#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৯
.
হসপিটাল থেকে মীতিকে বাসায় আনা হলো। এক সপ্তাহের লেজার ট্রিটমেন্টের পর বাসায় আনা হয়েছে তাকে, বাকি ট্রিটমেন্ট বাসায় থেকেই করানো হবে। রাতুল নিজের বাসাতেই নিতে চেয়েছিলো মীতিকে, কিন্তু মাহতাব শেখ মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান চিকিৎসা চলাকালীন পর্যন্ত। রাতুল আর দ্বিমত পোষণ করে নি। কিন্তু মীতি কিছুতেই এখানে আসতে রাজি হয় নি। বারবার বলেছে তার সংসারেই ফিরে যেতে চায়। পরবর্তীতে রাতুলের কথার সাথে আর পেরে উঠে নি। ছেলেটার উপর একরাশ অভিমান নিয়েই বসে আছে মেয়েটা। একজন নার্স চিকিৎসার যাবতীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে মীতির ঘর গোছাচ্ছে। ডাইনিং রুমে রাতুল, মাহতাব শেখ ও ডাক্তার কথা বলছে মীতির ব্যাপারে। টেনশন না দিয়ে কিভাবে মীতিকে হাসিখুশি রাখবে সেগুলোই বলছে।
নিজের রুম থেকেই তাদের কথাগুলো আধো আধো শুনতে পাচ্ছে মীতি। তবে কারোর কথাতেই তার মনোযোগ নেই, শুধু নিদিষ্ট মানুষটার কথাতেই গভীর মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। কান খাড়া করে শুনছে রাতুলের কথাগুলো। বড্ড অভিমান হয়েছে রাতুলের উপর। থাকবে না রাতুল, বাসায় চলে যাবে। এই কয়েকদিন হসপিটালে ছোটাছুটির জন্য অফিসে যেতে পারে নি ঠিক ভাবে। এখান থেকে অফিসের পথ অনেকটা দূর হয়ে যায় বলে বাসায় যেতে চায়। তাতেই মীতির অভিমান। রাতুলকে কিছুতেই যেতে দিতে চায় না সে। এতদিন পর একটুখানি কাছে পেয়েছে স্বামীকে। হসপিটালে থাকাকালীন তার যত্ন নিতেই ছেলেটার সময় ব্যায় হয়েছে। তাকল আর সময় দিতে পেরেছে কই?
মীতির করা ভাবনার মাঝেই ফাহমিদা খানম কিছু খাবার হাতে রুমে ঢুকলেন। মীতির গম্ভীর মুখপানে তাকিয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন, “মীতি, কিছু খেয়ে নেও মা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে এখন। কিছুই তো মুখে তুললে না।”
মায়ের কথার জবাব দিলো না মীতি, একই ভঙ্গিতে বসে রইলো। মেয়েটার সামনে খাবারগুলো রাখলেন ফাহমিদা খানম, একটু নিয়ে মেয়ের মুখের সামনে ধরে বললেন, “হা করো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
“খাবো না।”
বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলো মীতি। তাতে ফাহমিদা খানম গায়ে লাগালেন না মেয়ের কথা। আগের ন্যায় খাবার এগিয়ে দিয়ে বললেন—ওষুধ খেতে হবে তো, একটু মুখে দাও। এবার বেশ চটে গেল মীতি। বেশ জোরেই বলে উঠলো, “বললাম তো খাবো না আমি। এত আদিখ্যেতা দেখাতে হবে কেন? আমাকে না খাইয়ে তোমার মেয়ে জামাইকে খাওয়াও, খাইয়ে-দাইয়ে বিদায় করো বাসা থেকে। এতক্ষণ বাসায় করছে কি ওই ছেলেটা? যেতে বলো তাকে।”
সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লেন ফাহমিদা খানম, মেয়ের রাগ সম্পর্কেও বুঝে গেলেন। এতক্ষণের চাপা রাখা রাতুলের প্রতি রাগটা খাবারের উছিলায় তার উপর প্রয়োগ করলো। বরাবরই শান্ত মেয়ে মীতি। কিন্তু মেয়েটার এই অসুস্থতা যেন অশান্ত বানিয়ে দিয়েছে। ভেবেই হতাশার নিশ্বাস ছাড়লেন ফাহমিদা খানম। নরম কণ্ঠে মেয়েকে বললেন, “এতটা উত্তেজিত হচ্ছো কেন, আম্মু? শান্ত হও। ছেলেটা বললোই অফিসে জরুরি কাজ আছে কাল, এখান থেকেও কতটা পথ। কি করবে বলো?”
“কিছু করতে হবে না ওর, চলে যেতে বলো তাকে। এখনো কি করছে বাসায়?”
উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো মীতি, হার মানলেন ফাহমিদা খানম। মেয়েকে রাতুল ছাড়া কেউ সামলাতে পারবে না, তিনি নিশ্চিত। এই ক’দিন হসপিটালে থাকার পর তা বেশ বুঝতে পেরেছেন। ছেলেটা রাত-দিন যত্ন করে গেছে মীতির, সময় বের করে অফিসেও ছুটছে। এতদিন পর তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছেন, মাহতাব শেখের কথা। তিনি প্রায়শই বলতেন, মীতির জন্য রাতুল বেস্ট একজন। ছেলেটাকে তিনি কতই না ভুল বুঝে এসেছেন, ওটা ওটা নানান কথা বলেছেন। কিন্তু তার কোন কথারই প্রতিবাদ করে নি ছেলেটা। বরং মুখে একরাশ হাসি নিতে কথা বলে গেছে তার সাথে। রাতুলের সাথে এহেন কাজের কথাগুলো ভেবে নিজের কাছেই লজ্জিত হলেন ফাহমিদা খানম। মেয়েকে আর কিছু না বলে নার্সকে আসতে বলে নিজেও বেড়িয়ে এলেন রুম ছেড়ে।
ডাইনিং রুমে এসে কিছু বলার আগেই মাহতাব শেখ স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে, “খেল না, মেয়েটা?”
সবটাই শুনেছেন তিনি, তবুও জিজ্ঞেস করলেন। ফাহমিদা খানম রাতুলের দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠলেন, “শুনলেই তো। রাতুল চলে যাবে শোনার পর থেকেই রাগ নিয়ে বসে আছে।”
“আচ্ছা, আমি দেখছি মা।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো রাতুল, কথা না বাড়িয়ে সোজা মীতির রুমে চলে গেল। এবার যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন ফাহমিদা খানম, ভরসা পেলেন। রাতুলের প্রতি এই ভরসাটা আগে ছিলো না ওনার। মেয়ের প্রতি এতটা যত্ন, ভালোবাসা দেখেই যেন রাতুলের প্রতি বিশ্বাস নামক শব্দটা আপনা-আপনিই চলে এসেছে, সাথে রাগ কমিয়ে এসেছে স্নেহ ও ভালোবাসা।
.
একটুখানি খাবার নিয়ে মীতির মুখে ধরতেই মুখটা ফিরিয়ে নিলো মেয়েটা। হার মানলো না রাতুল, আবারও হাত এগিয়ে নিলো। এবারও মীতি মুখ ফিরিয়ে মিলো। খাবে না সে। ফের নিজের হাতটা এগিয়ে দিলো রাতুল, কিন্তু আগের মতোই মুখ ফিরিয়ে নিলো মেয়েটা। এবার খানিকটা বিরক্ত হলো রাতুল। মুখ ফুটে বিরক্তির স্বর তুলে বললো, “খাচ্ছো না কেন? দুপুর গড়িয়ে গেছে কখন, সেই খেয়াল আছে? মেডিসিন নিতে হবে না?”
কথা বলে না মীতি, গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে রয়। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে রাতুল, খাবারের প্লেট’টা রেখে এগিয়ে আসে। মীতিকে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে বলে, “কি সমস্যা, মীতি?”
“তুমি।”
বলেই চুপ হয়ে যায় মেয়েটা। রাতুল হেসে উঠে। পরমুহূর্তেই কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে ফের বলে, “তো, আমি কি সমস্যা করলাম তোমার?”
“আমার খাওয়া, ঘুম, ভালোলাগা, ভালোবাসা সবটাই তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাচ্ছো। আর এটাই আমার সমস্যা।”
ছলছল করে উঠলো মীতির চোখ দুটো। রাতুলের হাসি পেলেও নিজেকে সামলে নিলো। মেয়েটার মুখ দু’হাতে আঁজলা করে ধরে বললো, “আশ্চর্য! কান্না করছো কেন? খাওয়া, ঘুম, ভালোলাগা, ভালোবাসার জন্য কেউ কান্না করে? আচ্ছা বেশ, আমি যাবার আগে সবগুলোই দিয়ে যাচ্ছি। ঠিক আছে?”
বলেই একটু থামলো রাতুল। মীতিকে ছেড়ে দিয়ে ফের খাবার হাতে নিলো। এগিয়ে দিয়ে আবারও বললো, “এই তো, খেয়ে নেও। তারপর ঘুমাবে। ঘুমালে এমনিতেই ভালো লাগবে। আর ভালোবাসা… সেটা না-হয় তোমাকে ঘুম পারানোর সময় দিয়ে দিবো। কেমন?”
নিশ্চুপ রইলো মীতি, মুখ ফুটে কিছু বললো না। রাতুল খাবার কথা ইশারায় বললে এবার বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। বার কয়েক খাবার পর হঠাৎ আহ্লাদী কণ্ঠে মীতি বলে উঠলো, “আমার আদরও চাই।”
মীতির আহ্লাদীপানায় সামান্য হাসলো রাতুল। তবে মেয়েটাকে বুঝতে দিলো না এবারও। গম্ভীর সুর তুলে বললো, “আদর? আদর কোথা থেকে আসলো? এটা তো বলো নি তুমি।”
“এখন বলছি। চাই মনে চাইই। কিহ্? দিবা না?”
তেজী কণ্ঠে বলে উঠলো মীতি। রাতুল হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, “আচ্ছা… আচ্ছা বেশ, দিবো।”
তবুও মুখ ভার করে রাখলো মেয়েটা। কপাল কুঁচকে রাতুল জিজ্ঞেস করলো—আর কি চাই? সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে রাতুলের কাছে এগিয়ে এলো মীতি, দুরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। রাতুলের বুকে মাথা এলিয়ে আলতো করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। বলে উঠলো, “আমার তো এই পুরো তুমি টাকেই চাই, রাতুল।”
“পুরো আমিটাকেই তোমাকে দিয়ে দিলাম, নিয়ে নেও।”
.
সেদিন রাতটা থেকে গেল রাতুল। পরদিন সকালে মীতিকে নানান কথা বুঝিয়ে অফিসে যেতে হলো। মেয়েটার কথা রাখতে এতটা পথ জার্নি করে রাতে আসতেও হলো। ডাক্তার নিষেধ করে দিয়েছে, এই সময়টায় কিছুতেই উত্তেজিত হতে দেওয়া যাবে না মীতিকে। কোন কারনে হাইপার হলেই মাথায় রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা আছে, অতঃপর নাক ও কান দিয়ে রক্ত আসার সম্ভাবনা। শান্ত রাখতে হবে মেয়েটাকে। মীতিকে শান্ত রাখার যথা সম্ভব চেষ্টা করে গেছে রাতুল। এতটা পথ জার্নি করে রাত হলে ঠিকই ছুটে এসেছে মীতির কাছে।
কয়েকদিন লাগাতার আসতে পারলেও হঠাৎ একদিন অফিসের কাজে আটকে গেল। সারাদিন প্রচুর কাজের চাপে ক্লান্ত শরীরে গাড়ি চালিয়ে এতটা পথ আর আসতে পারলো না রাতুল। চলে গেল বাসায়। রাতুল আসবে না জেনে রাগারাগি করলো মীতি। রাগ করে রাতুলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে মোবাইল অফ করে রাখলো। মাহতাব শেখ ও ফাহমিদা খানম বোঝানোর পরেও কাজে দিলো না। উপায় না পেয়ে রাতুলই শ্বশুরের মোবাইল দিয়ে মীতিকে বোঝাতে সক্ষম হলো। মীতি বুঝলেও অভিমান ও মন খারাপ কোনটাই কমলো না যেন।
.
পরেরদিন সকালে ডাইনিং টেবিলে একা একা বসে নাস্তা করছিলো রাতুল। নাস্তা বলতে, জেল পাউরুটি। মুখে নিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে পানি দিয়ে গিলে ফেলছে শুধু। শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদরে, শ্বাশুড়ির হাতে ভালো মন্দ খাবার খেয়ে এগুলো কিছুতেই মুখে উঠছে না রাতুলের। তবুও ব্যাচেলর লাইফের মতো খেতে হচ্ছে। মনে মনে নিজেকেই গালি দিলো রাতুল।
“শ্লা! বউ কান্নাকাটি করে শ্বশুর বাড়ি যেতে যেতে বললো, তখন তো খুব ক্লান্ত শরীরের দোহাই দিয়ে কেটে পড়লি। এখন? এগুলোই তোর কপালে আছে রাতুল। পানি দিয়ে এভাবেই গিলতে থাক।”
বলেই কোন রকমে খাওয়ার চেষ্টা করলো। ভেবেছিল বাইরে থেকে খেয়ে নিবে, কিন্তু কিছু একটা ভেবে এগুলো খেতে নিলো। কথাটা ভাবতেই নিজের প্রতি রাগ এসে জড়ো হলো। শ্বাশুড়িটাও এ-কদিনে এমন অভ্যাস বানিয়ে দিয়েছে, যে বাইরে খাবারের কথা ভাবনাতেও আনে না ছেলেটা।
হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে নিজের ভাবনা থেকে ফিরে এলো রাতুল। কপাল কুঁচকে ফেললো হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো। কে এলো এ-সময়ে? ফের কলিং বেলের শব্দে এবার উঠে আসতে বাধ্য হলো ছেলেটা। দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মীতি… মুখ ফুটেই উচ্চারণ করে ফেললো রাতুল। তাতে যেন বেশ বিরক্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মীতি। কপাল কুঁচকে বললো, “ভুলে যাওয়ার সমস্যা তো আমার। তাহলে তুমি কেন ভুলে যাচ্ছো? হ্যাঁ! আমি মীতি। কেন,চিনতে পারছো না?”
“নাহ্! মানে… তুমি এখানে?”
“আশ্চর্য রাতুল! আমার বাড়ি, আমার সংসার। সেখানে আমি থাকবো না তো কে থাকবে? তোমার ইশা। দেখি সরো, যেতে দাও আমাকে।”
.
.
চলবে….