মন শহরে তোর আগমন পর্ব -০৫

0
1445

#মন শহরে তোর আগমন
#লেখনীতে – Kazi Meherin Nesa
#পর্ব – ০৫

এতদিন বাবার হারানোর যে ভয় পাচ্ছিলো জাফরান তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে আজ। বাবা আজ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পারি জমিয়েছেন পরকালে। কাল অব্দি সবকিছু কতো স্বাভাবিক ছিলো, মাত্র একদিনের ব্যবধানে বাড়ির পরিবেশ কি থেকে কি হয়ে গেলো। বাবার মৃত্যুর পর থেকে জাফরানের আচরণ কেমন যেনো অস্বাভাবিক লাগছে আমার কাছে। যে মানুষটাকে বাবার জন্যে এতো অশ্রু ঝরাতে দেখলাম তার চোখে আজ আজ শুরু থেকে শেষ অব্দি এক ফোঁটাও পানি নেই। কেমন যেনো নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে লোকটা। বাবাকে কবরস্থ করে মাগরিবের নামাজের কিছু সময় পর সবাই বাড়ি ফিরে যখন ড্রইং রুমে বসলো জাফরান তখন সোজা ওপরে চলে গেছে। কেউ কিছু বলেনি ওনাকে আর না আমি কিছু বলার সাহস পেয়েছি। সবার মনমেজাজ খারাপ, সকাল থেকে কিছু খায়নি কেউ। ভাবলাম সবার একটু তো খাওয়া দাওয়া করা দরকার। রান্নাঘরে চলে এলাম, তখন আমার মা এলেন

“এরকম দিন যে দেখবো কোনোদিন ভাবিনি জানো তো মা? গতকাল রাতেও বাবা জাফরানের সাথে কথা বলেছিলেন আর আজ”

“প্রকৃতির নিয়ম তো আর অস্বীকার করা যাবে না রে মা। কিন্তু ছেলেটা একদম একা পড়ে গেলো, ওর কথা ভেবে খারাপ লাগছে”

আমি একটু চুপ রইলাম, জাফরানের মুখটা মনে হলেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই থেকে ওনাকে এতটা বিদ্ধস্ত, অসহায় অবস্থায় দেখেছি যে এখন ওনার কথা ভাবলেই বুক কেপে ওঠে আমার

“মা, সবার জন্য কিছু খাবার বানাবো। সকাল থেকে কেউ কিছু খায়নি। কিন্তু কি বানাবো বুঝতে পারছি না”

“আমি করে দিচ্ছি সবার খাওয়ার ব্যবস্থা। তুই তোর ঘরে যা, তোর এখন জাফরানের কাছে থাকাটা দরকার। ছেলেটা সেই যে ওপরে গেলো আর তো নামেনি”

“কিন্তু মা, আমার সাহস হচ্ছে না। সবকিছু ভেবেই কেমন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, ওনার সামনে কিভাবে গিয়ে দাঁড়াবে? কি বলবো আমি?”

“আমি বুঝতে পারছি রে মা, এমন পরিস্থিতি তো তুই আগে দেখিসনি তাই এমন লাগছে। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না এখন। তুই শুধু জাফরানের আশপাশে থাক। ছেলেটার মনের অবস্থা ঠিক নেই, এখন ওর একজনকে নিজের পাশে প্রয়োজন”

মায়ের কথা শুনে হঠাৎ আমার শ্বশুরের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো, উনি বলেছিলেন জাফরানকে কখনো একা না ছাড়তে। আর আজকে জাফরান তার সবথেকে কাছের মানুষটাকে হারিয়েছে, এখনি তো আমার তার পাশে থাকাটা বেশি জরুরি। ওনার রুমের সামনে দাড়িয়ে আছি, রুমটা অন্ধকার করে রেখেছেন উনি। বেডে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরের উপর বসে আছেন উনি চুপচাপ। একটু বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছে আজ তাকে। আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলাম, বসলাম ওনার পাশে। উনি এক ধ্যানে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আস্তে করে বলে উঠলাম

“জাফরান, আপনি এখানে কেনো চলে এলেন? নিচে সবার সাথে গিয়ে বসলে, দুটো কথা বললে ভালো লাগতো আপনার। এখানে একা ঘরে বসে নিজেকে কষ্ট দেবার মানেই হয় না”

উনি নিশ্চুপ, ওনার মুখের দিকে ভালোভাবে একবার দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললাম। ঠোঁটটা হাল্কা ভিজিয়ে নিলাম

“জানি আপনাকে শান্তনা দেবার সাধ্য আমার নেই তবুও বলবো আপনার বাবা কিন্তু আপনাকে সব পরিস্থিতিতে স্ট্রং দেখতে চেয়েছিলেন। সেখানে আপনি আজ এতোটা ভেঙে পড়েছেন, আপনার বাবার কষ্ট হবেনা এতে?”

এবারও কোনো রিয়েক্ট করলেন না উনি। আমার ভয় হচ্ছে এটা ভেবে উনি আবার চুপ থেকে ট্রমাটাইজড না হয়ে যান

“জাফরান, আপনি কিন্তু আপনার বাবার কথা অমান্য করছেন। উনি আপনাকে এতদিন বুঝিয়েছেন যাতে আজকের দিনের মতো পরিস্থিতি এলে আপনি ভেঙে না পড়েন, নিজেকে কষ্ট না দেন”

একটা টু শব্দ করলেন না উনি, বুঝতে পারছি না উনি কি আমার কথা শুনছেন নাকি না?

“আপনি অন্তত আমার সাথে একটু কথা বলুন, আপনার মনের কষ্টের কথাগুলো শেয়ার করুন দেখবেন হাল্কা লাগবে। এভাবে গুম মেরে থাকলে তো আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। সেটা কি ঠিক হবে?”

আরো অনেকগুলো কথা বললাম কিন্তু উনি কোনো উত্তর দিলেন না, ভাবলাম উনি হয়তো আমার কথাগুলো বিরক্ত হচ্ছেন। উনি হয়তো কিছু সময় একা থাকতে চান তাই কোনো প্রতিউত্তর দিচ্ছেন না আমার কথার। আমি ওনার পাশ থেকে উঠে আসতে যাচ্ছিলাম

“তুমিও চলে যাচ্ছো?”

করুন কণ্ঠে বলে উঠলেন উনি, আমি এবার মুখোমুখি বসে পড়লাম। এটাই তো চাইছিলাম উনি কিছু বলুক, কথা বলুক আমার সাথে

“তুমিও চলে যাবে এখন?”

বাচ্চাদের মতো অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন, চোখদুটো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে ছিলো ওনার। গাল গড়িয়ে সেগুলো ঝরতে শুরু করেছে এখন,আলতো হাতে ওনার চোখের পানি মুছে দিলাম। এই প্রথমবার ওনাকে স্পর্শ করলাম আমি।

“ভাবলাম আপনি একা থাকতে চান তাই চলে যাচ্ছিলাম, আপনি চাইলেই থাকতে পারি”

আকুতির স্বরে উনি বললেন

“আমি একা থাকতে পারবো না, প্লিজ!”

কয়েক সেকেণ্ড ওনার পানে চেয়ে রইলাম, ওনার চোখেমুখে কেমন এক ভয় দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আচমকা উনি জড়িয়ে ধরলেন আমায়। ওনার বলিষ্ঠ বাহুজোড়ার মাঝে যেনো পিষ্ট হয়ে যাওয়ার জো হয়েছে আমার, তবুও কিছু বললাম না। উনি আমায় জড়িয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন, আমি আস্তে আস্তে ওনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। যন্ত্রণা কম তো করতে পারবো না তবে ওনার সাথে থেকে কষ্টটা একটু ভাগ করে তো নিতে পারবো
________________________

প্রায় অনেকটা সময় ধরে উনি ঠায় বসে আছেন, আমিও চুপ। চোখদুটো কেমন লাল হয়ে গেছে ওনার

“মা মারা যাবার বছরখানেক পর বাবা কানাডা পাঠিয়ে দিয়েছিল আমায়। বাবার থেকে আট বছর দূরে ছিলাম। অনেক অভিযোগ ছিলো বাবার ওপর আমার কারণ জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল আমাকে একটা অচেনা দেশে, একা। কিন্তু রাগ করে থাকতে পারিনি বাবার ওপর। লাস্ট ইয়ার দেশে ফেরার পর ভেবেছিলাম বাবার সাথে এবার অনেকটা সময় কাটাতে পারবো কিন্তু সেটা আর হলো না। আই অ্যাম সো আনলাকি”

“আপনি আনলাকি নন জাফরান, বলুন আপনি অনেক লাকি যে এমন একজন বাবার ভালোবাসা পেয়েছেন”

“আমার সবথেকে কাছে মানুষগুলো এভাবে চলে গেলো কেনো বলোতো? এতোটা খারাপ আমি যে সবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলাম? বাবাই তো ছোটো থেকে সব ছিলো। আজ বাবাও চলে গেলো। মা – বাবা দুজনের কেউই রইলো না আমার। কেনো আমার সাথেই বলতে পারো?”

“মানুষ তো মরণশীল তাইনা? সবাইকে একদিন আগে হোক পরে হোক যেতেই হবে। একে একে সব প্রিয় মানুষরাই তো হারিয়ে যান এভাবেই। সবটাই আল্লাহর ইচ্ছা তাই এখানে নিজেকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই”

“নিজের ওপর রাগ হচ্ছে আমার সুরভী, আমি যদি জেদ করে থেকে যেতাম দেশে তাহলে এই আট বছর বাবার থেকে দূরে থাকতে হতো না, হয়তো আমার কষ্টটা আজকের থেকে তুলনায় কিছু কম হতো”

“আপনি তো আর আগে থেকে জানতেন না এমন কিছু ঘটবে, তাছাড়া আপনার বাবা তো আপনাকে ভালোভাবে স্টাডি করানোর জন্যেই নিজের থেকে দূরে পাঠিয়েছিলেন! ওনার ও তো কষ্ট হয়েছে আপনাকে ছেড়ে থাকতে। তাও আপনার ভালোর জন্য উনি করেছেন”

খানিক সময় পরপর জোরে নিঃশ্বাস ফেলছেন উনি, বুঝতে পারছি নিজের অপ্রকাশিত কষ্টটা চেপে রাখতে খুব করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি এক গ্লাস পানি এনে দিলাম ওনাকে

“পানিটুকু খেয়ে নিন জাফরান”

উনি একটু পানি খেলেন, গ্লাস রেখে আমি উঠে দাড়ালাম। ভাবলাম ওনার জন্যে এবার একটু খাবার নিয়ে আসি

“আপনি বসুন, আমি একটু আসছি”

“এখানেই থাকো, যেও না কোথাও”

“যাবো আর আসবো আমি, দু মিনিট লাগবে”

“যেতে হবে না, এখানেই বসো”

“আপনার জন্যে একটু খাবার নিয়ে আসি?”

না সূচক মাথা নাড়লেন উনি। ফ্লোরের উপর আমার হাতটা ছিলো, উনি আমার হাতের ওপর হাত রাখলেন। একা থাকতে চান না উনি তাই আমায় নিজের পাশে চাইছেন, কথাটা ভেবেই কেমন এক ভালোলাগা কাজ করছে আমার মাঝে। কিন্তু ওনাকে এভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছে আমার, এটা কিভাবে প্রকাশ করবো? একটু বাদে উনি আমার কাঁধের ওপর মাথা রাখলেন

“জাফরান”

“একটু ঘুমাতে চাই আমি সুরভী”

“একটু খেয়ে তারপর ঘুমান। সারাদিন কিছুই তো খাননি, সারারাত না খেয়ে কিভাবে থাকবেন”

“খাবার এখন গলা দিয়ে নামবে না, প্লিজ জোর করো না”

আর কিছু বললাম না, এই মুহূর্তে ওনার একটু বিশ্রামের সত্যিই খুব প্রয়োজন। সুরভীর মা সবার জন্য খাবার বানিয়ে এনেছেন, কারো খাওয়ার ইচ্ছে নেই কিন্তু বাঁচতে হলে একটু তো খেতে হবে তাই একটু আধটু সবাই খেয়ে নিলো। তখন ওর বড় ফুপু জিজ্ঞাসা করলো

“সবাই খেলো কিন্তু জাফরান কই? ও তো সকাল থেকে কিছু খায়নি। ছেলেটার অবস্থা দেখেছো? ভাইজানের এই চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি বেচারা”

“ও দেশে ফিরেছে এক বছরও তো হয়নি, কতো প্ল্যানিং করেছিলো ও এখানে এসে বাবার সাথে সময় কাটাবে সে আর পারলো না, এত সহজে এই ঘটনা কিভাবে মেনে নেবে ফুপি?”

“ছেলেটাকে একটু খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর, জেনি যা তো খাবার নিয়ে জাফরানের কাছে”

“হ্যা, আমি দেখছি”

সুরভীর মা জাফরানের জন্যে প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বললেন

“জাফরান তো আর নিচে নামেনি, হয়তো রুমেই আছে। আপনারা খান, আমি ওর খাবার ঘরে না হয় দিয়ে আসছি”

“না অ্যান্টি, আপনি বসুন। আমি দিয়ে আসি, এমনিতেও ওর সাথে কথা বলার আজ সাহস পাইনি আমি। দেখে আসি কি অবস্থায় আছে”

সুরভীর মা আর আপত্তি করলেন না, খাবার প্লেটটা ওর হাতে দিয়ে দিলেন। জিনিয়া জাফরানের রুমের সামনে এসে থেমে গেলো, ভাই ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আর বিরক্ত করলো না। অনেকটা রাত হয়ে গেছে, জাফরান ও ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষন হলো। ওনার মাথাটা আস্তে করে আমার কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে কোলের ওপর রাখলাম। চশমাটা বিছানার ওপর রেখে দিলাম যাতে আবার ভেঙে না যায়। মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে ওনার, আলতো ভাবে ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওনার বদনপানে তাকিয়ে দেখছি। আমি সেভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় ওনাকে দেখিনি বললেই চলে, আজ সুযোগ পেয়েছি। জাফরানের মুখটা বেশ মায়াবী, চশমা পড়লে একটু গম্ভীর লাগে আর চশমা ছাড়া একদম তার উল্টো। হয়তো আজ এমন পরিস্থিতির শিকার না হলে এই মানুষটাকে আমি কোনোদিন দেখতামই না, আর না চিনতাম। ওনাকে আমি নিজের কাছে আসার অনুমতি দেবো না ঠিক করেছিলাম শুরুতেই কিন্তু আজ দূরে ঠেলে দিতে পারছি না কেনো? কেনো তাকে কষ্টে দেখে আমার এতো কষ্ট হচ্ছে। যেনো এই ঘুমন্ত যুবকটি কোনো এক অদৃশ্য মায়া ঘিরে ফেলেছে আমায়। “মায়া” নামক অনুভূতি যে অনেকটা চোরাবালির মতো, একবার সেখানে আটকে গেলে বেরিয়ে আসা যে অসম্ভব!
___________________________

সময় তো আর থেমে থাকে না, সে চলেছে আপন গতিতে। দুমাসের অধিক সময় কেটে গেছে, জাফরান এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কাজের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, তবে সেদিনের পর ওনাকে আর আমার সামনে এতটা ভেঙে পড়তে দেখিনি আমি। একটু একটু করে নিজের সংসার সামলানো শুরু করেছি আমি। জাফরান এখন আগের তুলনায় অনেকটা ইজি হয়ে গেছে আমার সাথে। কিন্তু ওনার একটা স্বভাব লক্ষ্য করেছি, আমার সাথে যা কথা বলেন অন্য কারো সাথে তার অর্ধেক ও বলেন না। বিষয়টা একটু বেশিই ভালো লাগে আমার। পড়া শেষ করে আজ একটু আগেই শুয়ে পড়েছি, খুব ঘুম পাচ্ছে। তখনই জাফরান রুমে এসে আমায় দেখে বললো

“আজ এতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছ যে? রোজ তো এই টাইমে বলেও তোমাকে ঘুম পাড়ানো যায় না। পড়া কমপ্লিট নাকি?”

“হ্যা, কাল তো ইজি পরীক্ষা। তাই ভাবলাম আজ একটু আগেই ঘুমাই। আপনি কি এখন কাজ করবেন?”

