মন উন্মনে আঁচড় পর্ব-০৩

0
700

#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৩

.
“তো, আমাকে কি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে মনে হচ্ছে?”

বলেই হো হো করে হেঁসে উঠলো রাতুল। ইশার কথা বলার ভঙ্গিতে যেন ব্যাপক মজা পেয়েছে সে, সাথে মেয়েটার বলা কথাটা। রাতুলের কথায় ফের কপাল কুঁচকে ফেললো ইশা। বিরক্তি নিয়ে বললো, “সেটা তো মীতির থেকে জানতে হবে। দেশে গেলে জেনে নিবো, কেমন?”

বলেই একটু থামলো মেয়েটা। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো, “এসব ছাড়ো, এখন বলো মীতিকে সারপ্রাইজটা দাও নি কেন?”

“বললাম তো, সুযোগটা পাই নি।”

“উফ্! সারাক্ষণ এত কাজের মধ্যে থাকলে সুযোগটা পাবে কখন, বলো? আমি হলে সংসারটাই তো করতে চাইতাম না।”

“সে ও চায় না।”

কথাটা বেশ ধীর কণ্ঠেই বলে রাতুল, শুনতে পায় না ইশা। জিজ্ঞেস করে, “কি বললে?”

“উহুঁ! কিছু না।”

“রাতুল, তুমি….”

শেষ করতে পারলো না ইশা। কথার মাঝেই থেমে যেতে হলো তাকে, মোবাইলের রিংটোনে। মোবাইলের স্ক্রিনে একবার নজর বুলিয়ে ইশারা করলো রাতুলকে, রাতুলও কিছু একটা বুঝতে পেরে যেতে বললো তাকে। আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল ইশা, সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো রাতুল।

রাতের প্রায় এগারোটা বাজে। বাংলাদেশে এখন নয়টা হবে হয়তো। ভাবলো মীতিকে একটা কল দিবে। কথা বলা প্রযোজন, মেয়েটার মনে কি চলছে তা জানা প্রয়োজন। হঠাৎ করে তো সংসারে ইতি টানতে পারে না। ভাবুক সে, সময় নিক, তবুও যেন ডিভোর্স নামক শব্দটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। নিজের করা ভাবনার মাঝেই কল দিয়ে ফেললো মীতিকে। পর পর দু’বার। ঢুকলো, কিন্তু রিসিভ হলো না। বোধহয় মোবাইলের আশেপাশে নেই মেয়েটা। একা বাসায় কি করছে কে জানে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলো রাতুল। ঘুমানো প্রয়োজন। সকাল হলেই ছুটতে হবে বিল্ডিংয়ের সাইড প্রজেক্টের কাজে। তবুও যেন ঢুবে যাওয়া নরম বালিশে মাথা এলিয়ে ভাবতে লাগলো মীতির সাথে প্রথম সাক্ষাৎতের সেই পরমুহুর্ত।

.
মীতিকে রাতুলের বাবা, মামা আগেই দেখেছিলো বলে আলাদা ভাবে দেখাদেখির প্রয়োজন বোধ করেন নিতারা। শুধু ছেলেমেয়ে একে-অপরকে যেন দেখে, জানে, সেটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলো। দু’চারটা কথা বলার পর আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য পাঠানো হয় রাতুলকে, মীতির রুমে। রুমে ঢুকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো রাতুল। বলে উঠে, “বাহ্! তোমার রুমটাতে বেশ সাজানো গোছানো। না কি আমি আসবে জেনে এমন সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছো?”

শেষ কথাগুলো ঠোঁটে ঝুলিয়েই বললো রাতুল। একটু থেমে ফের বলে উঠলো, “তুমি করে বললাম বলে মাইন্ড করলে কি?”

“উহুঁ!”

“তো? এবার বলো, কি জানতে চাও আমার সম্পর্কে?”

বলেই একটু থামলো রাতুল। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও, “কোথায় যাই, কি করি, কয়টা গার্লফ্রেন্ড এটাই তো?”

বলেই হাসলো রাতুল, লজ্জা পেল মীতি। ইস্! তখন কি বলতে কি বলে ফেলেছে। বলেছে তো বলেছে, আর সেটাও রাতুলের সামনেই। নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে চাইলো, মীতি। বলতে চাইলো, “নাহ্! মানে, বাবা তো সবসময়ই আপনার কথা বলতো। আমি তো জানতে চাইছিলাম আপনার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। তাই….”

“বুঝলাম। কিন্তু তার জন্য তো আমার সাথে থাকতে হবে তোমার। মানে, সময় কাটাতে হবে আর কি।”

নিশ্চুপ রইলো মীতি, মুখ ফুটে বললো না কিছুই। রাতুল ফের বললো, “আর গার্লফ্রেন্ড? সে তো দু’চারটা করে সবারই থাকে। আমার তো এই তিন, চার, উম্…পাঁচটা আছে।”

“বাবা কিন্তু আপনাকে নিয়ে বেশ আলোচনা করতো বাসায়, গল্প করতো আপনাকে নিয়ে।”

“উফ্! তাহলে কি আমি লেট করে ফেললাম?”

“কিসে?”

“এই যে, তোমাকে বউ করে নিতে আসতে।”

অজান্তেই মীতির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো, লজ্জাও পেল খানিকটা। নিজেকে স্থিতি করে বললো, “এখনো বিয়েটা হয় নি মিস্টার!”

“হয় নি, হয়ে যাবে।”

“সেটা তো আমার পজিটিভ উত্তরের উপর ডিপেন্ট করছে।”

“উত্তরটা নেগেটিভ আসার কারণ? পছন্দ নয় নি আমাকে?”

“দেখতে সুন্দর, স্মার্ট, ওয়েলসেটেল। পছন্দ হবে না কেন? যে কারোই পছন্দ হয়ে যাবে।”

মীতির কথায় হাসলো রাতুল। মেয়েটা কথা বলতে জানে, কথার মায়ায় ফাঁসাতে জানে। ঠোঁটের হাসিটা বিস্তৃত করেই বলে উঠলো, “হাসবেন্ড করার মতো পছন্দ করা যাবে না?”

“উমম্… যাবে না।”

“যাবে না?”

“উহুঁ! তবে…. জীবনসঙ্গী করার মতো পছন্দ করা যায়।”

ফের হাসলো রাতুল। খানিকটা এগিয়ে এলো মীতির কাছে, ঘুচিয়ে দিলো দুরত্ব। বলে উঠলো, “আমি কিন্তু মানুষটা বেশ সাধারণ।”

“সাধারণেও অসাধারণ বানিয়ে নিবো।”

“খুব ছোট্ট সাধারণ সংসার হবে কিন্তু আমাদের। এডজাস্ট করতে হবে।”

“মানিয়ে নিবো।”

“তাহলে, বিয়ের তারিখ কি এ-মাসেই রাখবো?”

খানিকটা লজ্জা পেল মীতি, দূরে সরে দাঁড়ালো রাতুলের থেকে। রাতুল হাসলো শুধু, একটু সময় নিয়ে বললো, “কালকে বের হই আমরা, ওই ঘন্টা খানিকের জন্য।”

“কেন?”

“আমাকে জানার জন্য।”

মীতি হেঁসেছিলো শুধু, সায় জানিয়েছিলো তার হাসিতেই। রাতুলকে না করতে পারে নি মীতি, সাধ্য হয় নি। ছেলেটাকে এর আগে কখনো দেখে নি, মীতি। কিন্তু বাবার মুখে শুনেছে অসংখ্য গল্প। সুযোগ পেলেই মাহতাব শেখ মেয়ের সামনে রাতুলকে মেলে ধরতেন, বলতেন ছেলেটার নানান কথা। বাবার মুখে শুনেই যে বুঝে খানিকটা বুঝে গিয়েছিলো রাতুল সম্পর্কে। আজ দেখা হওয়া কথা বলার পর যেন বাবার কথার অক্ষরে অক্ষরে মিল পেল। ছেলেটা সাধারণ, একেবারেই সাধারণ। প্রথম দেখায় সেই সাধারণ মানুষটাকেই যেন বেশ মনে ধরলো মীতির।
সেদিনই দু’জনের ঘরোয়া ভাবে এনগেজমেন্ট হয়। পরদিন রাতুলের কথা রাখতে বের হয় মীতি, অনেকটা সময় দু’জনে একসাথে কাটায়।

.
সবেই গোছল সেড়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়েছে মীতি। চুলগুলো মুছতে মুছতে নজর পড়ে বিছানায় থাকা মোবাইলের দিকে। কিছু একটা ভেবে হাতে নিলো, মুহুর্তেই কপাল কুঁচকে গেল স্কিনে জ্বলজ্বল করা নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে। দেখে তো মনে হচ্ছে দেশের বাইরের নাম্বার। কিন্তু বাইরের দেশ থেকে তাকে কে কল দিবে? কথাটা ভাবনায় আনলেও আমলে নিলো না, পাত্তা দিলো না খুব একটা। রাখতে নিলো মোবাইল, কিন্তু রাখলো না। রাতুলকে কল করতে হবে, কথা বলতে হবে তার সাথে। ছেলেটা সেই যে পরশুদিন আগে তাকে বাবার বাসায় দিয়ে গেল, অথচ এখনো নিতে আসলো না। কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে বউকে ভুলে যেতে হলো? তাছাড়া সে ভেবেই নিয়েছে বাসায় যাবে সে।
নিজের করা ভাবনার মাঝেই কল দিয়ে ফেললো রাতুলের নাম্বারে, কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে। পর পর আরও দু’বার কল করেও বন্ধ পেল। খানিকটা অবাক হলো মীতি, রাতুলের নাম্বার বন্ধ পেয়ে। সচারাচর মোবাইল বন্ধ করে রাখে না ছেলেটা, তবে কি চার্জ নেই? এবার সময়ের দিকে খেয়াল হলো তার। নয়টা পেরিয়ে দশটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা। রাতুল বোধহয় অফিসে চলে গিয়েছে, কোন কারণে বন্ধ করে ফেলেছে নিজের সেলফোন। সেদিকে আর মাথা ঘামাতে চাইলো না মীতি, মোবাইলটা ফের বিছানায় রেখে নিজের কাজে মত্ত হলো।

খুব কম সময়েই রেডি হয়ে একেবারে লাগেজ হাতে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে এলো মীতি। তাকে দেখেই ফাহমিদা খানম বেশ অবাক হলেন। অবাকের রেশ নিয়েই বলে উঠলেন, “কি ব্যাপার মীতি, লাগেজ হাতে বের হয়েছো কেন? কোথায় যাচ্ছো?”

“বাসায় যাচ্ছি, মা। রাতুল বোধহয় ব্যস্ত আছে, আসতে পারবে না। ওর ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি।”

অবাক হলেন ফাহমিদা খানম, কপাল কুঁচকে তাকালেন মেয়ের দিকে। বললেন, “বাসায় যাবে মানে? তুমি না রাতুল আসলে….”

“বাসায় যাবো মানে আমার বাসায় যাবো। আর বললাম তো রাতুল হয়তো ব্যস্ত আছে, আসতে পারবে না। তাছাড়া, তোমার তো ওকে পছন্দও নয় খুব একটা, ও না আসলেই বা কি?”

মেয়ের কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে চাইলেন ফাহমিদা খানম, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে মীতি, “বাসায় গিয়ে জানাবো আমি। আর হ্যাঁ! বাবা আসলে জানিয়ে দিও।”

বলেই আর দাঁড়ালো না মেয়েটা, লাগেজ হাতে বেড়িয়ে গেল বাসা থেকে। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ফাহমিদা খানম। বাবার মেয়ের কথা ও জেদের কাছে যেন কোন কথায় চলে মা তার। ঠিক যেটা বলবে তেমনটা হওয়া চাই। ভেবেই যেন সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়লেন ফাহমিদা খানম। মিথ্যে নয় মীতির কথাগুলো। রাতুলকে তিনি এখনো মন খুব একটা পছন্দ করতে পারেন না। কিন্তু কেন? জানা নেই তার উত্তর। হয়তো খুব সচ্ছল পরিবার হওয়ার কারণেই। একমাত্র মেয়ে তার, এমন ছেলের সাথে কে-ই বা বিয়ে দিতে চায় মেয়ের? যার পরিবারই গ্রাম থেকে উঠে আসা।
মেয়ের বিয়ের আগে ভেবেছিলেন মীতি হয়তো ছেলেটাকে দেখামাত্র ‘না’ করে দিবে, রাজি হবে না বিয়েতে। কিন্তু তার ভাবনাকে ছাড়িয়ে রাজি হয়ে যায় মেয়েটা। তাদের বিয়ের দেড় বছরেও মীতির মুখে রাতুলের কোন অভিযোগ শুনেন নি তিনি। শুনলে এখনো তিনি মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন বলে ভেবে রেখেছেন।

.
হাতের লাগেজ টানতে টানতে একটা পার্কের সামনে এসে দাঁড়ালো মীতি। মূলত এখান থেকেই তার সিএনজি তে উঠতে হবে। কিন্তু উঠলো না, ছোট গেইট’টা দিয়ে পার্কের ভেতর ঢুকে গেল। বিশাল বড় পার্ক, অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। কড়া রোদের এই সময়টাতেও যেন লোকসংখ্যা কমবার নয়। চারদিকে একবার নজর বুলালো মীতি। মাথাটা কেমন জানি ঝিমঝিম করছে। প্রায় অনেকটা সময় থেকেই। বারংবার মস্তিষ্কে উঁকি দিচ্ছে—বাসা থেকে চলে এসেছে সে। কিন্তু কেন? তার উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।
এক হাতে লাগেজ’টা শক্ত করে চেপে ধরে অপর হাতে মাথা চেপে ধরলো। হঠাৎই ঝাপসা হয়ে উঠলো চোখের সামনে, পড়ে যেতে নিলো। কিন্তু পড়লো না। দু’টো বলিষ্ঠ হাত এসে ধরে ফেললো তাকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করেও খুলে ফেললো মীতি, চোখের দৃশ্যপট হলো এক অপরিচিত পুরুষ মুখ। নিজেকে শক্ত করলো মেয়েটা, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগেই সেই বলিষ্ঠ হাতের অপরিচিত মানবটা তাকে বসিয়ে দিলো একটা বেঞ্চে। এগিয়ে দিলো একটা পানির বোতল। ঢকঢক করে তা পান করলো মীতি, খানিকটা স্বাভাবিক করলো নিজেকে। ফের অপরিচিত সেই মানুষটার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, “কে আপনি?”

“ফাহাদ। ফাহাদ খন্দকার!”

.
.
চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে