#মন_উন্মনে_আঁচড়
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
সূচনা পর্ব—
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উম্মুক্ত]
.
“একসাথে থেকে ঝগড়া করার চেয়ে বেটার আমরা আলাদা হয়ে যাই মীতি। আমি ক্লান্ত।”
“কি বললে?”
ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো মীতি। নিত্যকার স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার মাঝে রাতুলের মুখে হঠাৎ আলাদা হয়ে যাওয়ার কথায় থমকে গেছে মীতি। দেড় বছর সংসার জীবনের পর হঠাৎ এমন কথা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো তার জন্য। পরমুহূর্তেই যেন তার চোখের দৃশ্যপট হলো দুপুরের এক ঘটনা। স্থির হলো মীতি, রাতুল বলে উঠলো, “এতটা টেনশন আমি আর নিতে পারছি না, ক্লান্ত আমি….”
“তার আগে কি বললে তুমি?”
ফের ক্লান্তিমাখা স্বরে জিজ্ঞেস করলো মীতি। এবার নিজের ভুলটা হয়তো বুঝতে পারলো রাতুল। কিছু বলার আগেই মীতি আবারও বলে উঠলো, “তুমি আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা বললে, তাই তো?”
“এমনটা নয় মীতি। তুমি বুঝতে পারছো না?”
“কি বুঝতে পারছি না? এমনটায় তো বললে।”
“দেখো, ভুল বুঝছো তুমি। আমি তো…”
“নাহ্! মনের কথাটা আসলে প্রকাশ করেই ফেললে। তাই তো? আসলে আমিই বোকার মতো তোমার কাছে এক্সপেকটেশন রেখেছি।”
“মীতি তুমি….”
“আচ্ছা… এবার তুমি হ্যাপি থাকতে পারো। আমি কখনোই তোমাদের দুজনের মাঝে বাঁধা হয়ে আসবো না।”
“দুজন? আমাদের দুজনের মাঝে মানে?”
“হ্যাঁ! আমি আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না তোমাদের মাঝে।”
মীতির কথা বুঝলো না রাতুল, আর না বুঝলো মেয়েটার চোখের ভাষা। হয়তো অনেক আগেই মীতির চোখের ভাষাও বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে। আবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—কি বলছো? নিশ্চুপ রইলো মীতি, চোখ দুটো অশ্রুসিক্তে ভরে উঠলো। আধা সেকেন্ডের মতো সময় নিলো মীতি। ভারী কণ্ঠে বললো, “তোমার ফ্লাইট কালকে রাতে, তাই তো?”
“হ্যাঁ! কিন্তু তোমার কি হয়েছে মীতি? এভাবে….”
“কালকেই আমরা ডিভোর্সের জন্য উকিলের কাছে এপ্লাই করি। তারপর রাতের ফ্লাইটে তুমি কানাডা চলে যেও।”
থমকালো রাতুল, স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। মীতির আচমকা কথায় যেন তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে। বউকে সারপ্রাইজ দিতে এসে যে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে, তা যেন কল্পনাও করে নি। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে দেড় বছর সংসারের পর হয়তো আলাদা হয়ে যাওয়াটা অনেকের কাছে বেশ স্বাভাবিক। স্বামী স্ত্রীর মাঝে বনি-বনা হয়নি বলে আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু রাতুল তো মানিয়ে নিয়েছিলো, ভালোবেসে ফেলেছিলো মীতিকে। হঠাৎ বলা মীতির ডিভোর্সের কথাটা কিছুতেই মস্তিষ্কে নিতে পারছে না যেন। ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে গেল মীতি, নিপলক সেদিকে তাকিয়ে রইলো রাতুল।
.
ক্লান্তিমাখা নিদ্রাহীন চোখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উঠাচ্ছে রাতুল। দু’একবার ছাড়া কখনোই এই নিকেটিনের ধোঁয়ায় হাত লাগায় নি, মীতির সামনে তো কখনোই নয়। কিন্তু আজ যেন বড্ড টানছে তাকে এই নেশাদ্রব্য, মনের সুখে উড়িয়ে দিতে জানান দিচ্ছে। সে যেন এক সুপ্ত যন্ত্রণা হতে মুক্তি নিতে।
ঘরে নেই, মীতি। ঘন্টা দুয়েক আগে সেই যে ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবারের সময় ছোট খাটো ঝগড়া হলো, ডিভোর্সের কথা বলে পাশের রুমে ঢুকে দরজা আটকালো, তারপর আর সেই দরজা খুলে বেরোয় নি মেয়েটা। রাতুলও ডাকে নি। সে যেন বুঝতেই পারছে না ঠিক সমস্যাটা কোথায়। রোজকার কাজের চাপের সাথে নতুন করে দাম্পত্য জীবনের সমস্যাটাও যেন যুক্ত হলো।
হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ভাবনা ছুটলো রাতুলের, পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে রিসিভ করলো। সামান্যক্ষণ কথা বলেই রেখে দিলো। অজান্তেই যেন এক মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। যাক, সামান্যতম হলেও যেন নিশ্চিত হলো মীতির ব্যাপারে।
ইশার ফোন ছিলো। এক মাসের জন্য কানাডা যেতে হবে অফিসের কাজে, ইশাও তার সাথে যাবে। ফ্লাইট রাতে থাকলেও সেটা কোন কারণে ক্যান্সেল হয়েছে, রাতের পরিবর্তে সকাল সাড়ে দশটায় ফ্লাইট। তা জানাতেই ইশার ফোনকল। রাত প্রায় অনেকটা, এই মুহুর্তে ঘুমানো প্রয়োজন। কিন্তু মীতিকে অন্য রুমে রেখে ঘুমানোর সাধ্য নেই। তবে আনলো না সে মীতিকে, আর না নিজে গেলো সে-রুমে। থাকুক না সে নিজের মতো।
.
অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাতুলের। মনে হয়, এই তো—মাত্রই তো ঘুমিয়েছে। অলস ভঙ্গিতে পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখে নিলো। সাড়ে সাতটা বাজে। নয়টার মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে। আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকায়, বিছানা ফাঁকা পেয়ে কিছুটা অবাক হলো, কিন্তু পরমুহূর্তেই রাতের ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল রাতুলের। সুপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো রাতুল। ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু নাশতা বানালো। এর মাঝে বেশ কয়েকবার উকি দিয়ে দেখতে লাগলো অবস্থান করা মীতির রুমের দরজার দিকে।
খানিকটা সময় নিয়ে রেডি হয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে এলো রাতুল, কোন রকমে নাস্তাটাও সেড়ে নিলো। এতক্ষণেও মীতি উঠে নি ঘুম থেকে। হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে লাগেজ সহ বেড়িয়ে এলো একেবারে। চাবি দিয়ে দরজা গুলো মীতির অবস্থানকৃত রুমে ঢুকলো। বিছানার গা ঘেঁষে শুয়ে আছে মীতি, ঘুমে বিভোর। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর দাগ স্পষ্ট, ক্লান্তি ভাব বিদ্যমান।
বিছানার কাছে এগিয়ে এলো রাতুল, হাঁটু গেড়ে বসলো মীতির সামনে। সারারাত কান্নার পর চোখে একটু ঘুম ধরা দিয়েছে তা বেশ বুঝতে পারলো। আলতো করে হাত ছোঁয়ালো রাতুল, মীতির মুখ থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিতে। ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে খানিকটা কেঁপে উঠলো মীতি, নড়েচড়ে উঠলো। তবুও হাত সরালো না রাতুল। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে মীতি, শরীরের শতভাগ অঙ্গ অনাবৃত হয়ে আছে মেয়েটার। তা দৃশ্যপট হতেই অজান্তেই হাতের স্পর্শ গাড়ো হলো রাতুলের। কেঁপে উঠলো মীতি, আচমকাই চমকে উঠে চোখ খুললো। ভয়ের তাড়নায় এক ঝটকায় রাতুলের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দিয়ে নিজেও সামান্য দূরে সরে গেল। সহসায় রাতুল বলে উঠলো, “মীতি, আমি। ভয় পাচ্ছো কেন? দেখো, এই যে আমি।”
এবার ভালোভাবে তাকালো মীতি। এতক্ষণে ঘুমটাও ভেগে গেছে তার। নিজেকে স্থিতি করলো। জোরে বার দুয়েক নিশ্বাস টেনে বললো, “তুমি…. তুমি এখানে কি করছো? কেন এসেছো এখানে?”
“দেখো, শান্ত হও। আমার কথাটা একটু শুনো।”
“কিছু শুনতে চাই না আমি। যাও তুমি….”
“আই এম সরি! মীতি। রাতের ফ্লাইট’টা ক্যান্সেল হয়েছে। সাড়ে দশটায় ফ্লাইট, এখনি বেরুতে হবে আমার।”
স্তম্ভিত হলো মীতি, মুহুর্তেই স্থির হয়ে গেল। এতক্ষণে রাতুলকে লক্ষ্য করলো সে। ফর্মাল ড্রেসে একেবারে রেডি হয়ে এসেছে, দরজার কাছে রাখা লাগেজ। চকিতেই সবটা বুঝে ফেললো মীতি, তৎক্ষনাৎ মন মস্তিষ্কে গেঁথে গেল—মিথ্যা বলছে রাতুল তাকে। সময় নিলো না খুব একটা, মনের কথাটা আর্তনাদে বেড়িয়েও এলো। বলে উঠলো, “মিথ্যে বলেছো আমাকে, তাই না? আবারও ধোঁকা দিয়েছো, রাতুল?”
“ভুল বুঝছো, আমি জানতাম না। হঠাৎ করে….”
“ঠকিয়েছো আমাকে, আবারও আমাকে ঠকিয়েছো তুমি।”
“মীতি, আমার কথাটা একটু শোনো। আমি সত্যিই জানতাম না। রাতে ইশা কল দিয়ে জানালো বলে….”
ফের স্তম্ভিত মীতি, নামটা শুনতেই স্থির হলো। ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত হাসি, আর মনে হাহাকার। ‘ইশা!’ নামটা ও নামের মানুষকে বেশ ভালোভাবেই চেনে মীতি, জানে ‘ইশা’ নামের মেয়েটাকে। আর কথা বাড়ালো না, হয়তো চাইলো না কথা বাড়াতে। ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো, “আচ্ছা, চলে যাও।”
“মীতি, তুমি….”
“বললাম তো যাও। দেরি হলে ফ্লাইট মিস হবে।”
এগিয়ে এসে মীতিকে ধরার চেষ্টা করলো রাতুল। বাঁধা দিলো মেয়েটা, যেতে বললো তাকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাতুল। মেয়েটা বড্ড জেদি। যেটা বলবে, ঠিক তেমনটাই হওয়া চাই। আর বাক্য ব্যায় করলো না রাতুল, সরে এলো খানিকটা। রুম ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ হতেই ফের থেমে গেল, তাকালো মীতির দিকে। বললো, “এক মাস অনেকটা সময় মীতি। এই এক মাসের জন্য আমরা আলাদা। ভেবে সিদ্ধান্ত নিও ডিভোর্সের ব্যাপারে।”
নিশ্চুপ রইলো মীতি। আর দাঁড়ালো না রাতুল। দরজার কাছটায় রাখা লাগেজটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল। একটাবার পিছন ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। তাকালে দেখতে পেতে অশ্রুসিক্তে বিচলিত হওয়া এক রমণীর মুখ। সেই অশ্রুসিক্ত চোখেই হাজারো কথা বলে যাচ্ছে।
আধা সেকেন্ডের মতো অতিক্রম হতেই দরজা আটকানোর শব্দ হলো। সেই শব্দ মীতির কর্ণপাত হতেই ফুপিয়ে উঠলো, ধীরে ধীরে কান্নার গতিবেগ ও শব্দ দুটোই বৃদ্ধি পেল।
.
লাগেজ হাতে বেড়িয়ে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ালো মীতি। ঘুরে ঘুরে পুরো বাসাটা দেখতে লাগলো, বিরবির করে দু’বার বললো, “আমার বাসা, আমার সংসার।”
গড়িয়ে পড়া অশ্রু গাল ওড়নার দিয়ে মুছলো মেয়েটা। ফের বলে উঠলো, “মায়ায় জড়াতে পারলেও আপন করতে পারলাম না, ধরে রাখতে পারলাম না আমার সংসারটা। আমার সংসার…. কিছুদিন পর অন্য কারোর সংসারে রূপান্তর হবে।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে বাসা থেকে বেড়িয়ে এলো মীতি। রাতুল যাবার আধা ঘণ্টা পর মীতিও বাসা ছাড়লো, ছাড়লো সংসারের মায়া। আদোও এই সংসারের মায়া ছাড়তে পারবে কি-না জানা নেই মীতির, জানা নেই তাদের ভবিষ্যৎ। রাতুলও জানতে পারলো না মীতির চলে যাওয়া। তার দেশ ছাড়ার সাথে সাথে যে সংসারটাও ভাঙলো তা অজানাই রয়ে গেল রাতুলের।
.
কানাডার বিলাসবহুল হোটেলের বিশাল রুম। এই হোটেলেই রাতুলের অফিসের মিটিং, প্রেজেন্টেশন ও যাবতীয় কার্যক্রম হবে, তাই এই হোটেলেই উঠতে হয়েছে তাদের। রাতুল ও ইশার পাশাপাশি দু’টো রুম বুক দেওয়া। নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হতে ঢুকেছে রাতুল। রাতের প্রায় অনেকটা। ফ্রেশ হতে খানিকটা সময় নিয়ে গোছল সেড়েই বেড়িয়ে আসলো একেবারে। রুমে আসতেই দেখা পেল ইশার। ঠোঁটে ঝুলে আছে মুচকি হাসি।
রাতুলকে বেরুতে দেখে এগিয়ে এলো ইশা। ধীরে ধীরে অনেকটা কাছে চলে এলো। রাতুলের অনাবৃত্ত ভেজা গলা দু’হাতে জড়িয়ে নিলো, রাতুলও তার কোমড় আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে। ইশা বললো, “তোমার এই হ’টনেসে সেই কবেই তো ফেঁসে গিয়েছি রাতুল, এভাবে সামনে এসে কি পুরোপুরি মা’রার প্ল্যান করছো,?”
“তুমি ম’রতে চাইলে আমি মা’রতে রাজি আছি।”
“আমি রাজি!”
ফিসফিসিয়ে বললো ইশা, সহসায় হাতের বাঁধন দৃঢ় করলো রাতুল। ইশার ওয়েস্টার্ন ড্রেসের অনাবৃত পিঠে এক হাত বুলাতে লাগলো, অপর হাতে কোমরের বাঁধন দৃঢ় করে মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো একে-অপরকে, মিলিয়ে দিলো ঠোঁটে ঠোঁট। দু’জনে মেতে উঠলো চুম্বনকৃতে। অতিক্রম হলো খানিকটা সময়, দু’জনের কেউই ছাড়লো না একে অপরকে। বরং গভীর চুম্বনে মত্ত হয়ে সেভাবেই এগিয়ে গেল বিছানায়, শুয়ে পড়লো দু’জনে। ইশার ঠোঁট ছেড়ে এবার গলায় নেমে এলো রাতুল, ধীরে ধীরে ইশার বক্ষদেশে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে লাগলো। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। খানিকটা বিরক্ত হয়ে মাথা তুললো রাতুল। সামান্য উঠে বসলো, তারপর ঠিক নিজের মতোই অনাবৃত করতে লাগলো ইশাকে।
.
.
চলবে….?