মাতাল হাওয়া পর্ব-১২+১৩

0
526

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বারান্দার গ্রীল ধরে বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। শব্দহীন হেঁটে এসে বোনের পাশেই দাঁড়ায় চারু। বোনের দৃষ্টি লক্ষ করে গেইটের দিকে তাকিয়ে তার কাঁধে হাত রাখতে রাখতেই বলে,

-ঘটনা কি বলো তো আপা?

আচমকা চারুর কন্ঠ পেয়ে ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। তা দেখে অবাক হওয়া কন্ঠে চারু আবার জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো আপা? এমন ভয় পাইলা কেন?

-কিছু না, তুই ভূতের মতো আইসা ঘাড়ের উপর দাঁড়ালে ভয় পাবো না?

-আমি কখন তোমার ঘাড়ে উঠলাম! আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বলো তো ক্যাসটা কি?

-কিসের ক্যাস?

-এই যে এত বড় একজন মানুষ নিজে এসে তোমাকে বাসায় দিয়ে গেল। আসল ঘটনা কি বলো তো?

চারুর মাথায় একটা গাট্টা মে রে চিত্রলেখা বলে,

-একদম আমার সাথে পাকা পাকা কথা বলবি না চারু।

মাথা ঢলতে ঢলতে চারু বলে,

-মা র লা কেন আপা?

-এখন মাথায় মা র ছি ছোট করে। এরপর পাকনামি করলে মে রে হা ড্ডি গু ড্ডি ভেঙে ফেলবো। যা ঘরে যা। আমি গোসলে যাচ্ছি এক কাপ লাল চা বানায় দে।

চিত্রলেখা ঘরে যাওয়ার জন্য এক কদম বাড়িয়েও থেমে যায়। চারু দু’হাত মেলে পথ আটকে বলে,

-মা র ছো, মা র খাইছি এখন জবাব দিয়ে যাও।

-কিসের জবাব?

-লোকটা তোমায় বাসায় দিতে আসলো কেন?

-আমি অসুস্থ তাই দিতে আসছে। কি সব আজব প্রশ্ন করতেছিস চারু? আর লোকটা কি? উনার একটা নাম আছে। অন্তত স্যার ডাকতে পারিস।

-সে তোমার স্যার আমার না। ডাকাডাকি বাদ দাও, অফিসের অন্য সবাই অসুস্থ হলেও কি উনি এভাবে পার্সোনালি বাসায় দিয়ে আসে?

-আবার মা র খাবি আলতু ফালতু কথা বললে। উনি কোম্পানির মালিক, সিকিউরিটি গার্ড না যে সবাইকে বাসায় পৌঁছে দিবে।

-কাউকে বাসায় পৌঁছে দেয়া সিকিউরিটি গার্ডের কাজ না আপা। কিন্তু তুমি যাই বলো না কেন আমার মনে হয় তোমার বস শুধু তুমি বলেই বাসায় দিয়ে গেল, অন্যকেউ হলে দিয়ে যাইতো না।

-প্লিজ চারু এখন তুই তোর খেয়ালি পোলাও রান্না করতে শুরু করিস না। মূলত আমি উনার সামনে অসুস্থ হইছিলাম। উনি জানতো না আমার ফোবিয়ার কথা। জোর করে লিফটে নিয়ে গেছিল তাই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। এইজন্যই মনে হয় উনার আমার জন্য খারাপ লাগছে, হয়ত গিল্ট ফিল করছেন তাই বাসায় দিয়ে গেল।

-না রে আপা, এটা শুধু গিল্ট ফিল না। তোমার বস যেমনে তোমার দিকে তাকাইলো, তারপর ঔষধ এনে দিলো এতে পরিষ্কার বুঝা যায় উনি…

চিত্রলেখা চারুর মুখ চেপে ধরে বাঁধা দিয়ে বলে,

-চুপ, একদম চুপ। তুই এক্ষণ আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হবি।

