#মনের_গহীনে_শুধুই_তুমি
#পর্ব_34(#অন্তিম_পর্ব)
#Mst_Meghla_Akter_Mim
“বাবা আমাকে বাহিরে আসতে দাও এখন দয়াকরে। আর কতক্ষণ আটকে রাখবে আমায়? আমার খুব ক্ষুদা লাগছে বিশ্বাস করো! পেটে ব্যথা করছে ঘর টা খুলে দাও না।”-ঘরের দরজার কড়া নেড়ে চিৎকার করে রোদ বলে যাচ্ছে।
আদিল চৌধুরী কোনো উত্তর না দিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে পেপার পড়ছেন। রোজা চৌধুরী ছেলের উপরে রেগে থাকলেও ছেলের জন্য এখন কষ্ট হচ্ছে। রোজা চৌধুরী আদিল চৌধুরীর পাশে গিয়ে বললেন,” হ্যাঁ গো ছেলে টা কে এখন বাহিরে আসতে দাও।”
আদিল চৌধুরী পেপার রেখে মুখে রাগী রাগী ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন,” ওই ছেলেকে জীবন্ত মাটি দিলেও আমার রাগ কমবে না রোজা। ও ক্ষুদায় মরে যাক আমার কোনো যায় আসে না।”
“এমন করে বল না। ছেলেটার ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগ দেয়া দরকার, আমরা তো ওর মা বাবা।”
ইশা চৌধুরী আর জান্নাত নিচে নামলো সেদিকে আদিল চৌধুরী নজর দিয়ে বললো, “রোজা মৌ তার মেয়েকে পেয়েছে নাকি ইশা তার মেয়েকে পেয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি না।”
ইশা চৌধুরী বললো,” ভাইয়া কি যে বলেন না আপনি। মৌ আপার মেয়ে মানে তো আমারই মেয়ে।”
আদিল চৌধুরী তাৎচ্ছিল ভরা হাসি দিলো। জান্নাতের সামনে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”ভুল সবসময় খারাপ কিছুই উপহার দেয় মা।”
জান্নাত অপরাধী দৃষ্টিতে আদিল চৌধুরীর দিকে তাকালো। আদিল চৌধুরী আর কিছু না বলে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,” মৌ কোথায়?”
রোজা চৌধুরী বললো,”মৌ কেঁদে কেঁদে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেঘ চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না।”
-“আর নীল? প্রিন্স কেউ দেখছি না তো!”
-” নীল অফিসে গেছেন আর এইখানে আসবে না বলে গেছে। মৌ আর প্রিন্স আর পায়েল কে পরে যেতে বলেছে। আর প্রিন্স মনে হয় আয়রার সাথে আছে।”
“আচ্ছা।”
বলে আদিল চৌধুরী মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে বললেন,”এখন রোদ কে বাহিরে আসতে দিতেছি কিন্তু ওর সাথে কেউ কথা বলবে না।”
রোজা চৌধুরী মাথা নারাল।
____________
রোদের দরজার সামনে আদিল চৌধুরী আসতেই রোদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আদিল চৌধুরী এদিকে সেদিক দেখে দরজা খুলেই রোদের ঘরে প্রবেশ করে বললো, “মেঘ মা ভালো আছে তো? আর এই মেয়েটা সত্যি কি পায়েল?”
রোদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো আদিল চৌধুরীর দিকে। শার্ট পড়তে পড়তে বললো, “মেঘ ভালো আছে। আর তুমি আমায় পায়েল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছো এইটা আমি মানতে পারছি না।”
“কেনো কেনো?”
রোদ রহস্য মাখা হাসি দিয়ে আদিল চৌধুরীর চুলে একটা ফু দিয়ে বললো,” এইখানে এত কিছু জিজ্ঞেস করলে সবাই বুঝে যাবে তুমি মিথ্যা আমায় আটকে রাখার অভিনয় করেছ।”
“হুম ঠিক আমি যায়।”
” দাঁড়াও আব্বু একটু দাঁড়াও।”
আদিল চৌধুরী যেতে নিয়ে থেমে গেলো। রোদ দু পকেটে হাত দিয়ে বললো, “আব্বু আমি সিআইডি হওয়ার গুণ টা মনে হয় তোমার থেকেই পেয়েছি!”
আদিল চৌধুরীর মুখ অন্য রকম হয়ে গেলো। কিছু বলতে গিয়েও কি যেনো ভাবতে মগ্ন হয়ে গেলেন। রোদের সাথে কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। রোদ মুখে অদ্ভূত হাসি ফুটিয়ে তুললো।
______________
হলুদ শাড়ি পরে জানালার পাশে চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছে মেঘ। আজ এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে মেঘের মাঝে। অবশেষে রোদ তাঁকে ভালোবাসে। এইসব ভাবতেই হঠাৎ মেঘের মুখ মলিন হয়ে গেলো। মৌ ইসলাম, নীল ইসলাম আর প্রিন্সের কথা খুব মনে পড়ছে। তারা কি জান্নাত কেই নিজের মেয়ে ভেবেছে? প্রিন্স কি ওকে ই বোন ভেবেছে তা ভেবে একটুও ভালো লাগছে না মেঘের। মাথার ভেতরে চিন্তা আরো হানা দিলো প্রতীক হাসান আর মিমি হাসানের কথা ভেবে। তারা কি জানে মেঘ ঠিক আছে নাকি চিন্তা করছে? এইসব চিন্তা ভাবনার মাঝে দরজার knock করার শব্দ পেলো মেঘ। কাঁচের দরজা ভেদ করে দেখা যাচ্ছে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ বসে থেকেই বললো,
-“এসো ভাইয়া।”
রুদ্র রুমে প্রবেশ করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,”আমি এসেছি বুঝলে কিভাবে?”
মেঘ উঠে একটা চেয়ার রুদ্রের সামনে দিয়ে বললো,” বস ভাইয়া। আপনার বন্ধু বলে গেছিল আপনি আসবেন আর এমনিতেই তো ঘর থেকে বাহিরের সবকিছু দেখা যায়।”
রুদ্র মাথা চুলকে বললো, “তাই তো সব ভুলে যাই কেনো যে! ভাবি আগে খেয়ে নাও তো মা তোমার জন্য স্পেশাল ভাবে রান্না করেছে।”
মেঘ খাবার গুলো একটু সরে রেখে বললো, “খাবো ভাইয়া কিন্তু একটু পরে। এখন খেতে ইচ্ছা করছে না। আর ভাইয়া সবকিছু কি ভুলে যাচ্ছেন অর্চির সাথে সম্পর্কের পর হুম?”
বলে মেঘ হাসি দিলো। রুদ্র জোর পূর্বক হাসি দিয়ে বললো,” তোমার বান্ধবী তোমার চেয়ে কম রাগী তা বুঝতে পেরেছি। তবে ও আসায় আমার জীবন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।”
বলে একটু দেরি করে রুদ্র আবারো বললো,” ভাবি এখনই খেতে হবে নাহলে রোদ কিন্তু আমার উপর রেগে যাবে।”
মেঘ এক কাপ কফি রোদ কে দিয়ে বললো,”কফি খান তো? আমার আবার চা চলেনা।”
বলে বেডে বসল। রুদ্র কফি হাতে নিয়ে বললো,”আমারও ভাবি। কিন্তু তুমি খেয়ে নাও এখনই।”
মেঘ কফি কাপ রেখে বললো, “আট টা শবে পার হয়েছে, নয় টার আগেই খেয়ে নিবো। এখন একটু গল্প করা যায় কি আমার সাথে কফি খেতে খেতে? নাকি অর্চি আবার বকা দিবে?”
রুদ্র হেসে বললো,” ভাবি এমন টা মোটেও না। অর্চি একটুও রাগ করবে না। আর তুমি আমার সাথে গল্প করতে চেয়েছ এইটা আমার সৌভাগ্য।”
“আমি হলে কিন্তু খুব রাগ করতাম। রোদের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিতাম। ”
রুদ্র এক চুমুক কফি খেতে নিতেই মেঘের কথা শুনে বিষম খেলো। মেঘ পানি এগিয়ে দিলো। রুদ্র পানি খেয়ে নিয়ে বললো,” তাহলে অর্চি ঠিকই বলেছিল! আর রোদও সত্যি কথায় বলেছিল! ”
মেঘ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কি বলেছিলো?
“এইযে তুমি তোমার জিনিসে কারো ছায়া ও পছন্দ করো না। এমনি তে সবকিছু তে উদারতা থাকলেও ভালোবাসার জিনিস কাউকে ভাগ দিতে রাজি না। কিন্তু আমি এখন দেখছি তুমি এর চেয়েও বেশি ভালোবাস রোদ কে।”
“আমি এমন ই ।রোদের সাথে কাউকে আমার ভালো লাগে না। তবে আমি জানি সে আমারই কিন্তু তবুও ইচ্ছা করে সারাক্ষণ আমার কাছে বন্দি করে রাখি। ”
” রোদের জীবন সার্থক তোমাকে সে পেয়েছে। জানতো আমার বন্ধু তোমাকে খুব ভালোবাসে। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করব? ”
“হুম করুন। ”
” তুমি ই সেই লেডি বাইকার তো? না মানে রোদ তোমায় জিজ্ঞেস করতে গিয়েও হয়তো করেনি কারণ ও নাকি বিশ্বাস করে ওইটা ই তুমি। জানো সেই তিন বছর আগে থেকে তোমায় কত খুঁজেছে। ”
মেঘ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে বললো,” আপনি আমায় কষ্ট দিয়েছেন না এইবার আপনার পালা। আমি সেই লেডি বাইকার তা আপনাকে এখন তো জানতে দিবো না রোদ। ”
রুদ্র বললো,” ভাবি কি ভাবো? ”
মেঘ মাথা নাড়িয়ে চিন্তার ভান করে বললো,” ভাবতেছি কিন্তু ভাইয়া আমি তো বাইক চালাতে পারি না! রোদ মনে হয় অন্য কাউকে খুঁজেছে কয়েক বছর। ”
মেঘের কথাটা শুনে রুদ্রের যেনো মন ভেঙে গেলো। মুহূর্তেই মুখ মলিন হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থাকলো। তার পর তাড়াহুড়ো করে বললো, “মেঘ ভাবি আমার একটা জরুরী কল করতে হবে দু মিনিট আসি? ”
মেঘ মাথা নারিয়ে বললো,” ঠিক আছে ভাইয়া। অর্চি কে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলবেন।”
রুদ্র মুখ মলিন করে হ্যাঁ বললো। আর মেঘ মনে মনে ভীষণ খুশি, মুখে শয়তানী হাসি লেগে আছে। মেঘ জানে এখন রুদ্র রোদ কেই কল করবে আর রোদের কি অবস্থা হবে সেটা ভেবেই হাসি পাচ্ছে।
____________
রোদ মাত্র পরোটার এক টুকরো মুখে তুলেছে তখনই রুদ্রের কল আসলো। মেঘের কিছু হয়েছে কি না তা ভেবে সাথে সাথে ফোন তুললো রোদ। রোদ কিছু বলার আগেই রুদ্র বলে উঠলো,
-“ভাই এইটা কি হলো! তুই ভুল ভাই।”
খাবার টেবিলে সবাই আছে। রোদ সবার দিকে খেয়াল করে শান্ত গলায় বললো,” কি হয়েছে?”
-“কি হয় নি তা বল। তোর ওই লেডি বাইকার মেয়েটি আর মেঘ আলাদা। মেঘ ভাবি নিজে বলেছে ও বাইক চালাতে পারে না।”
রুদ্রের কথা শুনে রোদ আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। রুদ্র হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে কিন্তু রোদ ফোন রেখে থ মেরে গেলো। তার ধারণা, বিশ্বাস এতটা ভুল হতে পারে তা সে মানতে ই পারছে না। জান্নাত বলে উঠলো,” কে কল করেছিলো? তুমি চুপ করে কেনো? ”
রোদ একবার জান্নাতের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে উঠে নিজের ঘরে চলে আসলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের হাতে আঘাত করে বললো, “এইটা কিভাবে সম্ভব! তাহলে অন্য কাউকে এতদিন কল্পনা করেছি। না মেঘ এইসব বুঝলে কষ্ট পাবে।”
বলেই আলমারি খুলল। বললো, বাইকারের ড্রেস আর বাইকের চাবি এখনই সরে ফেলতে হবে। জীবন থেকে ওই অধ্যায় মুছে ফেলতে হবে কারণ আমার মেঘ কে ছাড়া আমার জীবনে আর কারো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। রোদ পুরো আলমারি খুঁজেও ড্রেস আর চাবি পেলো না। চিন্তায় মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে। বাইক টা তো অফিসে রাখা আছে আর কাল পর্যন্ত আলমারি তেই জিনিস গুলো ছিল। তাহলে কে নিলো এই প্রশ্ন মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছে রোদের। এর মাঝে দরজার সামনে আয়রা আর ঈশান এসে দাঁড়িয়ে পড়লো আর রোদ কে ডাকছে। রোদ দরজা খুলে দিতেই ওরা ঘরে এসে বললো,
-“ভাইয়া মেঘ বাড়িতে যায় নি দিহান কল করে বললো। ভাইয়া মেঘের কোনো বিপদ হয় নি তো?”
ঈশান আর আয়রার দিকে তাকিয়ে রোদ দরজা বন্ধ করে দিলো। ওদের মাথায় হাত দিয়ে বললো, “প্লিজ তোরা কোনো সীন ক্রিয়েট করিস না। আমার উপর তো তোদের বিশ্বাস আছে তাইনা? মেঘ সেভ আছে আর সময় মত সবকিছু জানতে পারবি ততক্ষণ একটু নীরব হয়ে থাক তোরা।”
ঈশান আর আয়রা একে উপরের দিকে তাকালো। রোদের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। রোদ একটু হেসে নিচে গেলো। রোদ নিচে যেতেই রোজা চৌধুরী রোদের সাথে কথা বলতে যেতেই আদিল চৌধুরী বললো,” রোজা আমি সবাই কে বারণ করেছি ওর সাথে কথা বলতে। ”
রোদ সেদিকে নজর না দিয়ে জান্নাতের কাছে গিয়ে বললো,”পায়েল একটু পর রেডি হয়ে নাও তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো।”
ইহানা টেবিলে বসে রোদের দিকে একবার তাকিয়ে ইশা চৌধুরীর দিকে ছল ছল করে তাকালো। সে আর নিতে পারছে না। কেনো যেনো ইহানা আর চুপ করে থাকতে পারল না। নিচু গলায় বললো,” ভাবি কে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারলে ভাইয়া?”
রোদ ইহানার কথায় ইহানার দিকে তাকালো। এই প্রথম ইহানা রোদ কে ভাইয়া বলে ডাকল। রোদের ভালো লাগলো এইটা ভেবে যে ইহানা ঠিক পথে আসছে। ইহানার কথার কোনো উত্তর দিলো না রোদ আর ইহানাও উত্তরের অপেক্ষা না করে দৌড়ে চলে গেলো। পরিবেশ টা থমথমে রূপ ধারণ করেছে খেয়াল করে ইশা চৌধুরী বললো,
–‘ যাও পায়েল রেডি হয়ে নাও।’
জান্নাতও সেই কথা মত রেডি হতে গেলো। রোদ চেয়ার এগিয়ে নিয়ে বসে মাথায় হাত দিলো। চিন্তায় তার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। চোখ থেকে দু ফোটা পানি পড়লো সবার গোপনে। এর মাঝেই অনুভব করলো রোদের মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রোদ মাথা তুলে দেখলো মৌ ইসলাম। রোদ স্বাভাবিক হয়ে বললো,
-“বস আন্টি।”
মৌ ইসলাম বসল। গলার স্বর বসে গেছে কেঁদে কেঁদে, চোখ মুখ ফুলে গেছে। রোদের প্রচণ্ড খারাপ লাগা কাজ করছে। মৌ ইসলাম রোদের হাতে হাত রেখে বললো,” বাবা মেঘ কে ফিরিয়ে অান। মেয়েটার ফোনে কল করেও পেলাম না। বড্ড অভিমানী মেয়েটা।”
রোদ চোখের ইশারায় যেনো আস্থা দিলো মৌ ইসলাম কে কিন্তু মুখে বললো, “আমি তোমার মেয়েকে ছোট বেলা থেকে ভালোবাসি আন্টি। ওকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে আমি চাই না।”
মৌ ইসলামের মুখ আরো মলিন হয়ে গেলো। রোদ আর সেখানে থাকলো না জান্নাত কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মৌ ইসলামের কাছে রোজা চৌধুরী এসে বসল। দুজনের চিন্তা একই। মেঘের ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে রোজা চৌধুরী প্রতীক হাসানের কাছে কল করলো কিন্তু সবকিছু বললো না। প্রতীক হাসান বললো মেঘ যায় নি। কথাটা শুনে আরো চিন্তায় আর ভয়ে ভরে গেলো বাড়ি যেনো। শুধু ইশা চৌধুরী কথাটা শুনে বেশ খুশি হলো।
__________
গাড়িতে রোদের পাশে জান্নাত বসে আছে। যাত্রা পথে রোদ জান্নাতের সাথে কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ বাদে একটা বিল্ডিং এর সামনে গাড়ি থামিয়ে জান্নাত কে নামতে বললো। জান্নাত নেমেই উক্ত ভবনে সিআইডি লেখা দেখে ভয় পেয়ে গেলো। কাপা কন্ঠে বললো,
–“কোথায় এনেছেন আমাকে?”
রোদ কোনো কথা না বলে জান্নাতের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো। জান্নাত ভয়ে কান্না পর্যন্ত শুরু করে দিয়েছে। রোদ কে দেখেই অন্য সিআইডি রা উঠে দাঁড়ালো। রোদের চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে।
অর্চি কে মেঘ সবকিছু বলছিল আর গল্প করছিলো এমন সময় কাঁচের অপাশে রোদের রাগী চেহারা দেখে ছুটে বেরোল মেঘ আর অর্চি। মেঘ কে দেখেই রোদ জান্নাত কে ঝাড়ি দিয়ে মেঘের দিকে এগিয়ে দিল। জান্নাত কান্না করছে দেখেই মেঘ জান্নাত কে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো আর রাগী দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ও কান্না করছে কেনো? আপনাকে বলেছিলাম তো ওকে কিছু বলবেন না।’
‘আমি ওকে কিছু বলিনি। এখন কথা না বাড়িয়ে সত্যি টা ও বলবে নাকি আমি কিছু করব তা বল।’
মেঘ বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আপ্নার কিছু করতে হবে না। রুদ্র ভাইয়া, আপনি ভেতরে আসুন। আর কেউ যেনো না আসে।’
বলে মেঘ জান্নাত কে ভেতরে নিয়ে গেলো। ভেতরে যেতেই জান্নাত আরো জোরে কান্না শুরু করে বললো,’ আপু সত্যি আমি জানতাম না আমাকে তোমার বিরুদ্ধে কিছু করতে হবে। আপু আমার যে কোন উপায় ছিল না। আপু আমায় ক্ষমা করে দাও আপু। ‘
মেঘ জান্নাতের চোখের জল মুছে দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,’ পাগলি একটা কান্না করছো কেনো? আমি জানি তো এত মিষ্টি একটা মেয়ে এমনি এইসব করেনি। কেনো এইসব করেছো? ‘
রোদ আর রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তাকিয়ে জান্নাতের চোখে ভয় ফুটে উঠলো। মেঘ তা বুঝতে পেরে জান্নাতের কাঁধে হাত রেখে বললো, “চিন্তা করো না উনি তোমার কিছু করবেন না আমি কথা দিলাম। তুমি শুধু সত্যি টুকু বল।”
অর্চি বললো, “হ্যাঁ বল না জান্নাত।”
জান্নাত কান্না থামিয়ে বললো, “আপু আমার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাবাই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ আমাদের পরিবারের। আমার কোনো ভাই নেই, ছোট একটা বোন আছে। জায়গা – জমি বিক্রি করেও বাবার চিকিৎসা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব আমি? নিজের চোখে তিলে তিলে বাবা কে তো মরতে দিতে পারি না। এমন সময়ে অবুঝ চৌধুরী আমাকে বলে একটা কাজ আছে যার জন্য দশ লক্ষ টাকা দিবে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও রাজি হয়ে যাই। কিন্তু যখন দেখলাম তোমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে আমি নিজের ভেতরে মরে যাচ্ছিলাম বিশ্বাস করো।”
মেঘ রোদের দিকে তাকালো। রোদ বললো,” হুম ও ঠিক বলছে ওর বাবার ক্যান্সার হয়েছে। ”
মেঘ মলিন মুখে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,” ওর বাবার চিকিৎসা খরচ কি আপনি দিতে পারবেন? আর না দিতে পারলেও সমস্যা নেই আমি পাপ্পা কে বললে উনি দিবেন। ”
মেঘের এই কথায় রোদ রেগে গিয়ে বললো, “তুমি আমার স্ত্রী আর আমাকে জিজ্ঞেস করছো? আমার আর তোমার টাকা ভিন্ন নয় মেঘপরী। আজ থেকে যেনো এমন কথা না শুনি। আর জান্নাতের বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা আমি করব।”
জান্নাতের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এইদিকে অর্চি কাশি দিয়ে মেঘ কে নাড়া দিয়ে বললো, “বাহ মেঘ! দুলাভাই তো তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কি নাম যেনো বললো? মেঘপরী… ”
রোদ লজ্জা পেয়ে গেলো আর মেঘ রেগে গিয়ে অর্চি কে কয়েকটা পিটুনি দিলো। এইবার রোদ serious হওয়ার মতো করে বললো,” অনেক হয়েছে এখন বাসায় যেতে হবে। দুপুর বেলা সবাই বাসায় থাকবে তাই তাড়াতাড়ি তোমরা রেডি হয়ে নাও সবকিছুর জন্য। ”
____________
চৌধুরী বাড়িতে চিন্তার চাদর জড়িয়ে আছে। মেঘ কোথায় সে কথা কেউ জানে না। নীল ইসলাম ও মেঘের খবর পাওয়া যাচ্ছে না শুনে চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। মিমি হাসান, প্রতীক হাসান আর তাদের সাথে দিহানও এনেছে। মিমি হাসান, মৌ ইসলাম আর রোজা চৌধুরী কান্না কাটি করছে। ঈশান আর আয়রা কে শান্ত লাগছে আগের চেয়ে। দিহান কে বেশ চিন্তিত লাগছে। অবুঝ চৌধুরী সবার সাথে তাল মিলিয়ে চিন্তার ভান করছে। নীল ইসলাম সহ সবাই বারবার রোদ কে কল করছে কিন্তু প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ রোদ ফোন তুলছে না। একবার ফোন করে বলেছে কেউ যেনো পুলিশে খবর না দেয়। মিমি হাসান কান্না করতে করতে বললো,
” মেঘের বাবা এখনই পুলিশে খবর দাও। রোদ কোথায় কে জানে! আমার মেঘ কে খুঁজে পেতে হবে ই। আমার মেঘের যদি কিছু হয় আমি রোদ কে ছেড়ে কথা বলব না বলে দিলাম।”
মিমি হাসানের কথা শেষ হইতেই উনার কানে মেঘের গলা আসলো। মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে, “মাম্মা আমি এসেছি আর কাউকে কিছু করতে হবে না। ”
মেঘের কথায় সবাই ওর দিকে তাকালো। সবার মুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস এলো কিন্তু অবুঝ চৌধুরী আর ইশা চৌধুরীর যেনো বারা ভাতে ছাঁই পড়লো এমন অবস্থা। সবাই মেঘের কানে গিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলো কোথায় ছিল ও? সবাই চিন্তা করছিলো এইসব। মেঘ কোন উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। মৌ ইসলাম এইসব প্রশ্ন না করে মেঘ কে আগে বসিয়ে দিয়ে বললো,
“মা কিছু খেয়েছিস? এইভাবে উধাও হয়ে গেলে সবাই চিন্তা করে বুঝিস না কেনো? একজনের উপর অভিমান করে উল্টা পাল্টা কিছু করা ঠিক না।”
মেঘ মনোযোগ দিয়ে মৌ ইসলামের দিকে তাকিয়ে উনার সব কথা শুনছেন আর ভাবছে মা হয়তো এমন ই হয়। অবুঝ চৌধুরী মেঘের পাশে এসে বললো, “এমন চিন্তায় ফেলেছিলে তুমি মেঘ। আর কখনো হারিয়ে যেও না। ”
মেঘ আড় চোখে ইশা চৌধুরী কে দেখে অবুঝ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো, “আমার কি আর দোষ বলুন চাচ্চু। যা হয়েছে সব তো আপনার জন্য ই।”
অবুঝ চৌধুরী মেঘের কথায় ভরকে গেলো। সবাই মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতীক হাসান আর মিমি হাসান স্বাভাবিক আছে শুধু। অবুঝ চৌধুরী ভয় লুকিয়ে বললো,”মজা করছো মেঘ? আমার জন্য মানে?”
“তোমার জন্য ই তো অবুঝ চৌধুরী।”- বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে রোদ বললো। রোদের সাথে রুদ্র আর পেছনে অর্চি আর জান্নাত। অবুঝ চৌধুরী রোদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“কি যা তা বলিস তুই। তোদের মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”
-“আমাদের মাথা একদম ঠিক আছে। এইবার তো তোমার মাথা খারাপ হবে। ”
নীল ইসলাম বললো,” রোদ কোনো কথায় বুঝতে পারছি না। একটু সোজা ভাবে বলবে বাবা?”
রোদ মুখে বাঁকা হাসি ফুটে তুললো। বললো, “এইযে কাল হুট করে যে মেয়ের আবির্ভাব হয়েছে সে পায়েল নয় যে জান্নাত। আর এই মেয়েকে পায়েল সেজে নিয়ে এসেছে অবুঝ চৌধুরী। ”
সবাই থ মেরে গেলো কথাটা শুনে। ইশা চৌধুরী আর অবুঝ চৌধুরী একসাথে বললো,” রোদ মজা করার সীমা পার করে যাস না।”
রোদ চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করে বললো,” রুদ্র লোক টা কে নিয়ে আয়। ”
রুদ্র একটা লোক কে নিয়ে আসলো। লোক টা কে দেখে অবুঝ চৌধুরী আরেকটু ভরকে গেলো। রোদ লোক টি কে দেখিয়ে বললো, “দেখো তো এই লোক কে চিনতে পারো?”
অবুঝ চৌধুরী বললো,” না আমি এই লোক টা কে চিনি না।”
লোক টা সাথে সাথে বললো, “স্যার মিথ্যা বলছেন কেনো? আপনি ই তো আমাকে কাল রাতে ওই মেয়েকে ধাক্কা দেয়ার জন্য বলেছিলেন।”
আদিল চৌধুরী এগিয়ে আসলো। রোদ কে বললো,”এইসব কি হচ্ছে?”
রোদ শান্ত গলায় বললো,” বাবা কাল মেঘ বাড়ি থেকে যাওয়ার পর চাচ্চু মেঘ কে মারার প্ল্যান করে। শুধু এই না, নীল আঙ্কেল আপনাদের মেয়েকে ছোট বেলায় ইনি ই কিডনাফ করে আর তাঁকে নদীর জলে ফেলে মারতে চায়।”
রোদের কথা শুনা মাত্র মৌ ইসলাম ডুকরে কেঁদে উঠে নীল ইসলামের কাঁদে মাথা দিয়ে বললো, “আমাদের মেয়ে তাহলে আর এই পৃথিবীতে নেই নীল ।”
নীল ইসলামের বুকের মাঝে কষ্টের আনল জ্বলছে। মৌ ইসলাম কে শান্ত করার চেষ্টা আজ করছে না। নীরবে চোখের জল ফেলছে। ইহানা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে কথা গুলো শুনে। তার বাবা মা এমন সে কল্পনাও করেনি। অবুঝ চৌধুরী এইবার রেগে বললো,
-” যা না তা বলার সাহস কিভাবে পাস তুই রোদ। প্রমাণ কোথায় তোর কাছে?”
চলবে….
#মনের_গহীনে_শুধুই_তুমি
#পর্ব_34 (#শেষ_অংশ)
#Mst_Meghla_Akter_Mim
রোদ বাঁকা হেসে বললো,” আমি প্রমাণ ছাড়া কিছু বলি না। তোমার কাল কের অপরাধের প্রমাণ জান্নাত আর এই ড্রাইভ টা। আর রইলো পায়েলের কথা!”
আদিল চৌধুরী রোদের কথা শেষ না হতে ই অবুঝ চৌধুরীর গালে স্বজোরে একটা থাপ্পড় দিলো। অবুঝ চৌধুরী রেগে গিয়ে উল্টে আদিল চৌধুরী কে থাপ্পড় তুলতে গেলো। তখন ই মেঘ এসে উনার হাত ধরে নেয়। আদিল চৌধুরী কল্পনা ও করেনি অবুঝ চৌধুরী তার গায়ে হাত তুলতে নিবে। মেঘের দিকে অবুঝ চৌধুরী রক্ত চক্ষু করে তাকিয়ে আছে। মেঘ উনার হাত নামিয়ে রেখে বললো,
–” চাচ্চু আর কত খারাপ হবেন? ওই দেখুন ঈশান থমকে গেছে এইসব জানতে পেরে। ইহানা, ঈশানের কি এইসব শুনে ভালো লাগছে? কেনো করেছেন এইসব আপনি? ছোটবেলায় আমাকে কেনো মা বাবা ছাড়া করেছেন চাচ্চু? কি দোষ ছিল আমার?”
মেঘের কথা শুনে মৌ ইসলাম কান্না থামিয়ে ফেললো। ইশা চৌধুরী বললো,” তাহলে সত্যি তুমি ই…”
মেঘ চিৎকার করে বললো,” হ্যাঁ আমি ই সেই মেয়ে যাঁকে আজ থেকে ষোলো বছর আগে পানি ফেলে মারতে চেয়েছেন আপনারা। আমি ই পায়েল আর আমার বাবা মার মেঘ।”
মৌ ইসলামের কাছে গিয়ে মিমি হাসান উনার কাঁধে হাত রেখে বললো, “হুম আপা এইটাই আপনার মেয়ে। আমাদের কোনোদিন সন্তান হয় নি। প্রতীক ওকে নদীর জল থেকে বাঁচিয়েছিল।”
রোজা চৌধুরী, আয়রা, দিহান সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মৌ ইসলাম কান্না থামিয়ে নীল ইসলামের দিকে তাকালো। তাদের আর কান্না করা উচিত নয়। প্রিন্স তো মহা খুশি। কিন্তু ঈশান দুমরে মুচরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অবুঝ চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললো,
–‘বাবা সত্যি এইসব? তুমি এমন কাজ করেছো বাবা? বল না।’
ঈশান অবুঝ চৌধুরীর হাত ধরে কথা গুলো বললো আর ওর চোখ পানি তে ধাপসা হয়ে আসছে। অবুঝ চৌধুরীর উত্তর না পেয়ে চিৎকার দিয়ে বললো, “বাবা উত্তর দাও।”
অবুঝ চৌধুরী এতক্ষণ চুপ থাকলেও আর চুপ থাকতে পারল না। ঈশান কে সরিয়ে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ আমি ই করেছি সবকিছু।”
ঈশান কথাটা শুনে পরে যেতে নিলো। রোদ ওকে শক্ত করে ধরলো। অবুঝ চৌধুরী আবারো বললো,” কিন্তু কেনো করেছি? কার জন্য করেছি? সবকিছু তো তোর জন্য করেছি ঈশান।”
ঈশান শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বললো, “কিসের আমার জন্য। তোমাকে এইসব কে করতে বলছে।”
ইশা চৌধুরী বললো,” তোর জন্য ই তো। আর মা বাবা কে বলে দিতে হয় না। এই বাড়ির সব সম্পত্তি রোদের নামে তাহলে তোর কি হতো ঈশান? সারাজীবন কি এদের দয়ায় বেঁচে থাকতি? তাই আমরা পায়েল কে সরিয়ে ইহানার সাথে রোদের বিয়ে দেয়ার কথা ভেবেছিলাম যাতে সব সম্পত্তি আমাদের হয়।”
আদিল চৌধুরী হেসে অবুঝ চৌধুরীর সামনে এসে বললো,” বাহ ভাই। এই সামান্য সম্পত্তির জন্য তুই এত বড় কাজ করলি? আমাকে বললে তোকে সবকিছু দিয়ে দিতাম। আর তোকে কে বলেছে রোদের সবকিছু? আরে আমাদের চার সন্তানের সমান ভাগ আছে এই সম্পত্তি তে। তুই কোনোদিন জিজ্ঞেস তো করতে পারতি আমায়। এতবড় খেলা কেনো খেললি?”
অবুঝ চৌধুরী চুপ করে আছে। তার আজ আর কিছুই বলার নেই। বড় ভাইয়ের উপর থেকে এই বিশ্বাস উঠে যাওয়ার কারণে এইসব ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু এইসব কিছু অবুঝ চৌধুরীর মাথায় ঢুকিয়েছিল ইশা চৌধুরী। অবুঝ চৌধুরী ক্লান্ত চোখে ইশা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
–” তুমি বলেছিলে ভাই আমাদের বঞ্চিত করবে কিন্তু দেখলে আজ? শুনলে তো ভাইয়ের মুখে সবকিছু সবার। তোমার জন্য আমি ভুল পথে পা বাড়িয়ে এত বড় ভুল করেছি।”
ইশা চৌধুরী আর অবুঝ চৌধুরী অপরাধীর চোখে কাঁদছে। মেঘের একদম ভালো লাগছে না ঈশানের জন্য। অবুঝ চৌধুরী রোদের কাছে গিয়ে বললো,” রোদ পুলিশ কে কল কর। আমাদের শাস্তি পাওয়া উচিত।”
রোদেরও ভালো লাগছে না উনাদের দেখে। চুপ করে আছে রোদ। অবুঝ চৌধুরী ফোন বের করে বললো,” আমি ই কল করছি।”
রোদ অবুঝ চৌধুরীর হাত ধরে বললো,” চাচ্চু পুলিশ কে কল করতে হবে না। আমি নিজেই একজন সিআইডি!”
রোদ সিআইডি শুনে সবাই আবার অবাক হয়ে গেলো। আজ শুধু সবাই অবাক ই হচ্ছে। অবুঝ চৌধুরী আর ইশা চৌধুরী ও অবাক হয়ে গেলো। রোদ বললো,
–“আমি একজন সিআইডি কথাটা আব্বু ছাড়া কেউ জানত না। তবে চাচ্চু ভুল তো ভুল ই তাইনা? তোমরা আমার পরিবার এই জন্য শাস্তি না দেয়াটাও তো অপরাধ। কিন্তু চাচ্চু আমি কথা দিচ্ছি তোমাদের শাস্তি পাওয়া হয়ে গেলে আবার সবাই একসাথে আগের মত থাকবো।”
অবুঝ চৌধুরী ঈশানের কাছে গেলো কিন্তু ঈশান কথা বললো না। রুদ্র অবুঝ চৌধুরী আর ইশা চৌধুরী কে সাথে নিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে আদিল চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চাইলো। আদিল চৌধুরীও কথা দিলো সে ফিরলে আবার একসাথে সবাই হাসি খুশি থাকবে আর ঈশান আর ইহানার খেয়াল রাখবে।
ঈশান নিজেকে সামলে নিয়ে ইহানার কাছে আসতেই ইহানা কেঁদে ফেললো। ওদের দুজনের কাছে রোজা চৌধুরী গিয়ে সান্ত্বনা দিলো। এদিকে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে মৌ ইসলাম আর নীল ইসলামের দিকে তাকিয়ে। মৌ ইসলাম হাত বাড়িয়ে বললো, “আয় মা।”
মেঘ দৌড়ে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলো। আজ সবাই সবকিছু ফিরে পেলো। প্রিন্স ও অনেক খুশি। ঈশান আর ইহানার একটু মন খারাপ। এর মাঝেই রোদ চুপ করে দাঁড়িয়ে সবাই কে দেখছে। দিহান রোদের কাছে গিয়ে বললো,
–“আপনি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন যে।”
রোদ নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, “আরো কয়েক জন কে শাস্তি দেয়ার আছে।”
সবাই রোদের দিকে তাকালো। ঈশান বললো, “আবার কে কি করেছে ভাইয়া?”
রোদ পকেটে হাত রেখে বললো,” কে আবার আদিল চৌধুরী!”
সবাই বললো,” উনি কি করেছেন?”
আদিল চৌধুরী শুধু এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে। রোদ আদিল চৌধুরী কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,” কি ব্যাপার আপনি চুপ কেনো? কি করেছেন জানেন তো?”
আদিল চৌধুরী রোদের হাত সরিয়ে বললো,” বাপের সাথে তোর জীবনে মিলে না তাই আজ আমাকে অপরাধী বানাতে চাস।”
রোদ মুখে হাসি টেনে বললো, “তুমি অপরাধী ই।”
মেঘ রেগে বললো, “আপনার সমস্যা কি বলুন তো? বাবার সাথে এমন করেন কেনো?”
রোদ বললো,” আরে তুমি আগে সবকিছু শুন। গ্রামের লোকজন আমাদের বিয়ে এমনি দেয় নি। বাবার প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের বিয়ে হৈছে। আর সবচেয়ে বড় কথা বাবা জানতো তুমি ই পায়েল। আর আমার শ্বশুর মশাইও!”
রোদের কথায় সবাই আদিল চৌধুরী আর প্রতীক চৌধুরীর দিকে তাকালো। কিন্তু তারা দুজন যেনো কিছুই জানেন না তেমন করে দুজনেই হাসি দিলো শুধু। মেঘ উনাদের সামনে গিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,” পাপ্পা আর বাবা সত্যি এইসব?”
প্রতীক হাসান বসে বললো,” আমি কিছুই বলব না আদিল ভাই বলুক।”
মেঘ আদিল চৌধুরীর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আদিল চৌধুরী হাসার চেষ্টা করে বললো, “আসলে হয়েছে কি তোকে একদিন রাস্তায় মারপিট করতে দেখেছিলাম তখন ই তোকে আমার পছন্দ হয়ে যায়। তারপর প্রতীক ভাইয়ের কাছে গেলে উনি তোর ব্যাপারে মানে পায়েল সম্পর্কে বলে তখন আমি জেনে যায় তুই পায়েল। আর এইদিকে তুই বিয়ে করবি না এমন ইচ্ছা সেজন্য আর কি করব এইভাবে বিয়ে টার প্ল্যান করেছিলাম।”
বলে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,” কিন্তু তুই কিভাবে জানতে পারলি?”
রোদ ভ্রু নাচিয়ে বললো,” আমি তোমারই ছেলে তো। সিআইডি বেশে গ্রামের মানুষ দের থেকে জেনেছি আর তুমি সবকিছু জানো তা জানতে পেরেছি তিন দিন আগে। প্রতীক আঙ্কেল কে মিথ্যা বলে সবকিছু জেনেছি।”
এদের কথা শুনে সবাই আজ শুধু অবাক ই হচ্ছে। মেঘ মুখ ফুলিয়ে বললো,” সবাই সব জেনে বসে আছো আর আমায় শুধু কষ্ট দিয়েছ। যাও কারো সাথে কথা নেই।”
বলেই মেঘ চলে যেতে নিলো আর মেঘ ওর হাত ধরে কাছে টেনে বললো,” আমার ভালোবাসার বন্ধন থেকে তোমার মুক্তি নেই মেঘপরী।”
দিহান কাশি দিয়ে বললো, “এইখানে সবাই আছে কিন্তু।”
তখন ই রোদ মেঘ কে ছেড়ে দিলো আর দুজনেই লজ্জা পেলো। নীল ইসলাম এর মাঝে বললো,” অ্যাটেনশোন প্লিজ!”
সবাই উনার দিকে তাকালো। উনি মুখে হাসি ফুটে মেঘ কে কাছে ডাকল। মেঘ উনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আর উনি বললেন,” তোমাদের সব কথা শুনেছি কিন্তু আমি আমার মেয়েকে এই ছেলের কাছে দিবো না। আমি আমার মেয়ের আবার বিয়ে দিবো।”
মেঘ মুখ বাঁকা করে বললো, “বাবাই কিন্তু ও তো আমার স্বামী।”
‘হুম জানি তো ।’
আদিল চৌধুরী বললো,” এই নীল মেঘ আবার বউ মা। অন্য কোথাও বিয়ে দিবে মানে কি?”
নীল ইসলাম আর মৌ ইসলাম মৃদু হেসে বললো,” অন্য কোথাও বিয়ে দিবো কে বলেছে? রোদের সাথে আবার সব নিয়ম মেনে বিয়ে দিবো।”
সবাই কথাটা শুনে খুশি হল। রোজা চৌধুরী বললো,” উফ ভয় পেয়ে দিয়েছিলি তো তুই।”
মৌ ইসলাম ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই ভয় পাস তো সবকিছুতেই।”
রোজা চৌধুরী মুখ ভেঙ্গচি দিলো।
__________
তিন দিন পর মেঘ আর রোদের বিয়ে হয়ে গেলো। এর মাঝেই মেঘ দিহান আর আয়রার কথা সবাই কে বলে আর সবাই মেনে ও নেয়। দুজনের পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে। আর জান্নাতের কোনো শাস্তি হয় নি। মেঘ ভেবে রেখেছে ঈশানের পছন্দের মেয়ের কথাও সবাই কে বলবে কিন্তু এখন না কারণ ঈশানের মন এখন ভালো নেই। তিন দিন মেঘ নীল ইসলামের বাড়িতে ছিল রোদের তো মেঘ কে না দেখতে পেয়ে করুন অবস্থা। বিয়ের সবকিছু শেষ করে রাত দশ টায় রোদ বাসর ঘরে ঢুকলো।কিন্তু ঘরে এসে দেখলো মেঘ নেই। কোথায় গেলো মেঘ? রোদ পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মেঘ কে পেলো না। চিন্তা হতে লাগলো এমন সময়ে ফোনে একটা এসএমএস আসলো। এসএমএস এ লেখা আছে “মিস্টার রোদ্দুর চৌধুরী আপ্নার বাড়ি থেকে দশ মিনিট যাওয়ার পর পুকুর পাড়ে একটা খোলা জায়গা আছে ওখানে চলে আসুন। এইখানেই আপনার বউ আছে।”
রোদ আর দেরি না করে ছুটল বাড়ি থেকে। কেউ কি মেঘের আবারো ক্ষতি করতে চায় এইসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। রাস্তার মাঝে উন্মাদের মত ছুটতেই রোদ দেখতে পেলো তার সামনে দিয়ে সেই লেডি বাইকার বাইক নিয়ে যাচ্ছে। রোদের মাথার ভেতরে আরো চক্কর দিয়ে উঠলো। একদিকে মেঘ আর অন্য দিকে এই বাইকার লেডি কে তা জানার ইচ্ছা। রোদ খেয়াল করলো বাইকার লেডি কিছুক্ষণের মধ্যেই যেনো উধাও হয়ে গেলো। রোদ আর সেই লেডির কথা মাথায় না এনে মেঘের জন্য ছুটল। কাঙ্খিত জায়গায় এসে রোদ থেমে গেলো। সামনে শুধু অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফোন বের করে ফ্ল্যাশ লাইট অন করতে নিবে তখন ই একটা আলোর আভা রোদের চোখে আসলো। রোদ চোখে হাত দিয়ে সেই আলো আটকাতে চেষ্টা করতেই আলো টা গিয়ে পুকুরের পাশের গাছের পাশে গেলো। রোদ খেয়াল করলো গাছের পাশে সেই লেডি বাইকার মেয়েটি হেলমেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর পাশে বাইক টা। রোদ আলতো পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো কিন্তু আবার থেমে গিয়ে চিৎকার করে বললো,
–” মেঘ কোথায় তুমি?”
কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না। কোথায় থেকে যেনো মেঘের গলা ভেসে আসলো। ‘ আমাকে ডেকে পাবে না চিনে নিতে হবে প্রিয়। আমি তোমার কাছে থেকেও কি এত দূরে যে খুঁজে নিতে এত দ্বিধা?’
রোদ আস্তে করে সেই লেডি বাইকারের কাছে গিয়ে কাঁপা হাতে কাঁধের দিকে হাত বাড়াতেই মেয়েটি মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে রোদের দিকে ফিরে তাকালো। রোদ দু পা পিছিয়ে গেলো। কাঁপা গলায় বললো,” মে… মেঘ তুমি ই!”
মেঘ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, “কেনো? অন্য কেউ হলে খুশি হতেন বুঝি?”
রোদ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,” কিন্তু তুমি তো বাইক চালাতে পারো না তাই বলেছিলে রুদ্র কে। আর এইভাবে হুট করে কেউ না বলে বেরিয়ে আসে?”
মেঘ রোদের গলায় দু হাত দিয়ে মিষ্টি করে বললো,” আগে যদি বলতাম তাহলে suprise আর থাকতো নাকি? আর আপনি আমার পরিচয় জেনেও না জানার অভিনয় করেছেন তাই আর কি আমিও করলাম একটু।”
রোদ মেঘের গালে হাত দিয়ে বললো,” আমি তাহলে ঠিক চিনেছিলাম আমার মেঘ কে তাইনা। আমার মনমহিনী আমার মনের গহীন শুধুই তুমি আছো আমি জানতাম। আমি ভুল ছিলাম না।”
মেঘ মাথা নারাল। রোদ হুট করে মেঘ কে জড়িয়ে ধরলো আর বললো,” তাহলে বাইকের চাবি তুমি ই ছড়িয়ে রেখেছিলে! ভালোবাসি মেঘপরী।”
মেঘ আস্তে করে বললো,” হুম। ”
কিছুক্ষণ পর রোদের সামনে একটা হেলমেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,” চলুন লং ড্রাইভ এ যায়? আপনি, পায়েল আর আপ্নার সেই লেডি বাইকার আর আমি।”
রোদ হেলমেট নিয়ে বললো,” পায়েল, লেডি বাইকার আর মেঘ সব তো তুমি ই।”
মেঘ হাসল। বাইক স্টার্ট দিয়ে বললো, “ভয় পাবেন না তো এই লেডি বাইকারের বাইক চালানো দেখে? আমি কিন্তু খুব একটা চালাতে পারি না।”
রোদ পেছন থেকে মেঘ কে জড়িয়ে ধরে বললো,” এখন তো তুমি আমার। তাই মরে গেলেও কোনো আফসোস থাকবে না।”
মেঘ বললো,” উম হুম মরে গেলে হবে না। একসাথে আরো বহুদিন বাঁচতে চাই।”
রোদ শক্ত করে মেঘ কে ধরলো আর মেঘ বাইক চালাতে থাকলো। এইভাবে পুরো রাত বাইক আর গল্প দিয়েই কেটে গেলো। দুটো মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো।
– – – – – – – সমাপ্ত – – – – – – – – – – –