উনি হেলান দিয়ে বসে পড়লেন ল্যাপটপ নিয়ে

“হুমম, এন্ড ডোন্ট ওয়ারি লাইট অফ থাকবে। তোমার ঘুমে প্রব্লেম হবে না, ঘুমিয়ে পড়ো”

আমিও উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়লাম, ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম হুট করেই ঘুরে তাকালাম জাফরানের দিকে

“আচ্ছা জাফরান, আপনি কি আমায় কালকে দিয়ে আসতে পারবেন এক্সাম হলে?”

ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি

“কালকে স্পেশাল কিছু আছে নাকি?”

“নাহ আসলে, এমনি বলছিলাম”

“যাওয়া আসায় কোনো প্রব্লেম হচ্ছে?”

না সূচক মাথা নেড়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলাম, আসলে আমি নিজেই জানিনা কেনো ওনাকে বললাম কথাটা। তার ওপর উনিও কিছু বললেন না, মনটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার। আমার এমবিএ এর লাস্ট এক্সাম ছিলো আজ, মোটামুটি হয়েছে আর কি। সেভাবে তো পড়ার সুযোগ পাইনি বিয়ের পর। পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরোতেই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কেয়া বলে উঠলো

“দেখ সুভী, আজ আমাদের এক্সাম ও শেষ। জানিনা এরপর আমরা কে কোথায় থাকবো। আজ আমাকে তোর বিয়ের ট্রিট টা দিয়েই দে”

“অমনি শুরু হয়ে গেলো তোর? পালিয়ে যাবো নাকি আমি? পরে নিস ট্রিট”

“মোটেই না, তুই তো জানিস আমার বাবা আমার বিয়ের জন্যে ছেলে খুঁজছে। কবে যেনো বিয়ে হয়ে দুর দেশে চলে যাবো আমি তখন ট্রিট নেবো কিভাবে? তার থেকে ভালো এখনি দিয়ে দে”

“সরি, এখন হবেনা। পরে একদিন দেবো”

কেয়া মুখ গোমড়া করে ফেললো, ও জানে আমি যেটা না করি সেটাকে হ্যা করানো সম্ভব না। পরে ও দাত কেলিয়ে হেসে বললো

“আচ্ছা যাহ, ট্রিট দিতে হবে না। অন্তত আমাকে জাফরান ভাইয়ের সাথে দেখা তো করিয়ে দে, তাকে তো দেখলামই না কোনোদিন। একটা ফটো অব্দি নেই ওনার তোর ফোনে”

কেয়ার কথায় ঠোঁট উল্টালাম আমি, সত্যিই আমার কাছে জাফরানের একটাও ছবি নেই। আসলে ছবি তোলার সুযোগ তো পাইনি কখনো

“এখন জাফরান কে তোর সাথে কিভাবে দেখা করাবো আমি বলতো? উনি তো অফিসে আছেন, তুই এক কাজ কর। একদিন বরং আমার বাসায় চলে আয় তখন দেখা করে নিস”

তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠলো, কেয়া টেনে আমার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো জাফরানের কল এসেছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম, উনি দরকার ছাড়া আমাকে ফোন করেন না। বান্ধবী আমার স্পিকারে দিয়ে দিলো কলটা!

“স্পিকারে দিলি কেনো?”

“আমি শুনবো তোরা কি কথা বলিস, কথা বল”

উনি তো আমার সাথে এমন কিছু বলবেন না যা লোকে শুনতে পারবে না, তাই স্পিকারে থাকা অবস্থাতেই কল রিসিভ করলাম

“কোথায় আছো?”

“এইতো ক্যাম্পাসে আছি, কিছু বলবেন?”

“আমি হলের মেইন গেটের সামনে আছি, চলে এসো”

এইটুকু বলেই ফোন কেটে দিলেন উনি, অবাক হলাম আমি। উনি এখানে কি করছেন? কেয়া তো খুশি, ওনার সাথে দেখা করতে পারবে ভেবে। হলের মেইন গেটের সামনে এসে দেখলাম ঠিকই উনি গাড়িতে হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছেন। এতদিন ধরে এক্সাম দিচ্ছি, একাই এসেছি। আজ ওনাকে হলের বাইরে দেখে হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠলো আমার। কাল আমি একবার বলেছিলাম। উনি দিয়ে তো জানি আমায় তবে নিতে এসেছেন, আমার কথা রাখলেন উনি? ভেবেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো আমার

জাফরানকে দেখে কেয়া কুনুই দিয়ে আমার হাতে গুতো দিয়ে বললো

“সুভী, আমার না বড্ড হিংসে হচ্ছে রে তোর ওপর। হি ইজ সো হ্যান্ডসাম”

“চুপ কর, ওনার সামনে গিয়ে এসব কথা বলে বসিস না আবার। এই ধরনের কথাবার্তা ওনার পছন্দ নয়”

ওনার সামনে এসে দাড়ালাম, সঙ্গে সঙ্গে উনি প্রশ্ন করে উঠলেন

“হাউ ওয়াজ ইউর এক্সাম?”

“হয়েছে মোটামুটি, কিন্তু আপনি হটাৎ এখানে? এইসময় তো অফিসে থাকার কথা আপনার তাইনা?”

“আমার এখানে আসাটা তোমার পছন্দ হয়নি নাকি?”

দ্রুত গতিতে না সূচক মাথা নাড়লাম, আমি যে কি ভীষণ খুশি হয়েছি ওনাকে বোঝাই কিভাবে? তখনই কেয়া আমাকে সরিয়ে জাফরানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো

“ভাইয়া, নিজের বৌর সাথে কথা তো বাড়ি গিয়েও বলতে পারবেন। এখন একটু আমার সাথে কথা বলুন”

ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো জাফরান, উনি তো চেনেন না আমার বান্ধবীকে।

“ও হলো কেয়া, আমার বান্ধবী”

“একি সুভী? আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড আর এতো সাদামাটা ইন্ট্রো করালি তুই আমাকে ভাইয়ার সঙ্গে? ভাইয়া, আমি হলাম আপনার বৌর বেস্ট ফ্রেন্ড আর আপনার সুইট শ্যালিকা”

আমার ছ্যাচড়া বান্ধবী আমার জামাইর সাথে হাত মেলানোর জন্য উসখুস করছিলো, ভেবেছিলাম জাফরান বুঝি হাত মেলাবে কিন্তু নাহ! উনি মুখেই “হাই” বললেন। কেয়ার ওপর একটু রাগ ও হচ্ছিলো ঠিকই তবে গর্ব হচ্ছিলো সেই মুহূর্তে আমার জাফরানের ওপর

“ভাইয়া, একটা অভিযোগ আছে আমার আপনার বৌর ওপর”

জাফরান আমার দিকে তাকালো, আমি ইনোসেন্ট ফেস করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি

“কি করেছে ও?”

“আমি সুভীর কাছে বিয়ের ট্রিট চেয়েছি, ও টালবাহানা করছে। বান্ধবী হিসেবে আমার এইটুকু পাওনা না বলুন তো?”

“অবশ্যই তোমার পাওনা”

“জাফরান, আপনি ওর তালে সায় দিচ্ছেন?”

“সায় দেবার কি আছে সুরভী? সি ইজ ইউর ফ্রেন্ড। এইটুকু তো চাইতে পারে তাইনা?”

“এই দেখুন, ভাইয়া আপনি বুঝে গেলেন আর আমার বান্ধবী বুঝলো না এইটুকু একটা ব্যাপার”

“ইটস ওকে! আমি তো বুঝেছি। তবে এরপর থেকে তোমার ট্রিট চাওয়ার থাকলে ওর কাছে নয় বরং আমার কাছে বলো। আফটার অল সি ইজ মাই ওয়াইফ আর ওয়াইফের ফ্রেন্ডকে ট্রিট দেবার দায়িত্ব এখন আমার”

“সি ইজ মাই ওয়াইফ” কথাটা এখনও যেনো আমার কানে বাজছে। ভাবিনি ওনার মুখে এই কথাটা কোনোদিন শুনবো, আশাও করিনি কখনো কিন্তু আজ যখন শুনলাম এতো ভালো লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে উনি যেনো একটু একটু করে আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানতে শুরু করেছেন। ছোট্ট একটা কথা তবুও সে যেনো একরাশ আনন্দ দিয়ে গেলো আমায়। জাফরান ট্রিট দেবার জন্যে রাজি হয়ে গেলো!বেশ বড়সড় একটা ট্রিট নিয়েছে বটে আমার বান্ধবী, জাফরান উল্টে ওকে আরো বেশি বেশি জিনিস নিতে বলছিলো। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম এসব দেখে, জাফরান আমার বান্ধবীকে আমার হয়ে ট্রিট দিচ্ছে। হাউ সুইট!
_____________________________

ড্রাইভ করছেন উনি, আর আমি এতক্ষন বাইরের দিকে দেখছিলাম। প্রাইভেট কার জাতীয় গাড়িতে উঠলেই অবস্থা খারাপ হয়ে যায় আমার, তার ওপর এসি চালু থাকলে তো আরো। জানালাটা খোলা থাকলে তাও একটু শান্তি। জাফরান তাই জানালা খোলাই রেখেছে। বাইরের দৃশ্য অবলোকন শেষে ওনার দিকে নজর দিলাম। গরমে ঘেমে উঠেছেন উনি, তবুও আমায় একবারের কিছু বলেননি। গাড়ির এসি ছাড়ার জন্যে জেদ ও করেননি। ঘর্মাক্ত ললাটে চুলগুলো লেপ্টে গেছে ওনার, চোখে চিকন নীল ফ্রেমের চশমা। পার্পল কালারের শার্ট পড়েছেন উনি। সবমিলিয়ে কি দারুন লাগছে ওনাকে। এক ধ্যানে ড্রাইভ করে চলেছেন উনি।

“আপনি তো ঘেমে যাচ্ছেন, এসি অন করে নিন। আমি জানালা আটকে দিচ্ছি”

“ইটস ওকে, কিছু করতে হবে না”

আমি প্রতিউত্তর না দিয়ে ড্যাশবক্স থেকে টিস্যু বের করলাম করে কপালটা মুছে দিলাম। আমার জন্যে বেচারা এই গরমে ঘেমে একসা হচ্ছে। উনি কিছুটা অবাক চোখে তাকালেন, আমি মুখ গোমড়া করে বললাম

“আপনাকে বড্ড সমস্যায় ফেলে দিয়েছি আমি তাইনা? কি করবো বলুন, আমি না এসির ওই অদ্ভুত স্মেল একদম সহ্য করতে পারিনা। কেমন সাফোকেশন হয়”

“আমি কি কিছু বলেছি তোমায়?”

