মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি ২ পর্ব-২০

0
705

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২০

আঁধারিয়া রজনী। শহরের অন্যতম এক সেরা হাসপাতাল। অসুস্থ রোগী, তাদের স্বজন, চিকিৎসক, নার্সদের আনাগোনায় মুখরিত পরিবেশ। ফিনাইলের তীব্র অস্বস্তিকর গন্ধ নাসিকা গ্ৰন্থিতে কড়া নেড়ে চলেছে। নার্স, ওয়ার্ড বয়দের পদচারণায় ব্যস্ত করিডোর। তবে এসব কোলাহল হতে সম্পূর্ণ মুক্ত এক কেবিন। সেথায় শুভ্র রঙা বিছানায় শায়িত হৃদি। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এতগুলো ঘন্টা বাদে একটু আরামে, অনেকখানি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। হাতে ক্যানুলা। অবিরাম চলছে স্যালাইনের ড্রিপ। প্রায় তিনদিনের বেশি সময় ধরে অ:পহৃত। চোখমুখ ডেবে গেছে। কালচে দাগ চোখের নিচে। প্রাণহীন খসখসে ওষ্ঠাধর। সদা প্রাণবন্ত ফিটফাট থাকা মেয়েটির আজ দৈন্যদশা। শরীরের ওজন যেন কয়েক কেজি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। দেখতে ক:ঙ্কালসার লাগছে। বড্ড নির্জীব। রূপকথার সেই ঘুমন্ত রাজকন্যার ন্যায় ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে মেয়েটি। এমন এক মুহুর্তে নিঃশব্দে কেবিনের দ্বার উন্মুক্ত হলো। দেখা মিললো এক সুঠামদেহী-সুশ্রী অবয়বের। শ্লথ পায়ে বেডের পানে এগিয়ে আসছে সে জন। যার বুকে অসহনীয় পীড়া। চোখে জ্বা’লাপো’ড়া। একান্ত নারীর দুর্দশায় ক্রন্দনে লিপ্ত হৃৎপিণ্ড। নিজের অবস্থাও করুণ। একাধারে স্ত্রী ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হচ্ছে। মিলছে না একটুও ছাড়-অবসর। শরীরটা কেমন অসার হয়ে আসছে। ভোঁ ভোঁ করে বোলতা আ’ক্রমণ করছে মস্তিষ্কে। যন্ত্রণা হচ্ছে ভেতর ও বাহিরে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল ইরহাম। রিমলেস চশমার আড়ালে লুকায়িত নভোনীল চক্ষু জোড়া আজ নির্জীব। অচঞ্চল। মৃ ত নদীর ন্যায় নিষ্প্রভ। শব্দহীন টুল টেনে প্রিয়তমার পাশে বসলো মানুষটি। নিষ্পলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো স্ত্রীর পানে। এ-ই কি সে মেয়ে যার সনে এক হালাল বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল? যার চঞ্চলতায় হারিয়েছিল গাম্ভীর্য? যার রিনিঝিনি হাস্য কলরব হৃদয়ে উচ্ছ্বাস বয়ে আনতো। এই কি সে হৃদি? তার হৃদয়ের রাণী?

হ্যাঁ। এই সে। তার হৃদরাণী। প্রতিকূলতার মধ্যে হারিয়েছে যার মাধুর্য। লাবণ্য। তাতে কি হয়েছে? রূপ লাবণ্যে কি আর ভালোবাসা হয়! পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত নারীও তার প্রিয়তমের নিকটে সবচেয়ে মোহনীয়। অপরূপা। সেখানে তার হৃদি তো। মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ওলটপালট ভাবনা হানা দিচ্ছে ভেতরে। নিজেও জানে না কি থেকে কি ভাবছে। কোন পথে চালিত হচ্ছে মস্তিষ্ক। কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে স্নায়ু। ক্লান্তি মাখা নয়নে হৃদির পানে তাকিয়ে রইলো মানুষটি। একটিবার ছুঁয়ে দিতে আনচান করছে মন। আলতো করে ছুঁয়ে দেখবে কি? ব্যথা পাবে না তো তার হৃদি? খুব বেশিই কি ক্ষতি হবে আলতো করে একটিবার ছুঁয়ে দিলে! বেসামাল মনকে সামাল দেয়া যে দুষ্কর হয়ে উঠেছে। মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে বিজয়ী হলো মন। আস্তে ধীরে কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিলো ইরহাম। আলতো করে ছুঁলো নির্জীব পেলব হাত। কেঁপে উঠলো অভ্যন্তরীণ সত্তা। ভয় হচ্ছে আজ। কম্পিত তার পৌরুষ চিত্ত। তার অর্ধাঙ্গী ব্যথা না পায়! ধীরে ধীরে আলতো ভাবে নিজ হাতের মুঠোয় পুরে নিলো কোমল হাতটি। অব্যক্ত ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো তনুমনে। নভোনীল চক্ষুদ্বয়ে এ মুহূর্তে অপরিমেয় আকুলতা। কখন চোখ মেলে তাকাবে তার হৃদি! ধন্য হবে দু নয়ন। আকাঙ্ক্ষিত সে-ই মুহূর্ত আসবে কখন! আস্তে ধীরে মুখ নামিয়ে আনলো ইরহাম। প্রিয়তমার হাতের উল্টো পিঠে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিলো। অজান্তেই শক্ত করে মুঠোবন্দী করে নিলো কোমল হাতটি। এই যে ধরলো। ছাড়বে না কভু। আমৃ”ত্যু বাঁচবে একে অপরের তরে। মনের গহীনে যেন আকুলিবিকুল হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো,

‘ মনের অরণ্যে এলে তুমি
কড়া নাড়লে হৃদয়ের বদ্ধ দোরগোড়ায়
তোমাতেই খুঁজে ফিরি সুখ আমার
তলিয়ে যাই সুখমিশ্রিত গভীরতায়… ‘

.

হৃদি’কে গত ভোররাতে উদ্ধার করার পর বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সেথায় সকাল গড়িয়ে দুপুর এলো। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং মানসম্মত চিকিৎসার্থে দুপুর নাগাদ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো হৃ’হাম এবং সঙ্গীরা। অ্যাম্বুলেন্সে করে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল সঙ্গিনীকে সাথে নিয়ে নিজ শহরে ফিরলো ইরহাম। ভর্তি করালো শহরের অন্যতম নামকরা উন্নতমানের হাসপাতালে। নিশ্চিত করলো সর্বোত্তম চিকিৎসা। সন্ধ্যাবেলা চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা হৃদির খবর জানতে পারলো। রাহিদ জানালো তাদের। অপ্রত্যাশিত সুসংবাদে বাকরূদ্ধ দুই পরিবারের সদস্যরা। ফারহানা ও মালিহা। দুই মা অঝোরে অশ্রু বিসর্জন দিলো। শুকরিয়া আদায় করলো রবের। কালবিলম্ব না করে ছুটে এলো এই হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন কন্যাকে দেখে তারা দু’জনেই দিশেহারা। কেঁদে চলেছেন অবিরাম। রাঈশা, নাজরিন, ইনায়া মিলেমিশে কোনোমতে তাদের সামলাতে সক্ষম হলো। শহরের দু’টো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাদের দুই আপনজন। হৃদি এবং পল্লবী। পল্লবী আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছেন। তবে স্বামী প্রদত্ত আঘাতের চিহ্ন এবং মনোবেদনায় পীড়িত। একটুখানি স্বস্তি পেলেন হৃদির খবর পেয়ে। যাক ওনার স্বামীর অপকর্মের ফল ওই মাসুম মেয়েটিকে সইতে হয়নি। ওপর ওয়ালার অশেষ রহমতে সহি সালামতে ফিরে এসেছে সবার আদরের হৃদি।

ঘড়ির কাঁটা নির্দেশ করছে এখন রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিট। ইরহাম ও হৃদির পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এখনো হাসপাতালে। ওয়েটিং জোনে উদাস বদনে বসে। হাসপাতালের পরিচালক এজাজ সাহেবের বন্ধুর বড় ভাই হন। তাই বিশেষ অনুমতি পেয়ে ভিজিটিং আওয়া’র শেষ হবার পরেও এনারা উপস্থিত। বাড়ি যেতে নারাজ। কিছু সদস্য অন্য হাসপাতালে। পল্লবীর কাছে। ইরহাম জানিয়েছে আগামীকাল সকাল সকাল মামীকে এ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে। ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতালে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও যাতায়াতে সমস্যা।

বর্তমানে হাসপাতালটি নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘেরা। অনুপস্থিত ইরহাম। তার অবর্তমানে সিকিউরিটি হেড রুস্তম, তার দলবল এছাড়াও কিছু পুলিশ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োজিত।

আজকের দিনটি বাংলার মাটিতে অন্যতম এক স্মরণীয় দিন। দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। স:হিংসতা হচ্ছে শহরের যত্রতত্র। মা:দক ব্যবসা এবং নারী পা:চারকারী চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে কয়েকজন নামীদামী ব্যক্তি। তন্মধ্যে জনাব শিকদার পুত্র জুনায়েদ শিকদার, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জহির আহসান, সরকারি দলের এক সচিব, এক প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দলের এক সাংসদ এবং প্রবাসী এক নামী ব্যবসায়ী রয়েছে। একসাথে একই দিনে স্বল্প সময়ের বিরতিতে ছয়জন প্রভাবশালী ব্যক্তির গ্রেফতার। দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। নিজেকে বাঁচাতে ম:রিয়া হয়ে উঠলো তারা ছয়জন। জানাশোনা সমস্ত কন্টাক্টে যোগাযোগ করে ঝড় তুললো। দুঃখজনক ভাবে তেমন লাভ হলো না। মিললো না সহায়তা। তাদের কারোর উকিল সাময়িক সান্ত্বনা দিলো। কেউবা দিলো আশ্বাস। পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে বা নিজ কর্মস্থল কিংবা পার্টি অফিস হতে গ্রেফতার হলো তারা ছয়জন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জনগণ দুইভাগে বিভক্ত হলো। একপক্ষ ধিক্কার জানাচ্ছে অপরাধীদের। কেউবা তাদের পক্ষে সাফাই গাইছে। অভিযোগ করছে নামী লোকেদের বাজেভাবে ফাঁ:সানো হচ্ছে। এ নিয়েই আরম্ভ হলো স:হিংসতা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে শহরের আনাচে কানাচে। বন্ধ হলো অফিস আদালত, প্রয়োজনীয় স্টোর। রাস্তায় যানবাহন চলাচল অবরুদ্ধ। সরকারী দলের ছেলেপুলেরা রাস্তায় গাড়ির টায়ার পু”ড়িয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলো। কয়েক জায়গায় তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পোস্টার ছিঁড়ে, আগুনে পু’ড়িয়ে দিলো। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চারিপাশ। তাদের অভিযোগ বিরোধী দল অর্থাৎ ইরহাম চৌধুরীর দল ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করেছে। এটা পূর্ব পরিকল্পিত ষ:ড়যন্ত্র। মানহানীর মামলা দায়ের করবে তারা। ছাড়বে না কাউকে।

অন্যায়কে সাময়িক দমন করতে গিয়ে মূল্য চুকাতে হলো সাধারণ জনগণের। দোকানপাট, অফিস আদালত বন্ধ। দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত। অন্যদিকে এসপি তাঈফকে বিনা নোটিশে বদলি করা হলো। নতুন পোস্টিং হলো বান্দরবানে। ওপরমহলে থাকা অসাধু ব্যক্তিরা দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে যাচ্ছে। সরাসরি কিছু করতে পারছে না বিধায় এটা ওটা মিথ্যা অভিযোগ দেখিয়ে শাস্তি দিতে চাইছে। তারা মানতেই পারছে না ছয়জন সঙ্গী এমন বাজেভাবে ফেঁ সে গেছে। শেষ দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে ডাক পড়লো পুলিশের ডিআইজি, সাংসদ ইরহাম চৌধুরী, অ্যান্টি ড্রা:গ ফেডারেশনের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং পুলিশ কমিশনারের। ঘন্টা দুয়েক সময় নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ-গোপন মিটিং হলো। খবর পেয়ে মন্ত্রনালয়ের বাহিরে অপেক্ষারত মিডিয়ার লোকজন। কি হচ্ছে ভেতরে। হঠাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ! কেমনতর আলাপণ হচ্ছে ভেতরে! জানা নেই। ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় রয়েছে মিডিয়া। অবশেষে মিটিং সমাপ্ত হলে স্বাভাবিক বদনে বেরিয়ে এলো তারা চারজন। মিটিংয়ের ফলাফল কি, বহু চেষ্টা সত্ত্বেও মিডিয়া ঠিক জানতে পারলো না। দেশব্যাপী এতটুকু ছড়িয়ে পড়লো যে, অপরাধীদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। মিলবে না ছাড়। এভাবেই তুমুল আলোড়ন এবং ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলো দিনটি।

গোধূলি লগ্ন। অ্যাডজাস্টেবল বেডে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসে হৃদি। পড়নে হাসপাতালের পোশাক। মাথা ও দেহের উপরিভাগ আবৃত দোপাট্টায়। পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে আসছে। যাচ্ছে। ডক্টর নার্স আসছে। শুধুমাত্র হাসপাতালের পোশাক পড়নে বড় অস্বস্তি হচ্ছিল মেয়েটার। নিজেকে কেমন আব্রু হীন লাগছিল। তাই আদুরে ননদ ইনায়া ওর জন্য দোপাট্টার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

হৃদি অশ্রুসজল নয়নে তাকালো সম্মুখে। ওর দু পাশে বসে দুই মা। জন্মদাত্রী মা ও শাশুড়ি মা। দু’জনে ওর দু’টো হাত মুঠোবন্দী করে বসে। চোখে জমে অশ্রু বিন্দু। হৃদির অধরকোণে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। কথাগুলো ঘন্টা বাদে হাসলো সে! সে ভাগ্যবতী এক জীবনে দুই মায়ের পরম স্নেহ লাভ করে। সবাই কি এমন সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায়? নাহ্। মেয়েটা মৃদু স্বরে বললো,

” আর কেঁদো না মাদার্স। তোমাদের চোখের পানিতে হাসপাতাল এই ভেসে গেল বলে। ”

হেসে উঠলো উপস্থিত তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা। নীতি , নিদিশা, রায়না। ইনায়া ও রাহিদ পল্লবীর কাছে। হৃদি এখনো মামীর বিষয়ে জানে না। ও জানে না এই একই ফ্লোরে চিকিৎসাধীন তার মামী শাশুড়ি।

নীতি বোনের কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো,

” একদম ঠিক বলেছিস তুই। কাল থেকে চাচী আর আন্টি যে পরিমাণ কান্নাকাটি করেছে, হিসাব করলে কয়েক গ্যালন তো হবেই। ”

নিদিশা আঙ্গুল গুণে বললো,

” উম্। দুই গ্যালন বোধহয়। ”

হেসে উঠলো সবাই। ফারহানা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

” মা র খাবে তোমরা। ”

নিদিশা দাঁত কেলিয়ে বললো,

” কোনটা গো? ঝাল নাকি মিষ্টি? আমার কিন্তু টক পছন্দ। ”

দুর্বলতা সত্ত্বেও শব্দহীন হেসে চলেছে হৃদি। ও ঠিক উপলব্ধি করতে পারছে ভাইবোনদের এমনতর কাণ্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইছে ওরা। কম তো ঝড়ঝাপটা গেল না। এবার নাহয় একটু পুরনো আনন্দ ফিরুক। ফারহানা চোখ গরম করে বললেন,

” টক-ঝাল-মিষ্টি সব একসাথে দেবো। ”

নিদিশা এমন ভাব করলো যেন জিভে জল চলে এসেছে,

” আহ্! টেস্টি টেস্টি! খাবো। ”

নীতি হেসে উঠলো। রায়না তাল মিলিয়ে হাসছে। তবে বেদনার ছাপ স্পষ্ট চেহারায়। মায়ের জন্য মন পু’ড়ছে খুব। হৃদি তাকালো শাশুড়ি মায়ের পানে। ওনার মুখখানি পুত্রবধূর পানে নিবদ্ধ। হৃদি মায়ের ম্লান ভাব লক্ষ্য করে হাতে আলতো চাপ দিলো। শান্ত ভেজা স্বরে বললো,

” আমি ঠিক আছি মা। আর কেঁদো না। তোমাদের প্রতি ফোঁটা চোখের পানিতে এ বুকে যে যন্ত্রণা হচ্ছে। ”

ফারহানাও তাকালেন মেয়ের মুখপানে। মালিহা অশ্রুসিক্ত নয়নে কয়েক পল তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়ালেন কন্যাসম পুত্রবধূর বাঁ পাশে। দু হাতের অঞ্জলীতে ভরে নিলেন মায়াবী মুখখানি। দু’জনে একে অপরের পানে তাকিয়ে। হঠাৎই ক্রন্দনে ভেঙে পড়লেন মালিহা। ঠোঁট দাবিয়ে রাখলেন হৃদির ললাটে। আবেগী মেয়েটিও নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। দু হাতে জড়িয়ে ধরলো দ্বিতীয় মায়ের কোমর। পেটে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে কায়া। ফারহানা আপ্লুত হয়ে তাকিয়ে। মেয়ে তার এতটা ভালোবাসা পাচ্ছে? বেয়াইন ওকে এতটা আপন করে নিয়েছেন! নীতি, রায়না ওরাও সিক্ত চোখে তাকিয়ে। মুহুর্তের মধ্যেই হাসিখুশি পরিবেশ আবেগপূর্ণ হয়ে গেল। মালিহা মেয়ের ললাটে চুম্বন এঁকে মৃদু স্বরে আওড়ালেন,

” আমার সোনা মেয়ে! ”

আরো গাঢ় হলো বন্ধন। হৃদি তখনও মায়ের পেটে মুখ লুকিয়ে। ইনায়া দরজায় দাঁড়িয়ে। দেখলো এই আবেগঘন দৃশ্য। ওর চোখেও জমলো নোনাজল। ঠোঁটে খুশির ছোঁয়া। ওর অনুপস্থিতিতে আম্মু মোটেও খারাপ থাকবে না। ভাবী ভালোবেসে আগলে রাখবে তার পরিবারকে। ইনশাআল্লাহ্।

.

নিকষকৃষ্ণ রজনী। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে হৃদি। ওর পাশে বসে ইনায়া, টুলে নিদিশা। নিদিশা একটা কমেডি বইয়ের পিডিএফ পড়ছে মোবাইল নামক যান্ত্রিক ডিভাইসে। হাসতে হাসতে অসুস্থ বোনকে সে কাহিনী শোনাচ্ছে। চিকিৎসাধীন বোনের মনমেজাজ ভালো রাখার ক্ষুদ্র এক প্রচেষ্টা। নিদিশার রঙঢঙ করে বলা হাস্যরসাত্মক কাহিনী শুনে হাসছে ইনায়া। শুধুমাত্র হাসি নেই অসুস্থ মেয়েটির ওষ্ঠপুটে। ইনায়া হাসিমুখে হঠাৎ ভাবীকে লক্ষ্য করলো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো ওর মুখ। ভাবী এমন মলিন বদনে শুয়ে কেন? শরীর খারাপ করছে! ত্বরিত উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধালো,

” ভাবী? কি হয়েছে? তোমার শরীর খারাপ করছে? ডক্টর ডাকবো? ”

হৃদির ঘোর কেটে গেল। তাকালো ওর পানে। নিদিশাও কাহিনী বন্ধ করে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে। হৃদি মেয়েটা কেমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। কি বলবে এবার? মেকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো অধরে। বললো,

” আমি ঠিক আছি ইনু। শুধু শুধু চিন্তা করছো। ”

” তাহলে তোমার কি হয়েছে? চোখমুখ এমন শুকিয়ে কেন? অস্থির লাগছে? ”

হৃদি কিছু বলার পূর্বেই নিদিশা বলে উঠলো,

” হ্যাঁ। খুব অস্থির লাগছে। তাই না আপু? ”

হৃদি চমকিত নেত্রে তাকিয়ে! বলে কি এই মেয়ে! ইনায়া ঘাবড়ে গেল। নিদিশাকে প্রশ্ন করলো,

” তুমি জানো ভাবী কেন অস্থির বোধ করছে? ”

” হাঁ জানি তো। ” বিজ্ঞের মতো বললো নিদিশা।

” কি হয়েছে বলো আমায়। চিন্তা হচ্ছে তো। ”

নিদিশা কোনোমতে হাসি চেপে বসে। বোনের শুকনো মুখ দেখে এবার রসিয়ে রসিয়ে বললো…

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে