মন গোপনের কথা পর্ব-০১

0
2300

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

( অনুমতি ব্যাতীত কপি নিষেধ )

মাহিদ তখন বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর পিহু মেডিক্যালে। একদিন মেডিকেলে থেকে ফেরার সময় রাস্তার মোড়ে মাহিদকে দেখতে পেল সে। হাতে কিছু কাগজপত্র। পায়ে দু কালো ফিতার চটি। পড়নে চেইক শার্ট। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে সিগারেট টানছে। সাদা এপ্রোনের পকেটে হাত পুড়ে অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাহিদের কান্ড দেখছে পিহু। ব্যারিস্টারের ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে? মামা কি জানে এসব? আর ওমেন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি কেন?
রাগে বেলুনের মতো ফুলতে লাগলো পিহু।

এদিক সেদিক তাকানোর পর মাহিদের চোখে পড়লো পিহু। দেখে ও না দেখার ভান করে এড়িয়ে গেল সে পিহুকে। পিহু অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। কিন্তু মাহিদ এল না। পিহু এক পা ও সরলো না। আরেকটু এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলো। ফোন টিপতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মাহিদ এল। হাতে থাকা ফাইলপত্র দিয়ে ধপাস করে পিহুর মাথায় মারলো পেছন থেকে। পিহু চেঁচিয়ে বলল

‘ তুমি সিগারেট খাও? আর সেটা মামা জানে?

‘ জানে না। ভাবছি তোর ব্যারিস্টার মামাকে আমি ঢাকঢোল পিটিয়ে বলব যে আমি সিগারেট খাচ্ছি। আর আমি সিগারেট খাইলে সেটা তোর বাপের কি?

পিহু থমথমে মুখে চেয়ে থাকলো।

‘ তোমাকে বলতে হবে না। আমি বলে আসি। তোমার একটু উপকার করি।

পিহু হনহনিয়ে এগিয়ে গেল। মাহিদ বাঁকা হেসে উল্টোপথে হাঁটা ধরলো। বন্ধুদের বলল

‘ আরেকটা ধরা। খবরদার সাবধান! আমার ব্যারিস্টার বাপের চামচা ঘুরাঘুরি করে এখানে। শালাদের আর কোনো কাজ নাই।

খান বাড়িতে পরী আর ছিকু আছে। তারা আজ পাঁচদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছে। পিহুকে আসতে বলেছিল মুনা। পিহু সেই সুযোগে ভাবলো নীরাকে কথাটা বলবে। মামা শুনলে নিশ্চয়ই মাহিদ ভাইয়ের উপর চটে যাবে।
পিহু খান বাড়ি পৌঁছতেই ছিকু দৌড়ে আসলো। পিহু পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল

‘ পিহু চকলেট আনিনি কেন?

পিহু হেসে তাকে কোলে নিল। বলল

‘ আব্বার জন্য তো চকলেট আনা বারন। ডাক্তার বারণ করে দিয়েছে ছিকুসোনা চকলেট খেতে পারবে না। দাঁতে পোকা হবে। পেটে ব্যাথা হবে।

‘ বিথা হবে কেন? চকলেট আনিনি কেন? কেন বাপ কেন?

পিহু তার গালে চেপে চুমু দিল। বলল

‘ আব্বার জন্য কেক বানাবে পিহু। আব্বা তখন খাবে।

‘ কেক বানাবে কেন?

‘ খাওয়ার জন্য।

পিহুকে দেখে নীরা মুনা খুশি হলো। পরী এসে বলল

‘ তাড়াতাড়ি গোসল নাও পিহু। খেতে এসো।

পিহু চলে গেল। মাহিদ এল অনেকটা পরে। ছিকুর জন্য আইসক্রিম আনলো। ছিকু তার কোলে উঠে বসে থাকলো। মিহি ভালো। তার জন্য আইসকিম আনিছে।
মাহিদ অনেক্ক্ষণ আদরটাদর করে ছুঁড়ে ফেলে দিল সোফায়। পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলল
‘ শালা তোরে আদর করলে ও সমস্যা। কোল থেকে নামোস না। যাহ ভাগ বাপ।
ছিকু কেঁদে দিয়ে বলল
‘ মিহি মারিছে কেন? কেন বাপ কেন?
সবাই তার কথা শুনে হেসে কুটিকুটি। নীরা এসে বলল

‘ আব্বা পিহু ও এসেছে।
‘ জানি। যেভাবে বলছ যেন প্রধানমন্ত্রী এসেছে।
‘ ধুর তোর সাথে কথা বলে লাভ নাই। যাহ গোসল সেড়ে নে।
মাহিদ চলে গেল।
পিহু গোসল সেড়ে রুম থেকে বের হতেই মাহিদের মুখোমুখি। পিহু মুখ মোচড়ে সরে পড়তেই মাহিদ মাথায় চটাস করে চাটি মেরে কেটে পড়লো। পিহু মাথার পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। বিড়বিড় করল
‘ গুন্ডা।
খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ খেল সবাই। নীরা রিপকে ফোন করে বলল
‘ আপনি কখন আসবেন ব্যারিস্টার?
রিপ সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল
‘ মাহি বাড়ি ফিরেছে?
‘ হ্যা কেন?
‘ আমি লাঞ্চ অফার পেয়েছি। রাতে খাব। মাহিকে সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলো। আমি এসে যাতে দেখি। কথা আছে।

নীরা ভয়ে ভয়ে বলল

‘ কি হয়েছে ব্যারিস্টার।
‘ কিছু হয়নি নীরা। ফোন রাখো। খেয়ে নাও।

নীরা মাহিদকে কিছু বলল না। ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাহিদকে বলল, যাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে।

মাহিদ রিপের কথা ফেলতে পারেনা। এক আল্লাহ ছাড়া পুরো পৃথিবীতে এই একজন মানুষকেই সে ভয় পায়। তাই সে মাগরিবের পরপর ফিরে এল বাড়িতে। রিপ এল এশার নামাযের পরে। মাহিদ আর ছিকু তখন খেলছে। পিহু আর পরীর মাথা খাচ্ছে। মাহিদ তার ঘরে যাওয়ার সময় পিহুর সাথে একাকী দেখা। তখন ফিসফিস করে বলল
‘ যদি আব্বাকে কিছু বলিস তোর খবর আছে।
‘ বলে দিয়েছি অলরেডি। দেখ মামা তোমাকে এসে কি করে?
মাহিদ দাঁতে দাঁত কিছু একটা বলতে চাইলো। না বলেই চলে গেল হনহনিয়ে।

রাতের খাবার দাবার শেষ হলো। রিপ চুপচাপ। মাহিদ ও পাশে বসে খেল। খাওয়ার পর চুপচাপ মাহিদকে ঘরে ঢেকে নিল রিপ। মাহিদ সামান্য অবাক। বিস্ময় তার চোখেমুখে। পিহু সত্যিই আব্বাকে বলে দিয়েছে? চাপা রাগ চেপে রাখলো মাহিদ। মাথা নামিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল

‘ কি হয়েছে আব্বা? ডেকেছ কেন?

রিপ ফোন করে বের করে ফোনের ওয়াল মাহিদের সামনে তুলে ধরলো। বলল

‘ এটা কে?

মাহিদ চমকে গেল। নীরা ভয়ে ভয়ে বলল

‘ শুনুন না, অনেক রাত,,,

‘ চুপ। তুমি যাও এখান থেকে। একটা কথা ও বলবে না। আমরা বাপ ছেলে কথা বলছি।

নীরা মাহিদের দিকে তাকিয়ে থাকলো কাঁদোকাঁদো হয়ে। তার বাচ্চাটার গায়ে যদি হাত তুলে? আর এই ছেলেটা ও পারে। তার দুটো দিতে ইচ্ছে করছে এখন।

মাহিদ কোনো জবাব দিল না। রিপ বলল
‘ তুই স্বীকার করছিস যে তুই সিগারেট খাস? চুপ থাকবি না মাহি।

মাহিদ মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

‘ কখন থেকে খাওয়া হচ্ছে এসব?

মাহিদ কি করে বুঝাবে সে শখের বশে সিগারেট টেনেছিল। তাই সে চুপ করে থাকলো।

‘ তুই ছেলে বড় হয়েছিস। তোর গায়ে হাত তুলতে ও আমার লজ্জা হয়। তার চাইতে বেশি লজ্জা হচ্ছে নিজের উপর। সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি। মানুষ শাসন করি, ন্যায় ভাষণ দিই কোর্টে, সেখানে নিজের ছেলেকে,,,

আর কিছু বলল না রিপ। মাহিদ চোখ তুলে বাবার মুখের দিকে তাকালো। বলল

‘ আব্বা আমি,,

‘ থাক। সিগারেট খাচ্ছিস খা। ভালো কাজ তো। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হয়ে খা।
যাতে আমার কানে না আসে আমার ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বখাটেদের মতো সিগারেট টানছে। বের হ বাড়ি থেকে। এই বাড়ির চৌ সিমানায় ও দাঁড়াবি না। যাহ।

মাহিদ মায়ের দিকে তাকালো। নীরা গুনগুন করে কাঁদছে। মিনমিন করে বলে উঠলো

‘ ঝড় বাতাস হচ্ছে বাইরে। আমার বাচ্চাটা এখন কোথায় যাবে? সামান্য ব্যাপার নিয়ে,,,

‘ যাহ। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এই বাড়িতে ত্রি সীমানায় ও যেন না দেখি তোকে। কত বড় হয়েছিস দেখি!

সোজা বের হয়ে এল মাহিদ। গলার রগ ফুলে উঠেছে। চোখ লালচে। রিপের গর্জনের আওয়াজ শুনে পরী পিহু এসে দাঁড়িয়েছিল বাইরে। মাহিদ বের হয়ে যাওয়ার সময় পিহুর মুখোমুখি। পিহু ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বুঝাতে চাইলো

‘ আমি মামাকে কিচ্ছু বলিনি। সত্যি!

মাহিদ গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল। ঝড় বাতাস বইছে ভালো করে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নীরা কেঁদে ফেলল মাহিদকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে। পরী এসে বলল

‘ পাপা এটা কি করেছ? ভাই এখন কোথায় যাবে? শাস্তিটা একটু বেশি হয়ে গেল। এই বয়সে এমন করে,

‘ ঘুমাতে যাও পরী। পিহু তুমি ও ঘুমাতে যাও। নীরা ঘুমিয়ে পড়ো।

নীরা কেঁদে উঠে চলে গেল সেখান থেকে। তার ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তাকে ঘুমাতে বলা হচ্ছে। পাষাণ লোক!

__________

ছাতা হাতে পিহু বাইরে বেরিয়ে পড়লো। বাতাস ও বইছে ভালোভাবে। রিপ ব্যালকণি থেকে সরে পড়ে বিছানার কাছে গেল। বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা নীরাকে বলল

‘ ডেকে নিয়ে এসো। বাগানে কাছে আছে দেখলাম। নীরা?

নীরা ফুঁপিয়ে উঠে বলল

‘ ও আমার কথায় আসবে না। আপনি যান।

‘ আমি পারব না।

‘ তাহলে কথা বলতে আসবেন না আমার সাথে।

রিপ চুপ করে বসে রইলো। একদম বাপের মতো ত্যাড়া হয়েছে ওই ছেলে।

পিহু ছাতা হাতে নিয়ে এদিকওদিক তাকাতেই মাহিদকে চোখে পড়লো। বাগানের উঁচু ঢিবির উপর বসে রয়েছে। পড়নের অফ হোয়াইট কালার শার্ট ভিজে পিঠে লেগে রয়েছে। পিহু পেছন থেকে ছাতা বাড়িয়ে দিল মাথার উপর। ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে থাকা মাহিদ ঘাড় ঘুরালো। ভয়ংকর শীতল চক্ষুকোটর। পিহুর অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। কাঁপা-কাঁপা গলায় সে বলল

‘ মামি কাঁদছে। বাড়ি চলো। মামা ওসব রাগের মাথায় বলেছে।

মাহিদ ছাতাটা নিল একহাতে। মোচড় দিয়ে চোখের সামনে সেটিকে আধমরা করে দূরে ছুঁড়ে মারলো। সাথে সপাটে চড় বসালো পিহুর গালে। পিহু ছিটকে পড়লো কাঁদায়।

‘ আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবি তোর খবর আছে। এইবার শুধু চড়, পরের বার জীবন্ত কবর দেব বেয়াদব।

ঝুপঝাপ বৃষ্টির আওয়াজের মধ্যে পিহুর কান্নার আওয়াজ শোনা গেল না। মাহিদ ততক্ষণে বাড়ির গেইট পার হয়ে নিরুদ্দেশ। রিপ এসে পিহুকে কাঁদায় পড়ে থাকতে দেখলো।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে