#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ১২
জাফরান সামনের দিকে তাকিয়ে সরু হেসে বললো
“হঠাৎ এমন কিছু চাইছো যে! আমার প্রেমে টেমে পড়ে গেলে নাকি?”
ওনার কথায় বিশেষ অবাক হলাম না আমি। আর প্রেমের কথা শুনেই তো মনে পড়ে গেলো “দায়িত্ব ও “প্রয়োজন” নামক শব্দ দুটো যেগুলো জাফরান আমার জন্যে বলেছিলো
“চাইলেও তো পারবো না, এক তরফা ভালোবেসে কষ্ট ভোগ করার ক্ষমতা আমার নেই! আমার যে আপনার প্রেমে পড়া বারণ আছে জাফরান”
“কেনো? মনটা কি অন্য কাউকে আগে থেকেই দিয়ে রেখেছো?”
“মন একটাই আমার, যাকে দেবার পার্মানেন্টলি দেবো”
কোনো উত্তর পেলাম না ওনার দিক থেকে। নাতাশার ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করতে পারিনি আমি এখনও, কনফার্মেশন ছাড়া সিওর হতে পারছিলাম না তাই কৌতূহল বশত প্রশ্ন করেই বসলাম
“আপনি কি এখনও নাতাশাকে ভালোবাসেন?”
“নাতাশা আমার অতীত সুরভী, আর ওর সাথে আমার সম্পর্কও অতীত হয়ে গেছে। এখন শুধু তুমি আছো আমার জীবনে। সম্পর্ক নিয়ে ছেলেখেলা করার মতো মানুষ আমি নই, নিশ্চিন্ত থাকতে পারো”
সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন উনি, একটুও সময় নেননি। বুঝলাম ওনার মনের আর মুখের কথা একি! নাতাশা তাহলে এখন আর ওনার মনে নেই, এবার নিজের ইচ্ছেটা ওনার সামনে তুলে ধরতেই পারি আমি!
“দেখুন, সব মেয়ের মতো আমিও সংসার সুন্দর করে করতে চাই। কিন্তু সেই সংসারে আমাদের সম্পর্কটা শুধুই দায়িত্বের থাকুক সে আমার কেনো কোনো মেয়েরই কাম্য নয়”
“তুমি আর আমি দুজনেই দায়িত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ। বাবার সামনে দুজনেই আমরা প্রমিজ করেছিলাম মনে আছে?”
“আমি যে দায়িত্বের কথা বলছি আর আপনি যা বলছেন দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে জাফরান। সেটা নিশ্চয়ই আপনি বোঝেন! স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই আমি জাফরান, কিন্তু সেটা শুধু দায়িত্ববোধ থেকে নয়। জানি ভালোবাসা বললেই হয় না, খুব জটিল একটা অনুভুতি। তাই ভালোবাসার দাবি রাখবো না আপনার সামনে কারণ সময়ের সাথে অনেককিছুই বদলে যায়! সময়ের ওপর ভরসা রাখবো আমি”
“আমাদের সম্পর্কটা কি অস্বাভাবিক মনে হয় তোমার?”
“অস্বাভাবিকই বটে! বিয়ের সম্পর্কে অনেককিছু থাকে জাফরান, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা এমন না। আমি চাই আমাদের সম্পর্ক লাস্টিং করুক, সারাজীবন আপনার সাথে থাকতে চাই আমি। তাই এইটুকু তো স্ত্রী হিসেবে চাইতেই পারি আমি তাইনা?”
জাফরান চুপচাপ শুনলেন আমার কথাগুলো। কিন্তু কি ভাবছেন, কি বুঝলেন আমায় কিছু বললেন না। আমার কথাগুলো কি আদৌ বুঝতে পেরেছেন? তাও বুঝতে পারলাম না! কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পাইনি! সকালের কড়া রোদের তাপ মুখে পড়তেই ঘুম থেকে জেগে উঠলো জাফরান। রোজ সকালেই ওর বারান্দায় রোদ এসে পড়ে, আজও ব্যতিক্রম হয়নি। ডানদিকে ঘুরতেই দেখলো সুরভী ওর কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। গত রাতে দুজনে কথার তালে তালে এখানেই ঘুমিয়ে গেছিলো। সুরভীর ঘুমন্ত মুখপানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো জাফরান, মনে পড়লো গত রাতে ওর করা প্রশ্নটার কথা। উত্তর দিতে পারেনি জাফরান। সুরভী ভেবেছিল জাফরানের কাছে উত্তর নেই, কিন্তু আদৌতে সত্যিই কি উত্তর নেই না ও ইচ্ছে করে দেয়নি সে তো জাফরানই একমাত্র জানে
_____________________________
ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি। দশটা বাজতে দু মিনিট বাকি! এতো বেলা অব্দি ঘুমানোর অভ্যাস নেই আমার। মনে পড়লো গত রাতে যে ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছিল তাই আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। গত রাতে বাইরে ছিলাম আমি, আজ আবার বিছানায়। নিশ্চয়ই জাফরান নিয়ে এসেছে। থেকে উঠে দাঁড়াতেই বেড সাইড টেবিলের ওপর দেখতে পেলাম গোলাপের গোছা। মুচকি হেসে হাতে তুলে নিলাম গোছাটা, ঘ্রাণ নিলাম ফুলের!
“জাফরান আমার জন্যে ফুল রেখে গেছে? বাহ! মনে ছিলো তাহলে ওনার। কিন্তু সরাসরি আমার হাতে না দিয়ে এখানে রেখে যাওয়ার কি দরকার ছিলো? পরেও তো দেওয়া যেতো নাকি!”
মনে মনে কথাগুলো ভেবে হাসলাম আমি। প্রথমবার গোলাপগুলো দেখে একটু বেশিই খুশি হলাম কারন এগুলো যে জাফরান নিজে এনেছে। পরে একটা ছোটো ফ্লাওয়ার ভাসে পানি দিয়ে রেখে দিলাম ফুলগুলো, যাতে কিছু সময় তাজা থাকে। ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই দেখলাম জিনিয়া আপু তার মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে
“জাফরান কোথায় আপু?”
“ও তো একটু আগেই অফিসে চলে গেছে। তুমি নাকি কাল অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলে তাই তোমাকে ডাকতে মানা করেছিলো”
“খেয়ে গেছেন উনি?”
“হ্যা বাবা, খাইয়ে দিয়েছি তোমার মহাশয়কে। এবার তুমি এসে বসো। খেয়ে নাও! আমি বেড়ে দিচ্ছি”
খেতে বসে পড়লাম। জিনিয়া আপু বেড়ে দিলো আমায়। হঠাৎ আপু হেসে বললো
“জাফরান আজ জগিং শেষে বাড়ি ফিরে আবার বেরিয়েছিলো। পরে দেখলাম গোলাপ হাতে নিয়ে ফিরলো! তোমার জন্য তাইনা?”
আমাকে হ্যা সূচক মাথা নাড়তে দেখেই জিনিয়া আপু আরো খুশি হয়ে গেলো
“বাহ! এবার প্রেমের রং বোধহয় সত্যিই আমার ভাইয়ের মনে লেগে গেছে”
“তোমার ভাইয়ের জীবনে প্রেম তো আগেও ছিলো আপু! এ আর নতুন কি?”
“আরে নাহ সুরভী! আমি জানি নাতাশার জন্যে জাফরান কখনো এরকম কিছু করেনি। সকাল সকাল গিয়ে টাটকা গোলাপ ফুল নিয়ে এলো তোমার জন্যে। কি রোমান্টিক ব্যাপার!”
আমি খেতে খেতে কিছুটা হতাশ স্বরে বললাম
“তোমার ভাই আস্ত একটা নিরামিষ! ওনার দ্বারা প্রেম টেম হবেনা। আর গোলাপের কথা বলছো? ওইটা আমি বলেছিলাম আনতে তাই এনেছে, নিজে থেকে না”
“সে যার কথাতেই আনুক এনেছে তো। দেখবে আস্তে আস্তে জাফরান নিজেই তোমার জন্য সবকিছু করতে শুরু করবে। একটু ধৈর্য্য ধরো”
“ধৈর্য্যই তো ধরে আছি আপু! জাফরানকে তো চেনো। সবকিছু নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখে। কিছু প্রকাশ করতে চায় না। কি যে চলে ওনার মনে কিছুই বুঝি না”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। ধৈর্য্য ধরেই তো আছি, জাফরানের প্রতি একটা বিশ্বাস আছে। আশা আছে জাফরান আমার কথা রাখবে! আমি জলদি ব্রেকফাস্ট করে সোজা কল করলাম জাফরানকে। একটা থ্যাংক ইউ তো বলতেই হবে। উনি কল রিসিভ করতেই আমি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম
“থ্যাংক ইউ”
“সকাল সকাল থ্যাংকস কেনো ম্যাডাম?”
“কেনো বললাম সে তো আপনি জানেন, নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন না”
“আমি তো জানিনা, তুমিই বলো শুনি”
“ভালোই রসিকতা করতে শিখে গেছেন দেখছি। এগুলো কিন্তু আপনাকে স্যুট করেনা”
“একটু একটু শিখছি, অলয়েজ কি একিরকম থাকবো নাকি? বদলের দরকার আছে”
“যাক! আপনি যে বদলাতে চাইছেন শুনে ভালো লাগলো। আর হ্যা ফুলগুলো খুব সুন্দর হয়েছে। ধন্যবাদ!”
হাসলো জাফরান!
“শুধু থ্যাংক ইউ? তুমি জানো সকাল সকাল ফ্লাওয়ার শপে গিয়ে ফুল কিনে এনেছি। ফার্স্ট টাইম কারো জন্যে এতো আর্লি মর্নিং গিয়ে ফুল এনেছি বুঝেছ? সো শুধু থ্যাংকস বললে হবেনা”
“তাহলে কি করতে হবে আমায়?”
“তোমায় কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু রেটিং দেবে”
“রেটিং? কিসের?”
“রাতে জানতে পারবে। আগে বাড়ি তো ফিরি”
আমি আর কথা বাড়ালাম না, কথা বাড়ানো মানেই ওনার সময় নষ্ট করা আর সেটা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। রেখে দিলাম ফোনটা, কিন্তু উনি কি এমন করবেন যার রেটিং আমায় দিতে হবে এটা ভেবে ভীষণ এক্সসাইটেড! দুপুরের পরে জিনিয়া আপু বাড়ি ফিরে গেলো, আমি আবার একা হয়ে গেলাম! আপু যাওয়ার পর মায়ের সাথে একটু কথা বলে বাড়ির কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলাম। সারাদিন টুকটাক কাজের মাঝে কেটে গেলো
_____________________________
রাতের খাবার বানাতে রান্নাঘরে এসেছি আমি, তখনই জাফরান এলো আর আমায় চুলার সামনে থেকে সরিয়ে নিজে দাড়িয়ে গেলো! প্রথমে বুঝতে পারিনি পরে বুঝলাম যে আজকের রান্নাটা উনিই করবেন
“আপনার এখানে কি দরকার?”
উনি কুকিং অ্যাপ্রোন পড়তে পড়তে বললেন
“মনে নেই সকালে কি বলেছিলাম? রেটিং দিতে হবে তোমায়! আজ রান্না করবো আমি, আর সেটা খেয়ে তুমি রেট করবে”
“কিহ! আপনি করবেন রান্না? মজা করছেন!”
“আমার এই ট্যালেন্ট সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই তোমার? আজ শেফ জাফরান সাঈদের সাথে মিট করাবো তোমাকে”
উনি রান্না করার জন্যে ভীষণ একসাইটেড বোঝাই যাচ্ছে। সত্যি বলতে আমি ওনার এই গুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না!
“আপনি রান্না করতে পারেন নাকি শুধু মুখে বলেই কেরামতি দেখাবেন? যদি তাই করেন তাহলে সরুন, আমি রান্না করে নেবো. আপনার ভরসায় বসে থাকলে আজ আর রাতে খাওয়া হবেনা আমাদের”
উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না উনি যে রান্না করতে পারেন কারণ এখন অব্দি কারো কাছেই শুনিনি এই কথা। আজ হুট করে উনি বললেন, বিশ্বাস করবো কিভাবে?
“তুমি আমায় ফ্রিজ থেকে সবজি বের করে ধুয়ে দিয়ে চুপ করে এখানে দাড়িয়ে থাকো। আজ আমাদের খাওয়া হবে কি হবে না সেটা আমি বুঝবো”
“জাফরান আপনি পারবেন না, শুধু শুধু গরমের মধ্যে ঘেমেনেয়ে একটা কান্ড হয়ে যাবে। আপনি ঘরে যান আমি রান্না..”
“ডু হোয়াট আই সে”
ওনার গরম দৃষ্টি দেখে আর কথা বাড়ালাম না। সবজি এনে ধুয়ে দিলাম। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে চোখের পলকে সবজিগুলো ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেললেন উনি। খেয়াল করলাম আমার থেকেও দ্রুত সবজি কাটলেন!
“ও বাবা! আপনি তো দেখছি আমার থেকেও ভালো সবজি কাটেন। ট্রেইনিং নিয়েছেন নাকি কোথাও থেকে?”
“ট্রেনিং করার দরকার হয়নি ম্যাডাম সব নিজেই শিখেছি! এন্ড ইয়েস শুধু চপিং না কুকিংও করতে পারি তাও আবার খুব ভালোভাবে। সো আমায় এতটা আন্ডারেস্টিমেন্ট করবেন না মিসেস সুরভী বুঝেছেন?”
“আগে রান্না করে খাওয়ান তো, টেস্ট করি তারপরই না বোঝা যাবে কতোটা ভালো পারেন”
আমার কথা শুনে উনি যেনো আরো বেশি এনার্জেটিক হয়ে উঠলেন, নিজেকে প্রমাণ করার জন্য একরকম উঠেপড়ে লাগার মতো অবস্থা আর কি! এরপর উনি খাবার বানাতে শুরু করলেন আর আমি হা হয়ে দেখতে লাগলাম! উনি যেগুলো বানাচ্ছেন ওগুলো পুরোপুরি আমাদের দেশী খাবার না, কিছুটা দেশী – বিদেশী মিক্স খাবার!
“উকিঝুকি মারছো কেনো?”
“বোঝার চেষ্টা করছি এটা কি বানাচ্ছেন!”
“তোমাকে আমি পরে রেসিপি দিয়ে দেবো দরকার হলে, এখন একটু শান্ত হয়ে দাড়াও”
আমিও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, আজ ভীষণ গরম পড়েছে! উনি দেখলাম ঘেমে গেছেন। রোজ কিচেনে কাজ না করার অভ্যাস থাকলে যা হয় আর কি!
“কনফ্লাওয়ার কোথায় রেখেছো? দাও তো!”
“দিচ্ছি”
সেলফের ওপরের তাকে কনফ্লাওয়ার রাখা, কদিন আগে জাফরানকে দিয়েই ওখানে তুলে রাখিয়াছিলাম কারণ অতো ওপরে হাত যায় না আমার! টুল ও নেই এখানে, তাই পায়ের সামনের দিকে ভর দিয়ে কিছুটা উচু হয়ে কৌটোটা নামানোর চেষ্টা করলাম। একটু চেষ্টা করলেই হাত যাবে ওখানে। কিন্তু আজ কেনো যেনো হাতটটা ওখানে যাচ্ছিলো না হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমার কোমরে হাত রেখেছে। চমকে উঠলাম, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পা জোড়া মাটি থেকে ওপরে উঠে গেলো আমার। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম জাফরান আমায় তুলে ধরেছে
“এটা কি করছেন?”
“আগে কৌটোটা নাও”
দেরি না করে কনফ্লাওয়ারে কৌটোটা নামিয়ে আনলাম, জাফরান আমায় নামিয়ে দেখলাম হাত ঝারাঝারি করছেন। আমি ফিক করে হেসে বলে উঠলাম
“আপনি না রোজ সকালে এতো এক্সারসাইজ করেন? আমার এইটুকু ওজন তুলেই হাত ব্যথা করতে শুরু হয়ে গেলো আপনার?”
“আজ বুঝলাম তোমাকে দেখে যতোটা হাল্কা মনে হয় ততোটা তুমি নও। ইউ আর ভেরি হেভি”
“আপনি আমায় মোটা বলছেন?”
“বেশি না, তবে একটু”
খুব রাগ হলো আমার, কি এমন ওজন আমার যে মোটা নামক উপাধি দিয়ে দিলেন আমায়? এরপর পুরোটা সময় আর একটাও কথা বলিনি আমি, চুপটি করে দাড়িয়ে ছিলাম। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিচকি হাসছিলেন, আমি তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি! এভাবে উনি আমায় বলতে পারলেন?
____________________________
জাফরান কয়েক রকমের খাবার বানিয়েছে, আমার কাছে সবগুলোই নতুন। কিছু খাবারের তো নামও জানিনা, তবে খেতে বেশ সুস্বাদু হয়েছে। লোকটা এতো ভালো রান্না করতে পারে না খেলে জানতাম না। আমি খাচ্ছি, উনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন
“এভাবে কি দেখছেন?”
” তোমাকে দেখছি!”
“আমাকে আজ নতুন দেখছেন নাকি?”
“শুধু কি খেয়েই যাবে? কেমন হয়েছে বলবে তো। এতো কষ্ট করে বানালাম, একটু প্রশংসা তো করো”
“আপনি কোনোদিন আবার খাবারের প্রশংসা করেছেন মনে করে দেখুন তো!”
উনি মুখ গোমড়া করে বললেন
“তুমি তো রোজ রান্না করো!”
“হ্যা তো? প্রথম যেদিন আমি রান্না করেছিলাম আপনাদের বাড়িতে এসে সেদিনও তো আপনি কিচ্ছুটি বলেছিলেন না। জিনিয়া আপু জিজ্ঞাসা ও করেছিল আপনাকে তাও বলেননি, তাহলে আজ আমি কেনো বলবো?”
অবাক হয়ে গেলেন উনি, এতো পুরনো কথা টেনে আনবো হয়তো ভাবেননি
“এটা কি ঠিক হচ্ছে সুরভী?”
“অবশ্যই ঠিক! শুদ্ধ বাংলায় একে বদলা নেয়া বলে বুঝেছেন?”
নাক মুখ ফুলিয়ে যা তা অবস্থা করে ফেলেছেন উনি! আমিও সুযোগ পেয়েছি, ছাড়বো কেনো? খেতে খেতে উনি আমার দিকে কয়েকবার চোখ গরম করে তাকিয়েছিলেন অব্দি কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি। সত্যি বলতে আমার বেশ মজা লাগছে ওনাকে জ্বালাতে! খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে এসে বসেছি সবে। মাথাটা যন্ত্রণা করছে, মাথার তালু একদম গরম হয়ে আছে
“কি হয়েছে?”
“মাথা ব্যথা করছে”
উনি আমার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন
“জ্বর তো নেই! মনে হয় এমনি ব্যথা করছে”
হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি, উনি কি একটা ভেবে বললেন
“বসো, আমি এখুনি আসছি”
“কোথায় যাচ্ছেন!”
“তোমার মাথা ব্যথা দুর করার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি”
“কি করবেন আপনি আবার”
“কি করবো দেখতেই পারবে। তুমি এক কাজ করো, নিচে বসো। আমি এখুনি আসছি”
ওনার কথা বুঝলাম না, তবে নিচে বসলাম! জানিনা কি করতে চাইছেন উনি। একটু পরেই দেখলাম ছোটো একটা বাটি করে আমার দুশমন কে নিয়ে এসেছেন সাথে করে, মানে তেল নিয়ে এসেছেন আমার মাথায় দেওয়ার জন্যে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়িয়ে বললাম
“একি! তেল এনেছেন কেনো!”
“এটা দিয়ে ভালোভাবে ম্যাসাজ করে একটু ঘুমালেই দেখবে মাথা ব্যথা কমে যাবে, বসো। আমি ম্যাসাজ করে দিচ্ছি”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম
“আপনি তেল লাগিয়ে দেবেন আমার চুলে? জাফরান প্লিজ, এই গরমের মধ্যে তেল দিতে বলবেন না। আর চুল চিপ চিপে হয়ে গেলে ভালো লাগেনা”
“চুল চিপচিপে হওয়ার চিন্তা বাদ দাও। মাথায় তেল না পড়লে তো ব্যথা করবেই। কোনোদিন তো তেল দিতে দেখলাম না তোমায়”
জাফরানের মুখে আমার মায়ের মতো জ্ঞানের কথা শুনে কেমন রিয়েক্ট করবো বুঝতে পারছি না। এই তেল দেওয়া নিয়ে আমার মা লেকচার দিতো আমায়। আমি আপাতত তেল থেকে বাঁচার চেষ্টায় আছি!
“জাফরান, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি একটু কড়া করে চা বানিয়ে খেলেই ব্যথা চলে যাবে”
“জেদ করছো কিসের জন্যে? তেল দিয়ে ভালোভাবে ম্যাসাজ করলেই মাথা ব্যাথা দুর হয়ে যাবে আর ঘুম ও ভালো হবে”
এবার উনি রেগে গেলেন, ধমক দিয়ে আমায় বসিয়ে দিয়ে বললেন
“তোমার আজকের সমস্যা তো আগে সলভ করো। কালকে সকালে না হয় শ্যাম্পু করে নিও? চুপ করে বসে থাকো এখন”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। উনি এবার একটু একটু করে তেল নিয়ে আমার মাথায় লাগাতে শুরু করলেন। দুঃখে কান্না পাচ্ছে আমার! আগে থেকেই মাথায় তেল দিতে একদম ভালো লাগেনা। মা জোর করে ধরে বেধে দিতো আর আজ জাফরান ও এমন করছে। ওনার জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হলাম তেল নিতে! কিন্তু উনি এতো সুন্দর করে তেল দিয়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন, সত্যিই আমার মাথা অনেকটা ঠান্ডা হয়েছে আর মাথা ব্যথাও অনেকটাই কমে গেছে। এরপর স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো দুটো বিনুনি পাকিয়ে দিলেন! লাস্ট কবে দুই বেনী পাকিয়েছিলাম মনে নেই! আমি বিনুনি দুটো হাতে ধরে দেখতে দেখতে বললাম
“ভালোই তো বিনুনি করেছেন কিন্তু এটা একটু বেশি হয়ে গেলো না?”
“ঠিকই আছে! এবার আরাম করে ঘুমাতে পারবে। আসলে জেনি কে এভাবে তেল দিয়ে বিনুনি করে দিতাম! একরকম প্রাকটিস হয়ে গেছে”
ওনাদের দুই ভাই বোনের সম্পর্ক এতো সুন্দর! শুনলেই মন ভরে যায়। আর উনি আজ যা করছেন সেসব ও অবাক করছে আমায়! অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি জাফরানের মধ্যে। এক রাতের ব্যবধানে এই বিশাল পরিবর্তনের কারণ কি? রোজকার মতন আজকেও টিভি দেখতে এসেছি আমি ড্রইং রুমে, উনি রুমে কাজ করছেন। প্রিয় “ওগি এন্ড দ্যা কক্রচেস” কার্টুন দেখে মনের সুখে হাসছিলাম তখনই…
“কি বাচ্চাদের মতো কার্টুন দেখো? এসব বাদ দিয়ে ফিল্ম দেখতে পারো না!”
জাফরানের গলা পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে তাকাতেই উনি এসে বসে পড়লেন আমার পাশে, হাত থেকে রিমোট নিয়ে হলিউড মুভির খোজ করতে শুরু করলেন। এই সময় কাজ ছেড়ে উনি এখানে কি করছেন ভেবে অবাক হচ্ছি আমি!
“আপনার কাজকর্ম নেই নাকি আজ?”
চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতেই উনি জবাব দিলেন
“আমাকে কি তোমার রোবট মনে হয়? কাজ ছাড়া অন্য কিছু করার ইচ্ছে হতে পারে না আমার? ভাবলাম আজ তোমায় একটু কোম্পানি দেই”
ভ্রু কুঁচকে নিলাম আমি। এই জাফরানকে চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছে আমার! এতগুলো দিনে কোনোদিন উনি আমার সাথে বসে একটুও টিভি দেখেননি
“আপনার কি হয়েছে বলুনতো? আজ অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করছেন”
“কি করলাম?”
“এইযে আমায় রান্না করে খাওয়ালেন, আবার আমার মাথায় তেল দিয়ে দিলেন। আমার কেয়ার করছেন। এখন আবার আমাকে কোম্পানি দিতে এলেন”
“তুমি অন্য মেয়েদের মতো আমাদের নরমাল একটা সম্পর্ক আশা করেছিলে তাইনা? গত রাতে তোমার কথার উত্তর দেইনি কারণ আমি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী”
“নরমাল কাপল লাইফ লিড করার শুরুটা তো কাওকে না কাওকে করতেই হবে তাইনা? তো ভাবলাম আমিই স্টার্ট করি অ্যাজ আ নর্মাল হাসবেন্ড! স্টার্টিং টা ঠিকঠাক ছিলো তো? এখন থেকে সব এভাবেই চলবে ওকে?”
টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম হঠাৎ চমকে উঠলাম ওনার কথা শুনে। উনি এসব আমার জন্যে করছেন? আমার আবদার রাখার জন্যে? আশা বিশ্বাস দুটোই ছিলো জাফরানের প্রতি কিন্তু এতো দ্রুত তা পূরণ হবে ভাবিনি। জাফরানের প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করছি। ওনার প্রতি এই চাওয়া, ওনার সাথে একটা স্বাভাবিক সম্পর্কের আশা কেনো করছি আমি? আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একটু বেশিই ভাবতে শুরু করেছি, ওনার সাথে থাকার এক তীব্র আকাঙ্খা জন্মাচ্ছে আমার মনে। সত্যি কি তাহলে আমি ওনাকে ভালোবেসে ফেললাম?
চলবে….