“কিন্তু আপনার আমার জন্যে সমস্যা তো হচ্ছে, নিজের চোখেই তো দেখছি”

“এই তো কিছুটা রাস্তা বাকি আছে, এটুকু এসি ছাড়া আমার সমস্যা হবে না। তুমি নিজের কমফোর্ট দেখো”

“সরি”

উনি ভ্রু কুঁচকে নিলেন

“এই তোমার থ্যাংকস আর সরি বলার ফোবিয়া আছে নাকি? যখন বলতে শুরু করো আর থামতে চাও না”

হেসে ফেললাম আমি, কৌতূহল বশত ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেই বসলাম

“আপনি বলেছিলেন কোনোদিন আমায় নিজের স্ত্রী বলবেন না তাহলে আজ কেয়াকে আপনি নিজের স্ত্রীর হয়ে ট্রিট কেনো দিলেন?”

মুচকি হাসলেন উনি!

“ও তোমার কাছে ট্রিট চেয়েছিলো, তুমি না করে দিয়েছিলে। এখন আমি ওখানে উপস্থিত থাকা অবস্থায় ওকে তো কিছু একটা বলতে হতো। তাছাড়া তোমার তো থ্যাঙ্কফুল হওয়া উচিত, তোমার ফ্রেন্ডকে আর তোমায় ট্রিট দিতে হবে না। বাঁচিয়ে দিলাম এই ঝামেলা থেকে”

“ধন্যবাদ জাফরান”

ড্রাইভের ফাঁকে একনজর তাকালেন আমার দিকে উনি

“এর জন্যে ধন্যবাদ বলার দরকার নেই”

“আপনি কেয়াকে ট্রিট দিয়েছেন তার জন্যে তো ধন্যবাদ বলিনি”

“তাহলে?”

“এইযে আপনি আমায় নিতে এলেন তাই দিলাম। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম আপনি আমাকে ড্রপ করে দিয়ে যান একদিন, তবে কোনো ব্যাপার না। পিক হোক বা ড্রপ যেকোনো একটা তো করেছেন”

“তোমার বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে সুরভী, আমার বাড়ি যাওয়াটা দরকার ছিলো। যাওয়ার পথেই তোমার এক্সাম হল, তাই ভাবলাম পিক করে নেই তোমায় এছাড়া কিছুই না”

“দরকার না থাকলে বুঝি আপনি আমায় নিতে আসতেন না?”

“আমি তো তোমায় পিক করতে আসিনি, জাস্ট ইন কেস এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমাকে নিয়ে যাওয়াটা বেটার হবে ভাবলাম তাই পিক করেছি, দ্যাটস ইট!”

নিমিষেই মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো আমার ওনার কথা শুনে, কোথায় ভেবে বসেছিলাম উনি আমার জন্যে এসেছেন আর উনি কিনা এভাবে বলছেন?বড্ড খারাপ লাগলো আমার, অন্তত আমার মন রাখতে মিথ্যে ও তো বলতে পারতেন উনি, এভাবে বলাটা কি খুব দরকার ছিলো?
_____________________________

ওনার কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লেগেছিলো আমার, তাই বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম কিন্তু এতো গরম লাগছে যে ঠিকমতো একটু ঘুমাতেও পারলাম না। ঘুমটা পূর্ন না হওয়ায় মাথাটা কেমন ধরে আছে। মুখে পানির দুটো ঝাপটা মেরে নিচে এলাম। ডানহাতে মাথাটা ধরে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলাম তখন ড্রইং রুমে ওনাকে দেখলাম

“আপনি এখনও বাড়িতেই আছেন? যাননি অফিসে?”

“নাহ! যে পেপারস দরকার ছিলো সেটা ড্রাইভারকে দিয়ে আমার সেক্রেটারির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি”

“ওহ। তারমানে আপনি বাড়িতে আছেন এতোক্ষণ ধরে?”

“তো কোথায় যাবো?”

আমি কিছু বললাম না, ওনার ওপর রেগে আছি আমি হুহহ! আমার মুড অফ করিয়ে দিয়েছে উনি। কড়া করে পুরো এক মগ চা বানিয়ে নিয়ে ওপরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই উনি ডেকে উঠলেন আমায়

“আবার ওপরে কেনো যাচ্ছো? এখানে এসে বসো”

“কেনো?”

“বসতে বলেছি বসবে, অনেক তো ঘুমালে। আরো শুয়ে থাকলে মাথা ব্যথা বেড়ে যাবে”

কথাটা খুব একটা ভুল বলেননি উনি, এখন আবার গিয়ে শুয়ে পড়লে মাথা এবার ঘুরতে শুরু করবে। গিয়ে বসে পড়লাম ওনার পাশে, টিভিটা অন করে দিলাম,ওনার সাথে একটাও কথা বলিনি তবে আমার অনুভব শক্তি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। থাকুক গে, আমার তাতে কি? টিভির দিকে তাকিয়েই চা খেতে যাচ্ছিলাম হুট করে আমার চায়ের মগ একরকম কেড়ে নিলেন উনি, সু সু করে এতোটা চা খেয়ে নিলেন। আমি বোকার মতো ওনার দিকে চেয়ে রইলাম কতক্ষন, উনি অর্ধেক খেয়ে আমার হাতে মগ ধরিয়ে দিলেন

“ইটস গুড! বাট এত্তো সুগার খাওয়া ভালো না সুরভী। এরপর থেকে আরো কম চিনি দিয়ে চা খাবে”

চায়ের পরিমাণ এখন মগের অর্ধেক হয়ে গেছে দেখে হা হয়ে গেলাম আমি। এই লোকটা চা খায়না তাতেই এতোটা খেয়ে নিলো? যদি চা খোর হতো তাহলে তো পুরো মগটাই সাবাড় করে দিতো!

“এটা কি করলেন আপনি”

“কি করলাম?”

“নিজেই দেখুন কি করেছেন, কতটা বানিয়ে এনেছিলাম আর কতটুকু করে দিয়েছেন আপনি”

মগ দেখিয়ে কথাগুলো বললাম। বাচ্চাদের হাত থেকে চকোলেট কেড়ে নিলে বাচ্চারা যেমন করে আমিও তেমন করছিলাম। চা খোর মেয়ে আমি, তাই কেউ আমার একটু চা খেয়ে ফেললেও খুব রাগ হয়। উনি সরু দৃষ্টিতে চেয়ে আমার কান্ড দেখছেন

“ইউ নো হোয়াট? ইউ আর বিহেভিং লাইক আ কিড। এইটুকু ম্যাটারের জন্যে এমন করছো?”

“এটা আমার জন্যে অনেক বড় ব্যাপার বুঝেছেন? আর আপনি তো চা খান না, তাহলে আমার চা টেনে নিয়ে খেলেন কেনো তাও আমার অনুমতি ছাড়া?”

“চা খাবার জন্য পারমিশনের কি আছে? তোমার অন্যান্য খাবার টেস্ট করা হলেও চা টা কিন্তু এখনও টেস্ট করিনি। ভাবলাম একটু টেস্ট করা দরকার তাই খেলাম”

“কেনো খাবেন? যখন খেতে বলতাম তখন তো খুব কফির সুনাম করেছিলেন তাহলে এখন কেনো? নিজের কফি নিয়ে খুশি থাকুন না। আমার চায়ের দিকে নজর কেনো দিচ্ছেন? দেখুন তো অর্ধেকটাই খেয়ে নিয়েছেন”

অভিমান করে আছি ওনার ওপর, তাই কিছুটা রেগেই কথাগুলো বলে ফেললাম। উনি হয়তো আশা করেননি আমি এভাবে রিয়েক্ট করবো

“হোয়াটস রং উইথ ইউ সুরভী! একটু চায়ের জন্যে এভাবে রিয়েক্ট করছো কেনো?”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না, ওনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অবশিষ্ট চা খেতে শুরু করলাম। উনি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন

“এক্সাম তো শেষ, এবার কি করার প্ল্যান করছো?”

“কিসের প্ল্যান করবো আবার? আই হ্যাভ নো প্ল্যান”

“তুমি কি রেগে আছো আমার ওপর?”

একবার তাকালাম ওনার দিকে, তারপর আবার টিভির দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললাম

“আপনার ওপর রাগ করতে যাবো কেনো আমি বলুনতো? এমনিতেও আমার রাগে বা আনন্দে কারো কিছু আসে যায় নাকি?”

উনি কিচ্ছু বললেন না আমার কথার উত্তরে, উল্টে সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে বললেন

“আজ সন্ধ্যায় আমার এক ফ্রেন্ডের ব্যাচেলর পার্টি আছে, সেখানে যেতে হবে। তৈরি হয়ে নিও”

“ব্যাচেলর পার্টিতে তো ছেলেরা যায়, আমি ওখানে গিয়ে কি করবো? আপনি গিয়ে এনজয় করে আসুন”

“যারা ম্যারেড তারা ওয়াইফ নিয়ে আসবে, সো তোমাকেও আমার সাথে যেতে হবে। রেডি থেকো”

উনি আর দাড়ালেন না, চলে গেলেন ওপরে। আমি কথা শোনার যেনো প্রয়োজন বোধ করেনা উনি, শুধু নিজের কথা বলার দরকারটা বোঝেন। একটু একটু করে মনের মধ্যে ওনার জন্যে ভালো লাগা হয়তো তৈরি হচ্ছিলো কিন্তু আজ সেটাও শেষ করে দিলেন উনি। নাহ, এই মানুষটার প্রতি আমি দুর্বল হবো না। কেনো দুর্বল হবো? উনি তো কদর করতেই জানেন না! তবুও ভাবলাম যাবো, ওনার বন্ধুগুলো কে দেখতে চাই। জানার শখ জাগলো যে তারা কেমন। ওনার বলে দেওয়া সময়েই তৈরি হয়ে নিলাম আমি, লাইট ব্লু রং এর শাড়ি পড়েছি। সাথে ম্যাচিং চুড়ি আর স্টোনের ইয়ার রিং। কিন্তু সমস্যা হলো কুচি যে দিয়েছি সেটা ঠিকঠাক হয়নি, সেগুলোকে আবার খুললাম। কুচি খোলার পর আরেক জ্বালায় পড়লাম, কিছুতেই ঠিকমতো দিতে পারছি না এবার! হুট করেই উনি রুমে ঢুকে পড়লেন। দুজনেই অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলাম, দুজনেই দু দিকে ঘুরে তাকালাম। উনি গলা খাকানি দিয়ে বললেন

“সরি, আমি খেয়াল করিনি তুমি রেডি হচ্ছো”

“রেডি তো হয়েই গেছিলাম, কেনো যে আবার ঢং করে এই কুচিগুলো খুলতে গেলাম। এখন তো দিতেই পারছি না”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে আমি নিজের কাজে ব্যাস্ত ছিলাম, উনি হয়তো আমার কথা কিছুটা শুনেছেন। রুম থেকে না বেরিয়ে উল্টে আমার সামনে এসে দাড়ালেন, আমি থতমত খেয়ে গেলাম

“আপনি গেলেন না কেনো?”

“আমি গেলে তোমার প্রব্লেম সলভ করবে কে? লেট হয়ে যাচ্ছে আমাদের”

আমি মুখ ফুলিয়ে নিলাম, কেনো যে মায়ের কথামতো সময় থাকতে একটু ভালোভাবে কুচি দেওয়া শিখলাম না! নাহলে আজ এরকম পরিস্থিতে পড়তে হতো না

“দাও, আমি কুচি করে দিচ্ছি”

“এক মিনিট, আপনি কুচি করবেন মানে? শাড়ি পড়াতে পারেন নাকি!”

“শাড়ি তুমিও পারফেক্টলি পড়তে পারো না। ট্রাই করতে তো প্রব্লেম নেই, দেখি দাও আমাকে”

সত্যি বলতে ওনার সামনে একটুও ইতস্তত বোধ করছি না আমি, জানিনা এমন কেনো হচ্ছে। দিলাম ওনার হাতে, উনি আস্তে আস্তে কুচি করে দিতে লাগলেন আর আমি ওনাকে দেখতে ব্যস্ত। ব্ল্যাক কালার শার্ট আর জিন্স পড়েছেন উনি, শার্টের মধ্যে আবার সাদা রং এর বর্ডার। হাতে কালো রং এর ঘড়ি। বেশ মানিয়েছে ওনাকে, শুধু চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সেগুলোই মনে হয় ঠিক করতে এসেছিলেন। কুচি করে দিয়ে উনি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন গোজার জন্যে। তারপর নিচু হয়ে বসে সুন্দর করে ঠিক করে দিলেন। আমি মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছি ওনায়, এমন একটা মানুষের ওপর কি রাগ করে থাকা যায়?

“ঠিক আছে দেখো তো?”

“একদম পারফেক্ট, শুধু চুলগুলো এলোমেলো লাগছে। হেয়ার সেট করেননি নাকি?”

মাথা তুলে তাকালেন উনি আমার দিকে, চশমা ঠিক করে বললেন

“আমি কুচির কথা আস্ক করেছি সুরভী, আমার কথা না!”

কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম আমি, ঈশ! উনি কি বলছিলেন আর আমি কি বলছিলাম। কি ভাববেন উনি এবার? আমি হ্যা সূচক মাথা নেড়ে বললাম শাড়ি ঠিক আছে। উনি উঠে আয়নার সামনে গিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললেন

“তুমি যে আমাকে চেক আউট করো জানা ছিলো না তো”

“কেনো? আপনাকে দেখা বুঝি আমার বারণ আছে?”

জানিনা কি ভেবে বাঁকা হাসলেন উনি, আমিও মুচকি হাসলাম। নিজের কাছে নিজে আর কি গোপন করবো? ইদানিং যে ওনাকে একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে, ওনার প্রতি রাগ অভিমানটার রূপ ও যেনো আগের তুলনায় একটু অন্যরকম। এর কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?
______________________________

আটটার দিকে জাফরান আমায় নিয়ে নিজের বন্ধুর পার্টিতে হাজির হলেন! ক্লাবে হলেও জাফরানের বন্ধুর ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন অনেকটা ঘরোয়া ভাবেই করা হয়েছে। খুব বেশি হলে বারো – চৌদ্দ বন্ধু এসেছে। তার মধ্যে চার – পাঁচজন ম্যারেড। ওনার বন্ধুগুলো বেশ মিশুক, আমারও ওনাদের সবাইকে ভালোই লাগলো। সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে তখন যখন জাফরান আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। এসবের দরুন লোকটার ওপর যে অভিমান করে থাকাটা যে আমার পক্ষে ভারী মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। আমি আর আরেক ফ্রেন্ডের ওয়াইফ একসাথে বসে কথা বলছিলাম। জাফরান কথা বলছিলো ওর এক ফ্রেন্ডের সাথে তখনই দেখলাম কোত্থেকে যেনো এক মেয়ে ছুটে এসে জাফরানের গলায় ঝুলে পড়লো! আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ আবার কোন আপদ এসে জুটলো? জাফরান ও দেখি হেসে হেসে কথা বলতে শুরু করলো মেয়েটার সাথে। আমি টেবিলে আর বসে থাকতে পারলাম না, সোজা উঠে গিয়ে জাফরানের পাশে দাড়িয়ে পড়লাম। শুনতে হবে তো সবটা যে কি কথা বলছে দুজনে! মেয়েটা চওড়া একটা হাসি দিয়ে জাফরানকে চোখ মেরে বললো

“কত্তদিন পর তোকে দেখছি জাফরান। তুই তো দেখছি একটুও বদলাসনি, সেই আগের মতোই হট এন্ড হ্যান্ডসাম আছিস”

আমি মুখ ফুলিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি! জাফরান ও দেখি বাঁকা এক হাসি দিলো। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে, আমার সামনে হাসতে কষ্ট লাগে ওনার আর অন্য মেয়ের সামনে হাসলে কিছুই না? ওনার দিকে চোখ গরম করে তাকালাম! উনি আরচোখে আমার দিকে দেখে মেয়েটাকে বললো

“নাতাশা এসব কথা ছাড়। মিট মাই ওয়াইফ সুরভী!”

মেয়েটা একনজর আমার দিকে তাকিয়ে অভিমানী স্বরে জাফরানকে বললো

“ওয়াইফ? বিয়ে করে ফেলেছিস? কিরে তুই জাফরান, খুব তো বলতিস আমাকে বিয়ে করবি। এখন অন্য একজনকে বিয়ে করে নিয়েছিস! কষ্ট পেলাম কিন্তু”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে