মনের গহীনে শুধুই তুমি পর্ব-৩১

0
1316

#মনের_গহীনে_শুধুই_তুমি
#পর্ব_31
#Mst_Meghla_Akter_Mim

ঝড়োবৃষ্টিতে চারিদিকে তুমুল শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টির বেগ কমার কোনো নাম নেই, বেড়েই চলেছে। রাস্তার পাশের গাছ দুলছে ঝড়ের তালে তালে। ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোর হলুদ আভা রাস্তায় কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে, সাথে চাঁদের আলোও রয়েছে। এর মাঝে ল্যাম্পপোস্টের পাশ দিয়ে নিজতেজ শরীর নিয়ে হাঁটছে মেঘ। বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে সেদিকে তার নজর ই নেই। চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেঘ বাবার বাড়িতে যায় নি, তার যেতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছিলো এই বৃষ্টির মাঝে নিজের কষ্ট বিলিয়ে দিতে। চৌধুরী বাড়িতে নিজেকে ঠিক রাখলেও আর পারছে না মেঘ নিজেকে ঠিক রাখতে। চোখ বেয়ে নোনা জল পড়ছে কিন্তু তা প্রতিলজ্ঞ হচ্ছে না বৃষ্টির জন্য। যে মেয়েটা বৃষ্টি তে ভিজতে পারে না সে আজ এই বৃষ্টির পানি তে রয়েছে প্রায় ত্রিশ মিনিট। আপন মনে হেঁটে চলেছে যেনো বাস্তব জগতের বাহিরে সে। হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে এখন আরো ক্লান্ত লাগছে। অবশেষে আর পা বাড়াতে পারলো না! রাস্তার মাঝে পড়ে গেলো মাথা ঘুরে! এত চিন্তা আর মানসিক যন্ত্রণা আর এই শরীর বোধহয় নিতে পারছে না। মেঘ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মেঘ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, এতক্ষণ কান্না করলেও মেঘ নীরব ছিল। কান্না করতে করতে মেঘ নিজে নিজে বললো,

–“কেনো আমার ভাগ্য এমন? রোদও আজ আমায় এভাবে অপমান করলো! আমি আর পারছি না।আমি আর বাঁচতে চাই না। নিজের মা বাবা অন্য একজন মেয়েকে নিজের মেয়ে ভাবলো। এ কেমন জীবন দিলে আমায়?”

মেঘ উঠতে নিলো আবারো। দুবার পড়ে যেতে নিলো তৃতীয়বার উঠতে সক্ষম হল। উঠে দু পা যাওয়ার আগেই মেঘের চোখে আলো এসে পড়লো। মেঘের চোখ এই আলো নিতে পারছে না। দু হাত চোখে দিয়ে আলো আটকাতে চেষ্টা করল। এদিকে মেঘ খেয়াল ই করেনি এটি একটা কার। একটু পর বুঝতে পারলো তখন কার টি ঠিক মেঘের সামনেই মেঘ সরে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই ঠিক সে সময় ই কেউ একজন এসে মেঘ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিলো। মুহূর্তে ই গাড়ি টি চলে গেলো। ধাক্কায় মেঘের কপালে চোট লাগলো মেঘ শুধু ধাপসা ধাপসা দেখলো হেলমেট পড়া কেউ তার সামনে। এর পর মেঘ আর কিছু দেখতে পেলো না।
_______________
চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে। সোফায় বসে একপাশে রোজা চৌধুরী চোখের জল ফেলছে তার পাশেই আয়রা মন খারাপ করে বসে আছে। আদিল চৌধুরীও মন মরা হয়ে বসে আছে। মৌ ইসলাম আর নীল ইসলাম মেঘের যাওয়া মেনে নিতে না পেরে ঘরে গেছে অনেক আগেই। সবার মন খারাপের মধ্যেও ইশা চৌধুরী বেশ খুশি। উনি পায়েল কে খাবার খাওয়া তে ব্যস্ত, আজ উনার যেনো আনন্দের শেষ নেই। ইহানাও খাচ্ছে। ঈশান রেগে ইশা চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললো,

–“একটা মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো শুধুমাত্র এই মেয়েটির জন্য আর তুমি এত আনন্দ কোথায় থেকে পাচ্ছ মা?”

ইশা চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললো, “আমার সবকিছুতে তোর ভুল না ধরলে হয় না ঈশান? দেখছিস মেয়েটা খাচ্ছে তাও এত কিসের কথা!”

ঈশান ইহানার দিকে তাকিয়ে বললো, “বেশ তো মেঘ কে দেখে হিংসায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলি তুই আজ এই মেয়েকে দেখে তোর যে কোনো প্রতিক্রিয়া ই নেই! বাহ সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে বুঝতেই পারছি না। ”

ইহানা ঈশানের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। ভাইয়ের কথা উত্তর হয়তো সত্যি তার কাছে নেই। জান্নাত মানে ছদ্মবেশী পায়েল হুট করে বললো,

–” সূর্য তো ঠিক দিকেই উঠেছে। আপনি মনে হয় জানেন না সূর্য পূর্ব দিকে উঠে তাইনা? ”

ঈশানের রাগ আরো বেড়ে গেলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটির তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশানের নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে কি করে এমন মেয়েকে সে এক দেখায় পছন্দ করেছিলো। মেয়েটি কে কিছু বলতে গিয়েও না বলে ঈশান ওর ঘরে চলে গেলো।

এত কিছুর মধ্যেও রোদ এমন ভাব করছে যেনো কিছুই হয় নি। কারো মন খারাপ কিংবা কথা কিছুই তার গায়ে মাখছে না। সে সিড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে কি যেনো করছে। এদিকে মায়ের কান্না আর সবার মন খারাপের দিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। আদিল চৌধুরী রেগে ছিল এখন আরো রেগে গেলো মেঘ কে রোদ যেতে বাধ্য করলো সেজন্য। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও রোদের ভাবলেসহীন কাজ কর্ম আর সহ্য করতে পারলো না। উঠে দাঁড়িয়ে সোজা রোদের সামনে গিয়ে কোনো কথা না বলে ফোন নিয়ে রোদের গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। উনার থাপ্পড়ে জান্নাত, ইহানা খাওয়া বন্ধ করে উঠে আসলো সাথে ইশা চৌধুরীও আসলো। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রোদ এই থাপ্পড়ে মোটেও অবাক হইনি কারণ সে জানে থাপ্পড় তার প্রাপ্ত।রোদ অবাক হয়ে আদিল চৌধুরীর দিকে তাকালো কিন্তু রোদ এইটা ভেবে একটু অবাক হলো থাপ্পড় টা এত পরে কেনো দিলো আদিল চৌধুরী। আদিল চৌধুরী রক্ত চক্ষু করে বললো,

–” তোর মত কুলাঙ্গার ছেলে আমার তা ভাবতেও লজ্জা করছে।”

রোদ উনাকে আরো রাগীয়ে দেয়ার জন্য বললো, “আব্বু কি করলাম আমি? আমি তো আমার ভালোবাসা পায়েলের জন্য সবকিছু করতে রাজী। আমার আর পায়েলের মাঝে মেঘ কাঁটা হয়ে ছিল।”

আদিল চৌধুরী রোদ কে আরেকটা থাপ্পড় দিতে গিয়েও আটকে গেলো রোদের মুখে বাঁকা হাসি দেখে। আদিল চৌধুরী তার ছেলেকে খুব ভালোভাবে চিনে এই হাসির পেছনে কোনো রহস্য নিশ্চয় আছে। উনি রোদের হাত ধরে উপরে নিয়ে যেতে নিলো আর বললেন,

–” তোকে থাপ্পড় দিয়ে কোনো কাজ হবে না। চল তোকে আমি কি করি পরে বুঝবি।”

এতক্ষণে ছদ্মবেশী পায়েল দাঁড়িয়ে দেখছিল। ইশা চৌধুরী ইশারা করতেই জান্নাত আদিল চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললো,

–“আঙ্কেল প্লিজ আমার রোদ কে কিছু বলবেন না। ওর কষ্ট আমি নিতে পারবো না।”

আদিল চৌধুরীর উত্তর দেয়ার আগেই আয়রা জান্নাত কে টেনে নিয়ে এসে বললো,

–” তোমার এক মুহূর্তে এত কিসের ভালোবাসা ভাইয়ার প্রতি? ভাইয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম ও তো ছোট থেকে এই নামেই আটকে আছে। কিন্তু তিন বছরের বাচ্চা তো কিছুই বুঝত না তার কিভাবে এত ভালোবাসা বলবে আমায়?”

জান্নাত কথাগুলো শুধু শুনছে। তার নিজেরও খারাপ লাগছে মেঘের সংসার ভাঙতে কিন্তু সে যে নিরুপায়। রোজা চৌধুরী আয়রা কে অন্য দিকে টেনে বললো,

–” বাদ দে তুই। আমার নিজের সন্তান ই ঠিক নেই।”

এদিকে রোদের মুখে হাসি লেগেই আছে আর আদিল চৌধুরীর চোখ রোদের সেই হাসি তে ই। রোদ ভ্রু কুঁচকে আদিল চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,

–“চলো আমায় ঘরে নিয়ে গিয়ে কি করবে করো। বয়স হয়ে গেছে তোমার তাই দু একটা ইচ্ছা পূরণ করা ছেলে হিসেবে আমারও দায়িত্ব!”

রোদের কথায় সবাই অবাক হয়ে গেলো কিন্তু আদিল চৌধুরী অবাক হলো না। রাগ করার ভান করলো কিন্তু সে বুঝতে পারছে তার ছেলের কোনো উদ্দেশ্য আছে। রোদ জান্নাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে আদিল চৌধুরীর সাথে ঘরে গেলো।

…………..
ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে আদিল চৌধুরী তার ছেলের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। রোদ মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

–” মারবে না আমায়? তোমার বউ মা কে এভাবে কষ্ট দিলাম? আচ্ছা শুন আব্বু আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দাও এইটা সবচেয়ে ভালো আইডিয়া তাইনা?”

আদিল চৌধুরী হাতের ভেতরে হাত দিয়ে রোদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–“নিজেকে আমার বাপ ভাবিস!”

–“হাই আল্লাহ এইটা কিভাবে ভাবব! আমি তো তোমার মতো রাগী মানুষের বাবা হতে ই পারি না।আমার ছেলে হবে আমার মত শান্ত, ভদ্র আর…. ”

রোদের কথা শেষ না হতে ই আদিল চৌধুরী রোদের কান মলা দিয়ে বললো,

–” বাপের সাথে acting করতে আসিস! বান্দর! মেঘ প্রথম দেখায় তোকে ঠিক চিনেছিল তুই একটা বান্দর। ”

রোদ আহ করে উঠে দাঁত বের করে হাসি দিলো। দিয়েই আদিল চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরে বললো,

” আব্বু তুমি আমাকে এত বুঝ কেনো? তোমাকে আমি এখনো চিনে উঠতে পারলাম না। অনেক ভালো তুমি সত্যি!কিন্তু আমি মোটেই বাদর নয়। ”

–” ইহ একটু আগেই তো আমাকে বুড়ো আর রাগী বললি।আর তুই বাঁদর একদম ই। নাহলে এইসব করতি।”

রোদ হেসে বললো, “সে তো সবাই কে দেখানোর জন্য! তুমি আর আমি বন্ধু না? যা ইচ্ছা বলতে ই পারি।”

আদিল চৌধুরী তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,” হৈছে হৈছে। আমি সবকিছু বুঝতে পারি। এখন বল আমার কি করতে হবে?”

–” কিছুই না। তুমি শুধু বাহিরে গিয়ে রাগী রাগী ভাব রাখবে আর সবাই কে বলবে আমাকে তুমি আজ ঘরে বন্দি করে রেখেছ আর আমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ। ব্যাস আর কিছু না!”

–” ও আচ্ছা। মাত্র এইটুকু! আর তুই কি করবি?”

রোদ রহস্য মাখা হাসি দিয়ে বললো,” সে তো তুমিও জানো। মেঘ এর কাছে যাবো।”

আদিল চৌধুরী রোদের কাঁধে হাত রেখে বললো,” এই না হলে আমার ছেলে। সিআইডি তুই এইটা সবাই জানলে আজ আর তোর অভিনয় তেমন কাজে আসতো না। তাড়াতাড়ি যা বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে তো।”

রোদ আবারো আদিল চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরলো ।রোদের জীবনে এই মানুষ টা অনেক কাছের। রোদ সবার কাছে সবকিছু লুকাতে পারলেও এই মানুষটির কাছে তা সম্ভব হয় না। শুধুমাত্র আদিল চৌধুরী ই জানে তার ছেলে একজন সিআইডি।

——————-
চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে