#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৭
.
বিষন্ন মনে, বিক্ষিপ্ত চেহারা নিয়ে হসপিটালের করিডোরের চেয়ারে বসে আছে রাতুল। পিছনের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে আছে, চোখ দুটো স্ব-যত্নে বন্ধ করা। তার থেকে সামান্য অদূরে পাশাপাশি বসে আছেন মাহতাব শেখ ও ফাহমিদা খানম। সবার চোখে মুখেই চিন্তিত ভাব স্পষ্ট। ফাহমিদা খানম মেয়ের এহেন অবস্থার জন্য এতক্ষণ রাতুলকে দোষারোপ করলেও এখন চুপ করেই আছেন। আপাতত মীতিকে নিয়েই সবার যত দুঃচিন্তা।
তখন হঠাৎ মীতি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতেই সবাই হতভম্ব হয়ে যায়, কোন রকমে সামলে নেয় রাতুল। মাহতাব শেখ ও ফাহমিদা খানম মীতির কাছে এগিয়ে এসে উত্তেজিত হয়ে ডাকতে থাকেন মেয়েকে। তখনই রাতুল খেয়াল করে মীতির নাক ও কান দিয়ে বেরিয়ে আসা র’ক্ত। তৎক্ষনাৎ মীতিকে কোলে তুলে নেয় রাতুল, মাহতাব শেখের উদ্দেশ্যে, “বাবা, মীতিকে এখনি হসপিটালে নিতে হবে।”
বলেই বেড়িয়ে আসে বাসা থেকে। মাহতাব শেখ ও ফাহমিদা খানমও চলে আসেন। হসপিটালে আনার পরেই ডাক্তাররা মীতির চিকিৎসা শুরু করে দেন, আর এদিকে ফাহমিদা খানম নানান ভাবে দোষারোপ করতে থাকেন রাতুলকে। নিশ্চুপ থাকেন মাহতাব শেখ, থামতে বলেন স্ত্রী’কে। শেষমেশ উপায় না পেয়ে ধমক দিয়েই থামিয়ে দেন ফাহমিদা খানমকে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তাররা আসতেই মীতির কথা জিজ্ঞেস করা হয়। রাতুল বলে উঠে, “ডক্টর, মীতি এখন কেমন আছে?”
“দেখুন, ওনার কন্ডিশন খুব একটা ভালো নেই। আমরা চাইছি দ্রুত অপারেশনটা হোক।”
“কি হয়েছে ওর?”
“এতকিছু এখন বোঝাতে পারবো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফর্মালিটি গুলো পূরণ করুন। আপনি ওনার কি হন?”
ঘোরের মাঝেই রাতুল বলে বলে উঠে ‘ওর হাসবেন্ড!’ আর সময় ব্যায় করে না ডাক্তার। কিছু কাগজ এগিয়ে দিয়ে তাতে সাইন করতে বলে। মাহতাব শেখের সায় পেতেই তাতে সাইন করে দেয় রাতুল। চলে যায় ডাক্তার, জ্বলে উঠো অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতি। দুঃচিন্তার মাত্রা বৃদ্ধি পায় সকলের।
তখন থেকে প্রায় ঘন্টা হতে চললো, এখনো অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতিটি নিভে নি, বেড়িয়ে আসে নি ডাক্তার। হঠাৎ মীতির অসুস্থ হয়ে যাবার কারণটাই যেন খুঁজে পাচ্ছে না রাতুল।
প্রায় এক ঘন্টার বেশি সময় পর অপারেশন থিয়েটার হতে বেড়িয়ে এলো ডাক্তার। মীতিকে রাখা হলো আইসিইউ তে। তার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার বললো, “অপারেশন সাকসেসফুল। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর উনি কিভাবে রিয়াক্ট করবেন, বুঝতে পারছি না।”
মীতি ঠিক আছে শুনে খানিকটা স্বস্তি পায় সবাই। রাতুল জানতে চায়—ঠিক কি হয়েছে মীতির? সহসায় জবাব যেয় না ডাক্তারটা। একটু সময় নিয়ে রাতুল ও মাহতাব শেখকে নিজের কেবিনে ডাকে তাদের।
.
“উনি কি কিছুদিনের মাঝে মাথায় কোনভাবে আঘাত পেয়েছিলেন?”
ডাক্তারের প্রশ্নে একে অপরের দিকে একবার তাকালো রাতুল ও মাহতাব শেখ। রাতুল বললো, “মাথায় আঘাত? কই, না তো।”
“একটু মনে করার চেষ্টা করুন। ছোটখাটো কোন এক্সিডেন্ট বা পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলো কি না?”
ভাবতে লাগলো রাতুল, কিন্তু সহসায় মনে করতে পারলো না। ডাক্তারকে ‘না ‘ বলতে চাইলেই হঠাৎ তার মস্তিষ্কে হানা দিলো প্রায় মাস তিনেক আগে মীতির বলা কথাগুলো।
প্রায় তিন মাস আগের একটা রাতে বাসায় ফিরে মীতিকে বিছানাতে পায় রাতুল। সেদিন তাড়াতাড়িই ফিরেছিলো বলে মীতিকে জিজ্ঞেস করে, “এই অবেলায় শুয়ে আছো কেন?”
কারণ না থাকলেও মীতি খিটখিটে মেজাজে জবাব দেয়, “মাথা ব্যাথা করছে।”
কপাল কুঁচকে ফেলে রাতুল, এগিয়ে এসে মীতির মাথায় হাত রাখতেই ‘আহ্!’ শব্দে আর্তনাদ করে মেয়েটা। রাতুলের কপালের ভাজ গাড়ো হয়, সন্দেহ হয়। বলে উঠে, “পড়ে গিয়েছিলে, মীতি? মাথায় ব্যাথা পেয়েছো?”
তখন আর লুকিয়ে রাখতে পারে না মীতি, রাতুলকে বলে সবটা। ঘর পরিষ্কার করছিলো, মীতি। দেওয়ালে, আলমারির উপরের ময়লা পরিষ্কার করছিলো, কিন্তু হঠাৎ পা পিছলে ছোট্ট টেবিলটা থেকে ফ্লোরে পড়ে যায় মেয়েটা, আঘাত পায় মাথায়। সবটা জানার পর বেশ রাগারাগি করে রাতুল, তৎক্ষনাৎ নিয়ে যেতে চায় ডাক্তারের কাছে। কিন্তু ‘ঠিক আছি’ বলে এড়িয়ে যায় মীতি, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না বলে রাতুলকে বোঝায়।
.
সবটা শোনার পর ডাক্তার কিছু একটা ভাবেন। খানিকটা সময় নিয়ে বলে উঠেন, “ওহ, আই সি! তখন মাথায় আঘাতটা পাওয়ার জন্যই তাহলে….”
“আমাকে এসব আগে কেন বলো নি রাতুল?”
রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন মাহতাব শেখ। এবার যেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। আদরের মেয়ের এমতাবস্থা মেনে নিতেই পারছেন না তিনি। রাতুল বলতে লাগলো, “বাবা, আসলে ব্যাপারটা এতটাও গুরুতর ছিলো না। পেইন কিলার খাইয়ে দেবার পর ব্যাথাও সেরে গিয়েছিলো। তাছাড়া মীতিও চায় নি ডাক্তার দেখাতে।”
“ব্যাপারটা গুরুতর না হলেও ওনার মাথায় আঘাত পাওয়াটা গুরুতর হয়ে উঠেছে, মি. রাতুল।”
নিশ্চুপ রইলো রাতুল। ব্যাপারটা এতটাই গুরুতর হবে জানলে যে ভাবেই হোক, মীতিকে সেদিন হসপিটালে আসতো রাতুল। এই মুহুর্তে ঠিক কি জবাব দিবে সেটাই যেন খুঁজে পেল না ছেলেটা। মাহতাব শেখ ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমার মেয়েটার ঠিক কি হয়েছে ডক্টর? কেন বলছেন না ক্লিয়ার করে?”
“ডিমেনশিয়া! উনি ডিমেনশিয়ায় চলে গেছেন।”
“ডিমেনশিয়া? মানে?”
অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রাতুল। ডাক্তারের কথাটা যেন বুঝতে পারলো না। মাহতাব শেখও একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে ডাক্তার বলে উঠলো, “ডিমেনশিয়া মানে, এমন কিছু অনুভব করা—যেটা কখনো থাকেই না। হ্যালুসিনেশন বা ইমাজিনেশন করা।”
“মানে? কি বলতে চাইছেন ডক্টর?”
“দেখুন মি. রাতুল, ডিমেনশিয়া হল একটি যৌগিক শব্দ যা স্মৃতিশক্তি, ভাষা, সমস্যা সমাধান এবং অন্যান্য চিন্তাভাবনার দক্ষতা হ্রাসের কারণে যে রোগ এবং অবস্থার জন্য ব্যবহৃত হয় যা একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
স্মৃতিশক্তি হ্রাস ডিমেনশিয়ার একটি উদাহরণ। আলঝেইমার হল ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ এবং এটি এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা।”
“আপনি বলতে চাইছেন মীতির মানসিক ভাবে অসুস্থ?”
“আমি বলছি না, কিন্তু এমনটাই ঘটেছে।”
বলেই একটু থামলো ডাক্তারটা। কিছু একটা ভেবে সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি তো বললেন প্রায় মাস তিনেক আগে উনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন, তাই তো? আচ্ছা, এই তিন মাসে কি ওনার মাঝে কোন পরিবর্তণ লক্ষ্য করেছিলেন? লাইক, কোন কিছু ভুলে যাওয়া, নিজের মতো কিছু একটা ভেবে নেওয়া, ছোট ছোট কারণ উন্মাদ হওয়া?”
ডাক্তারের কথাগুলো যেন মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারছে না রাতুল। মীতিকে মানষিক ভাবে অসুস্থ বলার পর থেকেই যেন তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সুপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে পাশে বসা মাহতাব শেখের দিকে তাকালো রাতুল। তিনিও মেয়ের অবস্থার অবগতি হতে চোখ মুখ কালো করে বসে আছেন। ভাবতে থাকলেন মেয়ের গত এক মাসের লক্ষ্মণ। রাতুলও মীতির হঠাৎ পরিবর্তন গুলো ভাবতে থাকলো, সাথে মাহতাব শেখের বলা কথাগুলো ভাবতেই মীতির লক্ষ্মণগুলো আন্দাজ করে নিলো। মাহতাব শেখকে রাতুলের বিরুদ্ধে বলা মীতির কথাগুলো একটাও সত্যি ছিলো না। মাঝে মধ্যে মীতির অস্বাভাবিক আচরণ ও সন্দেহ করায় রাতুল রেগে যেত, মীতিকে বোঝানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু মীতির বলা কথাগুলো শোনার পরই যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো রাতুল, বারংবার ভেবেছিলো এতগুলো মিথ্যে কেন বললো মীতি? সে তো তখনও বুঝতে পারে নি মেয়েটা মানসিক ভাবে বিপর্যয় আছে।
ডাক্তারের কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে রাতুল, মাহতাব শেখও সায় জানান তাতে। ডাক্তার বলেন, “মূলত ওনার মাথায় আঘাত পাবার জন্যই ডিমেনশিয়াতে চলে যান। সমস্যাটা একবারে ধরা না দিলেও ধীরে ধীরে তা প্রকোট হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় স্মৃতিশক্তি স্বাভাবিক থাকে, তবে অন্যান্য পরিবর্তন দেখা দেয়। উদাহরণ স্বরূপ আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বার্থপর এবং অনুভূতিহীন বলে মনে হতে পারে। তারা রূঢ়ভাবে আচরণ করতে পারে বা খুব সহজেই উন্মাদগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারে।”
একটু থামলো ডাক্তারটা। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বললো, “ক্রমাগত এই রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমস্যাগুলো আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয় এবং রোগীকে সংকীর্ণ গন্ডিতে আবদ্ধ করে। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন দুর্বিসহ হতে থাকে এবং সহসায় সবকিছু ভুলে যেতে পারে-বিশেষ করে কোন সাম্প্রতিক ঘটনা ও পরিচিত ব্যক্তির নাম। সমস্যা তার জীবনে সঙ্গী হয়ে যায়।”
“এর চিকিৎসা কি ডক্টর? আপনি ওকে ঠিক করে দিন প্লিজ!”
“দেখুন মি. রাতুল, যতটুকু সম্ভব আমার তা করছি। কিন্তু সত্যি বলতে এই রোগের প্রপার কোন চিকিৎসা নেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিমেনশিয়ার সমস্যাটাও বৃদ্ধি পায়। অল্প সময়ের জন্য কিছু ওষুধ রোগীর দৈনন্দিন জীবনকে সহজতর করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।”
“তবে কি আমার মেয়েটা কখনোই ঠিক হবে না, ডক্টর?”
নির্জীব কণ্ঠে বলে উঠলেন মাহতাব শেখ, রাতুলও নিশ্চুপ। মুখ ফুটে ঠিক কি বলবে সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছে না। তাদের আশ্বস্ত করে ডাক্তার বললো, “ডিমেনশিয়া কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। তাই এতটা চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই। ওনার কন্ডিশন সিরিয়াস হলেও জীবনের কোন ঝুঁকি নেই।”
এবার যেন খানিকটা স্বস্তি পেল রাতুল। বললো, “তাহলে ওর চিকিৎসাটা….”
“আল্জ্হেইমার রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় না, তবে এর উপসর্গ কমাতে চিকিৎসা করা যেতে পারে। ডিমেনশিয়ার সাথে যুক্ত কিছু ধরণের রোগ নিজেরাই নিরাময় হয়, অন্য ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।”
.
.
চলবে…..
[রি-চেক দেওয়া হয় নি। অনেক ভুল থাকতে পারে। ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,]