মন শহরে তোর আগমন পর্ব -১১

0
1533

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ১১

বৃষ্টিভেজা রাস্তায় হাঁটছি আমি আর জাফরান। একটু আগেই বৃষ্টি নেমেছে, এখন একটু গুম মেরে আছে তবে। আকাশটা এখনও থমথমে, মেঘলা! যেকোনো সময় আবার বৃষ্টি নামবে হয়তো। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না দেখে জাফরান আমায় আনতে চায়নি, তবুও আমি জেদ করে এসেছি! আজকের বিকেলটা যে জাফরানের সাথে না কাটালে যে বিরাট এক ক্ষতি হয়ে যাবে আমার। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন, সেখানে বিশেষ মানুষটার সাথে একান্তে একটু সময় না কাটালে কি চলে? চোখ বুঁজে বৃষ্টি শেষে থেকে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়ার পরশ গায়ে মাখছিলাম আমি

“সুরভী আজ তোমায় অন্যদিনের তুলনায় অনেকটা আলাদা লাগছে। কি ব্যাপার বলোতো?”

মুচকি হেসে তাকালাম জাফরানের দিকে, উনি যে অনেকটা কনফিউজড সে বুঝতে বাকি নেই আমার!

“কারণ আজ আমি অনেক খুশি তাই হয়তো অন্যরকম লাগছে। আপনার আমাকে হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগেনা নাকি?”

“সেটার রিজনই তো আস্ক করছি। এতো খুশির কারণ কি? কোনো লটারি পেয়ে গেছো নাকি?”

“লটারি পাওয়া ছাড়া বুঝি মানুষের আনন্দের এর কোনো কারণ থাকতে পারেনা?”

“মানুষের কথা তো বলতে পারবো না কিন্তু তোমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আর হঠাৎ আমায় সাথে নিয়ে এলে কেনো এই কারণ কিন্তু এখনও জানা হলো না। কোন উদ্দেশ্যে এনেছো তাও কিন্তু বলোনি এখনও”

“আমি আপনার কাছে সময় চেয়েছিলাম জাফরান, সেটা আপনি দিয়েছেন। এরপরও এতো প্রশ্ন কেনো? আপনার কি ইচ্ছে নেই আমার সাথে সময় কাটানোর?”

“সেটা কখন বললাম? তুমি তো ভুল বুঝছো আমায়। জানতে ইচ্ছে করছে যে তোমার খুশির কারণ কি। তাই আস্ক করছিলাম”

দাড়িয়ে পড়লাম আমি, উনিও থেমে গেলেন!

“বলবো! একটু ধৈর্য্য তো ধরুন! আচ্ছা শুনুন আমার না আপনার থেকে কিছু চাই”

কিছুটা অবাক হলেন উনি, কারণ আজ অব্দি সেভাবে ওনার কাছে কিছুই দাবি করিনি আমি

“রিয়েলী? সুরভী ফার্স্ট টাইম তুমি আমার থেকে কিছু চাইছো নিজের মুখে। আজ যা চাইবে পাবে। শাড়ি, জুয়েলারি কি চাও তুমি বলো”

সব ছেলেদের মতো ওনারও একইরকম চিন্তাধারা দেখে হেসে ফেললাম আমি

“আমার এসব কিছুই চাইনা জাফরান”

“কেনো? যতদূর আমি জানি মেয়েরা তো এগুলোই চায়। এগুলোর প্রতি মেয়েদের একটা উইকনেস থাকে”

“সব মেয়েদের দুর্বলতা কিন্তু শাড়ি গয়না নয়। আপনি আমাকে আজ অব্দি দেখেছেন এসবের প্রতি আসক্ত হতে?”

না সূচক মাথা নাড়লো জাফরান

“আচ্ছা তুমিই বলে দাও কি চাও?”

“এক গোছা লাল গোলাপ!”

আমি যে এমনকিছু চাইবো সেটা হয়তো ভাবেননি উনি! বেশ অবাক হয়েছে লোকটা!

“শুধু গোলাপ আর কিছুনা?”

“নাহ! শুধু এক গোছা লাল গোলাপ”

মিনিট দুয়েক জাফরান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আমি পলকহীন দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখছি। ওনার এই মুচকি হাসি যে কতবার আমায় ঘায়েল করেছে সে খবর কি উনি জানেন? ওনার প্রতি অভিমান, রাগ – ক্ষোভ যাই থাকুক, দিনশেষে যেনো এই হাসি দেখলেই সব উবে যায়। এসব লক্ষণ তো একদিকে ইঙ্গিত করছে! আচ্ছা আমি কি ওনার প্রেমে পড়ে গেলাম? তখনই ঝুমঝুম করে আবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমরা আর উপায় না পেয়ে পাশের একটা চায়ের দোকানে বসলাম। ওপরে টিনের চাল থাকায় রক্ষে হয়েছে। আমি তো বৃষ্টি বেশ উপভোগ করছিলাম কিন্তু জাফরান বরাবরের মতোই বিরক্ত। কারণ ওনার নাকি বৃষ্টি ভালো লাগেনা

“আজ বেরোনোই ঠিক হয়নি। দেখেছো? এই জন্যেই মানা করেছিলাম। পরে একদিন আসতে পারতাম”

“তাতে কি হয়েছে? বৃষ্টি তো প্রকৃতির সবথেকে সুন্দর সৃষ্টি! এতে বিরক্ত হবার কি আছে? আমরা বসি কিছুক্ষণ, বৃষ্টি চলে যাবে”

“আই হেইট রেইনস! তুমি জানো সেটা”

“কিন্তু আমার তো বৃষ্টি অনেক ভালো লাগে”

জাফরান হয়তো আরো কিছু বলতো কিন্তু সুরভীর মুখপানে চেয়ে থেমে গেলো। একটা মানুষ এতটা পরখ করে বৃষ্টি দেখতে পারে তা জানা ছিলো না ওর। মেয়েটার প্রতি ইদানিং এক অন্যরকম মায়া কাজ করতে শুরু করেছে ওর মনে, সে মায়াও বড় অদ্ভুত! যেনো কোনো ইন্দ্রজালের মতো আষ্টেপিষ্টে ধরছে জাফরানকে। “স্ত্রী” নামক মেয়েটার প্রতি কি তাহলে বিশেষ অনুভূতি জন্মেছে ওর মনে? নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে জাফরান। মন ও জানান দিচ্ছে, হ্যা সেই বিশেষ মায়া জড়ানো অনুভূতি তৈরি হয়ে গেছে সুরভীর প্রতি!

“চা খাবেন?”

চোখ গরম করে তাকালো জাফরান

“আপনি সেদিন আমার চা কেড়ে নিয়ে খেয়েছিলেন”

“কিন্তু ওটা তো তোমার হাতে বানানো চা ছিলো”

“দোকানের চা আমার বানানো চায়ের থেকেও বেটার, টেস্ট করে তো দেখুন একটু”

“না থাক! তোমার ইচ্ছে হলে তুমিই খাও”

আমি আর তর্কে জড়ালাম না ওনার সাথে, মালাই চা বানাতে বললাম চাওয়ালাকে! বৃষ্টির পানিতে জাফরানের চশমা ভিজে গেছে, ওটা খুলে উনি মুছতেই যাচ্ছিলেন তখন আমি ওনার হাত থেকে নিয়ে বললাম

“আমি মুছে দিচ্ছি”

ওড়না দিয়ে চশমাটা মুছলাম তারপর কৌতূহল বশত ওটাকে একটু চোখে দিয়ে দেখতে চাইছিলাম কেমন লাগে। জাফরান অবশ্য মানা করেছিলেন আমায়, কিন্তু আমি শুনিনি কিন্তু চোখে দেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝলাম কেনো না করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে খুলে চশমা ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম

“আল্লাহ গো! এটা কি! কয়েক সেকেন্ডেই তো আমার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। আপনি সারাদিন এটা পড়ে থাকেন কিভাবে!”

উনি হাসতে হাসতে চশমা চোখে দিয়ে বললেন

“হ্যাবিট হয়ে গেছে”

“যেমন আমি আপনার হ্যাবিট হয়ে গেছি তাইনা?”

আনমনে কথাটা বলে ফেলেছিলাম, উনি সেভাবে হয়তো খেয়াল করেনি

“কি বললে?”

“হ..হ্যা? কিছুনা”

_____________________________________

“আপনি জানতে চাইছিলেন না কেনো আপনাকে নিয়ে এসেছি আজ নিজের সাথে? কারণ আজ আমার জন্মদিন। জীবনের এই বিশেষ দিনটায় আমি আপনার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে চাইছিলাম”

ভুট্টা খেতে খেতে কথাটা বলেই ফেললাম। জাফরানের দিকে না তাকিয়েও উপলব্ধি করতে পারছি উনি বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে

“সারাদিন শেষে এখন বলছো এই কথাটা সুরভী? এটা কি আরো আগে জানানো উচিত ছিলো না আমায়?”

ভুট্টা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললাম

“এমনি বলিনি। আসলে আপনাকে আগে জানালে গিফট দেওয়ার জন্যে নিশ্চয়ই ব্যাকুল হয়ে উঠতেন কিন্তু আমার তো নিজের মতো কিছু চাওয়ার ছিলো। তাই আর জানাইনি। সরি!”

মুখ ভার করে মিনিট কয়েক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। একটু আগেও আমরা হাসাহাসি করছিলাম, উনি আমায় জোকস শোনাচ্ছিলেন সেটা নিয়েই মজা করছিলাম কিন্তু আমার একটা কথায় নিমিষেই ওনার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উনি বলে উঠলেন

“আপনি সরি কেনো বলছেন?”

“সেদিন অনেক কনফিডেন্স নিয়ে তোমার সম্পর্কে সব জানবো বলেছিলাম কিন্তু তোমার বার্থডেটাই জানিনা। আমার তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা ছিলো বাট উল্টে তুমি আমাকে দিচ্ছ। আই অ্যাম সরি”

বাচ্চাদের মতো মুখটা এইটুকু করে ফেলেছেন উনি। যেনো বড় কোনো অন্যায় হয়ে গেছে ওনার দ্বারা। তা দেখে আমি না হেসে থাকতে পারলাম না

“মনে হচ্ছে আমার সাথে থাকতে থাকতে আপনারও সরি বলার ফোবিয়া হয়ে গেছে”

“রাগিও না আর আমায় সুরভী। জেনি নিশ্চয়ই জানে আজ তোমার বার্থডে তাইনা?”

হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম আমি তাতে উনি আরো বিরক্ত হলেন। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললেন

“ভেরি গুড। সবাই আগে থেকে সব জানে, শুধু আমিই সবার লাস্টে থেকে যাই। আর তুমিও ইচ্ছে করে আমায় বলোনি! নট ফেয়ার সুরভী!”

“জাফরান, ইটস ওকে! আমি বলিনি বলেই তো আপনি জানেননি। কিন্তু এখন তো জানতে পারলেন। মন খারাপ করতে হবে না আর”

উনি নাক ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

“মন খারাপ কে করছে?”

“কেনো আপনি!”

“আমি কেনো মন খারাপ করতে যাবো?”

“আপনার মুখটা দেখবেন? আয়না এনে দেবো? একদম এইটুকু হয়ে গেছে”

“তুমি এটাই চাও যে সবাই তোমার ব্যাপারে সব জানবে শুধু আমি ছাড়া তাইনা? তাইতো সবার লাস্টে এসে আজ জানতে পারছি আজ তোমার বার্থডে। জেনি পর্যন্ত আমায় ধোঁকা দিলো”

উনি সেভাবে প্রকাশ করছেন না তবে আমি বেশ বুঝতে পারছি যে উনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। হয়তো এরকম আশা করেননি আমার থেকে। ওনার এই অভিমান দেখে অবাক হচ্ছি, ওনারও তাহলে আমার প্রতি অভিমান হয়?

“আপনি যে এতো রেগে যাবেন, অভিমান করবেন সে তো আমি বুঝতে পারিনি। তাহলে আগেই বলতাম। জাফরান, প্লিজ! এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। আর এমন হবেনা। এরপর থেকে যেকোনো ব্যাপারে আপনাকেই আগে জানাবো”

“এখন এসব বলে আর আমার মন ভোলানোর চেষ্টা করো না আর হ্যা তুমি আর কথা বলবে না আমার সাথে”

উনি আমায় কথা বলতে বারণ করছে, এটা মানা তো আমার পক্ষে অসম্ভব! আমি হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ওনার শার্টের কোনো টানতে টানতে বললাম

“এটা কি বললেন জাফরান! আপনি ছাড়া আর কার সাথে কথা বলবো বলুন?”

“কেনো? তোমার তো কথা বলার অনেক মানুষ আছে। তোমার ফ্রেন্ড আছে, তারপর তোমার কি যেনো হ্যা রুহান ভাইয়া আছে তাদের সাথে কথা বলো। আমার সাথে বলার কি দরকার?”

বলেই উনি উঠে গেলেন, আমি নাক মুখ কুচকে ফেললাম ওনার কান্ড দেখে। লোকটা যে এতো অভিমান করতে পারে ধারণা ছিলো না

“আরে কোথায় চললেন? রুহান ভাইয়ার সাথে কি কথা বলবো আমি এখন?”

তখনই উনি ঘুরে আবার এলেন আমার কাছে আর আমার ফোনটা নিয়ে আবার হাটা দিলেন। ওনার কান্ডকারখানা বুঝে উঠতে পারছি না। আমিও ছুটলাম ওনার পিছু পিছু। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আর উনি আর আমি হাঁটছি! চুপ করে আছেন উনি। আমি একটু উকি দিয়ে ওনার ভাবসাব বোঝার চেষ্টা করলাম

“বলছি আমার লাল গোলাপের ডিমান্ড কিন্তু এখনও পূরণ করলেন না। বার্থডে গার্লের কিন্তু আজ আপনার থেকে ফুল চাইই চাই”

“তোমার ডিমাণ্ড তো আমার রাখাই উচিত না সুরভী! এতো বড় একটা কথা লুকিয়ে রেখে এখন আবার ডিমান্ড করছো? কেনো ফুলফিল করবো?”

“ফ্রি তে ডিমান্ড করছি না। আপনি যদি আমার ডিমান্ড ফুলফিল করেন তাহলে আমিও আপনাকে রিটার্ন কিছু দেবো”

উনি উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে বসলেন

“কি দেবে?”

“আগে ফুল কিনে আনুন তারপর”

জাফরান আমার চাওয়া পূরণ করতে চেয়েছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আশপাশে কোনো ফুলের দোকান ছিলো না আর না কেউ ফুল বিক্রি করছিলো। আমার মন কিছুটা খারাপ হয়ে যায় যখন উনি ফিরে এসে বলেন ফুল আনতে পারেননি

“ডোন্ট ওরি, কালকেই তোমার রিমান্ড পূরণ করে দেবো আমি। তার বদলে কিন্তু রিটার্ন দেবার কথা ভুলে যেও না”

“আপনি তো দেখছি বেশ লোভী”

মুচকি হাসলেন উনি

“বউর থেকে রিটার্ন পাওয়ার আশা করার জন্যে যদি লোভী উপাধি পেতে হয় তাতে আপত্তি নেই আমার”

সচারচর উনি “বউ” শব্দটা উচ্চারণ করেন না কিন্তু যখনই করেনি তখনই বুকটা কেমন দুরুদুরু কেপে ওঠে আমার। জাফরানের জীবনে আমার কি ভূমিকা তা সম্পূর্ন জানা সত্ত্বেও প্রতি নিয়ত দুর্বল হয়ে পড়েছি আমি ওনার প্রতি! মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় সব ভুলে নতুন করে সব শুরু করতে। ওনার মুখে রোজ অন্তত একবার হলেও “বউ” ডাকটা শোনার এক অদ্ভুত ইচ্ছে হয়! জাফরান ঊর্ধ্ব মুখী তাকিয়ে দেখে আকাশের অবস্থা সুবিধার না

“সুরভী, আকাশের অবস্থা ভালো না। দেখো মেঘ ডাকছে, চলো আমরা বাড়ি যাই। তোমার ঘুরতে ইচ্ছে হলে কালকে না হয় নিয়ে আসবো”

জাফরান গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই হাত ধরলাম ওনার, ঘুরে তাকালেন উনি

“একটু দাড়ান জাফরান?”

“কিছু বলবে?”

না সূচক মাথা নেড়ে কিছু না ভেবেই হুট করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্দ হয়ে যায় জাফরান। রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে “স্ত্রী” নামক মেয়েটিযে এভাবে জড়িয়ে ধরবে সে জাফরান বুঝে উঠতে পারেনি। আমিও চুপ করে ওনার বুকের ঢিপঢিপ শব্দটি শুনছি, একটু একটু করে তার গতি বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু জাফরান আমায় ধরেনি, অবশ্য আমি সে আশাও করিনা। কয়েক মিনিট পর ছাড়লাম ওনাকে, মুচকি হেসে বললাম

“এবার চলুন”

জাফরান সরু হেসে এদিক ওদিক তাকালেন, আমিও তাকিয়ে দেখলাম রাস্তায় দাড়ানো গুটিকয়েক মানুষ কানাঘুষা করছে। কয়েকজন মুখ টিপে হাসছে। আমার এসব দেখে কেমন যেনো লজ্জা লাগছে। মুচকি হেসে আরচোখে তাকালাম ওনার দিকে। একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলেছি আজ! উনি হাল্কা গলা খাকানি দিয়ে বললেন

“তোমার সাহস আছে বলতে হবে”

“বাড়ি যাবো, চলুন তো!”

জলদি জলদি এসে বসে পড়লাম গাড়িতে। ঈশ! আমি রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে সবার সামনে ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম? নিজেই যেনো নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। মনের মধ্যে হুট করে এক প্রশ্ন উদয় হলো। আচ্ছা জাফরানের মনে কি দায়িত্ব – প্রয়োজন ছাড়া আমার জন্যে আর অনুভূতি সৃষ্টি হয়নি? এছাড়া কি ওনার জীবনে আমার আর কোনো বিশেষ জায়গা নেই?
__________________________________

জিনিয়ার সাথে মারাত্বক রাগারাগি করছে জাফরান, কারণ সুরভীর বার্থডের কথা কেনো ওকে জানানো হয়নি? ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে আছে একদম। আর ওর অবস্থা দেখে জিনিয়া তো হাসতে হাসতে শেষ

“তুই হাসছিস? জেনি, তুই আস্ত শয়তান একটা। আগে থেকে সব জেনেও কিছু বলিসনি আমায়। সুরভীর সামনে মান সম্মান থাকলো না আমার আর”

“আরে তাতে কি হয়েছে?”

“তাতে কি হয়েছে মানে? আরে ও আমার ওয়াইফ! আমার ওয়াইফের বার্থডে আমারই আগে জানার কথা অথচ জানলাম সবার পরে। তোর থেকে অন্তত এটা এক্সপেক্ট করিনি”

“আমি জানতাম নাকি এইটুকু নিয়ে তুই এমন করবি? সুরভীর প্রতি তোর তো তেমন কোনো ফিলিংস নেই। তাই ভাবলাম এইসব নিয়ে তোর মাথা ব্যথাও থাকবে না”

” আরে ফিলিংস এর কথা আসছে কোত্থেকে এখানে? ওয়াইফের বার্থডে মেইন ফ্যাক্ট”

“তুই যে এতো ওয়াইফের বার্থডের কথা বলছিস, ওর প্রতি তো তোর বিশেষ কোনো ফিলিংস নেই। তুই ওর প্রতি থাকা সব দায়িত্ব পালন করছিস এটাই যথেষ্ট না? আবার বার্থডে নিয়ে এতো রাগারাগির কি আছে?”

“এটাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে”

“ওহ! শুধুই দায়িত্ব? আর কিছুনা?”

জাফরান ভ্রু কুঁচকে তাকায়, জিনিয়া যে কোনদিকে উদ্দেশ্য করছে সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে। ও কোনো উত্তর না দিতে উঠে দাড়ায়

“তোর সাথে কথা বললে সেই একি টপিক বারবার টেনে আনিস কেনো?”

“আরে বস, মজা করছি তো। কোথায় যাচ্ছিস?”

“তুই আর সুরভী আজ আমার সাথে যা করলি কোনোদিন ভুলবো না। কিন্তু এখনও সময় আছে। আমার যেটা করা উচিত সেটা করতে যাচ্ছি”
___________________________________

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম, খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার নাম ধরে ডাকছে। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম জাফরানকে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত প্রায় দুটো বাজে

“কি হয়েছে জাফরান?”

“ওঠো তো একটু”

“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে জাফরান, কালকে কথা বলি”

ঘুমে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে আমার, আবার শুয়ে ঘুমাতে চাইছিলাম কিন্তু জাফরান আমায় জোর করে উঠিয়ে বারান্দায় নিয়ে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। তারপর বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে দিতেই ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম সামনের টেবিলে ছোট একটা চকলেট কেক!

“এটা এখানে কোত্থেকে এলো? বাড়িতে তো কোনো কেক ছিলো না”

উনি আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললেন

“আমি কিনে এনেছি”

“এটা আবার কেনো আনতে গেলেন?”

“সো হোয়াট? তুমি তো আমায় আগে বলোনি আজ তোমার বার্থডে ছিলো তাহলে হয়তো আরো কিছু অ্যারাঞ্জমেন্ট করতে পারতাম। যদিও তোমার বার্থডে শেষ হয়ে গেছে”

“আপনি অযথা খরচ করবেন বুঝেই তো বলিনি”

“ভালো করেছো। এখন এটা কাটো তো”

জাফরান ছুরি দিলেন আমার হাতে, আমি মুচকি হেসে কেক কাটলাম!

“হ্যাপি বার্থডে”

ওনার মুখে মিষ্টি একটা হাসি! এতক্ষণে যেনো শান্তি হলো ওনার। বিশেষ কোনো আয়োজন নয়, তবুও যেনো বিশাল এক পাওয়া ছিলো এটা আমার কাছে। জাফরান আমার বার্থডে সেলিব্রেট করেছে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। আমার স্থির নজর দেখে তুরি মেরে উনি বললেন

“ও বার্থডে গার্ল! শুধু তাকিয়েই থাকবে নাকি কেক খাওয়াবে আমায়? জানো কতো ঘুরতে হয়েছে এই কেকটা আনতে? সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছিলো, শেষে গিয়ে একটা দোকানে পেয়েছি”

এমনভাবে বলছিলেন যেনো কেক আনার জন্যে পাহাড়সম স্ট্রাগল করেছেন উনি! আমি হেসে এক টুকরো কেক খাইয়ে দিয়ে বললাম

“এতো স্ট্রাগল করার দরকার ছিলো না”

“অবশ্যই ছিলো, তুমি নিজে কিছু চাইবে না বলে কি ভাবো আমিও চুপ করে বসে থাকবো? আমি অমন নই বুঝেছো!”

“আপনি কেমন তা হয়তো আমার থেকে ভালো কেউ জানেনা জাফরান”

“ওহ রিয়েলী! গুড”

উনি কেক খাইয়ে দিলেন আমায়! এরপর বাকি কেকটুকু নিয়ে ফ্রিজে রেখে এসে বসলাম বারান্দায়, জাফরানের পাশে। আজ রাতের জন্যে ঘুম টাটা বাই বাই হয়ে গেছে বলা যায়! দুজনেই কিছু সময় নিরব ছিলাম। হুট করে জাফরান বলে উঠলো

“সত্যিই তোমার কিছু চাওয়ার নেই?”

“আছে! আমার লাল গোলাপ পেন্ডিং আছে। ভুলে গেলেন?”

“এছাড়া আর কিছু?”

“হুমম আছে তো”

উনি উৎসাহ নিয়ে তাকালেন আমার দিকে

“কি?”

“ছোট্ট একটা ইচ্ছে আছে, পূরণ করবেন?”

উনি মুখে কিছু বললেন না তবে মুখভঙ্গি দেখেই বুঝলাম শোনার জন্যে ভীষণভাবে আগ্রহী। আমি এখনও জাফরানের সেদিনের বলা কথাগুলো ভুলতে পারিনি, কিন্তু আমি ভুলতে চাই। একটা বিশ্বাস আছে যে সময়ের সাথে অনেককিছুই বদলায়, হয়তো আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি ও বদলে যাবে। আমি সব ভুলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম

“জাফরান, আপনি আমায় কি ভাবেন জানিনা। কোনোদিন জানতেও চাইবো না কারণ আপনার মনে কি আছে সেটা জানলে হয়তো আমি আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিকভাবে ভাবতে পারবো না। আপনার থেকে বিশেষ কোনো চাওয়া নেই। আর পাঁচটা স্বাভাবিক স্বামী – স্ত্রীর মতো সম্পর্ক, একটু ভরসা, বিশ্বাস এছাড়া আর চাওয়ার কিছুই চাওয়ার নেই। নিজ থেকে দাবি করবো না কোনোকিছুর, আমি চাই আপনি বিবেচনা করুন কি করবেন। পূরণ করবেন আমার এই চাওয়াটুকু?”

অবাক চোখে তাকালো জাফরান! এইটুকু আর্জি মাত্র মেয়েটার? এতোটা সহজভাবে কারো এতো সুন্দর চাওয়া থাকতে পারে? কি বলা উচিত জাফরানের? হ্যা নাকি না? না বলার প্রশ্নই তো ওঠেনা, কিন্তু হ্যা বললে যে নিজেই নিজের কথায় টিকে থাকতে পারবে না। মেয়েটাকে যে শুধু দায়িত্ত্ব হিসেবেই দেখে এসেছে সে, আজ হুট করে এই চাওয়াটা পূরণ করার মানে তো দায়িত্ব আর প্রয়োজনীয়তার গণ্ডি ডিঙিয়ে জীবনের বিশেষ অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া! সে তো নিজের সাথে নিজেরই করা ছলনাস্বরুপ হবে তাইনা?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে