মন মহুয়া পর্ব-০১

0
1295

মহুয়া

‍‍‍‍‍‍‍#মন মহুয়া

রাইটার – Farhana Rahaman আয়াত

পার্ট – ০১

ভোর ৫টা…

এখনো ভোরের আলো পুরোপুরি ফুটেনি।
মসজিদের ইমাম সাহেব নামায পরে একটু হাটতে বের হলেন।পাশেই কবরস্থান।ইমাম সাহেব এর কানে যেন চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।এগিয়ে গিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে উনার চোখ পরে হিজল গাছের নিচে। কাছে গিয়ে ইমাম সাহেব মাথায় হাত রেখে বলেন,
মহুয়া মা।তুই আবার এখানে এসেছিস?কতবার বুঝালাম তোকে কবরস্থানে মেয়েদের আসতে নেই।গুনাহ হবে।
মহুয়া মুখ টা মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে বলে,জানি হুযুর। কিন্তু কি করব বলুন।আমার যে কোন জায়গায় শান্তি নেই শুধু এখানেই পায় এক্টু শান্তি। আমি তো কাছে যাচ্ছি না হুযুর।শুধু দূর থেকে একটু দেখি।
তোর শান্তি হবে মা।আর একটু অপেক্ষা কর।
ঘরে ফিরে যা মা।এমন একা একা এত সকালে বের হওয়া উচিত না। বাবা চিন্তা করবে।যা মা।

মহুয়া উঠে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।কাছেই ওদের ঘর।
এটা মহুয়ার আজকাল কার ব্যাপার না।যখনি মন বেশি খারাপ হয় ও মায়ের কবর দেখতে চলে যায়। কেউ দেখার আগেই আবার চলে আসে।

মাত্র ৬ বছর বয়সে মহুয়ার মা মারা যায়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ের জন্য নারাজ ছিলেন কিন্তু সবাই বুঝায় যে এভাবে একা মহুয়াকে মানুষ করা তার পক্ষে সম্ভব না।আর তা ছাড়া যাকে বিয়ে করার জন্য বলছে সবাই সে আর কেউ না মহুয়ার আপন ছোট খালা।খালার থেকে বেশি কে আর ভালবাসবে তা ভেবেই মহুয়ার বাবা ও রাজি হয়।
কিন্তু সব ভাবনা সবসময় সঠিক হয়না।আপন খালা ততদিন আপন ছিল যতদিন নিজের কোন সন্তান জন্ম নেয়নি।মহুয়ার খালা রিনা আক্তার এর যখন দুটো যমজ শিশু এক্ ছেলে আর এক মেয়ে জন্ম নেয় তখন থেকে মহুয়া যেন আবার মা হারা হয়ে যায়।
মহুয়ার প্রতি শারিরিক নির্যাতন না করলেও মানসিক নির্যাতন করেন বহুগুন।যা অনেক বেশি কস্ট দেয় মহুয়াকে।
গত রাতেও মহুয়া একগাদা কথা শুনেছে মার থেকে।
কারন হল মহুয়ার জন্য তার মেয়ে আর ছেলের ভবিষ্যত নস্ট হচ্চে।মহুয়ার বাবা মহুয়ার নামে জমি কিনেছে। তার সন্তানের কোন ভাগ নেই তাই মহুয়ার মার এত রাগ।মহুয়ার বাবা রাসেদ আলম জেনে বুঝেই এ কাজটি করেন কারন ওনি ভালো করে জানেন ওনার অবর্তমানে মহুয়ার কি দশা হতে পারে।
মহুয়া বাবাকে অনেক বলেও তাও শুনেন নি ওনি।
ওনি বলেন আমি যা করেছি ভেবে করেছি।রিনি আর রাতুল মহুয়ার ভাইবোন এর জন্য ঘর এর জমিটুকু আছে।মহুয়া কে আলাদা করে কিনে দিলেন যাতে ঝামেলা না হয় পরে।মহুয়া ওদের সাথে থাকে ঠিক তবে বারবার সে যে আলদা তা মনে করিয়ে দে ওরা।
রাতুল অবশ্য মায়ের কথা মত চলেনা। মহুয়া কে খুব ভালবাসে। নিজের বোন রিনির থেকেও বেশি।বলতে গেলে বাবার মত হয়েছে রাতুল।

সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে মহুয়া। মায়ের জন্য আর পরা হবে কিনা তা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে মহুয়া।পড়াশুনার খরচ চালাতে একদম নারাজ ওনি।ওর বাবা সামান্য বেতনের চাকরি তাও সাম নের মাসে অবসর হয়ে যাবেন।সারাজীবনে উপার্জন এর টাকা থেকে অল্প অল্প কিছু জমিয়ে তিনি জমিটুকু কিনেছেন।আর একটি কাজ বাকি ওনার।সেটাও সেরে ফেলবেন শিগগিরই। কারন তার দেহে কোনো এক মরনব্যধি জন্ম নিয়েছে যা সকলের অজানা।

মহুয়া ঘরে ফিরে ঘরের কাজকর্ম শেষ করে নেয়।আজ আবার মিজান আংকেল রা শহর থেকে আসবে।পুকুরের একপারে মহুয়াদের ঘর অন্যপারে মিজান আংকেল এর দুতলা ঘরটা।বাবা বলে গেছে মিজান আংকেল আর ওনার স্ত্রী রেহেনা আসবেন।ঘর টা সাজিয়ে রাখতে।খাওয়া দাওয়া মহুয়াদের বাসায় করবে।মহুয়া ভাবছে ওরা কেন আসছে হঠাৎ। ওনারা কোন অনুসঠান হলে নাহয় ঈদে আসে।বেশি না ভেবে মহুয়া মিজান আংকেল এর ঘর টায় গিয়ে দরজা খুলে দেয়।বিছানা পত্র গুছিয়ে রাখে।রাতে থাকবেন।অনেকদিন বন্ধ থাকায় ঘরটায় ধূলো জমে গেছিলো।

মহুয়া মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কি রান্না করবে কিন্তু মা বাবার সাথে ঝগড়া করছে তুমুল ভাবে।কারণ টাও মহুয়া।মহুয়া দাড়িয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলো।
মা মহুয়ার বাবাকে বলছে, তোমার মেয়ে হূরপরি না যে এত দেমাগ দেখাও তুমি।আমার ভাইয়ের ছেলে কম কিসে।বাজারে নামডাক আছে।বড় কাপড়ের দোকান আছে।আর কতদিন ঘরের অন্ন ধংস করবে?
মহুয়ার বাবা রেগে বলতে লাগলো, তোমার কি উদেশ্য আমি ভাল বুঝতে পারছি।কিন্তু তা কখনো সফল হবে না।তোমার ভাইয়ের ছেলে যে কেমন আর কত সুনাম আমি ভাল জানি।যদি ভাবো এসব করে জমিটা কব্জা করবে তা হবেনা।আমার মেয়ের বিয়ে ওর মা মারা যাওয়ার আগেই ঠিক করে গেছে।আর আমি মরার আগে বিয়েটা দিয়ে যাব।তোমার গলার কাটা দূর করব।
মহুয়ার মা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,বানরের গলায় মুক্তোর মালা।তোমার ওই মেয়েকে ওমন শহুরে বড়লোক ছেলে বিয়ে করবে?
এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি তো মা।মা নাহও অন্তত খালা হয়ে তো মেয়েটাকে শান্তি দাও।আজ মিজান আর ওর বউ আসবে।দয়া করে ওদের সামনে তামাশা করো না।
যা খুশি করো শুধু মাথায় রেখ রিনির বিয়েও দিতে হবে।তোমার আদরের মেয়ের জন্য আমার মেয়ের যেন…..মহুয়ার বাবা কথা না শুনে উঠে বেরিয়ে আসে।দরজার পাশে মহুয়াকে দেখে। মহুয়ার চোখ ভিজে উঠেছে। ওর বাবা ওকে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসে।নিজের কাছে বসিয়ে বলে,
মা আমি তোকে সব বলছি। কান্না থামা মা।
– আব্বু আমি কি বোঝা তোমার কাছে?
-না মা। তুই তো আমার সব।আমি এখনই তোর বিয়ে দিতাম না।কিন্তু আমার যে….
-কি?
-না মানে বিয়ে তো দিতেই হবে।
-কি লুকাচ্ছো আব্বু?
-কই?
– আমি কে?
– আমার মা।
– মা বুঝে সব।বলো,,
মহুয়ার বাবা সত্যি টা গোপন করে বলে,
– তুই তো জানিস আমি আর তোর মিজান আংকেল খুব ভালো বন্ধু।আমাদের মতো তোর মা আর তোর রেহেনা আন্টিও খুব ভালো বান্ধুবী ছিল।তারা ছোট বেলায় তোদের বিয়ে ঠিক করে রাখে ওদের ছেলে মিনার এর সাথে।অবশ্য এটা তুই আর মিনার কেউ জানিস না।তোরা ছোট ছিলি তায় বলাও হয়নি।
আমি জানি মা তুই এখন ও ছোট।এস এস সির রেজাল্ট ও বের হয়নি।কিন্তু তুই তো শুনলি তোর মায়ের কথা।অবশ্য তোর নিজের মা থাকলে আমার চিন্তা হতো না।পড়াশোনা টা নাহয় বিয়ের পর করবি।আমি মিজান এর সাথে কথা বলে নিবো।

মহুয়া বাবার কথাগুলো শুনে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে আসে। মায়ের কথা মনে পড়ছে আবার।এত জলদি বিয়ে ভাবতে পারেনি।আর বাবা কেন এত তারাতাড়ি করছে তাও ভাবছে।অবশ্য হলে একদিকে ভাল হবে।ঘরের ঝামেলা দূর হবে।
মহুয়া মিনার কে ছোটবেলায় দেখেছে।ওর মা বাবা,বড়বোন মিরা, ছোটবোন মিমি,ছোটভাই মিলন আর ফুফু আমেনা ওদের চেনে মহুয়া।মিনার আসেনি পড়াশোনার জন্য।ওর মা বলতে শুনেছে অনেকবার।
মহুয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ে মায়ের ডাকে।রান্নার জন্য ডাকছে।

বিকাল এর দিকে মিনারের মা বাবা আসে।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে মহুয়ার বাবা মিনার এর মা বাবার সাথে ওদের বাসায় যায়।কথা বলার জন্য।
মহুয়াদের ঘরে বলতে গেলে ওর মা অশান্তি করবে আর মহুয়া জেনে যাবে আসল কারন তাই।

মিনার এর মা বাবা বেশ চিন্তায় আছেন এভাবে হুট করে আসার জন্য বলায়।ফোনে বলার জন্য বলেছিলেন তারা তাও বলেন নি।
মহুয়ার বাবা কথা বলা শুরু করলো,
মিনার আর মহুয়ার বিয়ে দিতে চায় তাও যত জলদি সম্ভব।
মিনারের মা বাবা একটু অবাক হয়।কারন মিনারের এর পরাশুনা এখনও শেষ হয়নি।একবছর বাকি মাস্টার্স ফাইনাল এর।আর মহুয়া মাত্র এস এস সি দিলো।এত জলদি বিয়ের কারন কি বলে উঠলেন মিনারের মা।
মহুয়ার বাবা এবার নিজেকে সামলাতে পারলো না।
চোখ ভিজে উঠেছে। এই দুজন মানুষের কাছেই মনের কথা ভরসা করে বলতে পারে মহুয়ার বাবা।
মিনারের বাবা কাধে হাত রেখে আবার জিজ্ঞেস করে।

আমি জানি এত তারাতাড়ি বিয়ে দেওয়া উচিৎ না।মহুয়ার এখনো ১৮ হয়নি।মিনার ও পড়াশোনার মধ্যে আছে।কিন্তু আমার হাতে যে এত সময় নেই।
মিনারের বাবা মা কিছুই বুঝতে পারছে না।
মহুয়ার বাবা আবার বলে উঠে,
আমার ব্রেইন টিউমার। অপারেশন করলেও বাচার সম্ভাবনা খুব কম।আর তোমরা তো জানো আমি না থাকলে আমার মহুয়ার কি হবে।রিনি আর রাতুল এর জন্য ওদের মা আছে কিন্তু আমার মহুয়ার আর কেউ নেই।আমার মেয়েটা তোমাদের কাছে থাকলে আমি শান্তিতে মরতেও পারবো।

মিনারের মা বাবা দুজনেই চুপ হয়ে আছে।স্বান্তনার উপায় দেখছে না।তবু ও মিনারের মা বলে,ভাই ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।আমরা দেখছি। মিনারের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।

মহুয়ার বাবা বলে, আমার হাতে সময় কম ভাবি।আর যদি না পারেন বলবেন আমি এখানেই মহুয়ার বিয়ে দিয়ে দিব।
মিনারের মা বলে, কি বলছেন ভাই মহুয়া আমার মেয়ে।আমার ছেলের সাথে ওর বাগদান হয়েছে যখন ভাবি ছিলো। আমাদের ছেলের বউ মহুয়াই হবে।
আপনি এসব আর বলবেন না।দুটো দিন অপেক্ষা করুন।আপনি যা চান তাই হবে।

মহুয়ার বাবা ঘরে ফিরে আসে।

মিনারের মা বাবা পরের দিন সকালেই ফিরে যায়।
মিনার কে রাজি করাতে হবে।এখনো মিনার ও এই সব বিয়ের কথা জানে না।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে