#মন মহুয়া
রাইটার – Farhana Rahaman আয়াত
পার্ট -০৩
মহুয়া…….
হ্যাঁ মা বলো।আমি আর রিনি তোর ফুফুর বাড়ি যাচ্ছি।
ঘরের মধ্যে পটের বিবি হয়ে না বসে কাজকর্ম সেরে রাখবি।আর শুন আজ পুকুরে জাল দিবে।মাছগুলো কেটে রাখবি।আমি ফিরে যা করার করব।বাপ মেয়ে আবার বড় মাছ রেধে সাবাড় করিস না।নেহাৎ তোর ফুফু জোর করলো যেতে তাই যেতে হচ্ছে।
কি হলো কথা কানে গেছে।
মহুয়া হ্যাঁ সূচক মাথা টা ঝাকালো।
মহুয়া মা বের হয়ে বড় রাস্তার মোড়ে গাড়িতে উঠলে একটা বড় নিশ্বাস ফুঁকে। যেন আজ স্বাধীনতা দিবস।
তাড়াতাড়ি করে ঘরের সব কাজ সেরে পুকুরের দিকে গেলো। এখনো জাল দেয়নি।বাবা আর চাচাতো ভাই করিম এখনো নিয়ে আসেনি।মাছ দেখতেও সময় লাগবে তাই মহুয়া গেল তানিয়ার কাছে।তানিয়া মহুয়ার সবচেয়ে কাছের মানুষ। বন্ধু, বোন সব।সবকিছু ওর সাথে ভাগাভাগি করে নেয়।তানিয়ার কোনো ভাই বোন নেই তায় মহুয়াকে নিজের বোন বলে মানে।তবে আজকাল তানিয়া মহুয়ার বাড়িতে যায়না।ওর মায়ের কথাগুল সয্য করতে পারেনা।একটু বাকপটু তাই মুখের উপর বলে ফেলে সবটা তাই মহুয়ার মার দুচোখে বেশি পড়ে।মহুয়া যতটা শান্ত তানিয়া ততটা অস্থির।
মহুয়া বলে কয়ে তানিয়া কে নিয়ে আসে ওদের ঘরে।অনেকগুলো মাছ কাটতে বেশ সময় লাগবে।দুজন করলে আজ শাপলার বিলে যাবে দুজন। তানিয়া বকবক করতেই লাগলো। মহুয়া বলে যদি চুপচাপ কাজ সেরে শাপলার বিলে যেতে পারে তাহলে একটা খবর দিবে।তানিয়া আরো বেশি বকবক করতে লাগলো।
প্রায় ৯ কেজি মাছ দুজন কেটে পরিস্কার করে নিল দুপুর ১টার মধ্য।মহুয়ার বাবা বলে গেছে বড় কাতাল মাছ টা রান্না করতে।কিন্তু মহুয়া ভাবছে মায়ের কথাগুলো। জানতে পারলে আস্তো রাখবেনা।
তানিয়া ওর কান্ড দেখে বলে মাছগুলো কি কাচা গিলে খাবি নাকি।এতক্ষন কাজ করিয়ে খাওয়ানোর ইচ্ছে নেই নাকি।খিদের জ্বালায় পেটে মোচড় দিচ্ছে।
মহুয়া বলে মা জানলে শেষ। আর এত বড় মাছ রান্না করলে তুই বাবা আমি নাহয় খেলাম।কিন্তু বাকিগুলো?
তানিয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,ওরে আমার বাবুটা এত চিন্তা। আমি এখনি সমাধান করে দিচ্ছি।শুন চাচা কে তো বলে বুঝানো যাবে।তাই বড় মাছটা থাক তোর মাকে শুধু এটা দেখিয়েই খুশি করে দিস।আর এই যে বড় তেলাপিয়া গুলো আমার চোখে আটকে আছে তিনটা সুন্দর করে ফ্রাই করে ফেল দেখি।আমি ততক্ষনে হাত মুখ ধুয়ে আসি।
মহুয়া খিলখিল করে হেসে দিলো ওর এমন এক্টিং করে কথা বলা দেখে।একমাত্র তানিয়াই পারে ওকে হাসাতে।
মহুয়া মাছ ভেজে বাবা আর মহুয়া কে নিয়ে খেয়ে নিলো।বাবা মাছ দেখেই বুঝে গেছে মহুয়া এমাছ কেন রাধলো তাই আর কিছু বললো না।মহুয়া মাছের কড়াই টা সহ ধুয়ে তুলে রেখে বাবাকে বলে বেরিয়ে পরলো।৩ টা বেজে গেছে।ঘন্টা খানেক সময় আছে।
শাপলার বিলে আসলে মহুয়ার যেন সব মন খারাপ দূর হয়ে যায়।অনেকটা জায়গা জুড়ে শাপলা আর শাপলা। দেখলেই খুশিতে মনটা ভরে যায়।তার থেকেও বেশি ভালো লাগে মহুয়া গাছটা।মহুয়ার নামের সাথে মিলে যায় বলে এই গাছের প্রতি আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করে।আর মহুয়া ফুলের মিষ্টি ঘ্রানে একটা মাদকতা কাজ করে।মহুয়ার ইচ্ছে করে গাছটার কাছেই একটা ঘর বেধে থেকে যেতে।তা তো সম্ভব না তাই মহুয়া ফলের বীজ নিয়ে বাড়ির পুকুর পাড়ে অনেকবার পুতে দিতো চারা হওয়ার জন্য কিন্তু ছারা হতো না।যাও একটি হলো চাচা গাছ কাটার সময় কেটে ফেলেছিল।বেশকিছু ফল কুড়িয়ে ওরনার কোনায় বেধে নিলো।বিলে নেমে শাপলা তুলতে লাগলো। তানিয়া নিজে সেল্ফি তুলছিলো সাথে মহুয়ার ও বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নেয়।দুজন গাছের নিচে বসে শাপলার কান্ড থেকে আশ তুলে খেতে লাগলো।
তানিয়া বলে কি যেন বলবি বলেছিস বলবি না?
বলছি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি তুই?মহুয়া বলে উঠে।
-এটাই তোর কথা ছিলো?
মহুয়া বলে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তানি।
তানিয়া বলে সত্যি? মহুয়া মাথা নেড়ে হুম বলে।
তানিয়া চুপ করে থাকে। মহুয়া বলে কার সাথে জানিস?মিনার ভাইয়ার সাথে।
তানিয়ার খুব খারাপ লাগছিলো একা হয়ে যাবে তাই কিন্তু খুশিও হচ্ছে।হেসে বলে আলহামদুলিল্লাহ। যাক তোর মা কটকটির হাত থেকে রক্ষা পাবি?
মহুয়া বলে আমার আর রক্ষা,আমার কপালে সুখ থাকলে মা,, তানিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলে আমার শুরু করলি তো শাবানার ডাইলগ।দেখবি ভালই হবে সব।
মহুয়া বলে আমাকে মনে পরবে না তুর?
তানিয়া হেসে বলে মনে পরার কি আছে,
মহুয়া জানে পাগলীটা মুখে বলছে।মহুয়াও থাকবে কি করে ভাবছে।নিজের ফোন ও নেই যে কথা বলবে।
আসরের আজান দেওয়ার আগে আগেই মহুয়া বাসায় ফিরে আসে। ফিরে দেখে বাবা পুকুরঘাটে বসে খুব হেসে হেসে কথা বলছে।বাবাকে অনেকদিন পর এভাবে হাসতে দেখে মহুয়ার ও ভাল লাগছে।
মা ও চলে আসে।বুরকা খোলার আগেই রান্নাঘরে ঢুকে দেখা শুরু করে মাছগুলো। বড় মাছটা দেখে শান্তিতে বসে বড় মাছটা মহুয়াকে রান্না করতে বলে বাকিগুলো ওর চাচাদের ফ্রিজে রাখতে বলে ঘরে চলে যায়।
মহুয়ার বাবার ডাক শুনে বাবার রুমে যায়।মহুয়ার মা গাল ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে।মহুয়ার বাবা বলে,মা তোর আংকেল ফোন করেছে। সামনের শুক্রবারে আকদ টা সেরে ফেলবেন বলছে।
তার মানে বাবা এইজন্যই এতো খুশি।আর মাত্র ৫দিন বাকি।বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে।
মিনারের কথাগুলো রেহানের বারবার মনে পড়ছিলো।জয় ঠিক ই বলেছে এত বেশি করে ফেলেছে যে সামনে যেতে লজ্জা হচ্ছে।তারপরও একবার সামনে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। খুব জরুরি।
মিনারের মা আর বোনেরা মিলে কিছু টুকটাক শপিং সেরে ফেলে। মিনার কলেজে যায়নি এইকয়দিন।বাবার সাথে অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখছে।
মিনারের বাবারা ৩ভাই।বড় ভাই মিনারের আব্বু,মেঝ ভাই বিদেশে থাকেন।ছেলেও বিদেশে পড়াশুনা করে।বউ আর এক মেয়ে থাকে এখানেই। ছোট চাচা আর তার বউ আছেন।তাদের কোন সন্তান নেই।মিনাররা থাকে উপরের ফ্লোরে।মেঝ চাচা সেকেন্ড ফ্লোরে, আর ছোট চাচা নিচের ফ্লোরে।
মিনারের মা ছোট চাচা আর চাচিকে ডেকে সবটা জানায় বিয়ের ব্যাপার এ।ওনারা বেশ খুশি হয়।আর সবটা বুঝেন।মেঝ চাচীকে বলেন নি,বরং সবসময় গোপন করতে হবে নাহয় পুরো এলাকায় মাইকিং করে করে জানিয়ে দিবে।
বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে মিনারের ফুফু আর বড়বোন মিরা ছাড়া সবাই চলে আসে গ্রামে।রাত টা পার হলেই জুম্মার নামাযের পর আকদ।
মহুয়ার বাবা সামর্থ্য অনুযায়ী সব আয়োজন করেছে। মিনাররা কাউকে না জানালেও মহুয়ার বাবা ছোটখাটো দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছে।রাতে মেহেদী আর হলুদের আয়োজন করেছে।
সন্ধ্যা নামতেই লাল সবুজ রঙের ঝারবাতির আলো তে ভরে উঠে মহুয়াদের উঠোন আর পুকুর পাড়টা।
মহুয়াকে দেখে বলবেনা ওর ই বিয়ে হচ্ছে।সকাল থেকে জীবনের শেষ কাজ করিয়ে নিচ্ছে ওর মা।রিনিতো সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত। কত লোকজন আসবে দেখবে।
মিনারের ঘরের মধ্যে অস্থির লাগছিলো তাই ছাদে উঠে পায়ছারি করছে।সিগারেট খাবে তার ও উপায় নেই।কখন কে দেখে ফেলে।মিনার লুকিয়েই স্মোকিং করে।হাটতে হাটতে মিনারের চোখ যায় পুকুরঘাটে।একটা ছোট মেয়েকে ৫জন মহিলা পানি দিয়ে গোসল করাচ্ছে।মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছেনা ঠিকভাবে। মিনার ভাবে যতসব আজগুবি চিন্তাভাবনা। এইসময় গোসল করাচ্ছে কেন?দিনে কি অসুবিধা ছিল।এম্নিতেই ঠান্ডা পরছে একটু।মায়ের ডাকে মিনার নিচে যায়।একি কয়েকজন মহিলা কলসি হাতে দাড়িয়ে আছে আর ফিসফিস করছে কেও হাসছে।মা বলেছে ওর গোসল করতে হবে।মিনার মাকে বলে এসব কি?আমি সকালেই শাওয়ার নিয়েছি।মা বলে নিয়ম।মিনার বলে এসব আজগুবি নিয়ম আমি মানতে পারবোনা।তুমি জানো এসব আমার পছন্দ না।জোর করো না প্লিজ।মিনার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।মা আর কি করবে সবাই কে বাইরে যেতে বলে।
মিনারের মা আর ছোটবোন মিমি মহুয়ার জন্য যে গায়ে হলুদের শাড়ি গয়না কিনেছিল সেগুলো আর ওদের পরিবারের সবার জন্য কেনা জামাকাপড় নিয়ে মহুয়াদের বাসায় যায়।মিনার কে আনা গেল না এত বলেও।
তানিয়া বেশ হেসেহেসে মহুয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ কি যেন হলো তানিয়ার খুব কস্ট হতে লাগলো। হয়তো আর চেপে রাখতে পারছে না কান্না।একবার কান্না করে নিলেই যেন আবার শক্তি খোজে পাবে।তাই তানিয়া মিনারদের পাশে যে বড় কাঠাল গাছ তার নিচে বসে কাদতে লাগলো। মহুয়াদের উঠোন আর সবখানে মানুষ তাই এখানেই কিছুক্ষন বসে। উঠে চলে আসার সময় জোরে খেলো এক ধাক্কা তাও মিলনের সাথে।তানিয়া ভয় পেয়ে মোবাইলের আলোটা জ্বালায়।মিলনকে আগে দেখেছিল তাই চিনে।বলে,আপনি অন্ধকারে ভুতের মতন হাটছেন কেন?
মিলন চুপ করে চেয়ে আছে তানিয়ার দিকে।কান্না করে মুখটা লাল হয়ে গেছে তানিয়ার,চোখ গুলো ভিজে আছে। কেমন একটা মায়াবি চাহনি। নিজেকে সাম্লে নিয়ে বলে সেটা তো আমিও বলতে পারি।এত রাতে এখানে কি?মিলন বলে।
তানিয়ার এমনি ভাল লাগছে না তাই কথা না বাড়িয়ে চলে আসে। মিলন ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।একটু হেসে ঘরে চলে আসে।
হলুদ এর সাজে মহুয়াকে যেন হলদে পরী লাগছে ওকে।কিন্তু মুখে হাসির লেশ মাত্র নেই বরং চোখের কোনায় জল ছলছল করছে।কি করবে একবার ও মায়ের কবর টা দেখা হলো না।ঘর থেকে বের হতে দিল না।কিন্তু আর পারছেনা।খুব মনে পরছে।
মহুয়া চুপচাপ বসে আছে সবাই এক এক করে ওকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। এক এক করে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে চলে গেলো। মহুয়া তানিয়াকে যেতে দিল না।তানিয়া বসে বসে মহুয়ার দুহাত মেহেদী তে রঙিন করে দিল।
মহুয়ার সাথে তানিয়ার ও খাওয়া হয়নি।রাত ও হয়েছে।তানিয়া মহুয়াকে বসিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দুকাপ চা আর কেক নিয়ে আসে। তানিয়া মহুয়াকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেল।মহুয়া তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে জল পরছে।মায়ের পর বাবা আর তানিয়াই ওকে অনেক বেশি ভালবাসে।এতটা যত্ন করে। মহুয়াকে কাদতে দেখে তানিয়া বলে, কিরে বিয়ে বাড়ি কে মরা বাড়ি বানাবি নাকি।জানি জানি এই রোজিনা কে ছাড়া শাবানা থাকবে কি করে তাই ভাবছিস তো?চিন্তা করিস না উপায় করে ফেলেছি।
মহুয়া কান্না থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বলে কি উপায়?
তানিয়া বলে, তোর দেবর বা ভাসুর একটা ধরে বিয়ে করে তোর কাছাকাছি চলে যাবো।শুনলাম তোর নিজের একটা দেবর আছে?সেটিং করে ফেলবো!
মহুয়া এবার ফিক করে হেসে দিলো।
দুজন কথা বলে বলে বাকি রাত টা পার করে দেয়।
চলবে