দু’বোনের বাকবিতন্ডার মধ্যেই বাসার গেটটা খোলার শব্দ হতেই দু’জনে সেদিকে তাকায়। মামুন দরজা দিয়ে ঢুকছে। তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মামুনকে দেখে চারু নিজের মুখের থেকে বড়বোনের হাত সরিয়ে বলে,

-ঐ নেও তোমার মজনু চলে আসছে।

-একদম বাজে বকবি না বলছি।

কড়া করে ধমকে ওঠে চিত্রলেখা চারুকে। ততক্ষণে ওদের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে মামুন। কাছে এসে এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে,

-এখন শরীর কেমন মায়া?

-মামুন ভাই কতদিন না বলেছি আপনাকে আমার নাম মায়া না চিত্রলেখা।

-দুনিয়ার জন্য তুমি যাই হও আমার জন্য তুমি মায়া, আমার মায়া।

চিত্রলেখার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। সে নিজেও বুঝে মামুন নামক মানুষটা তার সবটুকু বিশুদ্ধতা দিয়ে তাকে ভালোবাসে, চায়। এই মানুষটার ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার অপারগতায় চিত্রলেখার মাথা নুইয়ে আসে।

-আপনার হাতে মিষ্টি কেন মামুন ভাই?

মামুনের হাতে মিষ্টি দেখে জানতে চায় চারু। মুখের হাসি প্রশস্ত করে মামুন বলে,

-মিষ্টি নিয়া আসছি মায়ার জন্য।

-কিন্তু মিষ্টি কোন খুশিতে?

-খুশিতে না তো অসুখে। মায়ার শরীর খারাপ তাই নিয়া আসলাম।

-ওমা এটা কেমন কথা মামুন ভাই? মানুষ অসুস্থ মানুষ দেখতে গেলে ফল নিয়ে যায় আর আপনি আসছেন মিষ্টি নিয়ে!

-যার জন্য আনছি তার পছন্দকেও তো প্রাধান্য দিতে হবে নাকি? আমি জানি তো মায়া ফল তেমন একটা পছন্দ করে না। ফলের মধ্যে ঐ এক আমটাই খায় সে। এটা তো আমের সিজন না। তাই মায়ার পছন্দের রশমালাই নিয়া আসলাম।

-আপনি আপার পছন্দ অপছন্দ সব জানেন তাই না মামুন ভাই?

জিজ্ঞেস করে চারু। হাসি হাসি মুখ করে মামুন বলে,

-যাকে ভালোবাসি তার পছন্দ অপছন্দ না জানলে আর কি ভালোবাসলাম?

মামুনের কথাকে আর প্রশ্রয় না দিয়ে এবারে চিত্রলেখা বলে,

-মামুন ভাই কষ্ট করে আসছেন এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। চারু বানিয়ে দিবেন আপনি ভেতরে এসে বসেন। আমার একটু বিশ্রাম দরকার পরে নাহয় কথা হবে আমাদের।

মিষ্টির প্যাকেটটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে মামুন বলে,

-না না আজকে আমি বসবো না। তুমি সুস্থ হও আরেকদিন নাহয় তোমার হাতে চা খাবো। আজকে আমার কাজ আছে।

-আপনার আবার কিসের কাজ? আপনি কোনো কাজ করেন নাকি?

কথাটা বেফাঁস বেরিয়ে যায় চারুর মুখ গলে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার জিহ্বা কাটে সে। চিত্রলেখা চোখ পাকিয়ে তাকায়। মাথা নিচু করে রেখে মামুনের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নেয় চারু। হাসি হাসি মুখ করে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে মামুন বলে,

-আজ আসি মায়া।

-আসুন মামুন ভাই।

চিত্রলেখা আর অপেক্ষা করে না। ভেতরের দিকে যেতে যেতে বলে,

-আমার জন্য এক কাপ লাল চা বানিয়ে দে চারু। সঙ্গে একমুঠ চালও ভেজে দিস তো। চাল ভাজা দিয়ে লাল চা খেতে মন চাইছে। আমি গোসলে যাচ্ছি, এরপর ঘুমাবো। ঘুমানোর আগে চা খাবো। জলদি কর হা করে দাঁড়িয়ে থাকিস না।

বড় বোনের বলে যাওয়া কথা কান দিয়ে শুনলেও চারু তাকিয়ে থাকে মামুনের চলে যাওয়ার পথে। কি মায়া মানুষটার মধ্যে! কত মায়া নিয়ে ভালোবাসে সে চিত্রলেখাকে। বোনের প্রতি মামুনের ভালোবাসা দেখলে চারুরও মায়া হয় মানুষটার জন্য। বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে ওঠে। চিত্রলেখা যদি কোনোদিন মামুনের ভালোবাসা গ্রহণ না করে তাহলে কী হবে মানুষটার? আনমনে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে চারু৷ অজানা কষ্ট হয় তার মামুনের জন্য। সবার ভালোবাসায়ই কি এত কষ্ট মিশে আছে? পৃথিবীর সব ভালোবাসাই কি যন্ত্রণা দেয়?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সবেই বৃষ্টিদের বাসায় এসে বসেছে লিখন। এখনো ঠিকঠাক পড়ানোও শুরু করতে পারেনি। এরমধ্যেই চারু ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছে। বড়বোনের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। মেসেজটা পেয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লিখন চিন্তিত মুখে। তা দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে?

-আজকে পড়াইতে পারবো না বৃষ্টি। বাসায় যাইতে হবে এক্ষুনি। খালাম্মাকে বইলো কাল পড়ায় দিবো।

-কিন্তু হঠাৎ কি হইছে সেটা তো বলবেন নাকি?

-আপার নাকি শরীর ভালো না। ওর ফোবিয়া আছে, এট্যাক হইছে। আমাকে এখনই বাসায় যাইতে হবে।

লিখনকে ব্যস্ত হতে দেখে বৃষ্টি ধমকের সুরে বলে,

-চুপচাপ এখানে বসেন।

-আজকে পড়াইতে পারবো না বৃষ্টি।

-পড়াইতে হবে না। এখানে বসে থাকেন। আমি না আসা পর্যন্ত নড়বেন না।

বৃষ্টি তৎক্ষনাৎ ভেতরে গিয়ে একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে লিখনের সামনে রেখে বলে,

-শান্ত হয়ে পানিটা খান।

-পানি খাওয়ার সময় নাই বৃষ্টি। আপা অসুস্থ।

-জানি আপা অসুস্থ। কিন্তু আপনি যা শুরু করছেন এভাবে বাসায় গেলে আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। তখন আপনাকে কে দেখবে? আপনি চুপচাপ শান্ত হয়ে পানিটা খান আমি আসতেছি।

লিখনকে পানি খেতে দিয়ে আবার ভেতরে চলে যায় বৃষ্টি। মিনিট দু’য়েক পড়ে ঠিকঠাক ভাবে ওড়না মাথায় দিয়ে ফিরে আসে। এসেই লিখনকে জিজ্ঞেস করে,

-এখন ঠিক আছেন আপনি?

থমথমে মুখ করে লিখন বলে,

-এখন বেটার লাগছে।

-তাহলে চলেন।

-কোথায়?

-আপনার বাসায় আর কোথায় যাবেন?

-আমি তো বাসায় যাবো কিন্তু তুমি কই যাবা?

-আমিও আপনার বাসায় যাবো, আপাকে দেখতে। এখন কথা বলে সময় নষ্ট না করে চলেন তো।

-কিন্তু খালাম্মা?

-আম্মুকে বলে আমি অনুমতি নিয়ে নিছি।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। বৃষ্টিকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি নামক ছোট মেয়েটা বড়দের মতো শাসন করে তাকে। ঠিক যেন প্রেমিকার মতো। বৃষ্টি মেয়েটার আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা সব কিছু অন্যদের খুব সহজেই মুগ্ধ করতে সক্ষম। যদিও লিখন কোনোদিন বৃষ্টিকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেনি। একদম বউ ম্যাটেরিয়াল একটা মেয়ে। যার জীবনে যাবে তার জীবনটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিবে সুখ-শান্তিতে।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়েই লিখন রিকশা ডাকে। তা দেখে বৃষ্টি বলে,

-এইটুকু রাস্তা যেতে রিকশা লাগে নাকি? হেটেই তো যেতে পারবো।

-হেঁটে যাইতে হবে না। চলো রিকশায় যাই।

বুকের ভেতর অদৃশ্য শব্দ হয় বৃষ্টির। রিকশায় উঠে বসতেই বুকের ভেতরে হু হু করে বৈতে শুরু করা বাতাস যেন ক্রমশ তুফানে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রিয় মানুষের গা ঘেষে রিকশায় বসার প্রথম অনুভূতি বৃষ্টিকে সর্গীয় সুখ দেয়। লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসতে চায়। লিখনের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না ওর। রাস্তায় থাকা কুকুরের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আচমকা লিখনের কথায়, কর্মে ভাবনায় ছেদ পড়ে বৃষ্টির। লিখন আচমকা বৃষ্টির হাত ধরে বলে,

-সামনের রাস্তা ভালো না, ভাঙা। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বসো নাহলে পড়ে যাবা।

চমকে গিয়ে লিখনের মুখের দিকে তাকায় বৃষ্টি। কিন্তু নিজের চমকে যাওয়াটা এই মুহূর্তে লিখনের কাছে প্রকাশ করে না ও। সবসময় অল্পে সন্তুষ্ট থাকা বৃষ্টি কখনোই ভাবেনি একসাথে এত সুখানুভূতি এসে তার হাতে ধরা দিবে। অতিরিক্ত সুখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তা টের পেয়ে লিখন বলে,

-তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন বৃষ্টি? জ্বরটর আসবে নাকি?

মাথা ঝাঁকায় বৃষ্টি। লিখন সামনের দিকে তাকায়। তাই হয়ত লক্ষ করে না বৃষ্টি তার একবুক ভালোবাসা নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছি।

চারু চা আর চাল ভাজা নিয়ে ঘরে এলে চিত্রলেখা বলে,

-শুন চারু লিখনকে কিছু জানাইস না। একবারে বাসায় আসলে বলবোনি। ততক্ষণে ঘুম দিয়ে উঠলে আমি আরও সুস্থ হয়ে যাবো।

চারু এগিয়ে এসে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-নেও, মা রো।

-ঢং করতেছিস কেন? তোরে মা র বো কেন আমি?

-ভাইয়াকে অলরেডি জানায় দিছি।

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত দিয়ে ছোট বোনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আল্লাহ তোরে এত কম ধৈর্য্য কেন দিছে রে? কতদিন বলছি কিছু একটা হইলেই ফট করে সবাইকে বলে দিবি না।

-ওমা আপা! তুমি অসুস্থ এই কথা আমি ভাইয়াকে জানাবো না? পরে ভাইয়া বো ক বে আমাকে কেন জানাই নাই তারে।

-ব ক লে আমি ওরে ব কে দিতাম।

আসামীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে চারু। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চিত্রলেখা আরও বলে,

-এখন বিদায় হ চারু আমি ঘুমাবো।

তবুও যায় না চারু। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে চিত্রলেখা আবার বলে,

-দাঁড়ায় আছিস কেন? যাইতে বললাম না তোরে?

এগিয়ে গিয়ে বোনের গা ঘেষে বসে বলে,

-তোমার মাথার চুল নেড়ে দেই আপা?

-যাবি না তাই তো?

মাথা ঝাঁকায় চারু। তা দেখে চিত্রলেখা বলে,

-আচ্ছা চিরুনি নে, চুল আঁচড়ে দে। কিন্তু কোনো কথা বলবি না। এমনি মাথা ভাড় হয়ে আছে। তোর আজাইরা বকবকানি শুনতে মন চাচ্ছে না।

-আচ্ছা কথা বলবো না।

দু’বোনের কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি সমেত বাসায় এসে উপস্থিত হয় লিখন। এগিয়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-কি হইছে আপা তোর?

-আরে কিছু হয় নাই। আমি ঠিক আছি।

রাগি রাগি চোখ করে চারুর দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তখনই পাশ থেকে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-এখন তোমার কেমন লাগছে আপা?

হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-একদম ঠিক আছি। তুই কষ্ট করে আসতে গেলি কেন রে বৃষ্টি?

-ওমা তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে দেখতে আসবো না তা হয় নাকি?

চিত্রলেখা বৃষ্টিকে আলতো করে জড়িয়ে রেখে চারুকে বলে,

-যা বৃষ্টির জন্য মিষ্টি নিয়ে আয়।

বৃষ্টি চারুর হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলে,

-আপা আসো আমি তোমার চুল আঁচড়ে দেই।

বৃষ্টি ও নাঈমকে কয়েক বছর ধরে পড়ানোর সুবাদে বৃষ্টির এই বাড়িতেও আসা যাওয়া আছে। একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।

—————————————————————————–

রওনক নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তানিয়া। কাছাকাছি এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে,

-ব্যস্ত নাকি?

ল্যাপটপটা বন্ধ করে রওনক বলে,

-সামান্য। কিছু বলবে নাকি?

-আজ সারাদিন অফিসে ছিলে না। কোথায় গিয়েছিলে?

-একটু কাজ ছিল বাইরে।

-সেটা জানি তোমার একটা মিটিং ছিল। মিটিংয়ের পরে তো আর অফিসে ফিরলে না।

-কোনো জরুরী দরকার ছিল নাকি?

-কিছু ডকুমেন্ট দেখানোর ছিল। মেইল করে দিয়েছি চেক করে নিও।

-ঠিক আছে দেখে নিবো।

তানিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় রওনক। বলে,

-আর কিছু বলবা?

-সারাদিন কই ছিলা তুমি?

-একটু কাজ ছিল বাইরে বললামই তো।

-কি কাজ?

-পার্সোনাল কাজ।

-এত বছরে প্রথম শুনছি রওনক জামান অফিস আওয়ারে পার্সোনাল কাজে বাইরে গেছে। কি এমন পার্সোনাল কাজ জিজ্ঞেস করতে পারি কি?

-আপাতত থাক ভাবী। বলার হলে পরে কোনো এক সময় বলবো নাহয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে। অপেক্ষায় থাকলাম।

এগিয়ে এসে রওনকের মুখোমুখি বসে তানিয়া। রওনক বুঝতে পারে তানিয়া হয়ত আরও কিছু বলতে চায়। তা আন্দাজ করে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চাও।

মাথা ঝাঁকায় তানিয়া। তা দেখে রওনক বলে,

-আজ কি কথার ঝুলি নিয়ে এসেছো নাকি? বলো আর কি বলবা।

-আম্মার সাথে কথা বলছো?

-কোন বিষয়ে?

-তোমার আর সাবার বিষয়ে।

-সাবার সাথে আমার আবার কিসের বিষয়?

-বুঝেও কেনো না বুঝার ভান করতেছো রওনক? আমি তোমাদের বিয়ের কথা বলতেছি।

-যা বলার সেটা তো আমি সবার সামনেই বলছি ভাবী। এরপরে কি আর কোনো কথা থাকতে পারে?

-কিন্তু রওনক আমারও মনে হয় তোমার এবার বিয়েটা করে নেয়া উচিত।

-আবার বিয়ে!

-শুনো রওনক, মানুষের জীবনে একবারই বিয়ে হয় এটা একটা লেইম লজিক। প্রয়োজন হলে মানুষ দু’বার বিয়ে করবে এতে তো দোষের কিছু নেই।

-আমিও দোষের কথা বলছি না ভাবী। কিন্তু আমার তো প্রয়োজন নেই।

-একটা মানুষ সারাজীবন একা থাকতে পারে না রওনক।

-আপাতত আমার সমস্যা হচ্ছে না ভাবী। যদি পরে মনে হয় বিয়ে করা প্রয়োজন তাহলে করে নিবো। এখন তো প্রয়োজন দেখছি না।

-তোমার এখন প্রয়োজন না মনে হলেও আমাদের মনে হয় এটাই উপযুক্ত সময় রওনক।

-ভাবী প্লিজ! আই রিকুয়েষ্ট টু ইউ, এখন তুমিও মায়ের মতো শুরু হয়ে যেও না। বিয়ের বিষয়টা কয়দিনের জন্য সাইডে রাখো প্লিজ।

-অনেক তো সাইডে রাখলাম আর কত?

-আরও কয়টা দিন প্লিজ।

-মনে হয় না এবার তুমি আর বিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে।

-কেন?

-আম্মার সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার আর?

-না তো।

-উনি কিন্তু খাওয়া দাওয়া করছেন না ঠিক মতো।

-ভাবী তুমি একটু মাকে বুঝাও। বলো এসব বাচ্চামো ছেড়ে দিতে। আমি বাচ্চা না যে আমাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে। বিয়ে করতে বলবে আর আমি লাফিয়ে বিয়ে করতে চলে যাবো। বিয়েটাই জীবন নয়।

-আমি একটা এডভাইস দেই রওনক?

-বলো শুনছি।

-তুমি যদি একান্তই সাবাকে বিয়ে করতে না চাও তাহলে নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে পারো। যদি তোমার নজরে এমন কেউ থাকে তাহলে তাকেই নাহয় বিয়েটা করে ফেলো। কিন্তু এবার তোমাকে বিয়ে করতেই হবে। সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে তোমার বিয়ে। আম্মা চায় তুমি বিয়ে করো। বিয়েটাই জীবন নয় তবে বিয়ে জীবনের অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট। যা চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

-কিন্তু মা চায় আমি সাবাকে বিয়ে করি।

-তুমি যার সাথে ভালো থাকবে আম্মা তাকেই মেনে নিবে দেখে নিও। আম্মার জন্য তুমি সবচাইতে বেশি জরুরী, সাবা না।

উঠে দাঁড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে তানিয়া রওনকের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো। এই সমস্যার এবার একটা সমাধান হওয়া প্রয়োজন রওনক।

রওনককে তার ভাবনার হাতে ফেলে সন্তপর্ণে বেরিয়ে যায় তানিয়া। ভাবী বেরিয়ে যেতেই উঠে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জ্বালায় সে। সিগারেটটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে ট্রাউজারের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আজ সকালে চিত্রলেখার তোলা একটা ছবি বের করে। হাসপাতালের বেডে চিত্রলেখা যখন বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে ছিল তখন এই ছবিটা তুলেছিল রওনক। কেন তুলেছে তা সে নিজেও জানে না। চিত্রলেখার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে সিগারেটে লম্বা করে আরেকটা টান দিয়ে তানিয়ার বলে যাওয়া কথা ভাবতে লাগে। তার নিজের পছন্দের কেউ কি আছে? আবার কি সে কাউকে পছন্দ করতে পারবে? ভালোবাসতে পারবে? ভালোবাসা কি বসন্তের মতো নাকি? বছর ঘুরে যেমন বসন্ত আসে তেমনি কি মানুষের জীবন থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গেলে আবারও নতুন করে ভালোবাসা আসে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে