❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১১)+(১২)
একটা সংসার গড়তে যেমন অনেক কষ্ট, তার ভা’ঙ’ন আট’কানোটাও অনেকটা কঠিন। পরিপূর্ণ এক সংসারের যাবতীয় তত্ত্বাবধানে যখন পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের লোকজনের কথা, কাজ এবং ইশারাকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তখন সেই সংসারে ভা’ঙ’নের চিত্র ফুটে ওঠে অতি সহজেই। কেউ মুখ ফুটে না বললেও তার কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে বুঝে নেয়া যায়, সে ভা’ঙ’ন চাইছে। বিশেষ করে এই সমাজের যৌথ পরিবারগুলোতে এই চিত্রটা বেশিই লক্ষ্মণীয়। একজন সংসার গড়তে চাইলে অন্যজন তা ভে’ঙে গুড়িয়ে দিতে চায়। একটা সংসার ভা’ঙ’তে একজন দু’মুখো নারী কতখানি প্রভাব ফেলে তা সেই নারীকে কাছ থেকে উপলব্ধি না করলেও বুঝা হবে না কখনো। তাই ব্যক্তিকে চিনতে, এমন মুখোশধা’রী দু’মুখো চরিত্রের নারীদের চিনতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কাটাতে হবে অতি সুক্ষ্মভাবে। তবেই কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
আরমান সাহেবের পরিবারটাও এমন। যতদিন এই ঘরের আসল কর্ত্রী, অর্থাৎ অনিক, আলিফের মা বেঁচে ছিলেন ততদিন সংসার সুখের স্বর্গ বৈ কম ছিল না। সংসার কীভাবে আগলে রাখতে হয় তা তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। যদিও ঝা’মে’লা খুব একটা ছিল না, তবুও একটা সংসারের গোটা দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। সন্তানদের লালন-পালন করা, স্বামীসেবা করা, ঘর আগলে রাখা ছাড়াও একজন নারী যেভাবে সংসার বাঁচাতে যত সেক্রিফাইস করে তার সবটাই করেছিলেন তিনি। দু’হাতে অতি যত্নে আগলে নিয়েছেন পুরো সংসারকে। কখনো অযত্ন, অবহেলা কিংবা কোনো ত্রুটিবিচ্যুতিকে ঘেঁষতে দেননি সংসারে। অথচ তাঁরই ছেলের বউ মারাত্ম’কভাবে বাইরের লোকের কথাকে প্রশ্রয় দিয়ে সংসারে ভা’ঙ’ন টে’নে আনছে। যা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কখনও!
মাইসারাকে বিদায় দেয়ার পর থেকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে ফারজানা। কার্যসিদ্ধি না হলেও, পথের কাঁ’টা আপাতত সামনে নেই; এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে স্বস্তির এবং শান্তির তার কাছে! হাসিমুখেই মায়ের সাথে বসে গল্প করছিল। হুট করেই আলিফ আজকে ভদ্রমহিলাকে এই বাড়িতে ডেকেছে৷ কেন ডেকেছে সেটা অবশ্য পরিষ্কার হয়নি, তবে তাদের আমোদফুর্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে, বেশ সুখী তারা। ত্বোয়া চায়ের ট্রে’টা রেখে আলগোছে সরে গেল সেখান থেকে। এরপর আলিফ এসে সামনে দাঁড়ালো। ফারজানার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মায়ের সাথে দরকারি কিছু কথা আছে। তোমার ব্যাগপত্র গোছাও! আজ তো তোমারও এখান থেকে যাওয়া উচিত।”
-“মানে!”
বিস্ময় নিয়ে স্বামীর চেহারার ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলো ফারজানা। কিছু বুঝতে পারলো না। আলিফ আবারও বলল,
-“যা বলছি তা করো। দ্রুত ব্যাগ গোছাও। আর আজকেই এই ঘর ছেড়ে বের হও।”
-“কী বলছো তুমি এটা! বের হবো মানে? এটা আমার ঘর, আমার সংসার। আমি কেন বের হবো? হ্যাঁ দু’চার দিন বেড়াতে যাওয়া যায়, তাই বলে ঘর ছেড়ে বের হবো৷ তোমার কথায় তো মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইছো।”
-“বেশি কথা বলো না, যা বলছি সেটা করো। অযথা বকবক করার সময় আমার নেই।”
ফারজানা নড়লোও না। আঁটসাঁট বেঁধে ওখানেই বসে রইলো! আলিফ সেটা দেখে আবারও বিরক্তি নিয়ে তাকালো। বলল,
-“কথা কানে যায়নি তোমার? মায়ের সাথে যেতে চাও তো, দ্রুত তৈরী হও। নইলে একাই এতটা রাস্তা যেতে হবে। রাত হলে একা যাওয়া রিস্ক! আমি এতটাই দায়িত্বহীন নই যে, নিজের স্ত্রীকে একা ছেড়ে দিব।”
ভদ্রমহিলাও আলিফের এহেন আচরণে ভীষণ চমকালেন। কিন্তু চেহারায় হাসি বজায় রাখতে বাধ্য হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“যা মা, জামাই যখন চাইছে ক’টাদিন বিশ্রাম নেয়া উচিত তোর। নাহিয়ানকেও তৈরী করেনে!”
এ পর্যায়ে ফারজানা উঠে দাঁড়ালো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতরে চলে গেল। এবার ঝেড়ে কাশলো আলিফ! নিজের ভেতরে রাখা লুকায়িত কথার ঢালি তুলে ধরলো শাশুড়ির সামনে! তিনি শুধু সব হজম করলেন। কোনো কথা বললেন না। বলার মুখ তার নেই, তবুও চুপ থাকাই যেন সম্মতিকে প্রশ্রয় দেয়। তিনি টের পেলেন, মেয়েকে কুযু’ক্তি দিয়ে ঘর আলাদা করতে আসেননি বরং ছলেব’লে কৌশলে নিজের অজান্তেই মেয়ের সংসার ভে’ঙে দিয়েছেন! তবে তিনি বেশি অবাক হলেন আলিফের কর্মকাণ্ডে। এমন শান্তশিষ্ট ছেলেটা হঠাৎ করে বউয়ের বিরু’দ্ধে চলে গেল কী করে!
*****
বিদায়ের সময় এক অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলো আলিফ! যখনই মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, অমনি হাতের টানে নাহিয়ানকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। তার এমন আচরণে স্তব্ধ হয়ে গেলেন সকলে। আরমান সাহেবও স্থির চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের মুখপানে। ছেলেকে সোজা কোলে তুলে ত্বোয়ার কাছে দিল। ফারজানার সামনে এসে বলল,
-“এবার যাও।”
-“মানে!”
একেই তো আলিফের আচরণ, ভাবভঙ্গি তার ঠিক লাগছে না, তারউপর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপে রীতিমতো আগুন ঝড়ে পড়তে লাগলো তার চেহারা দিয়ে। দু’ঠোঁট একত্রে চেপে খানিকটা রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আলিফ মুচকি হাসলো। বলল,
-“কথা দিয়েছিলে, সংসারকে আগলে রাখবে। কিন্তু তা না করে, ভাঙ’ন ডেকে আনলে। ওইটুকু বাচ্চা, কী বুঝে এত ঝগ’ড়াঝাটি। তবুও ওর সামনেই তুমি সারাকে উল্টাপাল্টা কথা বলেছো। ভুলে গেছো, বাবা-মায়ের আচরণ সন্তানদের ভবিষ্যতের রূপকে চিহ্নিত করে। আজ তুমি যা করছো, তা ও শিখছে, নালিশ দিচ্ছে! তোমার কাছে থাকলে ও মানুষ হবে না। ঠিক তোমার মতোই, স্বার্থপ’র, সুবিধাবাদী আর লো’ভী তৈরী হবে!”
-“মুখ সামলে কথা বলো বাবা! কী বলছো বুঝে বলছো তো?”
ভদ্রমহিলার তর্জ’ন-গর্জ’নের রূপ দেখে অট্টহাসিতে ফে’টে পড়লো আলিফ। ত্বোয়াকে বলল,
-“যা ওকে ঘুম পাড়া!”
কোনো প্রকার দ্বিরুক্তি ছাড়াই মাথা নেড়ে নাহিয়ানকে নিয়ে চলে গেল ত্বোয়া। ফারজানা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। তার এখনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। আলিফ কী করছে, বা কী করতে পারে এমন কোনো ধারণাই এখনো উঁকি মারছে না মনে। তবে সে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। দু’হাতে খাম’ছে ধরেছে মায়ের হাত। ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছে স্বামীর দিকে। ছোট্ট একটা বোতল টি-টেবিলের উপর রাখলো আলিফ। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমি দুঃখিত বাবা, তুমি থাকা সত্ত্বেও আজ একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আমাকে! যাকে আমার পছন্দে ঘরে এনে তুলেছিলাম, তাকে আমার ইচ্ছেতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বললাম। তুমি আমার উপর রাগ করো আর যাই করো, তোমার বউমা যদি এক্ষুণি এই ঘর ছেড়ে বের না হয়, তবে আমিই বেরিয়ে যাব।”
আরমান সাহেবকে খানিকটা বিচলিত দেখালো। তিনি তার সন্তানদের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ করেছেন। বুঝিয়েছেন, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য। কোথাও কি তিনি ভুল করেছেন, যার কারণে তার সন্তান আজ এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে? তিনি কঠোর গলায় বললেন,
-“কীসের ভিত্তিতে তুই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
আলিফ বোতলটা হাতে নিল। তার উপরের লেখাটা বাবাকে পড়ে শুনালো। বলল,
-“যাকে বিশ্বাস করে তুমি-আমি, আমরা ঘর-সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলাম সেই মেয়েটাই তোমার ঘরটাকে ভে’ঙে দিচ্ছিলো বাবা! এই এসি’ডটা রান্নাঘরে রেখেছিল, যেন এটা সারার শরীরে লাগে।”
মাইসারা বাড়িতে আসার পর থেকে ফারজানার সাথে তার টুকটাক ঝগড়ার কথা নাহিয়ানের মুখ থেকেই শুনেছে আলিফ। ওইটুকু বাচ্চা ঝগড়ার দৃশ্য দেখে মুখস্থ করে বাবার কাছে বর্ণনা করেছে। যার ফলে, এত বছরের গড়ে তোলা সম্পর্কে টুকরো টুকরো সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে তার। যদিও আলিফ চাইতো না তার সন্দেহ আসুক, স্ত্রীকে দো’ষী সাব্যস্ত করুক, তবুও ফারজানার কিছু কিছু অহেতুক কাজ বার বার মনকে আঘাত করেছে। সন্দেহ সেদিনই গভীর হয়, যেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে স্ত্রী আর শাশুড়ির গোপনে দেখা-সাক্ষাতের দৃশ্য তার চোখে পড়েছিল। আড়ালে তাদের এসি’ডের বোতল দেয়া-নেয়ার দৃশ্যটাও চোখ এড়িয়ে যায়নি তার। বাড়ি ফিরে গভীরভাবে ভেবেছিল সে। অপেক্ষা করছিল স্ত্রীর পরবর্তী পদক্ষেপের। যখন দেখলো, ফারজানা এসি’ডের বোতলটা রান্নাঘরের শেলফে রেখে মা’কে ফোন করে বলেছিল,
-“জায়গামতো রেখে দিয়েছি মা। এবার শুধু সারার উপরে পড়লেই হবে। এই মেয়েটা যেকোনো দিন আমার সবকিছু কে’ড়ে নিবে। সাজানো-গোছানো সংসারকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হবে। যতই বলো, সারা তাদের আপন। আর আমি তো পরের ঝি! এত সহজে তাকে গোটা সংসারের দায়িত্ব কীভাবে দিয়ে দিই বলো! আমিও দেখে ছাড়বো, আমার ঘর, আমার সংসার কী করে সে আমার থেকে কে’ড়ে নেয়!”
এরপরই সে সুযোগ বুঝে বোতলটা সরিয়ে তেলের টিনটা সেখানে রেখে দিয়েছিল। ভাবেনি, ওতো বড়ো জিনিসটা গড়িয়ে পড়তে পারে। যার কারণে মাইসারাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যথা দিয়েছে সে। এরজন্য গোপনে মাইসারার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে আলিফ। শুধু বলেছে চুপ থাকতে। মাইসারাও ভাইকে বুঝিয়েছে, যেন এসব ভুলে যায়। এ নিয়ে কোনো ঝা’মে’লা সে চায় না। অথচ আলিফ চুপ থাকতে পারছে না। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, যাকে ভালোবেসে সবকিছুর ভার ছেড়ে দিয়েছিল, সেই পিছন থেকে ছু’রিকাঘা’তে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে মন! সব শুনে আরমান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি। শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলে-বউমার দিকে।
*****
-“শুধু তাই নয় বাবা, সেদিন গ্যাসের চুলাতেও আগু’ন লাগা ওর ইচ্ছাকৃত কাজ! ও মনে-প্রাণে চায়, সারাকে মে’রে ফেলতে। যেন গোটা সংসারের ভোগবিলাসিতা সে একাই পেতে পারে!”
ফারজানা এবারও কোনো কথা বললো না। চুপচাপ শুনে গেল। আলিফ আবারও বলল,
-“প্রতি মাসে আমি সংসারে টাকা দেয়ার পরেও তোমার বউমা টান পড়েছে বলে তোমার কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়। সেই টাকা, ব্যাংকে জমা রাখে। এটা অবশ্য ফারহান বলেছে! একই মায়ের পেটে জন্ম হলেও, একটা মানুষ হয়েছে অন্যটা অ’মানুষ! ভাবতেও খারাপ লাগছে, এই অমানুষটাকে নিয়ে এতদিন সংসার করেছি, বিশ্বাস করেছি, ভালোবেসেছি! নিজেরই ঘৃ’ণা হচ্ছে এখন!”
আরমান সাহেবও কথা বাড়ালেন না। বুঝতে পারলেন, ছেলে আজ সব জেনেই মাঠে নেমেছে। কিছু না বললেও খারাপ দেখায়। তাই ঠাণ্ডা মাথায় বললেন,
-“তুমি যবে থেকে এখানে এসেছো, কখনো তোমাকে কোনোকিছু নিয়ে অভাব করতে হয়েছে? আমি জানি, মাস শেষে আলিফ সংসারের পিছনে টাকা দেয়, তবুও তুমি প্রতি মাসে বাড়তি পনেরো হাজার আমার কাছ থেকে নিয়েছো! বুঝিয়েছো, সংসারে টানাটানি হচ্ছে। আমি সেটাই বিশ্বাস করতাম। অথচ আমাদের ক্ষেত ভরা ধান, বারোমাসি সবজি, এমনকি মাছেরও অভাব নেই। তবুও তোমার চোখে সব জায়গায় অভাব ছিল। তোমাকে নিজের মেয়ে ভেবে, এতগুলো দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলাম, এটাই কি আমার ভুল ছিল মা? সংসার আগলে রাখতে পারবে না, এই ঘরে তুমি তোমার মনমতো কিছু পাচ্ছো না, সেটা আমাকে মুখ ফুটে বলতে! তোমাদের এই নীরব দ্ব’ন্দ্বের টানাপোড়নে আমি বয়স্ক মানুষটাকে কেন ফেললে, বলবে? দুনিয়াটা কি শুধুই ভোগ্যব’স্তু তোমাদের চোখে? শুধু পেলাম, খেলাম, জমালাম, এসব? ত্যাগ বলতে কিচ্ছু নেই? আমরা তবে সবাই ভুল ছিলাম। আমার আর কিছু বলার নেই বউমা! তোমাকে ধন্যবাদ, আমার, আমাদের সবার বিশ্বাসটাকে এভাবে ভে’ঙে দেয়ার জন্য!”
ফারজানা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চেয়েছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে আলিফ নিজেই বলল,
-“চলে যাও! সময়মতো ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে। তোমার মোহরানা তো আগেই দিয়েছি! রাখার মধ্যে আমি শুধু আমার সন্তানকে রেখে দিলাম। ব্যাংক, ব্যালেন্স যাবতীয় তোমারই রইলো! তুমি স্বাধীন। চারদেয়ালের এই গৃহস্থালি জীবন তোমার জন্য নয়!”
আহত চোখে তাকিয়ে রইলো সে। বলার মতো কোনো কথাই আজ তার কাছে অবশিষ্ট নেই। যা দিয়ে সে তার সংসার বাঁচাতে পারবে! কঠিন মনটা যেন এ পর্যায়ে আরও কঠিন হয়ে গেল! তবুও কোনো জবাব মুখ দিয়ে এলো না। ভদ্রমহিলা এবার মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলেন। আলিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“আমিও কোর্টে যাব! দেখে নিব, বাচ্চা তুমি কীভাবে আট’কে রাখো।”
আলিফ পালটা জবাবে হাসলো। ঘাড় নেড়ে বলল,
-“অসুবিধা নেই! আমিও এই এসি’ডের বোতলটা সোজা থানায় নিয়ে যাব। কোর্টে মা’ম’লা ঠুকে দিয়ে মা-মেয়েকে সারাজীবনের জন্য চারদেয়ালের ব’ন্দী জীবন উপহার দিব। আপনাদের এই সকল কাজের সাক্ষী, ফারহান। আমার বোনের দিকে আঙুল তুলেছে আপনার মেয়ে! ভাগ্য ভালো যে, তার হাত এখনো আমি ভে’ঙে ফেলিনি। বের হয়ে যান এখান থেকে!আপনাদের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলছি, যদি বাড়াবা’ড়ি দেখি, ঘা’ড় ধ’রে বের করে দিব।”
আলিফের এমনতর কঠিন চেহারা আগে দেখেনি ফারজানা! আজ যেন নতুনভাবে, নতুনরূপে নিজের স্বামীকে আবিষ্কার করলো সে। হাত-পা ধরে ক্ষ’মা চাইলে অপরা’ধের শা’স্তি কম হবে কী? ভেবে পেল না ফারজানা। কিছু বলার আগেই হাতে টান অনুভব করলো সে। ভদ্রমহিলা একরকম টা’নতে টা’নতেই ঘর থেকে বাইরে বের করলেন তাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর দরজা আ’টকানোর শব্দ শুনে পিছনে তাকালো সে। গ্রিলের ফাঁকে একজোড়া অভিমানী চোখ যেন তাকে তখনই কিছু বললো। বুঝিয়ে দিল, মানুষটা পুরোপুরি ভে’ঙে যাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই দৃষ্টির ভাষা পড়তে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তাকে। অথচ তা আরও আগে বুঝা উচিত ছিল তার।
*****
এতটা রাস্তার টানা ড্রাইভ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলো অনিক। যখন বাড়ি পৌঁছালো, তখন রাত প্রায় দশটা। মাইসারাকে পৌঁছে দিয়ে, তার সাথে কিছুটা সময় প্রয়োজনীয় কথা বলে সময় অতিবাহিত করার পিছনেই দেরী হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে শুধু জানালো, সে পৌঁছেছে। ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে আসলো তখন সবকিছু নীরব। প্রতিদিন টেবিলে খাবার দিয়ে ফারজানা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে! কী কী লাগবে, না লাগবে তা এগিয়ে দেয়ার জন্য। অথচ আজ সে সামনে নেই। গলার আওয়াজও শোনা গেল না। কিছুক্ষণ পর, লবণ আর লেবু নিয়ে খাবার টেবিলে আসলো ত্বোয়া। হাত ধুয়ে সে-ও খেতে বসলো। ঘরের এমন নীরব, থমথমে পরিবেশ দেখে অবাক হয়ে গেল অনিক। বলল,
-“তুই খাসনি এখনো?”
-“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ভাবীকে পৌঁছে দিয়েছো ঠিকঠাক? রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
আচমকা ত্বোয়ার মুখে ভাবী ডাক শুনে চমকে গেল অনিক। মুচকি হেসে বলল,
-“আমি সঙ্গে থাকলে অসুবিধা হওয়ার কথা?”
-“হয় না? রাস্তাঘাটে কত অসুবিধা হয়!”
ত্বোয়ার মূল কথা এটা ছিল না। মূলত সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেই এই কথা তুলেছিল। অনিক যেভাবে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে, যেকোনো সময় জানতে চাইবে ফারজানা কোথায়! তখন কীভাবে বলবে, সন্ধ্যের ঘটনা। বাড়তি কোনো কথা ছাড়াই খাওয়ায় মনোযোগ দিল ত্বোয়া। অনিকও খাবার মুখে তুলে বলল,
-“বাবা, ভাইয়া, ভাবীর খাওয়া শেষ? অসুস্থ নাকি, আজ তুই একা সব করছিস!”
হাতটা থেমে গেল ত্বোয়ার। মুখের ভাত গিলে পানির গ্লাসটা হাতে তুললো। কয়েক ঢুক পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। এত চেষ্টা করেও এড়িয়ে যাওয়া আর হলো না। আলিফ কড়া করে বলেছে, অনিকের কানে যেন সন্ধ্যার ঘটনাটা না যায়! এবার কীভাবে পালাবে সে। কী জবাব দিবে? মিথ্যে বলবে! চেপে রাখবেই না কতক্ষণ? এখন না হোক, সকালে তো সে জানবেই। যখন নাহিয়ান মা’কে খুঁজবে তখন তো জবাব দিতেই হবে! মুখ নিচু রেখেই এতসব কথা ভেবে যাচ্ছিলো ত্বোয়া। বোনের এমন লুকোচুরি ভাবটা চট করে নজরে পড়লো তার। চোখ নাড়িয়ে বলল,
-“কী ভাবছিস এত? একটা সাধারণ প্রশ্ন! এত গভীরভাবে ভেবে জবাব দিতে হবে? কী হয়েছে বল তো!”
-“বড়ো ভাইয়া, আন্টিকে ডেকে এনে ভাবীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে!”
খাবার মুখে মারাত্ম’ক বিষম খেল অনিক। ঝটপট পানি পান করে গলা পরিষ্কার করে বলল,
-“কী? কেন? কী দোষ তার?”
আর চুপ থাকতে পারলো না ত্বোয়া! সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই অনিকের সামনে তুলে ধরলো সে। যদিও সে তখন সামনে ছিল না। নাহিয়ানকে ঘুম পাড়িয়ে আড়ালে থেকেই সব কথা শুনেছে। এরপর আলিফ যখন তাকে চুপ থেকে রান্নার কাজ সামলাতে বললো, তখনই পুরো ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলো সে। এমন না যে, মাইসারা কিংবা ত্বোয়া দু’জনে আলিফের কানে এসব ঝগ’ড়ার খণ্ডচিত্র তুলে ধরতো। কয়েকদিন ধরে নিজেই গোপনে পর্যবেক্ষণ করছিল সে। এমনকি আজকের সিদ্ধান্ত, তার ভেবেচিন্তে নেয়া। সব শুনে অনিক খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো! বেসিনে হাত ধুয়ে মূল দরজা খুলে আবারও বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইলো। পিছন থেকে আলিফ বাজখাঁ’ই কণ্ঠে বলল,
-“এত রাতে বাইরে যাস না, ঘরে আয়। যে যাওয়ার সে গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন নেই।”
পা থামিয়ে দিল অনিক। কীভাবে বুঝলো, সে ফারজানাকেই ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছিলো। যেভাবেই বুঝুক, এভাবে তো সংসার ভা’ঙা যায় না। ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়! হয়তো জেনে-বুঝে মেয়েটা এসব করেনি। কারণ, ফারজানা কখনোই এমন ছিল না। সে বদলেছে, কেউ তাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে! এখানে তৃতীয় পক্ষের কানাঘুঁ’ষা নিশ্চয়ই আছে। ভা’ঙ’ন’টা আট’কাতেই হবে তাকে, নয়তো নাহিয়ানের জীবনটাও মাইসারার মতোই হয়ে যাবে। আরেকটা সুন্দর জীবন, আরেকটা সুন্দর স্বপ্ন ভে’ঙে যেতে বসেছে, যেভাবে হোক ভা’ঙ’নের আগেই জোড়া লাগাতে হবে।
*****
চলবে…
❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১২)
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)
অতীত এবং বর্তমানের সবচেয়ে বড়ো পার্থক্য হচ্ছে সময়ের সাথে সবকিছুর পরিবর্তন, আধুনিকতার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় যেকোনো কিছুর সহজলভ্যতা। এই আধুনিক যুগে দেশ যেমন উন্নত হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। আগেরকার দিনে যেসব রোগবালাইয়ের সাথে হরদম যু’দ্ধ করে প্রাণের মায়া নিমিষেই মানুষ ত্যা’গ করে মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়তো, এখনকার সময়ে সেইসব রোগকে দূরে ঠেলে দেয়া যাচ্ছে যথাযোগ্য ঔষধপত্র সেবন করে। কঠিন কঠিন রোগও বিলীন হয়ে যাচ্ছে, দামী ঔষধ এবং সচেতনতার ফলে। যুগের এই পরিবর্তনের অন্যরকম চিত্রটা হসপিটালে প্রবেশের পরই আয়ত্তে আনা যায় সহজে। এখানে যত আধুনিক টেকনলোজি ব্যবহার হয়, যত যন্ত্রপাতি ব্যবহার সবকিছুই কোনো না কোনো রোগের সাথে সংপৃক্ত। যে রোগই মানবদেহে বাসস্থান গড়ে নেয় তারই নিরামক হিসেবে কাজ করে নিত্যনতুন ঔষধ।
শিশু-ওয়ার্ডে ডিউটি থাকায় ঝটপট তৈরী হচ্ছে মাইসারা। পাশেই একটা বই নিয়ে তাতে চোখ বুলাচ্ছে রিপা। আপাতত তার ডিউটি নেই, তাই ফাঁকেই প্রয়োজনীয় চ্যাপ্টারটা পুনরায় অধ্যয়ন করছে। আচমকাই ফোনটায় ভাইব্রেশন হলো। পুরো টেবিলসহ রিপা নিজেও কেঁপে উঠলো সেই আওয়াজে। চোখের সামনে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম। সেটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে রিপা। বিড়বিড় করে ঠোঁট নেড়ে উচ্চারণ করলো,
-“মাই হ্যাপিনেস!”
মাইসারার তখনো সেদিকে দৃষ্টি নেই। সে গায়ে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে হাতের ঘড়িটা ঠিক করছে। তখনি তার হাতের দিকে নজর যায় রিপার। গতকাল থেকেই খেয়াল করছে, বাড়ি থেকে ফেরার পর মাইসারার মধ্যে কিছুটা পালটানোর আভাস টের পাচ্ছে সে। যদিও সেটা কিঞ্চিৎ সন্দেহ! কিন্তু ফোনের স্ক্রিনের নামটা তার সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিল। মাইসারা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তুই? আমায় আগে কখনো দেখিসনি?”
-“তোকে একটু অন্যরকম লাগছে সারা!”
-“মানে!”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মাইসারা। ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো রিপা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে গেল! বামহাতের চুড়ি দেখিয়ে বলল,
-“আগে তো চুড়ি পরতি না! এটা খুলতে ইচ্ছে করছে না এখন? খুলে ফেল। কেমন যেন বিবাহিত, বিবাহিত, নববধূর মতো লাগছে!”
হাতের ঘড়িটা ঠিক মতো আট’কে দিল মাইসারা। অ্যাপ্রোনের উপরেই উড়না একপাশে রেখে দিল। রিপার কথার জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলো। এই হাসির অর্থ রিপা ধরতে পারলো না। কথা এড়িয়ে সরে যেতে চাইলে পথ আগলে দাঁড়ালো রিপা। চোখের সামনে ফোনটা ধরে স্ক্রিনের নাম্বার দেখিয়ে বলল,
-“তোর হ্যাপিনেসটা আবার কে বলতো! এত সকাল সকাল কী খুশির সংবাদ দিতে ফোন করছে সে!”
মাইসারার মুখটা হা হয়ে গেল। এইজন্যই মেয়েটা তার পিছনে এমন খবরদারি করছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা আনতে গিয়েই পড়লো বিপদে। রিপা সারা রুম ছুটে বেড়াচ্ছে ফোন নিয়ে। কাছে ভিড়ছে না, আবার দৌড়ও থামাচ্ছে না। একটা সময় হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। অনুরোধের সুরে বলল,
-“দে না প্লিজ। অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তার। রিসিভ না করলে খুব কষ্ট পাবে! এমন করিস না, দোস্ত!”
মাইসারার এমন করুণ সুরেও তার চেহারায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ দুঃখবোধের জন্ম হলো না। সে ঠিক একইভাবে জবাব দিল,
-“আহারে! কী প্রেম! একবার কথা না হলে, খুব কষ্ট পাবে! এই ক’দিনে সে এতটাই দামী হয়ে গেল তোর কাছে। বাহ্, ক্যায়া বাত। দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। কে সেই ভাগ্যবান পুরুষ, দেখেই ছাড়বো আজ। মাত্র এক সপ্তাহে সে আমার বান্ধবীকে আমার থেকে কে’ড়ে নিয়েছে।”
রিপা দেরী না করে ঝটপট ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিল। ওপাশে অনিক প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-“সারা কোথায়? অনেকক্ষণ ধরে কল করছি অথচ রিসিভ করছে না।”
এপাশে রিপাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তার মুখে কোনো কথা নেই। যেমন হা হয়ে ছিল, সেই হা হওয়া মুখে মাইসারার দিকে তাকালো সে। মাইসারা পারলে অট্টহাসি দেয়। কিন্তু রিপার এমন ফেস দেখে চুপ থেকে তাদের কথোপকথন হজম করার জন্যই দাঁড়িয়ে রইলো। রিপা পানসে মুখে জবাব দিল,
-“ভাইয়া আপনি! আমি তো ভাবলাম কে না কে, হুট করে সারার হ্যাপিনেসের কারণ হয়ে গেল। ও তো রুমে নেই, আপনি বরং এক ঘণ্টা পর ফোন করুন! আসলে বলবো, আপনি কল করে তার খোঁজ করেছেন। রাখি…?”
ওপাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ আসলো না। রিপা এবার মোবাইল নিয়ে মাইসারার সামনে গেল। হাত টে’নে এনে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“বুঝলাম না কিছুই! ভাইয়ার না বিয়ে ঠিক হয়েছিল? তাছাড়া অনিক ভাইয়ার নাম্বার তোর ফোনে ছোটো ভাইয়া দিয়ে সেইভ করা ছিল। হুট করে সেটা ‘মাই হ্যাপিনেস’ হয়ে গেল কী করে?”
মাইসারা ফের হাসলো। ফোনের গ্যালারি ওপেন করে তাদের বিয়ের ছবিটা বের করে রিপার মুখের সামনে ধরে বলল,
-“দেখ! কার সাথে হয়েছে।”
বর-কনের একত্রিত কয়েকটা কাপল ছবি দেখলো রিপা! কনের জায়গায় বরাবরই মাইসারাকে দেখা গেল। চোখ গোল গোল করে বলল,
-“ওরে শাঁ’কচু’ন্নি বিয়ে করে ফেললি! তা-ও নিজের কাজিনকেই। আর পাত্র ছিল না? তাছাড়া তোর সাথেই কেন?”
-“পরে বিস্তারিত বলি, এখন ডিউটি আছে।”
রিপা ঘাড় নাড়লো। রুম ছেড়ে বের হওয়ার পথে কন্টাক্ট লিস্টের প্রথম নাম্বারে ডায়াল করলো মাইসারা। ফোন কানে ঠেকিয়ে দ্রুত এগোতে লাগলো নির্ধারিত কাজের জায়গায়।
*****
নাশতার টেবিলে ভীষণ অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছে ফারজানাকে। ভদ্রমহিলা মেয়ের এমন অহেতুক মন খারাপের কারণে খানিকটা রেগেই গেলেন। নাশতা সামনে অথচ সে খাচ্ছে না, কারও সাথে কথাও বলছে না। কেমন নীরবতার ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছে একদম। তিনি মেয়েকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে পছন্দ করেন, এমন বিষণ্ণতায় ভরা চেহারা কিংবা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মলিন চাহনি বড্ড বিরক্তিকর ঠেকলো তাঁর কাছে। খানিকটা ধম’কের সুরে বললেন,
-“খালি পেটে এমন ঢং করিস না তো। কিছু খেয়ে সারাদিন কাঁদলেও কেউ তোকে কিচ্ছু বলবে না। এই মুহূর্তে এসব ন্যাকামি বন্ধ কর। সেই আসছে পর থেকে কানের কাছে একই ঘ্যা’নঘ্যা’ন!”
মায়ের এমন কথায় ভীষণ চমকালো ফারজানা। এতদিন এই মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বেরিয়েছে। এখন তিক্ত কথা বের হচ্ছে। কষ্ট পেলেও নিজেকে মানিয়ে নিল সে। এই মায়ের কথাতেই নিজের সুখের সংসারে অশান্তির আগু’ন জ্বালিয়েছে এসেছে। যখন বুঝা উচিত ছিল, তখন এই বোধশক্তি ছিল না। মায়ের কথাই মূখ্য ছিল তার কাছে। মায়ের চিন্তাভাবনা আর যুক্তিই সঠিক ভেবেছিল সে। ভাবেনি, মায়ের এতসব যুক্তির প্যাঁ’চে পড়ে সব খো’য়াবে! আজ যখন নিঃস্ব হয়েছে তখন ঠিকই উপলব্ধি হচ্ছে। মন খারাপের রেশটা অল্প সরানোর চেষ্টা করলো সে। ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“যত পারো বকো, আমি কিছু বলবো না। পারলে আমার ছেলেটাকে এনে দাও।”
ভদ্রমহিলা ঠোঁট বাঁ’কিয়ে চলে গেলেন। ফারহান যতটা ধৈর্য্য নিয়ে নাশতা করতে বসেছিল, বোনের এই কথা শুনে তার ধৈর্যের বাঁ’ধটাও ভে’ঙে গেল। চোখেমুখে রাগের রেখা টে’নে বলল,
-“বার বার যখন বুঝাতাম তখন তো কথা কানে তুলিসনি! এখন বুঝ, মা আর সন্তানের টানটা কেমন! তেমনি রক্তের টানও এমন। তুই তার বোনের ক্ষ’তি করতে চেয়েছিলি, সে তোর ক্ষ’তি করে বুঝিয়ে দিল, পরের অনি’ষ্ট করতে গেলে নিজেরই অনি’ষ্ট হয়! মায়ের কথায় আরও লাফদে, যখন কোনো কূল-কিনারা পাবি না তখন টের পাবি। পস্তানো ছাড়া আর কোনোকিছুই করার থাকবে না।”
হাত ধুয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ফারহান। ঝটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল ভার্সিটিতে। এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি তার। মাস্টার্সের শেষ পর্যায়ে আছে। পাশাপাশি পার্ট-টাইম জবও করে সে। যা দিয়ে সংসার খরচ দিব্যি পুষিয়ে নেয়। ফারহান যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ ভাইয়ের কথাগুলো ভাবলো ফারজানা। হাতের মোবাইল নিয়ে ত্বোয়াকে ফোন করলো। এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তারাও নাশতা করছে। যদি রিসিভ করে তবে নাহিয়ানের সাথে অল্পক্ষণ হলেও কথা বলে নিবে। এতে যদি মনটা একটু শান্ত হয়।
বার বার ঘড়ি দেখছে ত্বোয়া। ফাঁকে ফাঁকে নাহিয়ানকে নাশতা খাওয়াচ্ছে। একেবারেই তৈরী হয়ে গেছে দু’জনে। ভাইপোকে স্কুলে পাঠিয়ে সে-ও ভার্সিটি চলে যাবে। হুট করেই ফোন আসাতে তাতে দৃষ্টি দিল সে। ফারজানার নাম্বার দেখে দুই ভাইয়ের দিকে তাকালো। আলিফ সেটা খেয়াল না করলেও অনিক ইশারায় বলল রিসিভ করতে। ত্বোয়া চুপিসারে সেটা রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো। ফারজানা ওপাশে ততক্ষণে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। শুধু একবার নাহিয়ানের জন্য কথা বলতে চায়, এমন সব আহাজারিতে অস্থির করে তুলেছে তাকে। ত্বোয়া কিছু বলার আগেই হাত থেকে ফোন কে’ড়ে নিল আলিফ। টানটান গলায় বলল,
-“এ বাড়িতে আপনার কেউ থাকে না, তাই অনুরোধ আগামীতে এখানকার কাউকে আর ফোন করবেন না। সব সম্পর্ক আপনি নিজে ভে’ঙে যেতে দিয়েছেন। দয়া করে আর কারও মাথা খাবেন না।”
মুখের উপর এতসব কথা বলে ফোন কে’টে দিল আলিফ। ঝটপট ফারজানার নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে ফোনটা ত্বোয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“ফের যেন এই লুকোচুরি না দেখি! সামলে রাখতে না পারলে বল; রাখবি না। আমার ছেলেকে আমিই সামলে নিতে পারবো। এরজন্য কারও সাহায্যের প্রয়োজন হবে না আমার।”
সকাল থেকে বেশ কয়েকবারই নাহিয়ান তার মা’কে খুঁজেছে। ত্বোয়া প্রতিবার এড়িয়ে গেছে, নয়তো কথার ছলে ভুলিয়ে দিয়েছে। তার জানা নেই, এভাবে একটা বাচ্চাকে মা ছাড়া কীভাবে আগলে রাখবে! খাওয়ানো, পড়ানো নিয়ে তো অসুবিধা নেই, অসুবিধা তো তখনই হয়, যখন অবুঝ মন মায়ের সঙ্গ পেতে ছটফ’ট করে। ত্বোয়া বুঝে উঠতে পারে না, তার কী করা উচিত। এই মুহূর্তে এসব ঘটনা মাইসারাকে জানানোও উচিত না। শুনলেই সবকিছু ছেড়ে ছুটে আসবে মেয়েটা। অথচ এই অসহায় মুহূর্তে ওর সহযোগিতার বড্ড প্রয়োজন অনুভব করলো ত্বোয়া।
*****
অনিকের মনে হলো এই মুহূর্তে তার ভাই একটু বাড়াবাড়ি করছে। হ্যাঁ অন্যায় করলে শা’স্তি অবশ্যই দেয়া উচিত। যে অন্যায় করেছে শা’স্তি কেবল তার জন্যই বরাদ্দ করা উচিত। শুধু শুধু মাছুম বাচ্চাটা কেন তার ফল ভোগ করবে। সকালে তাড়াহুড়ো ছিল দেখে কিছু বলার সুযোগ পায়নি। কিন্তু অফিস থেকে ফিরে যে দৃশ্য দেখলো তাতে সে বিচলিত হয়ে গেল। একরত্তি বাচ্চাটা মায়ের অভাবে কেমন নেতিয়ে গেছে। কয়েকটা ঘণ্টার ব্যবধানে গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তার। গায়ের চাদর জড়িয়ে রাখার পরও তার কাঁপুনি থামছে না। ত্বোয়া একা একা কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। চিন্তায় আরমান সাহেবও দু’টানার মধ্যে পড়ে গেলেন। ছেলেকে বকতেও পারছেন না, বুঝাতেও পারছেন না। সব ঠিক হলেও এই একটা জায়গায় সবাই ভুল করছে। একজনকে শা’স্তি দিতে গিয়ে দু’জনকেই শা’স্তি দিচ্ছে। অনিক টের পেল, আর যদি সে চুপ করে তাকে এই বাচ্চাটা অকা’লেই ঝরে যাবে। ভাইয়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
-“সামলেছো? মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দেখেছো কী অবস্থা? এভাবে যদি দু’দিন রাখো, বাঁচাতে পারবে? ভাইয়া, একটা সন্তানকে তার মা যতটুকু সুরক্ষা দেয়, ততটুকু সুরক্ষা তাকে আর কেউ দিতে পারে না। সে যেই হোক। বাবা, চাচা, খালা, এদের কারও সংস্পর্শই তাকে মায়ের অভাব ভুলিয়ে দিবে না। এই শক’টা ও সামলাতে পারছে না। এটা ওর ব্রেইনে কতখানি প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারছো না তুমি?”
-“কেন? যে সন্তানের মা, সন্তান জন্ম দিয়েই মা’রা যায়; তার বাচ্চা বাঁচে না? সে যদি বাঁচতে পারে, তবে আমার বাচ্চাও বাঁচতে পারবে।”
-“ভাইয়া দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। তোমাদের এই মান-অভিমান, ন্যায়-অন্যায়ের প্রভাব পড়ছে ওর উপর! যা ধীরে ধীরে ওকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলবে। প্লিজ, এমনটা করো না৷ হয় ভাবীকে বাড়িতে আনো, নয় কয়েকটা দিনের জন্য বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছে রেখে এসো!”
-“অসম্ভব! আমার বাচ্চা আমি কারও কাছে রাখবো না। বাঁচুক, কী ম’রুক! ও এখানেই থাকবে।”
অনিক দু’হাতে চোখমুখ মুছলো। ভাইয়ের অনুমতিরও প্রয়োজন মনে করলো না আর। ওয়ারড্রব থেকে নাহিয়ানের প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় একটা ব্যাগে ভরে তাকে ত্বোয়ার কোলে দিল। ব্যাগটা দ্রুত হাতে বাইকের পিছনে আট’কে দিল। আলিফ আটকাতে চেয়েও পারেনি। ভাইকে জোরপূর্বক সরিয়ে নাহিয়ান আর ত্বোয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। যাওয়ার বেলা শুধু বলে গেল,
-“আলাদা থাকবে কি একসাথে থাকবে এটা তোমাদের দু’জনের ব্যাপার! ভুল করেও যেন তার প্রভাব এসে এই বাচ্চাটার উপর না পড়ে! আমাকে বিগ’ড়ে যেতে বাধ্য করো না, ফল কিন্তু মোটেও ভালো হবে না।”
রাগে নিজের চুল খাম’চে ধরলো আলিফ। অনিক আর দেরী করলো না। প্রথমে সেই ডাক্তারের চেম্বারে আসলো, যেখানে ছোটোবেলা থেকেই নাহিয়ানের চিকিৎসা হয়! এরপর প্রয়োজনীয় ঔষধ আর পরামর্শ নিয়ে রওনা দিল ফারজানার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ফোনের মাধ্যমে সেটা শুধু ফারহানকেই জানালো। অন্তত নাহিয়ানের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রকার ঝা’মে’লা টে’নে আনবে না সে। যত সমস্যা আছে, সবকিছুর সমাধান হবে, আগে বাচ্চাটা সুস্থ হোক। আগের মতো হাসুক, দৌড়াক, নিশ্চিন্তমনে ঘুরে বেড়াক বাড়ির আনাচে-কানাচে। এইটুকু বয়সে যেন গুটিয়ে যাওয়া স্বভাব না আসে তার মধ্যে, সেদিকেই তীক্ষ্ণ নজর অনিকের। শৈশবের এতসব জটিল, কঠিন প্রভাবই বাচ্চার মস্তিষ্কে মারাত্ম’ক প্রভাব ফেলবে। এতে বাচ্চার ভবিষ্যৎটাও নষ্ট হয়ে যাবে! যার যার সমস্যা, তার তার নিজস্ব। তার জন্য কেন ওইটুকু বাচ্চার সুন্দর জীবন গঠনের পথ এখনই থেমে যাবে! কোনোভাবেই তা হতে দেয়া যাবে না। এমনসব চিন্তাভাবনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনিক।
*****
চলবে…