাম খুব।

রওনকের কথায় চিত্রলেখার গাল লাল হয়। পেছনে থাকা হাত সামনে এগিয়ে ধরে রওনক। তার হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আমার ফুলের জন্য ফুল।

দি বিজনেস টাইকুন রওনক জামানের মতো মানুষ এমন কথাও বলতে জানে কেউ নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাসই করবে না। যেমন চিত্রলেখা নিজেও ভাবতো একটা সময় এই মানুষটার জীবনে হয়ত রসকষ নেই। অথচ তার জীবনে আসার পর টের পাচ্ছে এই লোকটার মতো করে কেউ হয়ত ভালোবাসতেই জানে না৷ চিত্রলেখাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে আচমকাই তার গালে চুমু খায় রওনক। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে,

-আই মিসড ইউ সো মাচ, লাভ।

আগের চাইতে আরও বেশি লাল হয় চিত্রলেখা। রওনকের তাকে কথায় কথায় বউ ডাকা, লাভ ডাকায় গলে পানি হয়ে যায় সে। আর কথা বলতে পারে না। রওনকের বুকে মুখ লুকানো ছাড়া এই লজ্জা থেকে বাঁচার পথ খুঁজে পায় না সে। আলতো আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় রওনক প্রিয়তমাকে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

রওনকের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে চিত্রলেখা। চাদর টেনে নিজেদের ঢেকে রেখেছে সে। প্রিয়তমার বিবস্ত্র পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রওনক বলে,

-তুমি চাইলে আমরা আরেকবার…

-একদম না।

চেঁচিয়ে ওঠে চিত্রলেখা। রওনকের বুক থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

-একে তো অসময়ে আবার গোসল করতে হবে আমার।

-সেজন্যই তো বলছি আরেকবার হয়ে যাক।

-জি না, এখন চোখ বন্ধ করুন।

চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করতে বলায় চোখ সরু করে নিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কেনো?

-আমি বাথরুমে যাবো। চোখ বন্ধ করুন জলদি আর একদম তাকাবেন না বলে দিচ্ছি।

-আমার কিচ্ছু দেখা বাকি নেই। এমনকি ছুয়ে…

রওনক কথা শেষ করতে পারে না এর আগেই হাত বাড়িয়ে তার মুখ আটকে ধরে চিত্রলেখা। লজ্জায় নাস্তানাবুদ হয়ে বলে,

-ছিঃ এসব এভাবে বলে কেউ?

নিজের ঠোঁটের উপরে থাকা বউয়ের হাত সরিয়ে নিয়ে রওনক বলে,

-আমি না বললে কে বলবে?

-একদম না, চোখটা বন্ধ করুন প্লিজ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণে হয়ত মীম, মিশকাতও উঠে গেছে। সবাই সন্ধ্যার নাস্তা করবে।

-মীম, মিশকাতের খেয়াল রাখার জন্য বাসায় লোক আছে। সবাইকে নাস্তা দেয়ার লোকও আছে। একদিন তুমি ওদিকটা না দেখলেও সব হয়ে যাবে।

-জানি হয়ে যাবে কিন্তু আমি চাই না হয়ে যাক। আমি নিজে সব করতে চাই। ভুলে যাচ্ছেন মীম, মিশকাতের জন্যই কিন্তু আজ আমরা একসাথে।

-আর তোমার মনে হয় শুধু মীম, মিশকাতের জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি আমি?

-তাহলে কেনো করেছিলেন?

-এতদিনেও বুঝোনি?

-আমার ভেবে নেয়াটা তো ভুলও হতে পারে।

-আমার মুখে শুনতে চাও?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে তা নিজের আচরণ, ব্যবহারের, কাজকর্মে বুঝাতে কিচ্ছু বাকি রাখেনি সে। তবুও তার মুখে অন্তত একবার শুনতে চায় চিত্রলেখা। কিন্তু নিজে থেকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না তার। আজ সুযোগ পেয়ে সেই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না সে৷ রওনক কিছু বলার আগে তাদের বেডরুমের দরজায় দড়াম করে শব্দ হয়। শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজার ওপাশ থেকে মীম বলে,

-মিমি তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছো?

মীমের কন্ঠ শুনতে পেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় চিত্রলেখা। এগিয়ে গিয়ে রওনকের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফাস কন্ঠে বলে,

-বলুন আমি বাথরুমে আছে। আর আপনি চোখ বন্ধ করুন, জলদি।

এমুহূর্তে দরজার অন্যপাশে মীম দাঁড়িয়ে না থাকলে চিত্রলেখার কথা কোনোভাবেই মানতো না সে। আজ বউয়ের অযৌক্তিক লজ্জা পাওয়া ভাঙ্গিয়েই ছাড়তো। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই চোখ বন্ধ করে সে। এক দৌড়ে চিত্রলেখা বাথরুমে চলে গেলে রওনক নিজেও বিছানা ছেড়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজা খুলে মীমকে দেখে প্রশস্ত হাসে। তাকে দেখতে পেয়ে নিজের সব কয়টা দাঁত বের করে হাসে মীম। গাল ভরা হাসি নিয়ে বলে,

-ছোট পাপা!

কোলে নেয়ার জন্য হাত মেলে দিয়ে রওনক বলে,

-কাম অন চ্যাম্প।

মীমও একমুহূর্ত বিলম্ব করে না তার ছোট পাপার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। মীমকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-প্রিন্সেস কোথায়?

-নিচে, মিমির জন্য অপেক্ষা করছে। মিমিই তো প্রতিদিন আমাদের ইয়ামি ইয়ামি নাস্তা বানিয়ে দেয়।

কথা বলতে বলতেই এক নজর রুমের এদিক থেকে সেদিক চোখ বুলায় মীম, তার মিমিকে খুঁজে পাবার আশায়। রওনককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মীম নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-মিমি কোথায়?

-মিমি ফ্রেশ হচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই নিচে যাবে।

-চলো তাহলে আমরাও নিচে যাই।

-পাপাকে একটু ফ্রেশ হতে হবে যে। অফিস থেকে এসেছি, চট করে ফ্রেশ হয়েই নিচে জয়েন করছি।

-ওকে।

মীমের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় রওনক।

চিত্রলেখা শাওয়ার শেষ করে বের হতেই রওনক বাথরুমে ঢুকে যায়। চেঞ্জিং রুমে কাপড় পরার সময় ভাবে আজ শাড়ি পরবে সে। যা ভাবা তাই করা। রওনক গোসল সেরে বেরিয়ে আসার আগে চট করে একটা কফি রঙের জমিনে সাদা রঙের ভাটিকের শাড়ি সাদা রঙের ব্লাউজ দিয়ে পরে নিচে চলে যায়। রওনক নিচে নেমে তাকে শাড়িতে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে। সেই মুহূর্তের কথা ভেবেই গাল জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে তার।

চিত্রলেখা নিচে নেমেই দেখে আজ জাহানারা নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। চিকেন ও এগ দিয়ে স্যান্ডুউইচ করেছে। রওনককে অসময় বাসায় দেখে ভেবে নিয়েছিল আজ হয়ত চিত্রলেখার নিচে নামতে সময় লাগবে। সেই আন্দাজ করেই নিজ উদ্যোগে নাস্তাটা বানিয়ে ফেলেছে সে। কেবল চা করাটা বাকি। ইতোমধ্যে এক দিলারা জামানকে বাদ দিয়ে এই বাড়ির প্রত্যেকে চিত্রলেখার বানানো চায়ের ভক্ত হয়ে গেছে। তাই নাস্তা বানালেও চা বানায়নি সে। এগিয়ে এসে জাহানারার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানায় চিত্রলেখা। হেসে দিয়ে জাহানারা বলে,

-তোমার হাতের বানানো ছাড়া তো কেউ চা খেতে চায় না তাই চা করিনি।

হাসি হাসি মুখ করে চায়ের ক্যাতলি হাতে নেয় সে। পেছন থেকে এগিয়ে এসে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-কি বানানো হয়েছে আজ? ভীষণ খুদা পেয়েছে আমার।

দু’জনে একত্রেই পেছন ঘুরে দেখে তানিয়া এখনো অফিসের কাপড়ে আছে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে মাত্রই বাসায় ফিরেছে সে। ফিরেই সরাসরি কিচেনে। জাহানারা জিজ্ঞেস করেন,

-ফ্রেশ না হয়েই খাবে?

-ফ্রেশ হওয়ার এনার্জি নেই। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি।

-বসো, আমি এক্ষুনি খাবার দিচ্ছি।

তানিয়া এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়ায়। অন্যরা কেউ যেনো শুনতে না পায় সেদিকে সতর্ক থেকেই বলে,

-অসময়ে গোসল ঘটনা কি?

চিত্রলেখাকে অবশ্য জবাব দিতে হয় না। তানিয়া নিজেই দুষ্টু হাসি হেসে বলে,

-ওহ আচ্ছা আজ তো কার প্রাণ ভ্রমরা যেনো বিকেলেই বাসায় ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই আজ বিশেষ কিছু…

-ভাবী!

তানিয়াকে কথা শেষ করতে দেয় না চিত্রলেখা। এতদিনে এই মহিলাকে চেনা হয়ে গেছে তার। লেগ পুল করার একটা সুযোগও হাত ছাড়া করে না সে। এক্ষুনি লজ্জা পাবার মতো কথাবার্তা বলে ফেলবে সে।

-হ্যাঁ, বলো শুনছি।

-আপনার খাবার রেডি।

আর কিছু বলে না তানিয়া। জানাহারা এগিয়ে এসে খাবার প্লেট এগিয়ে দিলে সেটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে দুষ্টু হেসেই বলে,

-আজ বেঁচে গেলে। ঘরে যাচ্ছি ওখানেই খাবো।

তানিয়া বেরিয়ে যেতেই ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে চিত্রলেখা তা দেখে জাহানারা জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

-না, কিছু না তো। কিছু হয়নি।

চা বানানোয় মন দেয় সে। এরা দেবর, ভাবী কারো থেকে কেউ কম যায় না। ব দে র হাড্ডি এক একজন।

চা বানানো শেষ করে ড্রইং রুমে বেরিয়ে আসলে চিত্রলেখা দেখে রওনক নেই এখানে। মীম, মিশকাতকে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে সে এখনো নিচে আসেনি। আজ দিলারা জামানও নাস্তা করতে আসেননি। দেরি না করে রওনকের জন্য চা ও নাস্তা নিয়ে উপরে চলে যায় তাকে দিতে। নিজের ঘরের লিভিং রুমে ডুকে সেন্টার টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখে শব্দ না করে। রওনক এখনো দেখেনি সে শাড়ি পরেছে। তার হুটহাট শাড়ি পরাটা রওনকের ভীষণ পছন্দ। বেডরুমে ডুকতে নিয়ে কদম থমকে যায় চিত্রলেখার। পা কেঁপে উঠলেও নিজেকে পরে যাবার আগে সামলে নেয় সে। তাদের বেডরুমের দরজা সামান্য খোলা তা দিয়েই দেখতে পা রওনকের মুখোমুখি একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে সাবা। রওনক এদিক পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে তাই সে চিত্রলেখাকে দেখতে না পেলেও সাবা পেছনে দরজার দিকে তাকালেই তাকে দেখতে পাবে। দু’জনের মধ্যে কি কথা হচ্ছে শুনতে পায় না সে। তার কানে কথা ভেসে আসলেও সেসব বুঝতে পারছে না চিত্রলেখা। কীভাবে বুঝতে পারবে? চোখের সামনে থাকা দৃশ্যটাই তো হজম করতে পারছে না সে। সামান্য এগিয়ে এসে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরেছে সাবা। তাকে বাঁধা না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রওনক। যেনো সাবার কর্মকান্ডে পূর্ণ সমর্থন আছে তার। রওনক বাঁধা না দেয়ায় নিজের ঠোঁটটা এগিয়ে দেয় সাবা রওনকের ঠোঁটের দিকে। তাকে নিজের ঠোঁটের উষ্ণতায় জড়িয়ে নিতে। এই দৃশ্য দেখার সাহস, ক্ষমতা কোনোটাই নেই চিত্রলেখার। সাবার ঠোঁট রওনকের ঠোঁটের দখল নিতেই পেছন ঘুরে যায় সে। কোনোরকম শব্দ না করে চুপচাপ বেরিয়ে যায়, যেমন শব্দহীন এসেছি সেভাবেই। দোতলার করিডোরের শেষ মাথায় একটা খোলা বারান্দা আছে। নিঃশব্দে এখানে এসে দাঁড়ায় সে। চোখের পানি তার আপনা-আপনিই বইছে, তাদের আজ আর অনুমতির প্রয়োজন নেই। শব্দ করতে চায় না বলে বারান্দার গ্রীল ধরেছে শক্ত বাঁধনে। সব মিথ্যে, সব। তার দেখা, জানা সব মিথ্যে। তার জানা মানুষটাও। অনুভূতিগুলোও মিথ্যে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

সাবার ঠোঁট রওনকের ঠোঁট স্পর্শ করার আগেই নিজের ঠোঁটের আগে হাত তুলে ধরে সে। যার ফলে সাবার বাড়িয়ে দেয়া ঠোঁট আর রওনকের ঠোঁটকে স্পর্শ করতে পারে না, তার হাত স্পর্শ করে। একমুহূর্ত সময় নিয়ে সাবাকে পেছন দিকে ধাক্কা দেয়। আচমকা ধাক্কাটা আসায় তাল সামলাতে না পেরে পেছন দিকে ছিটকে পরে সাবা।

-রওনক!

আচমকা ধাক্কায় চেঁচিয়ে ওঠে সাবা। রওনক এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। বড় করে নিঃশ্বাস নেয় সে। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। সাবা এখনো ফ্লোরেই বসে আছে। রওনক এগিয়ে এসে সাবার সামনে বসে খানিকটা তার দিকে ঝুঁকে তবে সতর্ক দূরত্ব বজায় রেখে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

-অনেকক্ষণ ধরে তোমার বুলশীট শুনতেছি কিন্তু কেনো শুনতেছি নিজেও জানি না। মেবি আমার বৌয়ের জন্য। চন্দ্র আমার লাইফে আসার পর থেকে আমার পেশেন্সের লেভেল বেড়ে গেছে বলতেই হয়। কিন্তু আমার বৌকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সেটা আবার আমার সহ্য হয় না। সো ইউ বেটার ফা ক অফ বিফর আই ডিস্ট্রয় ইউ। আমাকে মেয়েদের সম্মান করতে শিখানো হয়েছে নাহলে এক্ষুনি এখানেই তোমাকে থাপড়ে মে রে ফেলতাম আর কেউ টেরও পেত না। তোমার মতো মেয়েকে চুটকি বাজিয়ে গায়েব করে দেয়াটা আমার জন্য কোনো বড় বিষয় নয় কিন্তু আমার চন্দ্র জানতে পারলে কষ্ট পাবে তাছাড়া আমার মা আমাকে এই শিক্ষা দেয়নি সেজন্য এই যাত্রায় বেঁচে যাচ্ছো তবে এটাই লাস্ট, গেট দিজ ইন ইউর স্মোল হেড। নাও গেট লস্ট বিফর আই চেঞ্জ মাই মাইন্ড।

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রওনকের শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে সাবা। তার দৃষ্টিতে ভয় স্পষ্ট। মুখে স্বীকার না করলেও এই রওনককে সে ভয় পায়। সাবা উঠে যাবার আগে রওনক আরও বলে,

-আগেও বলছি আবারও বলছি এরপর যেনো তোমাকে আমার বৌ বা আমার আশেপাশেও না দেখি। আই সোয়ার সাবা আই ইউল ডিস্ট্রয় ইউ উইথ মাই ওন হ্যান্ডস। নাও গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম।

একমুহূর্ত সময় না নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সাবা। এত অপমানে শোধ সে নিবেই। একটা রাস্তার মেয়ের জন্য তাকে অপমান করা কিছুতেই হজম করবে না সে। সময় মতো ঐ পরিচয়হীন রাস্তার মেয়েটাকে সে নিজের পথ থেকে ঠিকই সরাবে। রওনককে সে নিজের করেই ছাড়বে। দাঁতে দাঁত চেপে রওনকের ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। এক্ষুনি কিছু বললে সেটা তার নিজের দিকেই ব্যাকফায়ার করবে তাই কিছু না বলেই বেরিয়ে যায় সে।

চিত্রলেখা কোথায় আছে দেখার জন্য বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে আসতেই সেন্টার টেবিলে থাকা নাস্তার ট্রে দেখে রওনকের বুঝতে অসুবিধা হয় না তার চন্দ্র এসেছিল। নিশ্চয়ই কিছু দেখছে সে। হয়ত তাকে ভুল বুঝেছে। ভুল বুঝাটাই স্বাভাবিক। চিত্রলেখাকে খুঁজতে নিচে যায় সে। ড্রইং রুম, কিচেন কোথাও খুঁজে পায় না তার চন্দ্রকে। জাহানারা, তানিয়া এমনকি মীম, মিশকাতকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারে না। চিত্রলেখাকে ফোন করতে নিজের মোবাইল হাতে নেয়ার জন্য প্যান্টের পকেটে হাত দিতে দেখে তার মুঠো ফোনটা সঙ্গে নেই। তাই নিজের মোবাইল ফোন আনতে আবার উপরে চলে আসে সে। নিজের ঘরে ঢুকার আগে রওনকের খেয়াল হয় একটা জায়গা আছে যেখানে হয়ত সে তার চন্দ্রকে পেতে পারে। এর আগেও বেশ কয়েকবার চন্দ্রকে ওখানে দেখেছে সে। দেরি না করে করিডোরের শেষ মাথায় থাকা বারান্দার দিকে পা পাড়ায়। বারান্দার দরজায় এসে চিত্রলেখাকে দেখতে পেয়ে নিঃশব্দে দাঁড়ায় সে। একমুহূর্ত সময় নেয় চন্দ্রকে বুঝতে। কতটুকু ভেঙে পড়েছে সে সেটা বুঝতে।

নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ব্যস্ত চিত্রলেখা আচমকাই থেমে যায় পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। তৎক্ষণাৎই পেছন ঘুরে দেখার চেষ্টা করে না তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে। বরং পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেনো বুঝতে না পারে তাই খুব সাবধানে হাত তুলে নিজের গাল পেয়ে পরা পানি আঙ্গুলের টানে মুছে ফেলে। এক্ষুনি নিজের চোখের পানি কাউকে দেখাতে চায় না সে।

খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। চিত্রলেখার পেটের কাছে ফাঁক গোলে হাত বাড়িয়ে পেটের কাছটায় জড়িয়ে ধরেছে সে। মুখ নামিয়ে চিত্রলেখার কাঁধে চিবুক রাখে। কেবল রওনকের নিঃশ্বাস শুনতে পায় চিত্রলেখা। কথা বলে না দু’জনের একজনও। চিত্রলেখা পরপর কয়েকবার ঢোক গিলে ধৈ ধৈ করে বুকে চিড়ে বেরিয়ে আসা কান্না গিলে ফেলার চেষ্টা করে। পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে যেনো অযাচিত অশ্রু এসে ভীড় না জমায়। এইমুহূর্তে কেঁদে ফেলে ভেঙে পড়তে চায় না সে। ভাঙতে রাজি সে তবে এক্ষুনি নয়। বেশখানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিস্তব্ধতাদের ছুটি দিয়ে রওনক বলে,

-প্রতিবাদ না করে, নিজের হক আদায়ে মজবুত না থেকে আড়ালে এসে চোখের পানি ফেললে হবে? নিজেরটার তোমাকেই ধরে রাখতে হবে। তুমি হাল ছেড়ে দিলে অন্যকেউ তোমাকে ঠেলে আগে চলে যাবে। তোমারটা তোমার থেকে কেঁড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে।

আগের চাইতে আরেকটু বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে তার চন্দ্রলেখাকে। রওনকের কথা শুনেই ঝড়ঝড় করে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় চিত্রলেখা। নিজেকে সামলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেসব বিফলে যায়। চেষ্টা করেও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। চিত্রলেখার কান্নার শব্দ না হলেও শরীরের কাঁপুনি ঠিকই টের পায় রওনক। প্রিয়তমা কাঁদছে সেটা জানার জন্য নিজ চোখে দেখতে হয় না তাকে, এমনকি তার কান্নার শব্দও শুনতে হয় না। চিত্রলেখা কেন্দ্রীক সবকিছু অনুভব করতে পারে সে। রওনক নিজেই বলতে থাকে,

-আমাকে আর চন্দ্রলেখা ব্যাতিত কেউ ছুঁয়ে যাবে সেটা আমি এলাও করব ভাববে কীভাবে? ওখানেই মে রে হাড্ডি গুড়া করা ফেলবো। আমি শুধু আমার চন্দ্রের। আমাকে ছুঁয়ে দেয়ার, ভালোবাসার একমাত্র দাবিদার আমার চন্দ্র। পালিয়ে এলে কেনো? আমার উপর ভরসা নেই? আমাকে বেঈমান মনে হয়? তোমাকে ঠকানোর কথা আমি ভাবতেই পারি না, ট্রাস্ট মি। আমার জন্য তুমি কাঁদবে সেটা আমি মানতেই পারব না।

চিত্রলেখার কাঁধের উপরে থাকা চুল একপাশে সরিয়ে সেখানে আলতো স্পর্শে চুমু খায় রওনক। কোমড় জড়িয়ে প্রিয়তমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার গাল বেয়ে পরা অশ্রুদের ঠোঁটের স্পর্শে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। চিত্রলেখার ঠোঁটের একদম কাছাকাছি গিয়ে চোখের চোখ রেখে বলে,

-ট্রাম মি বৌ, আই লাভ ইউ মোর দ্যান মাই লাইফ।

চিত্রলেখাকে এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে তার কাঁপতে থাকা ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের দখলে নিয়ে নেয় সে। প্রিয়তমাকে বুঝাতে চেষ্টা করে তার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। চিত্রলেখার কান্নার গতি বাড়ে। একটুর জন্য ভেবেছিল মানুষটাকে বুঝি সে হারিয়ে ফেলেছে। প্রতারিত হওয়ার চাইতে মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয় যেনো বেশি ঝেঁকে বসেছিল তাকে। কিন্তু মানুষটা তাকে ভালোবাসে, তার সব দিয়ে ভালোবাসে। সময় বিলম্ব না করে চিত্রলেখা নিজেও হাত বাড়িয়ে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরে। তার ঠোঁটের ছন্দে তাল মেলায়। একে-অপরকে সঙ্গ দিয়ে ভালোবাসার সঙ্গীতে নতুন সুর তুলতে ব্যস্ত দু’জনে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে