মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-১+২

0
1959

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#সূচনা_পর্ব

পাত্র বেশে নিজের অন্যতম ক্রাশকে দেখে বিমূঢ় হৃদি! তার অবাধ্য নয়ন জোড়া বারংবার নিবদ্ধ হচ্ছে সম্মুখে বসে থাকা মানবের পানে। সে কি স্বপ্ন দেখছে! নাকি এটাই বাস্তব! বারকয়েক আঁখি পল্লব ঝাপটালো মেয়েটা। নিশ্চিত হলো সে ভুল নয়। মানুষটি সত্যিই উপস্থিত। বিষয়টি উপলব্ধি হতেই পুলকিত হলো তনুমন। র’ক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো কপোলদ্বয়ে। নেহাত গুরুজনরা উপস্থিত। নয়তো এতক্ষণে খুশিতে আত্মহারা হয়ে একদফা নৃত্যকলা হয়েই যেতো। কোনোরূপ নিজেকে সংযত করে নিলো মেয়েটা। পিছলে যেতে উদ্যত শাড়ির আঁচল টেনে কৃষ্ণকালো কেশ অনেকাংশে আবৃত করে নিলো। জোরপূর্বক বসে রইলো অবনত মস্তকে। পাত্রের ঠিক বাঁ পাশেই বসে ছোট বোন ইনায়া। প্রসন্ন চিত্তে মেয়েটা বড় ভাইয়ের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

” ভাইয়া! ভাবিকে দেখতে খুব সুন্দর তাই না? মাশাআল্লাহ্! আমার তো খুউব পছন্দ হয়েছে। ভাবী হিসেবে একেই কনফার্ম করলাম। ”

ইরহাম অসন্তুষ্ট চাহনিতে বোনের পানে তাকালো। ক্ষীণ স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” বিগড়ানো মেজাজ আর বিগড়ে দিস না। ওকে? ”

ভাইয়ের কথায় খুশি হতে পারলো না ইনায়া। আশানুরূপ জবাব না পেয়ে সবার অলক্ষ্যে ভেংচি কেটে দিলো। অতঃপর তাকালো হৃদির পানে। মাশাআল্লাহ্! ভাবী তার খুব পছন্দ হয়েছে।

মালিহা উৎফুল্ল ভাব লুকিয়ে একপ্রকার স্বাভাবিক কণ্ঠে রায়হান সাহেবকে বললেন,

” ভাই সাহেব। আমরা তো হৃদি মা’কে দেখলাম। কথা বললাম। এবার যদি ছেলেমেয়েরা একটু আলাদা ভাবে কথা বলে তাহলে ভালো হয়। বুঝতেই পারছেন এখনকার ছেলেমেয়ে এরা। ওদের চিন্তাভাবনা আবার ভিন্ন। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে বোঝাপড়া করে নিলে ভালো হয়‌। ”

রায়হান সাহেব এহেন প্রস্তাবে সম্মত হলেন।

” জ্বি নিশ্চয়ই। রাঈশা! ”

বড় কন্যা রাঈশা পিতার ইশারা বুঝতে সক্ষম হলো। পাত্র এবং ছোট বোনকে নিজের সঙ্গে আসার জন্য অনুরোধ করলো। ইরহাম বিরক্তিকর চাহনিতে মায়ের পানে তাকালো। মালিহা ইশারায় ভুংভাং বুঝিয়ে কোনোমতে সামাল দিলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। হৃদিও উঠে দাঁড়ালো। শাড়ি পড়ে হাঁটা মুশকিল। কোনোমতে বাঁ হাতে কুঁচি সামলে হাঁটতে লাগলো। রাঈশার পথ অনুসরণ করে দু’জনে পৌঁছে গেল ফ্লাটের সবচেয়ে বড়, সুন্দর, গোছানো বেলকনিতে। দেশী বিদেশী বিভিন্ন ফুলের সমারোহ সেথায়। মন মাতানো গন্ধে পুলকিত অন্তর। একটি ছোট বেতের সোফা এবং গোলাকার ক্ষুদ্র টেবিল রাখা সুন্দর কায়দায়। রাঈশা ওদের দু’জনকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে প্রস্থান করলো। শুভ্র পাঞ্জাবির পকেটে দু হাত গলিয়ে বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ইরহাম। তার মধ্যে আলাপচারিতা করার কোনো লক্ষণ শোভা পাচ্ছে না। একটিবারের জন্য পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির পানে তাকায়নি অবধি। নীরবে অতিবাহিত হলো দু মিনিট। এতেই হাঁপিয়ে উঠলো হৃদি। এতটা সময় ধরে সে নীরব ছিল! এ যে অবিশ্বাস্য, অত্যাশ্চর্য কাণ্ড! ‘ ওরা সাতজন ‘ এর বাকিগুলো জানতে পারলে পা ক্কা হুঁশ হারাতো। বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো মেয়েটি। উজ্জ্বল মুখশ্রীতে বললো,

” হাই! আ’ম হৃদি। হৃদি শেখ। নাম তো শুনা হি হোগা? তাই না? ”

রিমলেস চশমার আড়ালে কেমন অদ্ভুত চাহনিতে তাকালো ইরহাম। মেয়েটা বত্রিশ দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ইরহাম দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় বাহিরে তাকালো। হৃদি নিজের মতো বলে গেল,

” আপনি বোধহয় আমায় চেনেন না। তাতে কি হয়েছে? আমি আপনাকে ফুল্টু চিনি। বলতে পারেন আপনার গোটা ইনফরমেশন আমার মগজে ব ন্দী। অনায়াসে সুপার ডুপার হিট একখানা বায়োপিক বানিয়ে ফেলতে পারবো। খুব বেশিই ট্যালেন্টেড কিনা! ”

কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে বাক্যটি সমাপ্ত করলো হৃদি। ইরহাম রীতিমতো স্তব্ধ! কেউ কি করে এত বকবক করতে পারে! তা-ও অজানা অচেনা একজনের সঙ্গে? প্রথম সাক্ষাতে এ-ও সম্ভব?
.

বেলকনি সংলগ্ন করিডোরে বড় বোন নীতির হাত ধরে একপ্রকার টানাহেঁ’চড়া করছে নিদিশা। গন্তব্য বেলকনি। অনুনয়ের স্বরে নিদিশা বলে উঠলো,

” আপু। এই আপু। চল না। ”

নীতি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

” তুই কি রে? হৃদি ওদিকে ওর হবু কিংবা না হবু জনের সাথে কথা বলছে। সেখানে তুই গিয়ে কি করবি? আঁড়ি পাতবি? ”

দাঁত বের করে হাসলো নিদিশা। অর্থাৎ হ্যাঁ। সে এহেন উদ্দেশ্যেই যেতে ইচ্ছুক। নীতি আপত্তি জানালো।

” নো ওয়ে। আমি এসবে নেই। চাচু জানলে ফ্রি তে উপদেশ দেবে। আমি বাপু এসবের মধ্যে নেই। তুই গেলে যা। ”

বড় বোনের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়েও দমে গেল না নিদিশা। নীতি সেথা হতে প্রস্থান করতেই সে চুপিসারে অগ্রসর হলো বেলকনির পানে।
.

” আচ্ছা আমি যে আপনাকে চিনি। এতকিছু জানি। জিজ্ঞেস করবেন না এসব কি করে সম্ভব? হুঁ হুঁ? ”

ভ্রু নাচিয়ে শুধালো হৃদি। ইরহাম এতক্ষণে মুখ খুললো। ওর পানে তাকিয়ে একটাই শব্দ উচ্চারণ করলো শুধু,

” টকেটিভ। ”

হৃদি একটু ভাব নিয়ে বললো,

” সবাই এটাই বলে। নতুন কিছু বললে খুশি হতাম। ”

” ওকে। তাহলে নতুন কিছু বলেই ফেলি‌। ”

” হুম। হুম। বলুন। বলুন না। ”

কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটা। এতক্ষণে মানুষটা মুখ খুলেছে। কি বলতে চাইছে? নিশ্চয়ই ভালো কিছু? স্বল্প দূরত্বে পিলারের আড়ালে আরো একজন উপস্থিত। নিদিশা। সে-ও শুনতে উদগ্রীব।

পাত্রপক্ষ আতিথেয়তা গ্রহণ করে প্রস্থান করেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। পরিবারের সদস্যরা যে যার কক্ষের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শাড়ি পড়ে বেজায় শ্রান্ত রমণী গুটিগুটি পায়ে নিজ কক্ষে প্রবেশ করলো। আলগোছে কেশে জড়িয়ে থাকা ঘোমটা গড়িয়ে পড়লো পৃষ্ঠে। আকস্মিক শ্রান্ত মুখশ্রীতে পরিবর্তন এলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো মেয়েটা। দু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে পা”গলাটে রূপে নৃত্য করতে লাগলো।

” মনটা করে উড়ু উড়ু.. ”

লাফালাফির সংমিশ্রণে সে এক পা’গলাটে কাণ্ড। ইরহাম কিংবা পাত্রপক্ষ দেখলে নির্ঘাত চেতনা হারাতো। নৃত্যরত পা’গলী এক পর্যায়ে শাড়িতে পা পেঁচিয়ে ভীষণ বেকায়দায় বিছানায় পড়ে গেল। বক্ষস্থলে ভর ছেড়ে দিলো পুরোপুরি। লাফালাফি করে ঘন শ্বাস পড়ছে। অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। এলোমেলো শাড়ির প্রতিটি ভাঁজ। স্বেদজল উপস্থিত মুখশ্রী, গলদেশে। হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটা হেসে উঠলো। সোজা হয়ে শুলো। হাতের নাগালে থাকা মুঠোফোনটি নিয়ে অ্যাক্টিভ হলো অনলাইনে। মেসেজ পাঠালো ‘ ওরা সাতজন ‘ এর মেসেঞ্জার গ্রুপে।

” দোস্তগণ! আজকে এক চরম আশ্চর্যান্বিত কাণ্ড ঘটেছে। আন্দাজ কর তো কি হতে পারে? ”

অনলাইনে ছিল বন্ধুমহলের কয়েকজন। তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিলো আফরিন,

” কি হইছে বান্দুপি? পোলা না মাইয়া? ”

হৃদি জবাবে লিখলো, ” বিয়া শাদির খবর নাই। তুই এরমধ্যে মা বানাই দিলি আফু! এগ্লা কিন্তু আমার মতো সিঙ্গেলা জনগন্সের প্রতি অন্যায় অবিচার। ”

আফরিন হাসির ইমোজি দিলো দু’টো। সাবিত মেসেজ পাঠালো,

” ওই চু ন্নি! কি হইছে বল। অত ভনিতা না করে সোজাসুজি লাইনে আয়। অত আন্দাজ আপনা আপনা করার টাইম নাই কা। ”

হৃদি লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিলো বড় করে। নাদিরা লিখলো,

” ওরে লজ্জাবতী রে। লজ্জা রাখ আর বল কি হইছে। ”

হৃদি আরো দু’টো লজ্জা পাওয়ার ইমোজি দিলো। সাবিত এবার রাগান্বিত ইমোজি দিলো। হৃদি এ দেখে হেসে উঠলো। মেসেজ পাঠালো,

” আমি না আজকে… ”

নাদিরা প্রশ্ন পাঠালো,

” আজকে কি? ”

” আজকে.. আমার ওয়ান অফ দ্যা ক্রাশকে সামনাসামনি একেবারে ফেস টু চেহারা দেখছি। ”

আফরিন অবাক হওয়ার ইমোজি পাঠিয়ে লিখলো,

” কিহ্? সত্যি বলছিস? ”

সাবিত লিখলো,

” বাই দ্যা চৌরাস্তা। কোন বেডারে দেখছোছ? হেতি কেডা? কয় নম্বর ক্রাশ? তোর তো আবার বাজার লিস্টের চেয়েও লম্বা কেরোসিনের লিস্ট। ”

হৃদির রাগ হলো এমন চরম সত্য শুনে। সে লিখলো,

” বে দ্দ প। জানিস না মুখের ওপর সত্যি বলতে নাই? ”

” মুখের ওপর বললাম কই? মেসেজ দিলাম তো। ”

আফরিন মেসেজ দিলো,

” ফা’লতু কথা বাদ দে তো। এই হৃদি! তুই নামটা বল না। সত্যি বলবি কিন্তু। কারে দেখছোছ? বল। ”

হৃদি লজ্জা পাওয়ার ইমোজি সহকারে রিপ্লাই দিলো,

” ইরহাম চৌধুরী! ”

অতঃপর! বো মা এক ফা’টিয়ে অফলাইনে চলে গেল হৃদি। ওদিকে নিশ্চয়ই এখন তোলপাড় আরম্ভ হয়েছে! প্রকৃত ঘটনা জানতে উদগ্রীব ‘ ওরা সাতজন ‘ এর কুচুপু গুলো। সে ভেবেই মজা পাচ্ছে মেয়েটা। ওসব ভাবনা ত্যাগ করে এখন ইরহামে মগ্ন হলো। সে এখন বেশ চমকিত-পুলকিত ক্রাশকে দেখে! ভুলেই গিয়েছে আজ এ বাড়িতে ক্রাশের আগমনের মূল হেতু। বিয়েশাদী বিষয়টি মনে আছে কি? মোটেও নেই। তাই তো এত নিরুদ্বেগ সে।

আঁধারিয়া রজনী। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর লিভিং রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে শাশুড়ি বৌমা। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা রাজেদা খানম ভ্রু কুঁচকে শুধোলেন,

” কি বউ? খুশিতে তখন থে আকডুম বাগভুম করতাছো। মাইয়া এত পছন্দ হইছে? ”

মালিহা প্রসন্ন হৃদয়ে বললেন,

” হাঁ মা। হৃদি মেয়েটা দেখতে মাশাআল্লাহ্! দেখতে যেমন সুন্দর কথাবার্তার ধরনও তেমন। খুব মিষ্টি করে কথা বলে। শুনলে মনে হয় আরো শুনি। ওকে আমার ইরু’র সঙ্গে খুব মানাবে‌। ”

” তয় হুনলাম মাইয়া নাকি বেশি ছোডো? তোমার পোলা তো আধ দা”মড়া হইয়া গেছেগা। এহন শেষমেষ কচি মাইয়া আনবা? ”

মালিহা জিভ কাটলেন তৎক্ষণাৎ।

” ইশ্ মা! এসব কি বলছেন? আমার ইরু’র কতইবা বয়স? সবে ত্রিশ। ”

রাজেদা খানম তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে বললেন,

” হপায় তিরিশ! বয়সের কালায় বিয়া করলে অ্যা দ্দি নে চাইর বাচ্চার বাপ থাকতো। ”

সশব্দে হেসে উঠলো ইনায়া। লিভিং রুমে এসে দাদির মজাদার জোকস্ শুনে ওর হাসি থামতে নারাজ। হাসতে হাসতে দাদির পাশে বসলো। হাসির দমকে কথা আঁটকে আসছে।

” দাদি গো তুমি যা বললে না! সেটা যদি মায়ের ইরু বেপ্পি শোনে অন দ্যা স্পট চিৎপটাং! হা হা হা। ”

মালিহা শব্দ করে হেসে উঠলেন। দাদি বিরক্ত হয়ে বললেন,

” পটাং হইবো ক্যা? আমি কি ভুল কইছি? তিরিশ বছরের দা*মড়া পোলা। এহনো বিয়া করমু না করমু না ভজন গাইতে থাহে। ”

ইনায়া কোনোমতে হাসি থামাতে সক্ষম হলো। বললো,

” কি যে বলো না দাদি। ধরো ভাইয়া চার বাচ্চার বাপ। তোমার কথামতো, ঠিক আছে? তাহলে বিয়ে করলো কত বছরে? উম্? বিশ! তাহলে ভাবীর বয়স কত ছিল? দশ? ও এম এ! ”

হাসতে হাসতে ইনায়ার অবস্থা বেহাল। মেয়েটা পেট চেপে হেসে সোফায় লুটোপুটি খাচ্ছে। রাজেদা খানম মুখ বেঁকিয়ে পান চিবোতে লাগলেন। এসব অহেতুক হিসাবনিকাশের উনি ধার ধারেন না। আস্ত এক আধ দা*মড়া! এত হিসাব কষলেই কি তা পরিবর্তন হয়ে যাবে?

আঁধারে ঘনিভূত কক্ষ। বিছানার ঠিক মধ্যিখানে উপুড় হয়ে শুয়ে দীর্ঘকায় এক মানব। দেহের ঊর্ধ্বভাগ তার অনাবৃত। কটি’র ধারে পড়ে রয়েছে পাতলা কাঁথা। গভীর নিদ্রায় বুঁজে আঁখি যুগল। নীরবতা ভেদ করে সহসা শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো কক্ষ জুড়ে। হালকা হলো নিদ্রা ভাব। আঁখি বুঁজে বিছানার ডান পার্শ্বে থাকা অ্যালার্ম ক্লক ছুঁলো ইরহাম। বন্ধ করলো অ্যালার্মের কৃত্রিম ধ্বনি। কর্ণ কুহরে পৌঁছাতে লাগলো আযানের সুমধুর বার্তা। মহান রবের মহত্ত্ব প্রকাশের ধ্বনি। আস্তে ধীরে ডান কাত হয়ে শুলো মানুষটি। ভঙ্গ হলো নিদ্রা। আযান শেষে ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে আযানের দোয়া পাঠ করলো। অতঃপর আরামের নিদ্রা ত্যাগ করে উঠে বসলো বিছানায়। পাঠ করলো ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার দোয়া। দেয়ালঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে হাই তুললো। পদযুগল স্পর্শ করলো মেঝে। বিছানা ত্যাগ করে অদক্ষ ভঙ্গিতে কাঁথা ভাঁজ করে যথাস্থানে রেখে দিলো। তোয়ালে নিয়ে অগ্রসর হলো ওয়াশরুমে।

সমতল আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইরহাম। দু হাত গলিয়ে দেহে জড়িয়ে নিলো সফেদ পাঞ্জাবি। নিম্নে একই রঙা পাজামা। ডান হাতে স্বল্প সিক্ত চুলগুলো পেছনে ঠেলে টুপি পরে নিলো। অতঃপর বাঁ হাতে ঘড়ি পড়ে মোবাইল, ওয়ালেট পকেটে গলিয়ে প্রস্থান করলো কক্ষ হতে। উদ্দেশ্য জামায়াতে সালাদ আদায়।

সুবাহের মিঠি রৌদ্রে উজ্জ্বল বসুধা। পুষ্প সুরভিত বাগানে ছুটে বেড়াচ্ছে উচ্ছ্বল রমণী। উদ্দেশ্য তার প্রিয় ছানাকে আয়ত্ত্ব করা। শুভ্র তুলতুলে শরীরের ছানাটা অসংখ্য বৃক্ষের মাঝে সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চলেছে। পিছু পিছু হৃদি। জোরে জোরে ডেকে চলেছে,

” পকি! পকি থাম। অ্যাই পকি! দাঁড়া বলছি। দাঁড়া দুষ্টু।”

পকি শুনলে তো? ক্ষুদ্র শরীর নিয়ে ছুটে চলেছে। তবে বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হলো না। হৃদির হাতে বন্দী হলো পকি। পকিমন। তুলতুলে পশমে হাত বুলিয়ে মাথায় চুমু এঁকে দিলো হৃদি।

” আমার দুষ্টু পকি। আমাল ছোনা বাবুতা। মা’কে এভাবে কেউ দৌড় করায়? হুঁ? ”

বিড়াল ছানা জবাব দিলে তো? সে যে মূক। শুধু আদুরে স্বরে ডেকে উঠলো,

” ম্যাঁও! ”

” ও লে লে। ”

হৃদি বিড়াল ছানাকে আদরে আদরে সিক্ত করে তুলছিল। ঠিক সে মুহূর্তে কর্ণ কুহরে পৌঁছালো,

” ভার্সিটিতে পড়ে এতটাই লা’য়েক হয়ে গেছিস যে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করেছিস? ”

চলবে।

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২

রাঈশার মুখনিঃসৃত প্রশ্নে যারপরানাই অবাক হৃদি! বিড়াল ছানাকে আদুরে হাতে আগলে বোনের পানে এগিয়ে এলো সে। বিস্ময় মিশ্রিত কণ্ঠে শুধালো,

” এসব কি বলছিস আপু? আমি আবার কি করলাম? ”

” কি করেছিস? সত্যিই বুঝতে পারছিস না? ”

হৃদি অসন্তুষ্ট বদনে বললো,

” বুঝলে কি আর জিজ্ঞেস করতাম? তুই ঠিকঠাক গুছিয়ে বল তো হয়েছে টা কি? সকাল সকাল বরের সঙ্গে কিচিরমিচির হয়েছে বুঝি? তাই ম”টকা গরম? হুঁ?”

ভ্রু নাচিয়ে হাসি হাসি মুখে শুধালো হৃদি। এতে তেঁতে উঠলো রাঈশা।

” একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবি না। আমি ঠিকই আছি‌। বরং তুই ভুলভাল কাজ করছিস। ”

বিড়ালের তুলতুলে দেহে হাত বুলাতে বুলাতে হৃদি পুনরায় শুধালো,

” কি করেছি আমি? ”

” ইরহাম চৌধুরীর সঙ্গে তোর কি কথা হয়েছে? ”

প্রশ্নটি শুনে ঈষৎ চমকালো কি হৃদি! চোখ তুলে বোনের পানে তাকালো।

” আ আমি আবার কি বলেছি? সাধারণ কথাবার্তা। ও-ই সবাই যা বলে। ”

রাঈশা সন্দেহের চোখে বোনকে আপাদমস্তক দেখে নিলো।

” তাই নাকি? কিন্তু আমার কানে যে ভিন্ন কিছু এলো। ”

হৃদি মেকি হেসে বললো,

” হে হে। বাতাসে কত ভুলভাল খবর ছড়ায়। ওসবে কান দিতে নেই। বয়রা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ”

রাঈশা কিছু বলতে উদ্যত হতেই তার মোবাইলে কল এলো। হৃদি উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো ‘ ফাহিম ‘ কলিং। হৃদি বোনকে উড়ন্ত চু মু উপহার দিয়ে বললো,

” ডুলাভাই কলিং। নে নে। কথা বলতে থাক। আমি গেলাম। কাবাব মে হাড্ডি হতে নট ইচ্ছুক। ”

হাসিমুখে চতুরতা সঙ্গে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হলো হৃদি। দ্রুত পায়ে পকিমন’কে নিয়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো। রাঈশা তীক্ষ্ণ চাহনিতে বোনের গমন পথে তাকিয়ে।

ডাইনিং টেবিলের ওপর স্বাস্থ্যসম্মত-পুষ্টিকর খাবারের সমারোহ। আয়তাকার টেবিল ঘিরে চারটে চেয়ার দখল করে বসে এজাজ সাহেব, মালিহা, ইনায়া এবং রাজেদা খানম। এজাজ সাহেব ফ্রুট জুসে এক চুমুক বসিয়ে স্ত্রীর পানে তাকালেন। বললেন,

” হৃদি না কি যেন নাম মেয়েটার? ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্ৰাউন্ড আমার পছন্দ হয়নি। তবুও দেখতে গেলে। আমার নিষেধাজ্ঞা শুনলে না। গেলে, দেখলে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। ওসব এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। ”

সে মুহূর্তে চেয়ারে আসন গ্রহণ করলো ইরহাম। কর্ণ কুহরে পৌঁছালো মায়ের কণ্ঠস্বর,

” শোনো না মেয়েটা খুব মিষ্টি। ওকে আমাদের ইরুর সাথে খুব মানাবে। ”

মালিহার কথায় অমত পোষণ করলেন এজাজ সাহেব।

” দেখতে মিষ্টি হোক কিংবা তেঁতো। আমি যখন বলেছি ওটা বাদ দাও। তখন বাদ দাও। নেক্সট ফ্রাইডে মিস্টার হক আসছেন সপরিবারে। ওনার মেয়ে শায়না। উচ্চ শিক্ষিতা, বিউটিফুল, হাই সোসাইটি থেকে বিলং করে। ইরহাম চৌধুরীর স্ত্রী হিসেবে অমন কেউই পারফেক্ট। বুঝলে? কোনো হৃদি টিদি নয়। ”

বাবার কথা মানতে ব্যর্থ ইনায়া। সে মলিন বদনে বাবা, ভাইয়ের দিকে বার কয়েক তাকালো। তার যে ভাবী হিসেবে হৃদি আপুকে বেশ মনে ধরেছে। ওই শায়না তো আস্ত এক ময়দা সুন্দরী। ঢঙী। ভাবী হিসেবে একদম বেমানান। ভাইয়া কোনো প্রতিবাদ করছে না কেন? শেষমেষ ওর ইচ্ছে পূরণ হলো। ফ্রুট জেলে আচ্ছাদিত পাউরুটিতে এক বাইট দিয়ে ইরহাম বলে উঠলো,

” বলেকয়ে, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছো। তাই বলে ক্যারেক্টারলেস, উ গ্র স্বভাবের কাউকে বিয়ে করবো এমন ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করো না। ”

এজাজ সাহেব তেঁতে উঠলেন এহেন মন্তব্যে।

” মুখ সামলে কথা বলো ইরহাম। কাকে ক্যারেক্টারলেস, উ গ্র বলছো? শায়না মোটেও অমন মেয়ে নয়। ”

” ও কেমন সে সার্টিফিকেট নাহয় আর দিলাম না। একটু খোঁজ নিলে নিজেই জানতে পারবে। শুধু এটা জেনে রাখো শায়না নামক কোনো আপদ কাঁধে বইতে আমি মোটেও ইচ্ছুক নই। ”

বাবার দিকে না তাকিয়েই নিজস্ব মতামত পেশ করলো ইরহাম। অতঃপর ভোজন সম্পন্ন করে ডাইনিং ত্যাগ করলো। রাগে আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে এজাজ সাহেবের মুখশ্রীতে। এতক্ষণে মুখ খুললেন রাজেদা খানম। উনি একমাত্র পুত্রের উদ্দেশ্যে বললেন,

” তোরা জামাই বউ কি শুরু করছোছ বল দেহি? পোলাটা বিয়া করমু না করমু না করছে এতগুলা বছর। শ্যাষম্যাষ যহন রাজি হইছে তোরা মাইয়া লইয়া টানাহেঁ’চড়া লাগাইছোছ? অ্যা কেমন কথা? ”

মালিহা মৃদু স্বরে বলে উঠলেন,

” মা আমি তো.. ”

” তুমি তো চুপ ই থাহো। ওই শানু মাইয়া কেমন তুমি জানো না? জানো তো। তাইলে চুপ কইরা থাকলা ক্যা? জামাইরে কইতে পারলা না ওই মাইয়া এই বাড়ির বউ হইবার যোগ্যতা রাহে না। ”

মালিহা ভীত চাহনিতে স্বামীর পানে তাকালেন। এজাজ সাহেব রাগে ফেটে পড়লেন এবার। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,

” আমি এখানে শায়নার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট জানতে আসিনি। সবাই কান খুলে শুনে রাখো। এ বাড়ির বউ ওই শায়না ই হবে। অন্য কেউ নয়। ”

নিজের বক্তব্য পেশ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এজাজ সাহেব। প্রস্থান করলেন সেথা হতে। ইনায়া দুঃখী বদনে দাদির মুখপানে তাকালো।

” ও দাদি! ওই শায়না আপুকে ভাবী হিসেবে চাই না। সে কেমন তোমরা জানো তো। ”

দাদি ইতিবাচক সম্মতি জানালেন।

” হ জানি। হুদা চিন্তা করিছ না তো। দেহি কোথাকার জল কই গড়ায়। ”

চিন্তিত বদনে কিছু ভাবতে লাগলেন উনি। ওনার কথায় একটু হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলো মালিহা, ইনায়া।

গোধূলি লগ্ন। আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে ধরনী। নিজস্ব রুমে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে নিদিশা। হাতে চিপসের প্যাকেট। দৃষ্টি নিবদ্ধ ওয়াল স্মার্ট টিভিতে। সহসা পাশে বসলো এক রমণী। হকচকিয়ে গেল মেয়েটা। ডান পাশে তাকাতেই নজরে এলো হৃদিপু।

” হৃদিপু! তুমি? ”

চিপসের প্যাকেটে হাত গলিয়ে একটি চিপস মুখে চালান করলো হৃদি।

” হাঁ আমি। এমন ভূত দেখার মতো চমকে গেলি কেন? ”

বিনা কারণেই ঘামতে লাগলো মেয়েটা। চাচাতো বোনের এহেন আচরণ সুক্ষ্ণ চাহনিতে অবলোকন করলো হৃদি। আরেকটি চিপস মুখে পুরে বললো,

” এত ঘামছিস কেন? মনে হচ্ছে চুরি করে ধরা পড়েছিস? ”

মেকি হেসে নিজেকে সামলানোর প্রয়াস চালালো নিদিশা। শুকনো ঢোক গিলে হাত দিয়ে বাতাস করার ভঙ্গিমায় বললো,

” খুব গরম পড়েছে কিনা। তাই.. ”

” আচ্ছা? আমি তো ভাবলাম কূচুটে কাকিমার মতো কথা লাগিয়ে এখন ধরা খাওয়ার ভয় পাচ্ছিস। ”

তৎক্ষণাৎ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানালো নিদিশা।

” এই না না। আমি কিছু করিনি। আপুকে বলিনি। সত্যি বলছি। ”

হৃদি ওর দিকে ‘ খাইয়া ফালামু ‘ এমনতর চাহনিতে তাকিয়ে। হঠাৎই অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বোনের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

” নিদু সোনা। বড়দের কথায় কান দিতে নেই। ওকে? আরেকবার যদি এমন হয় তাহলে.. তোমার কলেজের পোল খুলতে আমার টাইম লাগবে না। ঠিক আছে? ”

মিষ্টি কথার মাঝে লুকায়িত স্পষ্ট হু’মকি। শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো নিদিশা। বোনদের মধ্যে এই একজন হৃদিপু। বড় ভ”য়ংকরী আছে। কাউকে ভয়ডর পায় না। একবার হু’মকি দিয়েছে মানে সে সত্যিই বিপজ্জনক অবস্থানে ঝুলছে। শেষমেষ তার কলেজের আকাম না ফাঁস হয়ে যায়! না বাপু না। সে আর আড়ি পাতবে না। সাধু হয়ে যাবে। ওসব আড়ি পাতা অন্যায়। পঁচা কাজ। সে তো গুড গার্ল। নিজেকে নিজেই বোঝালো মেয়েটা। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো। ডানে ফিরে চমকালো বেশ! হৃদি তার পাশেই আয়েশ করে বসে। দু পা ক্রস আকৃতি করে ওর চিপসের প্যাকেট দখল করে ওয়েব সিরিজ এনজয় করছে। বাব্বাহ! কি দ্রুত পরিবর্তন! কাঁচুমাচু করে নিদিশাও ওয়েবে মনোনিবেশ করলো। তা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছে হৃদি। বোনটা বড় সরল। ভয়ের ‘ ভ ‘ না দেখাতেই কেমন ভয় পেয়ে গেল! হাসি চাপিয়ে হৃদি সাসপেন্স থ্রিলার উপভোগ করতে লাগলো।

দিবাকরের আলোয় আলোকিত ধরিত্রী। প্রতিদিনের ন্যায় কাটছে সময়কাল। নিস্তব্ধ পরিবেশ সহসা কলিংবেলের শব্দে মুখরিত হলো। একজন পরিচারিকা এগিয়ে গেল সদর দরজার পানে। দরজা উন্মুক্ত করে চমকালো! কেউ নেই। জনশূন্য দ্বার। পরিচারিকা এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলিয়ে কাউকে পেল না। তাই দ্বার বদ্ধ করতে উদ্যত হতেই থমকে গেল। দরজার বাহিরে মেঝেতে রাখা এক বক্স। মোড়কে আবৃত বক্স দেখে পরিচারিকা ইতিউতি করে হাতে তুলে নিলো। অক্ষর জ্ঞান জানা সে পড়তে পারলো বক্সটি ইরহামের নামে এসেছে। তবে প্রেরকের নাম শূন্য। অদ্ভুত বক্সটি নিয়ে দ্বার বদ্ধ করলো সে। অগ্রসর হতে লাগলো মালিহার রুমের দিকে। তাকে জানানো দরকার এ বিষয়ে। তবে তা আর হলো না। রাজেদা খানমের ডাক শুনে মহিলাটি লিভিং রুমে কারুকার্য খচিত টেবিলের ওপর বক্সটি রেখে পা বাড়ালো রাজেদা খানমের রুমের দিকে। অদ্ভুদ সে নামহীন পার্সেল পড়ে রইলো টেবিলে।

তমস্র রজনী। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মেয়েটি। দৃষ্টি নিবদ্ধ ল্যাপটপের যান্ত্রিক পর্দায়। সেথায় প্রদর্শিত হচ্ছে এক মানব অবয়ব। পেশিবহুল পেটানো দেহ আবৃত শুভ্র পাঞ্জাবির অন্তরালে। বাতাসের তোপে স্বল্প এলোমেলো মসৃণ কেশ। নভোনীল চক্ষু জোড়া কিছুটা আড়াল হয়েছে রিমলেস চশমার আড়ালে। হালকা চাপদাড়ির উপস্থিতি তার শৌর্য, পুরুষালি মুখশ্রীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে কয়েক গুণ। অধরে লেপ্টে দুর্বোধ্য হাসির রেখা। বলিষ্ঠ দেহ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নতুন ক্রয়কৃত গাড়ির দেহে। বছর পাঁচেক পূর্বের ফটো এটি। যা পাঁচটি বছর পরও নারীমন কেড়ে নিতে সক্ষম। তোলপাড় সৃষ্টি করতে পারে কোমল হৃদয়ে। হৃদি বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে ল্যাপটপের পর্দায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ফটোখানা। মিথ্যে লাজে রাঙা হয়ে রাঙাপরী রূপ ধারণ করছে। সে মুহূর্তে পাশে এসে শয্যা গ্রহণ করলো কেউ। হকচকিয়ে গেল মেয়েটা। ডানে তাকিয়ে দেখতে পেল নীতি। ওর দিকে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

” কি বোনু? একশো নয় তম ক্রাশকে গিলে খাওয়া হচ্ছে? ”

মিথ্যে রাগ প্রকাশ করলো মেয়েটা।

” হোয়াট ইজ গিলে খাওয়া? সুন্দর করে বল। বল ক্রাশকে দেখে বিমুগ্ধ হচ্ছিলাম। ”

নীতি সুরে সুরে ব্যঙ্গ করে বললো,

” ও রে আমার বিমুগ্ধ রে! দিনরাত কতবার বিমুগ্ধ হস, হা? তোর তো আবার বিমুগ্ধ হওয়ার লোকের অভাব নেই। আজ রণবীর সিং, কাল আরমান মালিক, তো পরশু রণবীর কাপুর। এখন আবার দেশীয় প্রোডাক্ট ইরহাম চৌধুরী। ”

ইরহামের ফটোতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হৃদি বলে উঠলো,

” তাতে তোর কি রে! সুন্দর পুরুষে ক্রাশ খাওয়া মেয়েদের জন্মগত অধিকার। ”

” বুইন আমার। তোর এই নয়া অধিকার সম্পর্কে মানবাধিকার কমিশন এখনো জানে না। তাগোও তো জানা দরকার যে হৃদি শেখ নামক এক ক্রাশ পা’গলী নয়া অধিকার আবিষ্কার করছে। ”

ভেংচি কাটলো মেয়েটা। তা লক্ষ্য করে হাসলো নীতি। সে মুহূর্তে বাহির হতে শোনা গেল ফারহানা’র কণ্ঠস্বর।

” হৃদি, নীতি। তোরা কোথায়? খেতে আয়। ”

চাচির কণ্ঠ শুনে তড়িৎ উঠে বসলো নীতি। হৃদির পিঠে চাপড় মে রে বললো,

” ওই মাইয়া ওঠ। চাচি খেতে ডাকছে। না গেলে ক্রাশের বদলে ধুমতানা মা’ইর খাওয়া লাগবে। ওঠ ওঠ। ”

বিরক্ত হয়ে ল্যাপটপের শাটার অফ করে উঠে বসলো হৃদি।

” শান্তিতে ক্রাশকে দেখতেও দেয় না। ধ্যাৎ! ”

দু বোন কক্ষ ত্যাগ করে ডাইনিং এ পা বাড়ালো।

বদ্ধ দ্বার ঠেলে অন্ধকারে নিমজ্জিত কক্ষে প্রবেশ করলো ক্লান্ত মানব। সুইচবোর্ড স্পর্শ করে আলোকিত করলো গোটা কক্ষ। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। বাঁ হাত নামিয়ে রিস্ট ওয়াচ, পকেট হতে মোবাইল-ওয়ালেট বের করে রাখলো। অতঃপর রিমলেস চশমা খুলে রাখলো। পাঞ্জাবির বোতাম উন্মুক্ত করতে করতে পা বাড়ালো কাবার্ড এর দিকে। হঠাৎ থমকে গেল। পিছু ঘুরে তাকালো ইরহাম। বিছানার এক পাশে রাখা মোড়কে আবৃত বক্স। বক্সটি দেখেই ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। পাঞ্জাবির বোতাম সবগুলো উন্মুক্ত করে পা বাড়ালো সেদিকে। বিছানার ওপর থাকা বক্সটি হাতে নিলো। প্রেরকের নামহীন পার্সেল দেখে বদল এলো চেহারায়। হঠাৎই বক্স হাতে কক্ষে অবস্থিত ছোটখাটো বিন এর দিকে এগিয়ে গেল। বক্সটি ফেলে দিলো বিন এ। অতঃপর কাবার্ডের ধারে অগ্রসর হলো। পোশাক নিয়ে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের পানে।

দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসুধা। লিভিং রুমে টিভির পর্দায় ধ্যান জ্ঞান একত্রিত করে বসে মালিহা। বিপরীত দিকের সোফায় বসে মোবাইল স্ক্রল করছে ইনায়া। হঠাৎই মালিহা ভিন্ন অবতার ধারণ করলেন। অতি দুঃখে জর্জরিত হয়ে বলতে লাগলেন,

” বিবাহযোগ্য এক বাচ্চার বাপ হয়ে ঋদ্ধিও বিয়ে করে ফেলছে। করলো না শুধু আমার ইরু। এই দুঃখ নিয়ে বুড়ো বয়সে কোথায় যাই? তবে কি আমার কপালে পুত্রবধূর সেবাযত্ন লেখা নাই? ”

ইরহাম চুলে হাত বুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছিল। মায়ের কথাবার্তা ঠিক কানে পৌঁছাচ্ছে। তবুও সে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। চুপচাপ নামতে লাগলো। তবে ইনায়া চুপ থাকতে পারলো না। কিঞ্চিৎ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,

” ঋদ্ধি? এ আবার কে? চেনা পরিচিত কেউ? ”

” আরে ঋদ্ধি। আমাদের ঋদ্ধি। ”

” আরে মা কোন ঋদ্ধি? চিনতে পারছি না তো। ”

মালিহা অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন,

” চিনবি কি করে? দিনদুনিয়ার কোনো খোঁজখবর রাখিস? ”

ইনায়া ছোট ছোট চোখ করে মায়ের পানে তাকালো। এতে মালিহা মুখ খুললেন।

” ঋদ্ধিকে চিনলি না? আরে ঋদ্ধিমান সিংহ রায়। গাঁটছড়ার হিরো। ”

হতবিহ্বল ইনায়া! মায়ের পানে বি-স্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে। শেষমেষ গাঁটছড়া সিরিয়ালের হিরোর সাথে ভাইয়ার তুলনা? ভাইয়া শুনলে তো..! ইনায়া আশপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো। ইরহাম নেই। এসব অহেতুক কথাবার্তা শোনার মতো সময় তার নেই। সে নিজ গন্তব্যে বেরিয়ে পড়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মেয়েটা। ভাগ্যিস ভাইয়া কিছু শোনেনি। নাহলে কি যে বলতো!

আঁধারে নিমজ্জিত চারিদিক। কর্ম ব্যস্ততা সেরে ঘরে ফিরছে মানুষজন। রায়হান সাহেব এবং ছোট ভাই রাশেদ সাহেবও ফিরে এলেন। রাতের ভোজন সম্পন্ন করে দু ভাই কথা বলছিলেন লিভিং রুমে। সে মুহূর্তে সেথায় উপস্থিত হলো রাঈশা। রায়হান সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,

” আব্বু কিছু কথা বলার ছিল। ”

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে