মরীচিকাময় ভালোবাসা পর্ব-১৬

0
778

#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৬(বোনাস পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মৌরী তার কোম্পানিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। গত কয়েক মাস থেকে সে৷ নিজের বাবার কোম্পানি সামলাচ্ছে। মূলত দুই মাস আগে আজাদ চৌধুরীর হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপর থেকে ডাক্তার তাকে রেস্টে থাকতে বলায় বর্তমানে মৌরীকে সব কিছু সামলাতে হচ্ছে।

এই ৫ বছরে মৌরীর মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তরুণী থেকে যুবতীতে পরিণত হয়েছে। আগের থেকেও তার সৌন্দর্য যেন আরো বেশি পরিমাণে ফুটে উঠেছে। তবে মৌরীর ব্যক্তিত্বেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের থেকেও বেশি দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে সে। সাথে হয়ে উঠেছে অনেক কঠোর। আগের নমনীয়তা তার মধ্যে লেশমাত্র নেই।

কোম্পানিতে যাওয়ার আগে আজাদ চৌধুরীর সাথে দেখা করে নিলো মৌরী৷ আজাদ চৌধুরী মৌরীকে শুধালেন,
“সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো?”

“জ্বি, আব্বু। কোম্পানির সব ঠিকঠাকই চলছে।”

“আর তোমার জীবন?”

“আমার জীবনও ঠিকঠাক।”

“দেখ, আমি তোর বাবা হই। তাই তোর ভালোই চাইব। তুই কেন আর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিস না বল তো?”

“আমার জীবন কোথায় পিছিয়ে আছে আব্বু? একটা মেয়ে কি বিয়ে না করে আজীবন কা’টাতে পারে না?”

এমন সময় আতিফা বেগম সেখানে উপস্থিত হন। আজাদ চৌধুরীর ডাকেই এসেছিলেন তিনি। আতিফা বেগম বলে ওঠেন,
“না। এভাবে জীবন কা’টানো যায়না৷ অতীতে তোর সাথে খা’রাপ হয়েছে জন্য যে ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে না এমন তো নয়। আমি কোন কথা শুনব না। এই ৫ বছর আমরা তোর কথা শুনেছি এবার তুই আমাদের কথা শোন। আমি তোর জন্য ছেলে দেখা শুরু করছি। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমি তোর বিয়ে দিবো।”

“তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।”

বলেই মৌরী হনহন করে বেরিয়ে আসে। এইসব বিয়েশাদিতে আর মোটেই ইন্টারেস্ট নেই। আজকাল তো বিয়ের কথা শুনলেই মাথায় রাগ ওঠে।

মৌরী চলে যেতেই আজাদ চৌধুরী আতিফা বেগমকে জিজ্ঞেস করেন,
“আচ্ছা প্লাবণের কি খবর? ও কি জীবনে আর এগোনোর কথা ভাববে না?”

আতিফা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“ওর কথা তো তুমি জানোই। সেই একই জেদ নিয়ে পড়ে আছে। ও নাকি আজীবন একাই থাকবে।”

“আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ওদের ডিভোর্সটা না হলেই ভালো হতো।”

“এমনটা ভেবো না। যা হয়েছে একদম ঠিক হয়েছে। প্লাবণ যা কিছু করেছিল তারপর যদি মৌরী ওর সাথে জীবন কা’টানোর সিদ্ধান্ত নিত সেটা মোটেই ঠিক হতো না৷ তার থেকে ভালো ওরা আলাদা হয়ে গেছে। আসলে কি বলো তো সবার কর্মফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। এই যেমন দেখো তোমার ভাইয়াকে। লোকটা প্রতিদিন অনুশোচনা আর গ্লানিতে গুমরে গুমরে ম’রে। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখও ওনার নেই।”

“তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলো ভাবি। আমি চাই না এই দূরত্ব বজায় রাখতে। তাছাড়া, আমরা আর ক’দিনই বা বাঁচবো বলো। এই ক’দিনের দুনিয়ায় এসব ঝামেলা রেখে কি লাভ?'”

“ঠিকই বলেছ তুমি। ঝামেলা মিটিয়ে নিয়ে আমাদের পরিবার এক হয়ে যাক। ছেলে মেয়ে দুটো নিজেদের জীবনে এগিয়ে যাক এটাই এখন চাওয়া।”

___________________________
নিজেদের হাতঘড়ির দিকে বিরক্তির সাথে তাকিয়ে আছে প্রত্যুষ। সাথে ভীষণ রাগও হচ্ছে। প্রত্যুষ সব ক্ষেত্রে বড্ড খুতখুতে। বিশেষ করে সময়ের ব্যাপারে। কেউ পাংচুয়ালিটি মেইনটেইন না করলে সেটা একদম ভালো লাগে না প্রত্যুষের। আর আজ তাকে সেইটারই ফেস করতে হচ্ছে। চৌধুরী এন্টারপ্রাইজে এসে মৌরী চৌধুরীর জন্য অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করে চলেছে সে। কিন্তু তার আসার কোন নাম নেই। প্রত্যুষ এবার বিরক্ত হয়ে তার সেক্রেটারিকে বলে,
“ওনাদের কাছে খোঁজ নাও তো আর কতক্ষণ সময় লাগবে। মিটিং ১০ টার সময় হওয়ার কথা ছিল আর এখন ১০ঃ১৫ বাজে। তুমি খুব ভালো করেই জানো এসব আমার একদম পছন্দ নয়।”

“স্যার ওনারা আর ৫ মিনিট ওয়েট করতে বলেছেন।”

“তখন থেকে তো এটাই শুনে আসছি। এই জন্যই আমার কোন মেয়েদের সাথে মিটিং করতে ইচ্ছা করে না। এনারা সাজতে গুজতেই অর্ধেক সময় পার করে দেন তো কোম্পানি আর কি সামলাবে!”

“ইউ আর রংগ মিস্টার প্রত্যুষ খান। মেয়েরা যেমন নিজেকে পরিপাটি ভাবে সাজাতে পারে ঠিক তেমনি ভাবে কোম্পানিও খুব সুন্দর ভাবে সামলাতে পারে।”

প্রত্যুষ মৌরীর দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু মৌরীর দিকে তাকাতেই তার সব বিরক্তি মুগ্ধতায় পরিণত হলো। মৌরীর ডাগর ডাগর চোখ, সুশ্রী মুখ সব তাকে অদ্ভুত ভাবে মুগ্ধ করে। কিন্তু প্রত্যুষ খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে বলে,
“না প্রত্যুষ, নিজেকে সামলা। তোকে এমন করলে চলবে না। নারী মানেই ছলনাময়ী। তাদের দিকে তাকানোই যাবে না। তাদের এই সৌন্দর্যের পেছনে ভয়ানক রূপ লুকিয়ে আছে। যা একবার তোকে জ্বালিয়ে খাক করে দিয়েছে। আর দ্বিতীয় বার এই সৌন্দর্যের ফাদে পা দিলে চলবে না।”

এমন ভাবনা থেকে সে রূঢ় গলায় বলে,
“আপনার ১০ টায় আসার কথা ছিল৷ কিন্তু আপনি ১৫ মিনিট লেইট। আমি আপনার সাথে ডিল করার ভরসা পারছি না। এর আগেও অনেক কোম্পানির মালিকের সাথে মিটিং করেছি। কেউ আপনার মতো লেট করে মিটিং এ আসেনি।”

“দেখুন, মানুষের কোন প্রব্লেম থাকতেই পারে। আপনি যখন ১৫ মিনিট অপেক্ষা করেছেন তখন প্রেজেন্টেশন টা দেখে যান। তারপর যা বলার বলবেন।”

অতঃপর দুজনে মিটিংয়ে বসে। মৌরী তাদের কোম্পানির প্ল্যানিংটা দেখায়। প্রত্যুষের সেটা বেশ পছন্দ হয়। তবে মৌরী লেট করে আসায় সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল যে কি করবে। কিছুটা ভাবনা চিন্তা করে পরে কিছুদিন ভেবে তারপর ডিল নিয়ে কথা আগানোর কথা বলে প্রত্যুষ বিদায় নেয়।

প্রত্যুষ চলে যাওয়ার পর আজমল সাহেব আসেন মৌরীর কাছে৷ তিনি আজাদ চৌধুরীর সময়কাল থেকে কোম্পানিতে কর্মরত। আজাদ চৌধুরীর বেশ বিশ্বস্ত লোক তিনি। মৌরীকে উদ্দ্যেশ্য করে তিনি বলেন,
“তোমার একটু তাড়াতাড়ি আসার দরকার ছিল। তুমি তো জানোই এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”

“জ্বি, আঙ্কেল। আসলে আমি ইচ্ছে করে লেট করিনি। জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম।”

★★★
শামিম আজ তার বাড়িতে অনেক বড় একটা পার্টির আয়োজন করেছে। সেখানে সে ইনভাইট করেছে বিজনেস জগতের অনেক বড় বড় মানুষকে।

প্লাবণও আজ এসেছে সেখানে। যদিও আগে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু তারা এত বছরের বন্ধু যে এত সহজে নিজেদের বন্ধুত্ব শেষ করতে পারে নি৷ সব অভিমান পাশে ঠেলে এক হয়েছে আবার।

প্লাবণ শামীমকে বলে,
“তুই তো এখন বিয়ে করে ভালোই হ্যাপি আছিস।”

“আমার কথা বাদ দে। তুই নিজের কথা ভাব। আর কতদিন এভাবে একা থাকবি?”

“আজীবন।”

“এইজন্য আমি তোকে বলেছিলাম ভুল সিদ্ধান্ত নিস না। আজ জীবনে করা কিছু ভুলের জন্য এতদিন যাবৎ তোকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। মৌরীর সাথে তো তোর ডিভোর্সও হয়েছে। এখন তো আর কিছু ঠিক হবার নয়।”

“অতীতের কথা বাদ দে।”

এমন সময় সুমা সেখানে চলে আসে। তার কোলে তার এক বছর বয়সী সন্তান। প্লাবণকে দেখে সে বলে,
“কেমন আছ তুমি?”

কিন্তু প্লাবণ তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে যায়। সুমা শামিমের সামনে এসে বলে,
“আজো প্লাবণ ভাইয়া আমায় ক্ষমা করে নি। জানো তো নিজের অতীতে করা অন্যায়ের জন্য আজো আমার আফসোস হয়। হয়তো সেইজন্য আজ এত কষ্ট পাচ্ছি। আমার স্বামী আমাকে আর আমার বাচ্চাকে ফেলে অন্য নারীতে…”

“আসলে মানুষ ঠিকই বলে। পাপ কারো বাপকেও ছাড়ে না।”

“যাইহোক, এসব কিছুর মধ্যে তুমি তো মৌ ভাবিকে নিয়ে ভালো আছো। তোমার সিক্রেট লাভ।”

“হ্যাঁ, আমি সত্যি ভীষণ লাকি। আমি তো জানতাম মৌ অন্য কাউকে ভালোবাসতো হয়তো আমাকে বিয়ে করতে রাজিই হবে না। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমি প্রস্তাব পাঠাতেই রাজি হয়ে গেল।”

“হুম। ইউ আর আ লাকি ম্যান। তা আজকের মেইন গেস্ট যেন কে?”

“প্রত্যুষ খান। খান গ্রুপ অফ কোম্পানির মালিক।”

“উনি কখন আসবেন?”

“আর একটু পরেই চলে আসবে। আরে ঐ তো বল তে না বলতেই চলে এসেছেন।”

প্রত্যুষ এখানে এসেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মুখোমুখি হলো মৌয়ের। দুজনেই একে অপরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে