#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১০
নিশীথিনীর তমসাচ্ছন্ন চাদরে আবৃত বসূধা। প্রিমিয়াম ভিলার বাহিরে তখন মৃদু শীতল পবনের আধিপত্য। ভেতরে উষ্ণতা এবং শীতলতার চিত্তাকর্ষক মেলবন্ধন! রাহিদের সঙ্গে ফোনালাপে লিপ্ত ইরহাম। ডান কানে ঠেকে ক্ষুদ্র যন্ত্রটি। কথা বলতে বলতে অগ্রসর হচ্ছে নির্ধারিত বেডরুমের পানে। ভাইকে শুভকামনা জানিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
” উইশ ইয়্যু অল দ্য বেস্ট। ইনশাআল্লাহ্ সফলকাম হবি।”
ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টায় দিবারাত্রি ব্যস্ত রাহিদ। আল্লাহ্ চাইলে শীঘ্রই পাঁচটা না দশটা না একমাত্র ছোট বউটা’কে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। সে কথাই ফোনের মাধ্যমে জানাচ্ছিল ভাইকে। বিপরীতে শুভকামনা জানালো ইরহাম। সে পুরোদস্তুর আশাবাদী যে সফল হবে রাহিদ। একমাত্র আদরের-স্নেহের ছোট বোনের জন্য সে ভুল কাউকে নির্বাচন করেনি। দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়, রাহি ও ইনু একে অপরের জন্যি। আরো টুকটাক কিছু কথাবার্তা এবং উপদেশ প্রদান শেষে মানুষটি পৌঁছে গেল ঘরে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে হাতের মুঠোয় বন্দী করলো মোবাইল। তাকালো এদিক ওদিক। হৃদয়ের রাণী লুকিয়ে কোথায়? বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ঘরের আধখোলা জানালা বরাবর। সেথায় দাঁড়িয়ে তার হৃদরাণী। শীতাংশু’র জ্যোতি তার মনোরম আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিয়েছে মেয়েটিকে! কপালের দু পাশে থাকা খুচরো চুলগুলো খেলা করে বেড়াচ্ছে দু গালের কোমল ত্বকে। মোবাইলে কথা বলছে সে। বন্ধুদের সঙ্গে বোধহয়।
” হাঁ রে ভাই। অনেকগুলো ছবি তুলেছি। জাস্ট ফাটাফাটি উঠেছে। কালকে ঘুরতে গিয়ে আরো তুলবো। ইয়্যু নো না আমি কত ভালো ফটোগ্রাফার? এমন সুন্দর করে তুলবো না.. গাজীপুরের সিনারি (scenery) দেখে সুইস ফিল পাবি। ”
নাদিরা হেসে উঠলো ফোনের ওপাশে। ইচ্ছাকৃতভাবে দুষ্টুমি করে অবুঝের মতো শুধালো,
” সুইস? কোন সুইচ গো? লাইট ফ্যান অন করার? ”
প্রশংসার বদলে উপহাস! মেজাজ বিগড়ে গেল মেয়েটির। হৃদি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” তোর মতো গাঁ”ধীরে ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন দিছিল কে? হুঁ? এত বড় ছা”গলী। আজও জানিস না সুইজারল্যান্ডকে সংক্ষেপে সুইস বলে? ”
নাদিরা এবার মুখ টিপে হাসলো। বুঝদারের মতো ন্যাকা স্বরে বলে উঠলো,
” ওপস্! ভুল গায়ি থি। ”
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় হাত নাড়ালো হৃদি। অনমনীয় স্বরে বললো,
” জানা আছে। ইচ্ছা করে মক (mock) করছিস তাই তো? তুই শুধু দেখিস। এমন ছবি তুলবো না কনফিউজড হয়ে যাবি ইগ্লা সুইস নাকি গাজী? ”
সশব্দে হেসে উঠলো নাদিরা। সে হাসিতে সংক্রমিত হয়ে হৃদি নিজেও হেসে উঠলো। আস্তে ধীরে হাস্যরসময় আভা মুছে গেল মুখ হতে। নাদিরা হঠাৎই দুষ্টুমি করে বান্ধবীকে বলে উঠলো,
” হ্যাঁ রে হৃদু সোনা! বিয়ের এতদিন বাদে মধুচন্দ্রিমা গেলি। মধুর ঠিকঠাক স্বাদ পাচ্ছিস তো? নাকি রষকষহীন অবস্থা? হুঁ? আমার অবশ্য জিজুর ওপর শতভাগ বিশ্বাস আছে। এই সফর উনি কিছুতেই করলা’র মতো তেঁতো কাটাবেন না। কি তাই তো? ”
দুষ্টুমির মাত্রা এখন ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে। উপলব্ধি হতেই তপ্ত হলো কর্ণদ্বয়। স্বয়ংক্রিয় ভাবে মেয়েটির দু কপোল লালচে হলো। মেকি বিরক্তি প্রকাশ করলো হৃদি,
” উফ্ তুইও না? বড় বেশরম তো! সিঙ্গেল মানুষের এত জেনে কি লাভ? হা? আগে নিজে বিয়েশাদী কর। তারপর বলবো নে। ”
নাদিরা নাকমুখ কুঁচকে বলল,
” এতটুকু জানার জন্য বিয়ে করতে হবে? বয়েই গেছে। বিয়ে ছাড়াই বহুত জানি। আর লাগতো না। ”
শব্দ করে হেসে উঠলো হৃদি। হাসতে হাসতে বাঁ হাতে জানালার পাল্লা বন্ধ করে ফেলল। সরে গেল সেথা হতে। বেডের পানে অগ্রসর হবার তালে বান্ধবীকে দুষ্টুমিপূর্ণ স্বরে বলল,
” বিয়েশাদী লাগবে ক্যা? তুমি তো লিভ ইন করবা? তাই না চাঁদু? ”
ফোনের ওপাশে আঁতকে উঠলো নাদিরা,
” আসতাগফিরুল্লাহ্! নাউজুবিল্লাহ্! ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই মাইয়া তুই কিন্তু এবার আমার নিষ্পাপ চরিত্র নিয়া টানাটানি করতাছোছ! ”
বিছানায় বসে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো হৃদি। বাঁ হাতের তেলোয় লুকিয়ে গেল ওষ্ঠাধর। ওর হাসিতে তেঁতে উঠলো নাদিরা,
” অস”ভ্য মাইয়া। জামাই এত বেশি ভালুপাশা দিছে যে তুই পা-গল হইয়া গেছোছ। ফোন রাখ কইতাছি। ”
কটমট করে ক’টা গালমন্দ উপহার দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো নাদিরা। ওর হাস্যরসাত্মক কাণ্ডে এখনো হেসে চলেছে মেয়েটি। মোবাইল রাখলো পাশে। হঠাৎ হাসি মুছে স্বল্প স্বাভাবিক হলো বদন। ওয়াশরুম হতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে ইরহাম। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল হৃদি। ভাগ্যিস উনি কিছু শোনেননি। নাহলে কি ভাবতেন? বউ তার এত লুচি? ছিঃ! তবে মেয়েটির সে আশায় গুড়ে বালি। ভেজা মুখ তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে গম্ভীর স্বরে শুধালো একান্ত জন,
” বন্ধুকে আফটার ম্যারেজ টিপস্ দেয়া হচ্ছিল? ”
থমকে গেল হৃদি! বড় হলো চক্ষু। উনি না ওয়াশরুম ছিলেন! এসব শুনলেন কখন? এনার হাত-পা, মস্তিষ্ক, কান সব তো আবার একটু বেশিই সক্রিয়। চলে বেশি। ভুলেই গিয়েছিল। হুহ্!
” হাঁ। তাই করছিলাম। আফটার অল সিঙ্গেল বান্ধবী আমার। ঠিকঠাক টিপস্ না দিলে জানবে বুঝবে কি করে? ”
একটু ভাব নিয়ে বললো মেয়েটা। বিবাহিতা হিসেবে তার আলাদাই এক ভাব রয়েছে। বাকিদের মতো সে সিঙ্গেল নয়। এমপি জামাই আছে তার। অকস্মাৎ মেকি ভাব পলায়ন করে ঘটলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক কাণ্ড! ডান কাঁধ বরাবর এক শক্তপোক্ত হাতের লহু ধাক্কা। কোমল দেহটি হিল্লোলের(ঢেউয়ের) ন্যায় আছড়ে পড়লো বিছানার তুলতুলে আবরণে। বিহ্বল মেয়েটি এখন বিছানায় পড়ে। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পূর্বেই আরেক চমক! পুরুষালি হাতে আবদ্ধ হলো ঘাড়। তার অতি সন্নিকটে ঝুঁকে এসেছে স্বামী নামক মানুষটি। মেয়েটির মাথা উঠে গিয়েছে বিছানা হতে কিঞ্চিৎ উঁচুতে। ভারসাম্য বজায় রাখতে দু হাতে আঁকড়ে ধরে শুভ্র রঙা বেডশিট। দু’জনার মধ্যকার দূরত্ব অতীব ক্ষীণ। ছুঁই ছুঁই তাদের নাক। শিহরণ জাগানো উষ্ণ হাওয়া আছড়ে পড়ছে চোখেমুখে। মুদিত হয়ে আসছে নেত্র জোড়া। লহমায় মোহগ্ৰস্থ মানুষটি ঘুচিয়ে ফেললো মধ্যকার দূরত্ব। ক্ষণিকের জন্য প্রগাঢ় এক অধর সন্ধি। স্তব্ধ হৃদি! আবেশে সিক্ত হবার পূর্বেই সন্ধি বিচ্ছেদ হলো। এলোমেলো শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। চক্ষু বুঁজে অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির দলকে সামাল দিতে ব্যস্ত মেয়েটি। বিমোহিত মেয়েটির অধর কোণে ক্ষুদ্র ছোঁয়া অঙ্কন করে আরো নৈকট্যে এলো ইরহাম। ফিসফিসিয়ে বললো,
” চমক থাকছে কাল। এরপর নাহয় অজানাকে জেনো। বুঝিয়ো। গেট রেডি মাই গার্ল! ”
নজরকাড়া হাসি উপহার দিয়ে সঙ্গিনীর ডান পাশে ধপ করে শুয়ে পড়লো মানুষটি। তখনও বিস্ময়ে অভিভূত হৃদি! চমক! কেমনতর চমক থাকছে কাল? এমন রহস্য করে বললেন কেন! কোন অজানাকে জানতে চলেছে সে? কি হবে আগামীকাল? গভীর ভাবনায় মশগুল হয়ে গেল মেয়েটি। ওর হাবভাব লক্ষ্য করে নিম্ন অধর কা’মড়ে নিঃশব্দে হাসলো ইরহাম। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো উপরিভাগে রঙিন সিলিংয়ে। নিঃসন্দেহে আগামীকাল এক বড়সড় চমক আসছে! কাটাবে দু’জনে এক স্মরণীয়-মধুরতম রজনী!
.
দুই বন্ধুর সঙ্গে একটি ফ্লাটে বিগত চার বছর ধরে থাকছে রাহিদ। তিন বন্ধু ভাগাভাগি করে ভাড়া পরিশোধ করে থাকতো। ফ্লাটের গুণমান মোটামুটি ভালো। এখন বিচ্ছেদের ঘন্টা বেজেছে। বছর চারেকের পুরনো ঘরকে করতে হবে ত্যাগ। এখন আর একাকী নয় সে। বিবাহিতা স্ত্রী রয়েছে। বন্ধু ও স্ত্রী দুই মিলিয়ে তো একত্রে বাস করা যায় না। একজনকে ত্যাগ করা আবশ্যক। তাই তো চার বছরের অংশীদারি ত্যাগ করে বেশ কিছুদিন ধরে নতুন বাসার খোঁজ করছিল রাহিদ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে সাধ্য অনুযায়ী একটি ফ্লাটের খোঁজ মিলেছে। ছোট্ট ফ্লাট। নব দম্পতিদের জন্য একদম মানানসই। দু’টো বেডরুম, ডাইনিং-ড্রয়িংরুম একত্রে। রয়েছে একটি অ্যাটাচড্ ওয়াশরুম এবং কিচেন। একটি মাঝারি আকৃতির বেলকনি সংযুক্ত মূল বেডরুমের সঙ্গে। আজকে ফ্লাটটি কনফার্ম করে এসেছে রাহিদ। বেশকিছু ফটোও তুলেছে ফ্লাটের। বউকে দেখাতে হবে না?
এ মুহূর্তে রাহিদ বসে পুরনো সে-ই ফ্লাটে। ঘরের দুই পাশে দু’টো সিঙ্গেল খাট। রয়েছে একটি পোশাক রাখার লম্বা স্টিলের আলনা। সে আলনায় যত্রতত্র জড়িয়ে এলোমেলো শার্ট, গেঞ্জির স্তূপ। রয়েছে একটি স্টিলের আলমারি। উন্মুক্ত আলমারির এক পাল্লা। কি হোল এ অবহেলায় ঝুঁলে চাবি। দেয়াল সংলগ্ন ছোটোখাটো ওয়্যারড্রব। হা হয়ে খোলা দু’টো ড্রয়ার। সেথা হতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে জিন্স প্যান্ট এমনকি শার্টের হাতা। আরো একটি ঘর রয়েছে এই ফ্লাটে। সেটি মূলত তাদের স্টাডি রুম। এক কোণে একটি ফ্লোর বেড পাতা। সেথায় ঘুমায় তাদের আরেক সঙ্গী। বন্ধু। ওই ঘরটি বলতে গেলে নিরিবিলি। স্টাডি ম্যাটারিয়াল ব্যতীত তেমন কিছু নেই। তা-ও অবিন্যস্ত রূপে। টেবিলের ওপর বইয়ের ছন্নছাড়া দশা। নারীছোঁয়া বিহীন ঘর তো এমন বিরানভূমিতে পরিণত হবেই! পুরো ফ্লাটটি এমনই। কেউ প্রবেশ করলেই বুঝতে পারবে এটি ব্যাচেলরদের ঘর। ঘরের এলোমেলো, অবিন্যস্ত, অগোছালো রূপ তারই প্রমাণস্বরূপ।
নিজের সিঙ্গেল খাটে হেলান দিয়ে বসে রাহিদ। হাতে মোবাইল। নয়া বাসস্থানের ফটোগুলো তার বিবাহিতা স্ত্রী ইনায়াকে হোয়াটস্অ্যাপে পাঠিয়ে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো উপরে থাকা মেসেজগুলো দেখে। সে একাই বিগত দিনগুলোতে কত মেসেজ পাঠিয়েছে। কোনোটির রিপ্লাই মেলেনি। এত অভিমান! আর মাত্র দিন কয়েকের অপেক্ষা। আদরে-সোহাগে ভুলিয়ে দেবে সঙ্গিনীর অভিমানের প্রতি বর্ণমালা। সে ভেবেই উজ্জ্বল হলো চেহারা। পাশের সিঙ্গেল খাটে শুয়ে বন্ধু লক্ষ্য করলো এ উজ্জ্বলতা। তাই তো রসিকতার স্বরে শুধালো,
” কি মিয়া? জেগে জেগে বউয়ের স্বপ্ন দেখতাছো নাকি?”
ভাবনায় ছেদ পড়লো। রাহিদ তাকালো বন্ধুর পানে। হাসিমুখে বললো,
” আর মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর আর স্বপ্ন নয়। দিবারাত্রি চোখের সামনে থাকবে। ”
” খেলা হবে খেলা। তা বললা না মিয়া? ”
রাহিদ মেকি রাগ প্রকাশ করে বন্ধুর দিকে বালিশ ছুঁড়ে দিলো। সশব্দে হেসে উঠলো বন্ধু। রাহিদ নিজেও হাসছে। আশায় বাঁধছে বুক। কবে এ বুকে মাথা রেখে শান্ত করবে সে অশান্ত মন!
•
দিনমণির মিষ্টি কিরণ ক্রীড়ারত ধরনীর বুকে। হালকা পবনের ছোঁয়ায় নৃত্যে মশগুল বৃক্ষপত্র। বিছানা সংলগ্ন দাঁড়িয়ে দুষ্টুমির সম্রাজ্ঞী হৃদি। দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছে বিছানায় রাখা চারটি শাড়ির ওপর। ঘুরতে এসে সব ই বলতে গেলে শাড়ি এনেছে এবার। সাহেবের আদেশ। শাড়ি বিহীন অন্য কিছু চলবে না এখানে। কিইবা করার? স্বামীর আদেশ বলে কথা। দু’টো সালোয়ার স্যুট এবং চারটি শাড়ি এনেছে। যেটা ইচ্ছে পড়বে। আজ এ মুহূর্তে সে দ্বিধায় ভুগছে। ভুগবে না? সে তো এমনি এমনি শাড়ি পড়ছে না। স্বামী মশাইকে জোরসে ঝটকা দিতে শাড়ি পড়বে। মশাই এখানে আসার পরিকল্পনা থেকে আরম্ভ করে আসার পর শুধু ঝটকা ই দিয়ে যাচ্ছে। কাল রাতে অবধি দিলো। কি নাকি চমক রয়েছে। সে যাই হোক। কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই আজকের নারী। হৃদিও দেখিয়ে দেবে ঝটকা কারে কয়। পছন্দ মতো একটি শাড়ি হাতে নিলো মেয়েটা। ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি এটি। বেশ পাতলা আবরণ। হাতের তেলোয় শাড়িটি নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল হৃদি। এটা পড়লে কি সব দৃশ্যমান হবে? হুঁ? ভাবুক মেয়েটা শাড়ি নিয়ে ভাবতে ভাবতে দাঁড়ালো আরশির সম্মুখে। বুকের ওপর শাড়ি মেলে ধরলো। উঁহু ঠিকঠাক ই তো লাগছে। অতটাও পাতলা নয়। বোকাটা বুঝলোই না পোশাকের ওপর শাড়ি মেলে এর আবরণ পরীক্ষা করা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়। যাই হোক। র-ক্তলাল এই ট্রান্সপারেন্ট শাড়িটি বাছাই করলো হৃদি। আজ এই ট্রান্সপারেন্টে ই ফেঁ-সে যাবে এমপি মশাই। দেখবে, জ্ব’লবে কিন্তু হাতের নাগালে মিলবে না।
হৃদি ভোলেনি গতবারের কথা। এমনই এক শাড়িতে নিজেকে উপস্থাপন করেছিল সে। তাতেই মোহাচ্ছন্ন হয়েছিল ইরহাম। অতিক্রম করেছিল সংযমের সীমারেখা। প্রথমবারের মতন গভীর উ-ন্মাদনায় মেতে উঠেছিল তারা। ভুলে গিয়েছিল জাগতিক সকল হুঁশ। মেতেছিল একে অপরেতে। আকস্মিক বাঁধা। রাতের আঁধারে ফোন কল এলো। বাড়ি ফেরার পথে বাইক দু”র্ঘটনার শিকার হয়েছে সাহিল। অমায়িক ও পথপ্রদর্শক ‘ ভাই ‘ হিসেবে রাতের আঁধারে ছুটে গিয়েছিল ইরহাম। সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। মানুষটি বাড়ি ফিরলো প্রায় শেষ রাতের দিকে। সে রাতের উ-ন্মাদনা অপ্রত্যাশিত ভাবে সাহিলের জন্য ভণ্ডুল হয়েছিল। অতঃপর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় এমনতর অত্যন্ত মধুর রজনী আর মেলেনি। এখন তো সকাল। ফিরবে কি সে-ই মধুর লগন! ইশ্! কিসব ভাবছে সে! কোনো মা-দকতার সৃষ্টি নয় বরং এমপি সাহেবকে একটু শায়েস্তা করতে ইচ্ছুক সে। তাই তো এমনতর আয়োজন। মিটিমিটি হেসে শাড়ি ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে হৃদি অগ্রসর হলো ওয়াশরুমে।
_
সমতল আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে সদ্য স্নাতা হৃদি। ভেজা চুল গড়িয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ভিজে যাচ্ছে ব্লাউজের পেছনাংশ। সেথায় ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটির। সে তো ব্যস্ত শাড়ি সামাল দিতে। শাড়ির আঁচল লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। আরেক অংশ হাতের মুঠোয়। পাতলা শাড়িটি সামাল দিতে কেমন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তালবেতাল হয়ে যাচ্ছে কেন? বিরক্তিকর ধ্বনি মুখনিঃসৃত হলো। ভ্রু কুঁচকে শাড়ি গুঁজে নিতে মগ্ন মেয়েটি। তেমনই এক ব্যস্ত মুহূর্তে ঘরের ভিড়িয়ে রাখা দ্বার উন্মোচন করে ভেতরে প্রবেশ করলো ইরহাম। এ ভিলায় দু’টো রুম পাশাপাশি। ওদের বুকিং করা। তাই ভিড়িয়ে রাখা ছিল দ্বার। ভাবেনি স্বামী মহাশয় এমন বিব্রতকর মুহূর্তে ফিরে আসবে।
নিম্ন অধর কা’মড়ে শাড়িটি উদর বরাবর গুঁজে নিলো হৃদি। সমতল-স্বচ্ছ আরশিতে দৃশ্যমান তার শাড়ি বিহীন ঊর্ধ্বাঙ্গ। ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন অভাবনীয়-অপ্রত্যাশিত দৃশ্য অবলোকন করে স্তব্ধ ইরহাম! ধড়াস ধড়াস করছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। বেগতিক শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। স্বেদজল গড়িয়ে পড়ছে কপালের দু’পাশ বেয়ে। এ কেমন হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি! পদযুগল ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে বুঝি! বারকয়েক পলক ঝাপটালো ইরহাম। নাহ্! কল্প নয়। বাস্তব এ। হৃদরাণীর আবেদনময়ী রূপে তখন অ-গ্নিকাণ্ড হৃদয়ে! ঝ ল সে যাচ্ছে নেত্র যুগল। দাঁড়িয়ে থাকা হয়ে উঠলো দুষ্কর। চুম্বকের ন্যায় আকর্ষিত হয়ে চলেছে তনুমন। মোহমায়া জাপ্টে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। টি-শার্ট ও ট্রাউজার পড়নে মানুষটির। আজ এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করতে পারলো সঙ্গিনীর সিক্ত রূপ তার নিকট আ”সক্তির ন্যায়! এমনতর রূপ অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। শ্লথ পায়ে ব-শীভূত হয়ে ইরহাম এগোতে লাগলো হৃদির পানে। ততক্ষণে বরফের ন্যায় হিমায়িত হৃদি! আরশিতে নিবদ্ধ চক্ষু। স্বামীর আগমনে বিহ্বল মেয়েটি ভুলে গেল নিজেকে শাড়ির আবরণে আবৃত করতে। ভড়কানো চাহনিতে তাকিয়ে শুধু।
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১১
ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অভাবনীয়-অপ্রত্যাশিত দৃশ্য অবলোকন করে স্তব্ধ ইরহাম! ধড়াস ধড়াস করছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। বেগতিক শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। স্বেদজল গড়িয়ে পড়ছে কপালের দু’পাশ বেয়ে। এ কেমন হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি! পদযুগল ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে বুঝি! বারকয়েক পলক ঝাপটালো ইরহাম। নাহ্! কল্প নয়। বাস্তব এ। হৃদরাণীর অভাবনীয় রূপের ঝলকানিতে তখন অ-গ্নিকাণ্ড হৃদয়ে! ঝ ল সে যাচ্ছে নেত্র যুগল। দাঁড়িয়ে থাকা হয়ে উঠলো দুষ্কর। চুম্বকের ন্যায় আকর্ষিত হয়ে চলেছে তনুমন। মোহমায়া জাপ্টে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। টি-শার্ট ও ট্রাউজার পড়নে মানুষটির। আজ এ মুহূর্তে সে উপলব্ধি করতে পারলো প্রিয়তমার সিক্ত রূপের ঝলকানিতে তার সাড়ে সর্বনা’শ! বাঁ হাতে ঘরের প্রবেশদ্বার বদ্ধ করলো মানুষটি। শ্লথ পায়ে ব-শীভূতের ন্যায় এগোতে লাগলো হৃদির পানে। ততক্ষণে বরফের ন্যায় হিমায়িত হৃদি! আরশিতে নিবদ্ধ চক্ষু। স্বামীর আগমনে বিহ্বল মেয়েটি ভুলে গেল নিজেকে শাড়ির আবরণে আবৃত করতে। ভড়কানো চাহনিতে তাকিয়ে শুধু। স্বামীর প্রতিটি পদধ্বনি যেন কর্ণ গহ্বর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। অন্তরে বেজে চলেছে প্রেমের ছলাৎ ছলাৎ কলতান। ধীরলয়ে বদলে যাচ্ছে চোখের ভাষা। সম্মুখে থাকা আরশিও যেন আজ জানিয়ে দিলো সতর্কবাণী!
‘ আজ বুঝি নিস্তার নেই রে হৃদি! ‘
লাজে-সংকোচে-কিছুটা ভয়ে আনত হলো বদন। কম্পিত ডান হাতের সহায়তায় শাড়ির স্বচ্ছ আবরণে আবৃত হলো গাত্রের ঊর্ধ্বভাগ। ঠিক পেছনেই। অতি সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো ব-শীভূত মানুষটি। দৃষ্টি নিবদ্ধ তার আরশিতে। সেথায় দৃশ্যমান প্রিয় নারীর অবয়ব। সে অবয়বে নে-শাক্ত নয়নে তাকিয়ে ইরহাম। অবাধ্য নয়ন জোড়া আরশিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রিয় নারীর সারা অবয়বে। অত্যন্ত পাতলা আবরণীতে নিজেকে আবৃত করার বৃথা প্রয়াসে ব্যস্ত মেয়েটি। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের সাহসিকতা এখন বাতাসে ভেসে। মনে মনে বক্র হাসলো মানুষটি। দু’জনার মধ্যে বিদ্যমান সূক্ষ্ম দূরত্বটুকুও আজ আর সহ্য হয় না। তাই এলো। আরো নিকটে এলো। সে আগমন যেন অ”গ্নির ন্যায় উত্তপ্ত! অত্যুষ্ণ। যে উত্তাপে শিউরে উঠলো কোমল কায়ার অধিকারিণী। কম্পিত চিত্তে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলো হৃদি। কিন্তু চূড়ান্ত রূপে ব্যর্থ হলো। দু কাঁধ তখন স্বামীর আয়ত্ত্বে। সঙ্গিনীর দু কাঁধ শক্ত হাতে আঁকড়ে বাঁধা প্রদান করলো ইরহাম। মোহাচ্ছন্ন নয়ন জোড়া নিবদ্ধ হলো মেঘবরণ কেশরাশি’তে। বাঁ হাতের আলতো স্পর্শে ডান কাঁধ হতে সরে গেল কেশগুচ্ছ। ঠাঁই হলো কাঁধের বাম পাশে। আগত মুহুর্তের ভাবনায় শিরশির করে উঠলো মেয়েটির অভ্যন্তর। আলগোছে তার কাঁধ বরাবর নিম্নে ধাবিত হলো মানুষটির মুখখানা। পুরু অধর স্পর্শ করলো কাঁধের ডান পাশের কোমল ত্বক। আবেশে মুদিত হলো হৃদির আঁখি যুগল। বাঁ হাতে আঁকড়ে ধরলো পরিহিত শাড়ির একাংশ। অপরিমেয় মা-দকতায় বুঁদ হলো পুরুষালি সত্তা। শক্তপোক্ত দু হাতে অন্তর হতে গ্রহণ করলো অর্ধাঙ্গীকে। কোমল কায়া মিশে স্বামীর সনে। এলোমেলো-নে’শালো স্পর্শ সমূহ তখন পুরোদমে অনিয়ন্ত্রিত। অধরোষ্ঠ যেন বাঁধনহারা রঙতুলির ন্যায় সঙ্গিনীর কোমলতায় এঁকে চলেছে বাহারী চিত্রপট।
নিয়ন্ত্রণহারা অনুভূতিতে আবিষ্ট মানুষটি। থামতে নারাজ একবিন্দু পরিমাণ। পেশিবহুল দু হাতে পাঁজাকোলে তুলে নিলো অর্ধাঙ্গীকে। মোহাচ্ছন্ন মেয়েটির লজ্জালু মুখ লুকিয়ে স্বামীর গ্ৰীবাদেশে। দু হাতে জড়িয়ে তার গ্ৰীবা(গলা)। আসন্ন একান্ত মুহূর্তের কল্পনায় কম্পিত তনুমন। র”ক্তলাল আভা ছড়িয়ে মুখশ্রীতে। নে”শাক্ত মানুষটি চঞ্চল পায়ে এগিয়ে গেল। ঠাঁই হলো দু’জনার নরম তুলতুলে বিছানার আবরণে। স্ত্রীর সত্তায় আজ পুরোদস্তুর প্রমত্ত মানুষটি! অবিরাম আ!ফিমের ন্যায় নে-শালো স্পর্শানুভূতিতে গুটিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটি। তাকে নিজের মতো করে আগলে নিলো অসীম নে-শায় মত্ত ইরহাম। দিবাবসুর দীপ্তিতে আজ প্রথমবারের মতো একে অপরেতে হারিয়ে দু’জন। কখনোবা স্বামী নামক মানুষটির একান্ত কিছু শব্দগুচ্ছে লাজে মিইয়ে যাচ্ছিল মেয়েটি। তবে মিললো না বিন্দুতুল্য ছাড়! আদিম উ-ন্মাদনার সুখসাগরে দু’জনে চড়ে বসলো এক ভেলায়। অতিবাহিত হলো অবর্ণনীয়-তীব্র সুখময় এক লগ্ন।
.
গোধূলি লগ্ন। পশ্চিম আকাশে তখন লালাভ-কমলা আভা ছড়িয়ে। সগৌরবে অস্ত যাচ্ছে আদিত্য। বিহঙ্গের দল ফিরছে আপন নীড়ে। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো ইনায়া। ধীরপায়ে গিয়ে দাঁড়ালো জানালার পাশে। দু হাতে বিভক্ত করে সরিয়ে দিলো পর্দার আস্তরণ। একমুঠো আঁধার হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো ঘরে। বিষন্নতা মাখা হাসি ফুটে উঠলো অধরে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইনু। জীবনটা কেমন একঘেয়ে, বিষাদপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভালো লাগছে না কিছুই। কোনোরূপ পরিবর্তন নেই। সে যে এখন বিবাহিতা, কারোর অর্ধাঙ্গী তা-ও যেন মিথ্যে মনে হয়। মনের গহীনে পর্বতসম অভিমানের স্তূপ। রাহি ভাইয়ার আদুরে খুদে বার্তা কিংবা ক্ষমা চাওয়ার প্রচেষ্টা কেন যেন ফিকে লাগে। আজকাল নিজেকে নিজেই বুঝতে পারে না মেয়েটি। সবেতে অনীহা, মন্দ লাগা অনুভূত হয়। রোবটের ন্যায় আবেগহীন লাগে নিজেকে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? আচ্ছা সে কি মানসিকভাবে বিধ্ব-স্ত হয়ে পড়ছে! অস্থিরতার শিকার! মনোবিদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত? কে জানে কোনটা সঠিক। তার বোধহয় বায়ু পরিবর্তন করা উচিত। কিংবা নয়। আজকাল এই ঘর, চার দেয়ালের মাঝে বন্দী জীবন অসহ্যকর লাগে। তীব্র অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায় মুখাবয়বে। কবে মিলবে মুক্তি? স্বপ্নের রাজকুমার কি আসবে না মুক্তির বার্তা নিয়ে! ভাবনায় মশগুল মেয়েটি টেরও পেলো না কখন তার বিষন্ন অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা মুক্তো।
.
বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আবৃত বসূধা। বিমোহিত মেয়েটির দৃষ্টি নিবদ্ধ তার সুদর্শন স্বামীর পানে। আজ আরো এক ভিন্ন রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেছে মানুষটি। পড়নে তার কৃষ্ণবর্ণ ব্লেজার। উন্মুক্ত ব্লেজারের সম্মুখ ভাগ। সেথা হতে দেখা মিলছে শুভ্র রঙা হেনলি স্টাইল টি-শার্ট। পায়ে সফেদ স্নিকার্স। নিঃসন্দেহে নজরকাড়া লাগছে এ ক্যাজুয়াল লুকে! কখনো তার এমন রূপের দেখা মিলবে জানা ছিল না মেয়েটির। সর্বদা একই রূপে থাকা মানুষটি এবারের সফরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। যে রূপে ক্ষণে ক্ষণে মোহগ্ৰস্থ মেয়েটি! হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। হৃৎযন্ত্রে ধুকপুকানি বর্ধিত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। আজ সকালের পর থেকে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে লাজের বহর। মানুষটির চোখে চোখ মেলানো যেন এখন সবচেয়ে জটিলতম কর্ম মনে হয়। বড় দুষ্কর। লজ্জালু হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি। স্বামীর সৌজন্যমূলক ভাবে ধরে রাখা চেয়ারে বসলো। বিপরীত দিকের চেয়ারে বসলো স্নায়বিক দৌর্বল্যগ্ৰস্থ ইরহাম। দু’জনে এ মুহূর্তে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার আয়োজনে উপস্থিত। চমকপ্রদ এই নৈশভোজের আয়োজন করেছে হৃদির একমাত্র স্বামী মহাশয়। গতরাতে বুঝি এটার কথাই বলছিল! প্রথমবারের মতো কোনো রমণীর জন্য ক্যান্ডেল লাইট ডিনার আয়োজন। না চাইতেও বিচলিত এমপি সাহেব। এ আয়োজন ওর মনমতো হবে তো? নাকি কোনো খামতি রয়ে গিয়েছে! ও কি হতাশ হবে? দুশ্চিন্তায় কাতর এমপি সাহেব। কিইবা করার আছে? নারীমন বোঝা যে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন কাজ। কবি, সাহিত্যিকদের ভাষ্যে নারী এক রহস্য। যা ভেদ করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। ওপার বাংলায় গানও তো রয়েছে নারীমন নিয়ে,
‘ মেয়েদের মন বোঝা নয় রে নয় সোজা ‘
এলোমেলো বিভিন্ন চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছে। অস্থির অস্থির অনুভূতি হচ্ছে। ঘেমে যাচ্ছে কি ইরহাম? তন্মধ্যে হৃদি বিমোহিত চোখে অবলোকন করে চলেছে মুগ্ধকর আয়োজন!
গোলাকার টেবিল আবৃত ডিজাইনিং শুভ্র রঙা টেবিলক্লথে। টেবিলের মাঝ বরাবর অবস্থিত একটি ক্যান্ডেলাব্রা। ট্রিপল কাঠের অর্ধ-বৃত্ত নকশাযুক্ত এ ক্যান্ডেলস্টিকে বহ্নি শিখা ছড়িয়ে তিনটে মোমবাতি। পাশে একটি স্বচ্ছ কাচের গোলাকার পাত্র। জলে পূর্ণ তা। ডুবে কয়েকটি মোমবাতি। জলে তাদের প্রতিফলন এবং হলদে শিখার ঝলকানিতে সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! গোলাকার পাত্রে মোমবাতির পাশাপাশি বেশকিছু গোলাপের পাপড়ি, সুন্দর নুড়ি ডুবে সৌন্দর্য বর্ধন করে চলেছে। দু’জনের জন্য দু পাশে প্লেট। টেবিলে হালকাপাতলা ভোজনের ব্যবস্থা। হলদে ও লালাভের মিশ্রনে সে এক চোখ ধাঁধানো, প্রেমময় পরিবেশ! নিঃসন্দেহে এমন আয়োজনে পুলকিত হৃদি! তবে চিন্তায় ডুবে এমপি সাহেব। হৃদি বেশ কিছুক্ষণ ধরে তা লক্ষ্য করছে। কিছু আন্দাজ করতে পারলো কি!
” কি ব্যাপার ইরু সাহেব! এত সুন্দর আয়োজনে মুখ শুকনো করে বসে আছেন কেন? ফিলিং নার্ভাস? ”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে হৃদি। রুদ্ধকর অবস্থা মানুষটির। তপ্ত শ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
” ডু ইয়্যু লাইক দ্য অ্যারেজমেন্টস্? ”
মোহনীয় হাসলো হৃদি। সে ভুল নয়। আসলেই বিচলিত হয়ে আছে সাংসদ ইরহাম চৌধুরী। প্রথমবারের মতো এমন আয়োজন করেছে কিনা! তাকে প্রাণবন্ত হাসি উপহার দিলো মেয়েটি। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলতে লাগলো,
” ইরহাম! পুরোটা চমৎকার হয়েছে! আমি আপনাকে ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না এই মুহূর্তে ঠিক কি ফিল করছি। এই যে হলদে লাল আভা। ক্যান্ডেলস্টিক। এই পানিতে ভাসমান ক্যান্ডেলস্। আপনি, আমি একত্রে। এরচেয়ে সুন্দর, হৃদয়ছোঁয়া আর কি হতে পারে? জানেন এটা না আমার লাইফের ফার্স্ট ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। তা-ও আবার একমাত্র বরের সাথে। ইটস্ অ্যান আমেজিং ফিলিং! ”
হৃদির উচ্ছ্বসিত বদনে কাঙ্ক্ষিত উত্তর খুঁজে পেল ইরহাম। মুচকি হেসে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অর্ধাঙ্গীর পানে। এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো লক্ষ্য করা হয়ে ওঠেনি। কৃষ্ণবর্ণ স্যাটিন সিল্ক শাড়ি পড়নে মেয়েটির। শাড়ির পাড়ে আকর্ষণীয় স্বর্ণালী রঙা কারুকার্য! থ্রি কোয়ার্টার স্লিভে আবৃত দু হাতের অনেকখানি। দীঘল কালো কেশ সুন্দরভাবে পনিটেল করে বাঁধা। মুখজুড়ে মানানসই প্রসাধনীর ছোঁয়া। অপার স্নিগ্ধতা বিরাজমান আনাচে কানাচে। কানে একজোড়া ঝুলন্ত লম্বা দুল। মায়াবিনীর মায়াজালে বিভোর হলো কাঠিন্যতার খোলসে বন্দী অন্তর! মোহিত নয়নে তাকিয়ে অর্ধাঙ্গীর পানে! চোখে চোখ পড়তেই তা উপলব্ধি করলো হৃদি। লাজুক আভা ফুটে উঠলো মুখপানে। তৃপ্তিময় হাসলো ইরহাম। মৃদু স্বরে বললো,
” লেটস্ স্টার্ট আওয়া’র ফার্স্ট ক্যান্ডেল লাইট ডিনার? ”
লাজুক কন্যা ইতিবাচক মাথা নাড়ল। হাস্যবদনে প্রিয়তমার সঙ্গে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার উপভোগে মগ্ন হলো ইরহাম। নিজেই দু’জনের প্লেটে লাইট মিল পরিবেশন করলো। হৃদি প্রসন্ন বদনে স্বামীর নয়া রূপ অবলোকন করে চলেছে। বন্দী করছে হৃদয়ের রঙিন স্মৃতির বক্সে। কোনো একদিন এক বিষন্ন প্রহরে সে বাক্স খুলে এ স্মৃতিগুলো দেখবে। স্মরণ করে পুলকিত হবে মন। কেটে যাবে বিষন্নতা। ভেবে মুচকি হাসলো হৃদি। চমকালো ভাবনায় ছেদ পড়ায়। ওর পানে চামচ বাড়িয়ে ইরহাম। ইশারায় মুখে নিতে বলছে। আবেগপ্রবণ মেয়েটির চোখে জমলো অপ্রত্যাশিত সুখময় অশ্রু। মুচকি হেসে স্বামীর হাত হতে খাবার মুখে পুরে চমৎকার এ ভোজন পর্বের সূচনা করলো। অতিবাহিত হতে লাগলো মনোরম এই মুহূর্ত। টুকটাক আলাপণ। মাঝেমধ্যে একে অপরকে খাইয়ে দেয়া। দু’জনের চোখেমুখে অবর্ণনীয় উজ্জ্বলতা। আহা! জীবনে সুখী হতে এমন ছোটখাটো টুকরো টুকরো মুহূর্তই যথেষ্ট।
.
আঁধারিয়া চাদরে মোড়ানো ধরিত্রী। আকাশের বুকে শোভা পাচ্ছে শীতাংশু। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় শীতল তনুমন। ঝিঁঝিঁ পোকার কলতানে মুগ্ধ কর্ণদ্বয়। আশেপাশে রক্ষীর ন্যায় পাহারারত কিছু ছোট-বড় বৃক্ষ। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে পাতা একটি ফ্লোর ম্যাট। তাতে পাশাপাশি শুয়ে দু’জনে। স্বামীর ছড়িয়ে রাখা পেশিবহুল ডান বাহুতে শুয়ে হৃদি। দু’জনার দৃষ্টি নিবদ্ধ শীতাংশু’র পানে। কাছাকাছি পাশাপাশি কপোত-কপোতী। সে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ! চুপটি করে নেই হৃদি। আপন মনে প্রাণবন্ত রূপে বলে চলেছে কত কি। স্বামীর সঙ্গে বিয়ের এতগুলো মাস বাদে প্রথমবারের মতো একান্তে দিনযাপন। স্মরণীয় মুহূর্তগুলো পুরোদমে উপভোগ করে চলেছে সে। কে বলতে পারে আবার কবে মিলবে এমনতর মুহূর্ত! শৈশব হতে কৈশোর অতঃপর তারুণ্য। ছোট-বড় স্মরণীয় খুঁটিনাটি মুহূর্তগুলো জানাচ্ছে স্বামীকে। সে আজ সীমাহীন খুশি। হাস্যমুখে বলেই চলেছে। সে যেন প্রবহমান নদীর কলতান। হাওয়ার ঝাপটায় ক্রীড়ারত ঢেউয়ের মতো প্রাণবন্ত। চঞ্চল। মুগ্ধ শ্রোতার ন্যায় সব শুনে চলেছে ইরহাম। বউপাখি বলছে। চঞ্চলা পাখিটির কিচিরমিচির কলরবে বিমোহিত সে! কখনো শীতাংশু’র পানে তাকিয়ে কখনোবা তাকিয়ে স্ত্রীর মায়াবী আদলে। শুনছে সে। বলতে বলতে হৃদি এলো অপ্রত্যাশিত কাণ্ড কারখানায়। তার ক্রাশদের তালিকায়।
” জানেন আগে না আমি প্রচুর ক্রাশ খেতাম। মানে কারোর হ্যান্ডসাম লুক অ্যান্ড ড্যাশিং পার্সোনালিটি থাকলেই হয়েছে। ফিদা এই আমিটা! এই নিয়ে আফু, নাদু ওরা কত পঁচিয়েছে আমাকে। তাতে কি হয়েছে? আমি তো আমিই। উঠতে বসতে ক্রাশ খাচ্ছি। দেশি বিদেশি কেউই বাদ নেই লিস্টে। ব-হু ক্রাশ খেয়েছি জীবনে। ”
চোখেমুখে কাঠিন্যতা ভীড় করলো মানুষটির। তা লক্ষ্য বিনা আঙ্গুল গুনে ভেবে ভেবে হৃদি বলতে লাগলো,
” রণবীর সিং, রণবীর কাপুর, আরমান মালিক, ভিরাট কোহলি, দার্শান রাভাল, শারাদ মালহোত্রা, কার্তিক আরিয়ান, কারান কুন্দ্রা। আমাদের দেশে সিয়াম, জোভান, তাহসান, সাকিব আল হাসান, ইমরান, আয়মান সাদিক, ইরহাম চৌধুরী আরো অনেকেই আছে। এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। অনেকদিন ধরে মনে করি না তো। নাম কেমন ভুলে ভুলে গেছি। ”
হতাশা মিশ্রিত স্বরে বলল হৃদি। যেন ভুলে গিয়ে সে মস্তবড় অপরাধ করে ফেলেছে। হঠাৎ মেয়েটির দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো স্বামীর পানে। হকচকিয়ে গেল স্বামীর চাহনিতে অপ্রত্যাশিত তীক্ষ্ণতা উপলব্ধি করে। একটু আগেই না কেমন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল! এখন ক্ষ্যা পা ষাঁড়ের মতো লুক নিয়ে আছে কেন? গলা শুকিয়ে গেল হৃদির। আস্তে আস্তে সরতে সরতে স্বামীর পেশিবহুল বাহু হতে সরে হাতের কবজি বরাবর পৌঁছে গেল। আকস্মিক মাথা তুলে ওর দিকে ঝুঁকে গেল ইরহাম। তাতেই ফুরুৎ হৃদির প্রাণপাখিটা। ওর ভীত অভিব্যক্তি অগ্রাহ্য করে চোখে চোখ রাখলো ইরহাম। গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
” দেশীয় ক্রাশ সিয়াম, জোভান, তাহসান, সাকিব আল হাসান, ইমরান, আয়মান সাদিক, ইরহাম চৌধুরী? ”
দ্রুততার সহিত ইতিবাচক মাথা নাড়ল হৃদি। হাঁ। ওরাই। অতঃপর হুঁশ ফিরতেই ভয়ের চোটে নেতিবাচক মাথা নাড়ল।
” না না। কেউ নেই। শুধু স্বামী আছে। ক্রাশ ম্রাশ সব বাদ। ”
গলা এত শুকিয়ে আসছে কেন? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। এখন রাতদুপুরে বাহিরে পানি পাবে কোথায়? কিংবা পানি খেতে যাবে কি করে? দ্যাখো। কেমন চোখের চাহনিতেই মোড়াল সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে। উফ্! দমবন্ধকর অবস্থা। হঠাৎ..
চলবে.