মন শহরে তোর আগমন পর্ব -১৩

0
1530

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ১৩

অনেক খোঁজাখুঁজি পর অবশেষে একটা মুভি ওনার মনে ধরলো, যদিও আমার ইংলিশ মুভি তেমন একটা পছন্দ না তবে আজ ওনার জন্যে দেখবো। রিমোটটা রেখেই হুট করে জাফরান আমায় টেনে এনে একদম নিজের গা ঘেঁষিয়ে বসিয়ে, সাইড হাগ করে বসলো আমায়। ওনার বলিষ্ঠ হাতজোড়ার মাঝে পড়ে যেনো পিষ্ট হয়ে যাওয়ার জো হয়েছে আমার

“আমরা তো নরমালি বসে টিভি দেখতে পারি তাইনা? আমাকে এভাবে ধরে বসার কি দরকার?”

“এভাবে থাকলে কি প্রব্লেম? দেখো ফার্স্ট টাইম আমরা একসাথে বসে মুভি দেখছি। আর আমি এখন নরমাল হাসবেন্ড এর মতোই বিহেভ করছি”

অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে, আমার কথা আমার ওপরই ভারী পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম সময় লাগবে কিন্তু উনি এখনি এতো বেশি নরমাল হবার চেষ্টা করছেন দেখে অবাক হচ্ছি আমি। একটু বাদে খেয়াল করলাম উনি আরো শক্ত করে ধরেছেন আমায়! এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না

“কি করছেন জাফরান। এতো জোরে চেপে ধরেছেন কেনো! দম বন্ধ হয়ে যাবে তো আমার”

জাফরান ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে, এরপর হাতের বাধন কিছুটা হালকা করে দিলেন, আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। লোকটার মাথায় যে হুট করে কি ভুত চেপেছে আল্লাহই জানে। প্রায় এক ঘন্টা হলো মুভি দেখছি। থ্রিলার মুভি আমার মাথায় ঢোকে না, তবুও চুপচাপ দেখছি। আরচোখে তাকিয়ে দেখলাম উনি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। কেয়ার ভিডিও কল এসেছে, কিন্তু জাফরানের আমায় ছাড়ার নাম নেই!

“এই দেখুন আমার বান্ধবীর ফোন এসেছে। এবার তো রেহাই দিন আমায় একটু”

উনি আমাকে ধরে রেখেই পূর্বের ন্যায় টিভির দিকে তাকিয়ে বললেন

“তোমার হাত তো ছাড়াই আছে, এভাবেই রিসিভ করো কল। আমাদের রিলেশনশিপ যে নরমাল হচ্ছে সেটা তো একটু একটু করে সবাইকেই জানাতে হবে। শুরুটা তোমার ফ্রেন্ডকে দিয়েই হোক”

তাজ্জব বনে গেলাম আমি, বলে কি লোকটা?

“কি আজগুবি কথা বলছেন এসব! আমি এভাবে কল রিসিভ করবো!”

উনি কোনো উত্তর দিলেন না, আমি ওনার হাত সরিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওনার শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারলাম না। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আমি, এদিকে দুই বার কেয়ার কল কেটে গেছে। রিসিভ করতে পারিনি। উনি বাকা হেসে বললেন

“বেকার কষ্ট করে লাভ নেই, আমি না ছাড়লে তুমি উঠতে পারবে না এখান থেকে। চাইলে এভাবেই কল রিসিভ করো, নাহলে কেটে দাও”

“কি শুরু করলেন আপনি জাফরান?”

“বিহেভ করছি! নরমাল হাসবেন্ডের মতো! তেমনটা তুমি চেয়েছিলে”

“নরমাল হাসবেন্ডের মতো বিহেভ করছেন? সিরিয়াসলি? আপনি যা করছেন এটাকে অ্যাবনরমাল বিহেভ বলে?”

“তোমার যা ভাবার ভাবতে পারো! আই ডোন্ট কেয়ার। তোমার ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার ইচ্ছে হলে এভাবেই বলো নাহলে বলার দরকার নেই”

কি করবো বুঝতে পারছি না। এইভাবে যদি কল রিসিভ করি তাহলে কেয়ার সামনে মান সম্মানের টায়ার পাঞ্চার হয়ে যাবে। তাই ভাবলাম রিসিভ করবো না। ফোনটা এখনও বেজে চলেছে কিন্তু তুললাম না, পাশে রেখে দিলাম। উপায় না পেয়ে জাফরানের কাধে মাথা রাখলাম, উনিও তো আমায় ওইভাবেই ধরে রেখেছেন। সুযোগ পেয়েছি, ছাড়বো কেনো? টিভির দিকে মনোযোগ নেই আমার, আমি তো অন্য এক ভাবনায় মশগুল। ঈশ! প্রথমবার জাফরানের এতোটা কাছে আসার সুযোগ পেয়েছি, তাও ওনার মর্জিতে। এইটুকুই তো চেয়েছিলাম। চোখ বন্ধ করে ফিল করছিলাম ওনাকে! এই সুযোগে জাফরান আমার ফোনটা আস্তে করে নিয়ে কেয়াকে ফোন করে দিয়েছেন, আমি খেয়ালই করিনি!

“হাই কেয়া”

জাফরানের কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম আমি, চোখ খুলে দেখি কেয়া ভিডিও কলে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সরতে চাইলাম কিন্তু উনি আমাকে ওভাবেই ধরে রাখলেন। কেয়া তো হা করে তাকিয়ে দেখছে আমাদের। এদিকে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার বজ্জাত লোকটার জন্যে!

“ওয়াও, হাউ রোমান্টিক!”

আমি মুখ ফুলিয়ে জাফরানের দিকে তাকালাম, কিন্তু উনি তো একদম চিল মুডে আছেন। আজ বুঝতে পারছি লোকটা কতো মারাত্মক!

“কেয়া কল কাট কর। আমি পরে কথা বলবো তোর সাথে”

“কেনো পরে কথা বলবে? এখনি বলবে। কখন থেকে তোমাকে কল করে যাচ্ছে ও”

“আপনি একটাও কথা বলবেন না”

জাফরান বাঁকা একটা হাসি দিলো। আমার ওনার কার্যক্রম দেখে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। এমন কেউ করে নাকি? একদিনেই এতো নরমাল কে হতে বলেছিলো লোকটাকে? কেয়া ওপাশ থেকে হেসে বললো

“সুভী তুই তো ভাইয়ার সম্পর্কে একদম ভুল কথা বলেছিলি। ভাইয়া তো দেখছি বেশ রোমান্টিক! ঈশ! তোকে দেখে আমারও বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে”

“বিয়ের কথা বলিস না কেয়া, এমনি আছিস শান্তিতে। বিয়ে করলে সব শান্তি ঘুচে যাবে একদম”

“মোটেই না। আমার তো উল্টো মনে হচ্ছে। বিয়ের পরের লাইফটাই সবচেয়ে সুন্দর”

আমি কেয়াকে কিছু বলবো তার আগেই জাফরান কেয়ার কথার তালে তাল মিলিয়ে বলে

“সিঙ্গেল আর ডাবল লাইফের মধ্যে বিস্তর তফাৎ আছে। আমার একটা ফ্রেন্ড আছে, বিয়ে করতে চাইলে বলতে পারো। ওর সাথে সেটেল করে দেবো তোমায়”

হতভম্ব হয়ে জাফরানকে দেখছি। একটা লোকের মুখে সবসময় সিরিয়াস টাইপের কথা শোনার পর হুট করে এ ধরনের কথা শুনলে শক তো লাগবেই তাইনা? আমারও সেই অবস্থা! কেয়া উত্তেজিত হয়ে বলে

“সত্যিই ভাইয়া? বাহ! তাহলে তো আর কথাই রইলো না। আপনার ফ্রেন্ড নিশ্চয়ই আপনার মতোই হবে”

“একদম না, ওনার মতো কাওকে বিয়ে করার ভুল করবি না। এরকম লোকের সাথে সংসার করতে অনেক ধৈর্য্যর দরকার হয়। সে তুই পারবি না”

জাফরান ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে, কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে উঠলো

“এমনভাবে বলছো যেনো আমার সাথে সংসার না, যুদ্ধ করছো তুমি! কি দোষ করেছি আমি বলোতো? যা চাইছো সেটাই করার চেষ্টা করছি”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। হ্যা, আমিই তো একটু বদল দেখতে চেয়েছিলাম ওনার মধ্যে তাই বলে হুট করে উনি এতোটা বদলে যাবেন এটা আশা করিনি! কেয়া হেসে বললো

“ভাইয়া, আপনি ওর কথায় কান দেবেন না। সংসারের চিন্তায় একদম বদলে গেছে ও! কিন্তু আপনি যেমন আছেন তেমনি থাকুন!”

মুচকি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়লো জাফরান। ওনার প্রতি আমার একইসময় দুই রকম অনুভুতি কাজ করছে। একটু রাগ হচ্ছে আবার ভালোও লাগছে। এমন কেনো হচ্ছে? নামে আমার সাথে কথা হচ্ছে, কিন্তু আসল কথা তো কেয়া আর জাফরান বলছে, আমি তৃতীয় ব্যক্তির মতো শুনছি! উনি এখনো আমায় ধরে রেখেছেন, ভালোই লাগছে আমার!

“তোমার ফ্রেন্ড বাড়িতে একা থেকে থেকে বোর হয়ে যায়, মাঝে মাঝে এসে একটু কোম্পানি দিও ওকে। আমি তো আর সারাদিন বাড়ি থাকতে পারিনা”

“অবশ্যই আসবো ভাইয়া। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার বউকে মাঝে মাঝে কোম্পানি দেওয়ার দায়িত্ব আমার”

আমার এবার একটু রাগ হচ্ছে। যদিও কেয়া আমার বন্ধু কিন্তু এতোক্ষণ ধরে জাফরানকে ওর সাথে কথা বলতে দেখাটা ভালো লাগছে না! আমি টান দিয়ে এবার ফোন নিয়েই নিলাম জাফরানের থেকে!

“হয়েছে তোদের দুজনের কথা? এবার আমার সাথে কথা বল! কেনো কল করছিলি এতো? কোনো দরকার আছে?”

“আরে হ্যা আছে। স্কুলে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে! ভাবছিলাম আমরা যাবো! পুরনো সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে! তুই যাবি তো?”

রাজি হয়ে গেলাম আমি। স্কুলের টিচার, সহপাঠী সবার সাথে এতো বছর পর দেখা করার সুযোগ ছাড়ার ইচ্ছে নেই। জাফরান ও রাজি হয়েছে, আমায় যেতে দেবে। কেয়ার সাথে কথা বলে ফাইনাল করলাম যে আমি যাবো। কেয়ার সাথে কথা শেষ, এবার জাফরানের সাথে বোঝাপড়া করতে বসেছি! কিন্তু উনি এখন আমায় ছেড়ে ইচ্ছে করে টিভির দিকে মন দিয়েছেন! আমিও রিমোট দিয়ে বন্ধ করে দিলাম টিভি, তারপর বলতে শুরু করলাম

“কি করলেন এটা আপনি বলুনতো? কাল থেকেই কেয়া আমায় টিজ করতে শুরু করবে”

জাফরান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন, ঘাড় নুইয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন

“টিজ করার কি আছে? সামান্য হাগ করেছি! তাও সাইড হাগ, তুমি তো এমন বিহেভ করছো যেনো কেয়াকে লাইভে রেখে কিস করে ফেলেছি তোমায়”

কথাগুলো বলার সময় ওনার চোখেমুখে বিন্দুমাত্র লজ্জা শরমের বালাই নজরে পড়লো না, কিন্তু লজ্জায় আমার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না! ওনার লাগাম ছাড়া কথা শুনে হা হয়ে গেলাম আমি, সোফা থেকে উঠে একটা কুশন নিয়ে ছুড়ে মারলাম ওনার দিকে। মিনমিন

“মুখে লাগাম টানুন জাফরান সাহেব! একটা মেয়ের সামনে বসে আপনি এমন লাগামহীন কথাবার্তা বলতে পারেন না”

“সেই মেয়েটা তুমিই তো, বললে প্রব্লেম কি! আই গেস একজন হাসবেন্ড তার ওয়াইফের সাথে হাগ – কিস এইসব নিয়ে খোলাখুলি ডিসকাশন করতেই পারে”

উনি কথায় কথায় একি প্রসঙ্গ টেনে আনছেন, বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে আমিই বলেছিলাম ওনাকে নরমাল হাসবেন্ড এর মতো বিহেভ করতে! আফসোস হচ্ছে আমার, কোন দুঃখে যে বলেছিলাম কথাটা!

“আল্লাহ! কোথায় ফেঁসে গেলাম আমি! ঘাট হয়েছে আমার জাফরান, আমি কিছু স্বাভাবিক চাইনা! আমি না আপনাকে এভাবে দেখতে পারছি না। আপনি আবার আগের মতো হয়ে যান”

“এখন পসিবল না, আমি ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে এতো চেন্জ করতে পারবো না!”

কথাটা বলেই আবার টিভি ছেড়ে বসলেন উনি। গলা শুকিয়ে আসছে আমার, মাত্র কয়েক ঘন্টা, তাতেই লোকটা এতকিছু ফেললো! আল্লাহ জানে এরপর আর কি কি দেখতে হবে!
____________________________

সবে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছি আমি! কিন্তু বিছানার দিকে তাকিয়ে মাথা গরম হয়ে গেলো আমার! বিছানার ওপর একগাদা শার্ট আর ভেজা তোয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে! জাফরান রুমে নেই ঠিকই কিন্তু এগুলো তো ওনারই কাজ! তাছাড়া আর কে করবে এমন? ভেজা চুলগুলো ভালো করে টাওয়েল দিয়ে প্যাঁচিয়ে গোছাতে শুরু করলাম সব! একটু বাদে দেখলাম জাফরান এলো! আমি রেগে ভেজা তোয়ালে নিয়ে ওনার সামনে ধরে বললাম

“এটা কি?”

“টাওয়েল”

“এটার জায়গা তো বিছানার ওপর না! তাহলে এটা ওখানে কি করছিলো? আর আপনার শার্ট গুলো ছড়িয়ে রেখেছিলেন কেনো?”

“ডিসাইড করতে পারছিলাম না কোনটা পড়বো, তাই সব বের করেছিলাম”

অবাক হলাম আমি, কারণ ড্রেস চুজ করতে ওনার দু মিনিটও সময় লাগেনা আর আজ উনি বলছেন ডিসাইড করতে পারছিলেন না?

“কি পড়বেন ডিসাইড করতে পারছিলেন না। এটা আপনি বলছেন? ড্রেস নিয়ে সমস্যা তো আপনার কখনো হয়নি”

“হ্যা হয়নি, তাই বলে কি এখন হতে পারে না?”

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি আমায় পাশ কাটিয়ে সোজা আয়নার সামনে চলে গেলেন! চুল ঠিক করে চোখে চশমা পড়ে নিলেন। আমি আবারও বলে উঠলাম

“জাফরান! আপনি এই ভেজা টাওয়েল বিছানার ওপর ফেলে রেখেছেন? আর এই শার্টগুলো বাইরে ফেলে রেখে গেছিলেন! আপনি তো এমন অগোছালো ছিলেন না কখনো!”

“আমি অগোছালো না হলে তোমার তো সুবিধা হবেনা, তুমি যা চাইছো সেটাও পূরণ হবেনা”

“মানে?”

আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন উনি!

“একটা কথা ভেবে বলোতো আমাদের মধ্যে কখনো ছোটো কোনো ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বা তর্ক?”

না সূচক মাথা নাড়লাম আমি, এরকম তো কখনো হয়নি তাই একটুও ভাবার প্রয়োজন পড়লো না আমার

“হঠাৎ এই কথা কেনো বলছেন?”

“দরকার আছে বলার তাই। আমরা একে অপরের ওপর সেভাবে কখনো রাগ করার সুযোগ পাইনি, তুমি আমি দুজনেই প্রায় একরকম! একজনকে একটু অগোছালো তো হতে হবে। দুজনেই পারফেক্ট হলে চলেনা, একটু মিসম্যাচ না হলে পারফেক্ট কাপলও হওয়া যায় না! একটু আগেই তুমি একদম টিপিক্যাল ওয়াইফ এর মতো বিহেভ করছিলে! আই লাইক দ্যাট। এতদিন তুমি চেয়েছো এখন আমি চাই তুমিও টিপিক্যাল ওয়াইফদের মতো বিহেভ করো।”

জাফরানের কথাগুলো শুনে নিজের ওপর কেমন এক তিক্ততা কাজ করতে শুরু করলো আমার। আমি কি খুব প্রেসারাইজড করে ফেলেছি ওনাকে? যার জন্যে উনি জোর করে নিজেকে বদলাতে চাইছেন আমার জন্যে?

“জাফরান, আপনি প্রেসারাইজড হয়ে নিজেকে চেঞ্জ করার চেষ্টা করছেন তাইনা? আমি কিন্তু চাইনি আপনি জোর করে কিছু করুন, শুধু একটু..”

পুরো কথা শেষ করার আগেই উনি আমার গালে হাত রাখে অতি শান্ত কণ্ঠে বললেন

“আমি নিজেই নিজেকে চেঞ্জ করছি, এতে তোমার কোনো দোষ নেই! আমি রিয়ালাইজ করেছি যে যেভাবে আমরা লাইফ লিড করছি সেটা ভুল ছিলো। তোমার সাথে অন্যায় করছিলাম, আর নিজের সাথেও। সংসার বিষয়টা কেমন বোঝার চেষ্টা করিনি কখনো, পরে ভেবে দেখলাম আমার ফ্যামিলি বলতে এখন একমাত্র তুমিই আছো, তাই তোমাকে নিয়ে এবার সুন্দর করে সংসার করতে চাই! অনেককিছু মিস করে গেছি জানি, এবার সব রিফিল করতে চাই! আমিও চাই তোমার সাথে থাকতে”

চুপচাপ ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে যাচ্ছি। জাফরানও আমার সাথে থাকতে চায় শুনে অদ্ভুত শান্তি পেলাম আমি। এতদিন একটা ভয় ছিলো উনি যদি আমায় ছেড়ে দেন তাহলে কি হবে? মুখে যাই বলি কিন্তু সত্যি এটাই যে আমি ওনাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না!

“বাবাকে প্রমিজ করেছিলাম কিন্তু এতদিন সেটা ঠিকঠাক পূরণ করতে পারিনি কারণ আমাদের মধ্যে দূরত্ব ছিলো। তার কারণটাও অবশ্য আমি,তবে এখন নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই। তুমি একজন পারফেক্ট ওয়াইফ হিসেবে নিজেকে প্রুভ করেছো এবার আমার পালা। সুযোগ দেবে তো?”

জাফরানের কথার মাঝে একফোঁটা বিরক্তি নেই আর না তো মনে হচ্ছে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব বলছে। একটা মানুষ মন থেকে কিছু বললে সে তো বোঝাই যায়। আমারও বুঝতে বাকি রইলো না এবার ওনার বলা প্রত্যেকটা কথা মন থেকেই বলছেন। সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি। জাফরানের সাথে ছোট্ট একটা পরিপূর্ন সংসার সাজানোর যে স্বপ্ন আমি দেখতে শুরু করেছিলাম সেটা পূরণ হতে বুঝি খুব একটা সময় লাগবে না এবার!
__________________________________

আগে সার্ভেন্ট সারাদিন থাকলেও এখন দুপুরের পর কাজ করে চলে যান, কারণ বাড়ির টুকটাক কাজ তো আমিই করি। একটু আগেই সার্ভেন্ট কাজ করে গেছে। আমি তখন রান্নাঘরে ছিলাম, হঠাৎ কলিং বেজে উঠলো। আমি ভাবলাম আবার জাফরান এলো নাকি! হাত মুছে গিয়ে দরজা খুলে নাতাশাকে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। ও এখানে কি করছে! আমি ভেবেছি জাফরানের সাথে দেখা করতে এসেছে। নাতাশা সানগ্লাস খুলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে

“কেমন আছো সুরভী?”

“জ্বি ভালো। কিন্তু জাফরান তো বাড়িতে নেই”

“আই নো, আমি ওর সাথে না তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি আজকে। ভাবলাম তোমার সাথে সেদিন সেইভাবে তো আলাপ হলো না। তাই চলে এলাম”

হুট করে নাতাশার এখানে আসাটা কেমন অস্বাভাবিক লাগলো সুরভীর কাছে। অবশ্য সেদিন জাফরানের সাথে যেভাবে চিপকে ছিলো তারপর নাতাশাকে ওর একটুও পছন্দ না, কিন্তু জাফরানের বন্ধু বলে কিছু বললো না

“কোনো প্রব্লেম আছে কি তোমার?”

“না না, আসুন”

ভেতরে এলো নাতাশা। আমার সাথে একদম স্বাভাবিক আচরণই করলো মেয়েটা যেটা মোটেও আশা করিনি আমি। হুট করে ওনার এখানে আসার কারণটাও বুঝে উঠতে পারছি না। আমি একটু কফি বানিয়ে আনলাম ওর জন্যে। নাতাশা কফি খেতে খেতে ড্রইং রুমে হেঁটে হেঁটে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বললো

“বহু বছর আগে একবার এসেছিলাম এই বাড়িতে,অবশ্য তখন সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি!”

আমি উত্তর দিলাম না। কেনো যেনো নাতাশার উপস্থিতি আমার খুব একটা পছন্দ হয় না। ড্রইং রুমে পুরোটা ঘুরে দেখে এসে সোফায় বসলো নাতাশা। কফি কাপটা রেখে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো

“খুব টেস্টি কফি বানিয়েছো! আই অ্যাম ইমপ্রেসড!”

প্রতিউত্তরে ছোট্ট একটা হাসি দিলাম আমি!

“একা হাতে সবকিছু সুন্দর করেই গুছিয়ে রেখেছো দেখছি। আবার জাফরানকে ও ভালোই সামলাচ্ছ! একা একা কষ্ট হয় না এতকিছু করতে?”

“নিজের সংসার একা হাতে সামলাতে কষ্টের কি আছে? তাছাড়া নিজের জিনিস তো নিজেরই সামলে রাখতে হবে তাইনা? হাজার হোক এই বাড়ি আমার, সংসার আমার এর জাফরান ও আমার”

বেশ কনফিডেন্স নিয়ে গর্বের সাথে কথাগুলো বললো সুরভী, কিন্তু কথাগুলো শুনে খুব একটা খুশি হলো না নাতাশা। এতোক্ষণ মুখে তাও যে প্লাস্টিক মার্কা হাসি ছিলো সেটাও উবে গেল সুরভীর কথা শুনে। হাতের মুঠোয় থাকা সানগ্লাসটা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে নিজের রাত কন্ট্রোলের চেষ্টা করে যাচ্ছে নাতাশা।

নাতাশা পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাইলো, আমিও আর আপত্তি করলাম না। সবশেষে আমাদের রুমে নিয়ে এলাম নাতাশাকে। এই রুমে ঢুকেই এদিক ওদিক কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো মেয়েটা

“এটা সত্যিই তোমাদের রুম?

“হুমম। কেনো?”

“না মানে, জাফরানের রুমে সবসময় ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কালারের জিনিস থাকতো। কার্টন, বেডশিট সব। কিন্তু এখন তো দেখছি কালারফুল জিনিস”

“ঠিকই বলেছেন। আগে তেমনি ছিলো কিন্তু আমার ওইসব কালার ভালো লাগেনা তাই বদলে দিয়েছি। জাফরান ও কোনো আপত্তি করেনি”

নাতাশা কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। জাফরানের সাথে দু বছরের সম্পর্ক থাকা সত্বেও ওকে একটুও বদলাতে পারেনি ও, সেখানে মাত্র অল্পকিছুদিনের বিয়ে করা বউ এসে জাফরানের পছন্দ বদলে দিয়েছে? মানতে পারছে না নাতাশা!

“ওহ! সময়ের সাথে জাফরানের টেস্ট ও বদলে গেছে হয়তো। এনিওয়ে রুমে কোনো ওয়েডিং ফটো দেখছি না যে”

নাতাশার প্রশ্নে মনে পড়ে গেলো আমাদের বিয়ের দিনের কথা, বিয়েটা তো হয়েছিলো একরকম দায়সারা ভাবে। না ছিলো কোনো আনন্দ না ছিলো নিজের সম্মতি! সেখানে দুজনের বিয়ের ছবি থাকাটা তো বিলাসিতা সম। কিয়ৎক্ষণ ভেবে মুচকি হেসে বললাম

“সবকিছু কি ফ্রেমবন্দি করার দরকার পরে? কিছু স্মৃতি এমন থাকে যা মনের মধ্যে এমনভাবে সেটে যায় যে যখন ইচ্ছে চোখ বন্ধ করেই অনুভব করার যায়। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটাও তেমন”

নাতাশা ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, অদ্ভুত এক চাহনি। রাগ না ক্ষোভ বুঝলাম না তবে আমার উত্তরে যে সে খুশি হয়নি এইটুকু নিশ্চিত

“খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারো দেখছি তুমি। জাফরানকে এভাবেই ইমপ্রেসড করেছো বুঝি?”

“মানে?”

“না মানে, জাফরান গুছিয়ে কথা বলা পছন্দ করে। মানুষটাই তো পুরো গোছানো স্বভাবের, তুমিও সুন্দর কথা বলো। মে বি তোমরা দুজনই একে অপরের জন্যে পারফেক্ট”

“পারফেক্ট কিনা জানিনা, তবে জাফরানের উপযোগী হবার পুরো চেষ্টা করছি”

“জাফরানের মনের মতো হওয়া অতো সহজ না, আমি দু বছর ট্রাই করেও পারিনি। অ্যাডজাস্ট করতে পারছিলাম না আমরা দুজনে, তাইতো ব্রেকআপ হয়ে গেছিলো আমাদের”

“একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইলে অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই হয়। আপনাদের সম্পর্কে সেটার কমতি ছিলো তাই আজ আপনারা আলাদা হয়ে গেছেন। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মধ্যে সেটার কমতি নেই”

“বেশ কনফিডেন্স আছে দেখছি তোমার, নিজের আর জাফরানের সম্পর্কের ওপর এতো ভরসা?”

“ভরসা আর বিশ্বাস দুটোই আমাদের একে অপরের প্রতি আছে। যেখানে ভরসা বিশ্বাস থাকে সেখানে কনফিডেন্স ও আপনা আপনি এসে যায়! যাই হোক আসুন, দুপুরের লাঞ্চ করে যাবেন আজ”

মাথা নাড়লো নাতাশা, যদিও খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে করছে এখনি সুরভীকে এখান থেকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে, সেটাও তো পারবে না। সুরভী কিচেনে দাড়িয়ে খাবার গরম করছিলো, নাতাশাও ওর সাথে দাড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিলো। সুরভীর সামনে যথেষ্ট ভালো থাকার নাটক করে যাচ্ছে ও, কিন্তু এই ভালো আচরণের পেছনের উদ্দেশ্য তো অন্য!

“আপনি গিয়ে বসুন না, আমি এগুলো নিয়ে আসছি”

“ইটস ওকে! আমি একা একা ওখানে বসে কি করবো? এখানেই থাকি তোমার সাথে। আচ্ছা জাফরান কি দুপুরে খেতে আসে বাড়িতে?”

“যেদিন আসেন সেদিন আগেই বলে যান। অবশ্য দুপুরে খুব কমই বাড়ি আসেন উনি”

নাতাশা কিছু বললো না। আমি খাবার গরম করে নিয়ে একে একে টেবিলে রেখে আসলাম। এদিকে সুরভীকে যতো দেখছে ততই নাতাশার মাথায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠছে! রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ও নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে কিছু খুঁজতে শুরু করলো, আর ছোটো একটা গ্লিসারিনের বোতল পেয়ে গেলো। সুরভীর দৃষ্টির অগোচরে রান্নাঘরের সামনের ফ্লোরে বোতল আস্তে আস্তে ঢালতে শুরু করলো ও। আজ নিজের চোখেই সুরভীর যন্ত্রণা দেখার লোভ জেগেছে নাতাশার মনে। আনমনে কাজ করে যাচ্ছিলো সুরভী, নাতাশা এসে ততক্ষণে চেয়ারে বসে পড়েছে। ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসিটা চিলতে ফুটে উঠেছে। রান্নাঘরের দরজার সামনাসামনি আসতেই পায়ের নিচে পিচ্ছিল কিছুর আভাস পেলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পা স্লিপ করে দরজার কোণে মাথায় বাড়ি খেলাম। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ধরে নিচে বসে পড়লাম আমি। নাতাশা দুর থেকে সব দেখেও কিছুক্ষণ চুপ রইলো তারপর মেলোড্রামা করতে ছুটে এলো সুরভীর কাছে

“কি হলো সুরভী! পরে গেলে কিভাবে?”

“জানিনা। স্লিপ করে গেলাম কিভাবে!”

মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে, কপালের এক সাইডে হাত দিয়ে ভেজা অনুভব করলাম। একটু রক্ত বেরিয়েছে, মানে ভালোই চোট লেগেছে। নাতাশা বাঁকা হাসলো

“ঠিক আছো তো তুমি? দেখি ওঠো!”

নাতাশা আমায় তুলে চেয়ারে নিয়ে বসিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। আমি পানি খেয়ে ফ্লোরের দিকে তাকালাম, আজ তো ঘর সেই সকালে মোছা হয়েছে, পানিও পড়েনি। তাহলে পা কিসে স্লিপ করলো?

“ঠিক আছো সুরভী?”

“হ্যা, আমি ঠিক আছি। কিন্তু ওখানে পা কিসে স্লিপ করলো আমার?”

আমি উঠে দেখতে চাইছিলাম কিন্তু মাথাটা প্রচুর ব্যথা করছে। আচমকা ব্যথা পেয়েছি বলে হয়তো! নাতাশা ও আমায় বাধা দিয়ে বললো

“মে বি পানি পড়েছে কোনোভাবে। তাতেই তোমার পা স্লিপ করে গেছে”

“কিন্তু পানি কিভাবে পড়বে? আমি তো পানি পড়বে এমন কোনো কাজ করছিলাম না”

“আচ্ছা যা হবার হয়ে গেছে। বাদ দাও এসব! বসো এখানে, দেখো মাথায় চোট লেগেছে তোমার। ফাস্ট এইড বক্স কোথায়?”

“আমি ব্যান্ডেজ করে নিতে পারবো! আপনি বসুন, খেয়ে নিন”

নাতাশা আমার কথা শুনলো না, ফাস্ট এইড বক্স খুঁজে আমার ক্ষত পরিষ্কার করে ওয়ান টাইম ইউজড ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। কিন্তু আমার নজর তো ফ্লোরের দিকে। এদিকে কিছু দেখতে পেলাম না, তাহলে কি রান্নাঘরের সামনে সত্যিই পানি পড়েছে? এতদিন হয়ে গেলো কোনোদিন এরকম হয়নি তাহলে আজই কেনো হলো? কিছু সময় পর নাতাশা চলে যায়। ওর যাওয়ার পর আমি রান্নাঘরের সামনে এসে দেখতে শুরু করি কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো এখানে এখন কিছুই নেই, অথচ একটু আগেই এখানেই পা পিছলে পড়েছিলাম আমি। স্যান্ডেল খুলে ওই জায়গার ফ্লোরের ওপর একটু জোরে পা ঘষা দিতেই বুঝলাম এখানে পিচ্ছিল কিছু একটা ছিলো, কিন্তু মুছে ফেলা হয়েছে! মাথা কাজ করছে না আমার। কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝতে পারছিনা
______________________________

বিছানায় উবু হয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে নাতাশা, সামনে বালিশের ওপর জাফরানের ছবি রেখেছে। আজ খুব শান্তি লাগছে ওর। সুরভীকে কষ্ট পেতে দেখে এক পৈচাশিক আনন্দ পেয়েছে ও! আসার আগে আবার রান্নাঘরের সামনে থাকা কাপড়টা দিয়ে মুছে দিয়েছিলো জায়গাটা, বিধায় সুরভী ওখানে কিছু দেখতে পায়নি। জাফরানের ছবির ওপর আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দেয় নাতাশা

“জাফরান, তুমি আমায় ওই মেয়েটার জন্য নিজের লাইফে ব্যাক করতে দেবে না বলেছ তাইনা। আজ ওই মেয়েটা না থাকলে আমি তোমাকে কোনো না কোনোভাবে কনভিন্স করতে পারতাম, আবার আমরা আগের মতো হতে পারতাম কিন্তু সুরভীর জন্য সেটা হলো না। মেয়েটা তোমার টেস্ট অব্দি বদলে দিয়েছে, আমি মানতে পারছি না জাফরান! কষ্ট হচ্ছে আমার। এতো সহজে তোমাকে আমি ওর সাথে সংসার করতে দেবো না”

আনমনে কথাগুলো বলে জাফরানের ছবিতে ঠোঁট ছোঁয়ালো নাতাশা!
____________________________

গত আধ ঘণ্টা ধরে আমায় বকাবকি করে যাচ্ছে জাফরান! অফিস থেকে এসে যেই মাথায় ব্যান্ডেজ দেখেছে তখন থেকে শুরু করেছে বকাঝকা! একটা কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেনা আমায়! ভীষণ রেগে গেছেন উনি!

“দেখেশুনে কাজ করতে পারো না তুমি? কতোটা কেটে গেছে! এখন থেকে সার্ভেন্ট কে আরেকদিন আগে পাঠিয়ে দিয়ে যদি একা একা কিচেনে মাতব্বরি করতে যাও খবর আছে তোমার”

ঠোঁট উল্টে মিনমিন করে বললাম

“জাফরান, আমি ইচ্ছে করে তো এমন করিনি। আমি নিজেই বুঝতে পারিনি কিভাবে কি হয়ে গেলো। এভাবে বকছেন কেনো আমায়?”

“নাহ! এর জন্যে তোমাকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া দরকার। খুব বড় একটা কাজ করে ফেলেছো তুমি। সার্ভেন্ট কেনো রাখা হয়েছে বাড়িতে? তোমাকে আমি সেই শুরুতেই বলেছি এই বাড়িতে কাজ করানোর জন্যে আনিনি তোমায়”

সোফার ওপর বসেছিলাম, জাফরান আমার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। জলদি একটা কুশন হাতে তুলে নিলাম, আঙ্গুল দিয়ে ওর ওপর আঙ্গুল নাড়াতে লাগলাম। এটা দেখে আরো রেগে গেলেন উনি! হাত থেকে কুশন কেড়ে নিয়ে আমার দিকে ঝুকলেন উনি, বাজখাই গলায় বলে উঠলেন

“আমার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নাও সুরভী, যদি কাজ করার এতোই ইচ্ছে হয় দেখেশুনে করবে নাহলে করার দরকার নেই। ইডিয়ট একটা! যদি চোখে লাগতো, বা মাথায় গুরুতর চোট লাগতো তখন কি হতো?”

“আগে কখনো কি এমন হয়েছে বলুন? এখন একটা অঘটন ঘটলে কি করার আছে বলুন? কিছু না করে বসে থাকলেই যে দুর্ঘটনা ঘটবে না তার কি গ্যারান্টি?”

“মুখের ওপর তর্ক করো না সুরভী! একটা ফোন অব্দি করনি তুমি আমায়, যদি সেন্সলেস হয়ে পড়ে থাকতে তাহলে কি হতো?”

“এতো কিছু হতো না”

“মাথা গরম করিও না আর আমার, চুপ করো”

আরেক সোফায় কুশন ছুড়ে মেরে আমার পাশে বসলেন উনি, আমি ঠোঁট কামড়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই ভীষণ রেগে আছেন উনি, কিন্তু এই রাগের মাঝে চিন্তা কেয়ার দুটোরই মেলবন্ধন খুঁজে পেলাম। আমাকে নিয়ে লোকটার এতো চিন্তা? ভেবেই মুচকি হাসলাম! তখনই হুট করে উনি তাকালেন আমার দিকে

“হাসছো কেনো তুমি? কমেডি চলছে এখানে?”

দ্রুত হাসি থামিয়ে না সূচক মাথা নাড়লাম আমি। ওনাকে আর রাগানোর ইচ্ছে নেই আমার, জানিনা আমাকে আবার রাগের পরিণতি হিসেবে কি শাস্তি পেতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি ঘুরে বসলেন আমার দিকে, কপালে ভালোভাবে নজর বুলিয়ে নিলেন!

“ব্যথা করছে?”

“একটু একটু”

“বেশি ব্যথা করলেও তো বলবে না। তোমার তো আবার হাইড করার অভ্যাস আছে সবকিছু”

“আমি আপনার থেকে কখনো কিছু লুকাইনি”

“থাক! এখন আর কিছু বলতে হবেনা। চুপ করে বসে থাকো আমি দেখছি পেইন কিলার আছে কিনা। একটা খেয়ে নেবে, ব্যথা বেড়ে গেলে রাতে জ্বর আসতে পারে”

জাফরান উঠে দাঁড়াতেই ওনার হাতটা ধরে ফেললাম

“এতো ব্যস্ত হতে হবে না আমাকে নিয়ে, আই অ্যাম ফাইন”

“ব্যস্ত হতে হবে কি হবেনা সেটা আমি বুঝবো”

আমার হাত ছাড়িয়ে জাফরান চললো ওষুধ আনতে, আমিও আর বললাম না কিছু ওনাকে। সেই যে ওষুধ খেয়েছি তারপর আমার সাথে উনি একটাও কথা বলেননি। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চললো, এখনও নিশ্চুপ হয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন উনি। আমি ওনার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছি না বকাবকির ভয়ে। রোজ ঘুমানোর আগে বারান্দায় এসে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকেন উনি, আজও ব্যতিক্রম তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই সুযোগে আমি এসে দাড়ালাম ওনার পাশে, উনি আমার উপস্থিতি টের পেয়েও পূর্বের ন্যায় নিশ্চুপ রইলেন। আমি মজার ছলে বলে উঠলাম

“ব্যথা পেয়েছি আমি, কোথায় একটু সেবা শুশ্রুষা করবেন আমার তা না করে গুক মেরে আছেন কেনো?”

উত্তর দিলেন না উনি, উল্টে মুখটা ৩৬০⁰ অ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে নিলেন, বুঝলাম রাগটা এখনও পড়েনি

“আপনি এখনও রেগে আছেন আমার ওপর!”

“তোমার রেস্ট করা দরকার, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। নাহলে মাথা ব্যথা করবে”

“আপনি আগে বলুন, রেগে আছেন এখনও আমার ওপর? আপনি রেগে থাকলে আমি শান্তিতে ঘুমাবো কিভাবে? ঘুম না হলে এমনিতেও মাথা ব্যথা করবে”

সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালেন আমার দিকে জাফরান। ওনার তাকানো দেখেও কেমন ভয় ভয় লাগছে আমার!

“সরি”

উত্তর দিলেন না উনি। খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে, আমি চোখ নামিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম তখনই উনি দু হাতে আমার মুখটা তুলে ধরলেন, আমার চোখে চোখ রেখে শান্ত কণ্ঠে বললেন

“আমার তোমার সরি চাইনা সুরভী, একটা কথা জেনে রাখো। আমার লাইফে, আমার নিজের বলতে এখন তুমি ছাড়া কিন্তু আর কেউ নেই। বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি আমি, তোমার জন্য সাহস পেয়েছি মুভ অন করার। আরেকবার আমি ওইরকম পরিস্থিতির সামনে পড়তে চাইনা। সব হারিয়ে ফেলেছি, এবার আমার লাস্ট হোপ হারাতে চাইনা”

কথাগুলো শেষ করেই আমায় ছেড়ে রুমে চলে গেলেন উনি, আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। ওনার চোখে আজ ভয় দেখেছি আমি, আমাকে হারানোর ভয় পান উনি! শুকনো একটা ঢোক গিলে বুকের বামপাশে হাতটা রাখলাম আমি। খুব দ্রুত গতিতে চলছে হৃদপিণ্ডের ওঠানামা। এতদিন আমি ভেবেছি নিজের অনুভূতির কথা, আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওনার মনে কি আছে আমার জন্যে?

“জাফরান আমায় হারানোর ভয় পান! উনি কি ভালোবাসেন আমায়?”

আনমনেই কথাগুলো আওড়ে ফেললাম আমি। আজ প্রথমবার নিজের প্রয়োজন অনুভব করলাম, আমার জন্যে না জাফরানের জন্যে। বুঝলাম ওনার জন্যে হলেও নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে আমায়। দ্বিতীয়বার ওনাকে আর আমার জন্যে এতোটা চিন্তিত হতে দেবো না!
______________________________

আজ সকালে একটু দেরিতে ঘুমটা ভেঙেছে আমার, জলদি জলদি ফ্রেশ হয়ে কিচেনের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ডাইনিং টেবিলে তাকিয়ে দেখলাম খাবার রেডি!

“আরে সার্ভেন্ট তো এখনও আসেনি, এগুলো বানালো কে?”

জাফরান তখন কিচেন থেকে বেরোলো, আমায় চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো

“আমাকে নজরে পড়ছে না তোমার?”

“আপনি না পরশুদিন রান্না করলেন, আবার আজকে ব্রেকফাস্ট বানাতে গেছেন কেনো?”

“তাতে কি হয়েছে? তুমি মাথায় চোট পেয়েছো। একটু বেশি সময় ঘুমালে ভালো লাগবে ভেবে ডাকিনি। নিজে যখন ব্রেকফাস্ট বানাতে পারি তাই বানিয়ে নিয়েছি”

ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি, সকাল সকাল কোন হাসবেন্ড তার ওয়াইফকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়ায় জানা নেই। জাফরান আমায় দিনদিন অবাক করে দিচ্ছে!

“এভাবে দেখছো কেনো? ব্রেকফাস্ট বানানো একদম ইজি একটা ব্যাপার! ইটস নট আ রকেট সায়েন্স!”

“তাই নাকি? তা কি কি বানিয়েছেন দেখি”

উনি আমার দিকে প্লেটগুলো এগিয়ে একে একে দিতে শুরু করলেন, প্রায় তিনরকম আইটেম বানিয়েছেন দেখছি!

“বাটার টোস্ট, ভেজ স্যান্ডউইচ, ফ্রুট সালাদ আর অরেঞ্জ জুস। এর থেকে বেশি কিছু বানালাম না, তোমার যদি আবার ভালো না লাগে তাই। আগে এগুলো টেস্ট করে দেখো”

“এতোকিছু বানিয়েছেন?”

“ইয়েস, আসলে কানাডায় থাকতে নিজেদেরই তো সব করে নিতে হতো। আমি আবার অন্যের হাতের খাবার খেতে লাইক করতাম না। নিজেই শিখেছিলাম সব”

“পারেন বলেই কি এতকিছু বানাতে হবে? আপনি সকালে ঘুম থেকে কখন উঠেছেন বলুন তো আর এতকিছু কখন করলেন? জগিং এ যাননি নাকি আজ?”

“তোমার এতকিছু জানতে হবেনা। চুপ করে খাওয়া শেষ করো। তারপর মেডিসিন খাবে একটা। আমি সার্ভেন্ট কে বলে দিয়েছি, উনি এসে সব করবেন। আজ তুমি একটাও কাজ করবে না”

সকাল বেলা এগুলো খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার, ব্রেড খেতেই তো পছন্দ করিনা তার ওপর এগুলো! কিন্তু জাফরান এতো কষ্ট করে বানিয়েছে বিধায় আর উচ্চবাচ্য করলাম না। টুকটুক করে খেতে শুরু করলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে জাফরান নিজের পকেট থেকে একটা হেয়ার ব্যান্ড বের করে আমার সামনে রেখে বললেন

“ড্রইং রুমে এই হেয়ার ব্যান্ডটা পেয়েছিলাম সকালে! কিন্তু আমার জানামতে তুমি তো এমন হেয়ার ব্যান্ড ইউজ করো না”

খেতে খেতে বাম হাতে হেয়ার ব্যান্ডটা তুলে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম, আর একটু সময়ের মধ্যে বুঝেও গেলাম এটা কার

“আরে হ্যা, এটা আমার না। কালকে এরকম হেয়ার ব্যান্ড তো নাতাশা পড়ে এসেছিল”

নাতাশার কথা শুনে চমকে ওঠে জাফরান, বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসে

“হোয়াট! নাতাশা এসেছিলো বাড়িতে?”

“হ্যা, ওই গতকাল দুপুরে এসেছিলো। আপনি কালকে এতো রেগে ছিলেন আর এতকিছু হয়ে গেলো। এর মাঝে বলতেই ভুলে গেছিলাম নাতাশার কথা”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে